নিঃসঙ্গতার সমীকরণ

মানুষের জন্মের প্রায় সাথে সাথেই শুরু হয় সঙ্গি খোজা। প্রথম, মায়ের গোলাকার মুখোবয়ব হয় শিশুর প্রাথমিক সঙ্গি। তারপর এক এক করে সব গুলো ইন্দ্রিয়ই মায়ের ঘনিষ্ঠতার স্বাদ পায়। মায়ের সাথে সাথে বাবা আর পরিবারের অন্যরাও সঙ্গি হয়ে ওঠে শিশুর। নিজের পায়ে আক্ষরিক ভাবে দাঁড়ানোর পুরো ক্ষমতা হওয়া পর্যন্ত এই প্রাথমিক সময়ের সঙ্গিগুলোর অপরিহার্যতা দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। তারপর স্বাধীনভাবে সচল শিশু তার সঙ্গের গণ্ডি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়, এটাও তার ক্রমবর্ধমান সঙ্গের চাহিদার কারনেই, কিম্বা অন্য ভাষায় বললে ক্রমবর্ধমান নিঃসঙ্গতার কারনেই। খুঁজে বের করে খেলার সাথি। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। শারীরিক ভাবে স্বনির্ভর চলাফেরার উপযুক্ত হলেও নানা জটিল সব কারণে শিশু পরাধিন রয়েই যায়। ফলে মা-বাবা, এমনকি পরিবারের সঙ্গের গুরুত্ত বাড়তেই থাকে। কৈশোরেও মানুষ খেলার সাথি আর অন্য যত রকমের সাথি খোঁজা চালিয়ে যায়। দিনে দিনে বেড়ে ওঠা মন সঙ্গের নতুন সব মাত্রা খুঁজে পেতে থাকে। খুঁজে পেতে চেষ্টা করে নতুন সেসব মাত্রার সঙ্গিদের। নানা রঙের সঙ্গি। বয়ঃসন্ধিকালে হঠাৎ করেই শরীর হাত পা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। মন আর শরীরের পাল্লাপাল্লিতে কখনো মন আবার কখনো শরীর এগিয়ে থাকে। বেসামাল হয়ে পড়ে মানুষটা। অনেক সময় বেসামাল হয়ে ওঠে সঙ্গের চাহিদা আর বর্ণালী। দিনে দিনে একটু একটু করে তৈরি হয় পুরনাংগ স্বাধীনতার চাহিদা, বদলে যেতে থাকে সঙ্গের প্রয়োজনের ধরন, কিম্বা নিঃসঙ্গতার ধরণ। শিকড় যে মা বাবায়, তাদের মাঝে মাঝে পর কিম্বা শত্রুও মনে হতে থাকে। তাদের সঙ্গ যেন আর মনে চায় না। প্রায়শই নতুন নতুন সঙ্গী জোটে। প্রতিবারই যেন অভিসম্পাত পেতে থাকে পুরানো আর আঁকড়ে থাকা সম্পর্ক গুলো। শুধু বিপদের সময়ে যেন তাদের মর্চে পড়া চেহারা গুলো আবার চকচকে হয়ে ওঠে। তারপর বিপদ কেটে গেলে আবার নতুনের চাহিদার ঝনঝনানিতে জীবন ভরে ওঠে। পুরানো সম্পর্কগুলো কখনো কখনো জরাজীর্ণ রুপ ধারণ করে। শরীর, মন আর স্বনির্ভরতার অগ্রগতি কিন্তু থেমে থাকে না, থেমে থাকেনা নিঃসঙ্গতার উপলব্ধি। প্রাপ্তবয়সের গণ্ডি পার হতেই নানা পূর্ণতার স্বাদ পাবার পাশাপাশি পুরনাংগ সব সঙ্গীও খুঁজতে থাকে মানুষ। বন্ধুত্ব, পেশা, শিক্ষা আর ব্যাক্তিগত-জৈবিক চাহিদার নিরিখে নতুন সঙ্গীদের দল গঠন হয়। জীবনের বেশ কিছু সময় পার হবার পর আবার মানুষ ফিরে আসতে থাকে পরিবারের সঙ্গগুলোর মাঝে। তবে এবার নতুন এক পরিবার, নতুন এক মাত্রায়। এক মানুষের সঙ্গে শুরু হওয়া জীবনটা যেন আবার এক মানুষের মুখাপেক্ষী হতে চায়।
খোলা পৃথিবীতে আসার পর থেকে মানুষ যে সঙ্গি খোঁজা শুরু করে তা চলতে থাকে তার খোলা পৃথিবীর জীবন জুড়ে। এক সঙ্গি থেকে আরেক সঙ্গি, সেখান থেকে অন্য কেউ এভাবে যেন সময়ের নদীটা মানুষ পার করে। কোন কোন সঙ্গি হয় ক্ষণিকের, কোন কোন সঙ্গী হয় মাঝামাঝি, আবার কোন কোন সঙ্গি হয় সুদীর্ঘ কালের। যত কিছুই হোক, স্থায়ী কেউ হয় না। কোন না কোন ভাবে সব সঙ্গই হারাতে হয়। জন্মসূত্রে যে নিঃস্বঙ্গতা মানুষকে জীবন গড়তে প্রলুব্ধ করে, জীবন শেষের ঢালে সেই নিঃস্বঙ্গতাই আবার ঘাড়ে চেপে বসে নিষ্ঠুর “সিন্দাবাদের ভূত” এর মত। জীবনের শুরু যার হাত ধরে, শেষেও তারই রাজত্ব। ভেবে দেখলে দেখা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ স্বভাবে নিঃসঙ্গ না হলে জীবনের শুরু থেকে সঙ্গী জুটিয়ে জীবনে ঢোকা কখনই হত না। আবার জীবনের শেষে নিঃসঙ্গতা ফিরে না এলে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া হয়ে উঠতো অনেক বেশী কঠিন। তাই শুরুতে নিঃস্বঙ্গতা যেমন নীরব বন্ধু ছিল, শেষে ফিরে আসা নিঃস্বঙ্গতাও একই ধরণের সহায়ক বা বন্ধু। বুদ্ধিমান মানুষ তাই কখনো কখনো শত সঙ্গের মাঝেও নিঃসঙ্গতার সাথে বন্ধুত্বটা টিকিয়ে রাখে।
সব কিছুর পরও পৃথিবীর এই জীবনে সঙ্গী অপরিহার্য। খাবার কিম্বা শ্বাসের বায়ুর মতই এটারও ব্যবস্থা রাখতে হবে, যদি বাচতে চাই। কি করতে পারি আমরা যখন প্রয়োজন মাফিক সঙ্গী পাই না? জোর করে সঙ্গী পাওয়া যায় না, এটাই স্বাভাবিক। তাই সময় থাকতেই বিপদকালীন খাবারের মত বিপদকালীন সঙ্গীর ব্যবস্থা করে রাখুন। হতে পারে সেটা মানুষ কিম্বা অন্য কিছু। মানুষের মাঝে বিপদকালিন সঙ্গ পেতে হতে পারেন পরপোকারী, অন্তত ভালো আচরণের মধ্যে দিয়ে মানুষের উপকারের অভ্যাস রাখুন, দেখবেন কেউ না কেউ সর্বদা থাকবেই আপনার পাশে। অন্তত নিজেকে ভালো বাসুন। মনে রাখবেন আপনি নিজেও মানুষ। তাছাড়া যে নিজেকে ভালবাসেনা, তাকে তার কোন সঙ্গীও ভালবাসে না। প্রকৃতিকে ভালবাসুন। ভালবাসুন নতুনকে। যা কিছু পরের অধিকারের নয় তাই আপনার বিপদ কালের সঙ্গি হতে পারে, এ কথা মনে রাখবেন ।
আমার বিচারে সঙ্গী খোঁজায় সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ সে, যে জীবনের সরগরম সময়টাতেই সৃষ্টিকর্তা আর তার সাথে সম্পর্ককে খুঁজে পায়। ফলে সব কিছু খোয়ালেও ওই একটা সঙ্গী তার জীবনের প্রতিটা মুহুরতেই উপস্থিত থাকে। যদি সে সব চাপের উরধে উঠে ঐ সঙ্গীকে ভালবাসতে পারে, সত্যিকারের অর্থে নিসশঙ্গতাকে সম্ভবত সেই স্থায়ী ভাবে বশে আনতে পারে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, সৃষ্টিকর্তা সহ যেকোনো সম্পর্ক যদি খাঁটি ভালবাসায় গড়া না হয়, বিশেষ করে ছলচাতুরি বা লোক দেখানোর মিশ্রন থাকে, পরবর্তীতে তা সুবিধার পরিবর্তে ভয়াবহ পরিণতিই ডেকে আনে যা নিঃসঙ্গতার চেয়ে সব দিক থেকেই বেশী অকল্যাণকর। তাই নিঃসঙ্গতা দূর করতে কিম্বা নতুন সঙ্গী খুঁজে পেতে আর যাই হোক ছলচাতুরির আশ্রয় নয় – এটাই হওয়া উচিত সচল জীবনে সঙ্গী খোঁজার স্থায়ী মূল মন্ত্র।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সম্পর্ক

ছোট বেলা থেকেই আমি ভীষণ রকম আপনজন ভক্ত। সম্পর্ক আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। সম্পর্কের গুরুত্বটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি রকম হওয়াতে জীবনে খুব সামান্যই সম্পর্ক গড়েছি আমি। এক কথায় সম্পর্ক গড়ায় খুবই অসফল আমি। ভীষণ ব্যাক্তিগত আমার ভিতরের আমি। বলতে গেলে এতটাই ব্যাক্তিগত যে নিজেকে ছাড়া কাউকেই মনে ধরে না সত্যিকারের খোলামেলা ভাব বিনিময়য়ের জন্য। কখনো কখনো মনে হয়, বোধ হয় নিজেকেও খুব বেশী আপন মানি না আমি । তবে তার মানে এই না যে আমি মিশুক নই। মানুষের সাথে দারুন আন্তরিক ভাবে মিশতে পারি এবং ভালও লাগে । সমস্যাটা তৈরি হয় তখন, যখন কোন মেলামেশাকে শান্তভাবে নিজের কাছে সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে হয় । তাই বাবা মায়ের পর খুব অল্প কয়েকজনকেই কোন রকম ঘনিষ্ঠ উপাধি দিতে পেরেছি।
খুব ছোট বেলার কথা মনে পড়ে। কোন কিছু ভালো করে ভাবার ক্ষমতা হবার আগেই মা কে আপন মেনে নিয়েছি। খুব সহজ আর প্রাকৃতিক সমীকরণ, কোন পরিশ্রম করতে হয়নি, পরবর্তীতে এ নিয়ে কোন পরিতাপেরও প্রয়োজন পড়েনি। বাবা হুবহু তেমন ভাবে না হলেও একই রকমের এক প্রাকৃতিক সমীকরণের মধ্যে দিয়ে তাকে পাওয়া; বাবা ছিল এক প্রশান্ত নিরাপত্তার চিহ্ন যাতে আদর আর প্রশ্রয়ের মাখামাখি। সম্পর্ক গড়ায় পিছিয়ে থাকা আমি তাই বাবা মা সম্পর্ক দুটোর ওপর ভীষণ রকম নির্ভরশীল ছিলাম। তাইতো তাদের মৃত্যুর পর একেবারে তাদের মন থেকে মুছে ফেলেছি যাতে কোন কষ্ট না হয়। কিন্তু কষ্টে পড়েছি অন্য এক দিক দিয়ে। সম্পর্কের আকাল প্রায় দুর্ভিক্ষের পর্যায়ে চলে গেছে।
কপালগুণে পছন্দমতো বিয়েটা করেছিলাম বাবা মা জীবিত থাকতেই। ভয়াবহ সুখ দুঃখের দিন গুলোতে পাশে থাকা এই মানুষটা নিজের যোগ্যতায় প্রাকৃতিক সম্পর্কের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, আমার স্বীকৃতির কোন ধার ধারেনি। সন্তান কলিজার টুকরা, স্থায়িভাবে খেলার পুতুল করে নিয়েছি তাকে, কোন ভার বইতে দেই না, সম্পর্কের ভারও না। ফলে ভয়াবহ এক আকাল দেখা দিল পিতামাতার অনুপস্থিতিতে। বেচারা স্ত্রী আমাকে একা সামাল দিতে পাগল প্রায়। সমাধান ছাড়া জীবন চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়লো। এই সুযোগে বেশ কিছু ধান্দাবাজ ঘনিষ্ঠতার অসাধারণ অভিনয় করে কলিজায় আগুন লাগিয়ে দিল। ঠিক এমন একটা সময়ে একজনের কথা মনে পড়ে দারুন একটা শান্তি পেলাম। বুঝতে পারলাম, এই সম্পর্কটা আরও আগেই কাজে লাগান উচিত ছিল; যা হোক, ঠিক করলাম অন্তত এখন থেকে এটা মনে রাখবো।
জীবনের নানা রকমের বিপদে বহু জনের মুখাপেক্ষী হয়েছি। তবে একজন রয়েছে যার কাছে প্রতি বারই উপস্থিত হয়েছি। কতবার ঠিক কি কি রকমের সাড়া তার কাছে পেয়েছি এ আলোচনায় তা আনা সম্ভব নয়। তবে আজ, ঠিক এই মুহূর্তে পেছনে ফিরে তাকালে যখন অনুভব করি আমি ভালো আছি, ভালো মন্দ সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ভালই ছিলাম, বিশ্বাস করতে পারি ভালই থাকব আশা করি, তখন ভাবি, যে ভালো রেখেছে এতকাল এবং বিশ্বাস করি ভবিষ্যতেও রাখবে, তাকে হৃদয়ের দিক থেকে এতদিন ঠিক কোন পর্যায়ে রেখেছি? হ্যাঁ আমি সৃষ্টিকর্তার কথা বলছি, তাও শুধুমাত্র আস্তিকের জন্য, অন্য কারো ক্ষেত্রে নয়। পরিষ্কার বুঝতে পারি। ধর্মের যত মোটা আস্তরণই নিজের ওপর লাগাই না কেন, হৃদয়ে তাকে সামান্যই জায়গা দিয়েছি, তাও বেশিরভাগ বিপদের সময়। অথচ, খুব সামান্যতেই বুঝতে পারি তাকে সম্পর্কের জায়গা দেয়া খুব সহজ, আবার সবসময়ই কাছে কাছে।
তাই এখন যতবার সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ হয়, সবার আগে ভালো লাগে, ভালবাসা-স্নেহ উপলব্ধি করি। নিয়ম কানুনে আমি বরাবরই দুর্বল। তারপরও সে কখনো আঘাত করা তো দূরে থাক, কল্পনারও অতিত সব উপহার দিয়েছেন। ভালো সম্পর্কের নিয়ম ধরে ভুলভালের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথা বেশির ভাগ সময়ই মনে থাকে না। তবু পরম মা, বাবা, কিম্বা যেকোনো ভালো বন্ধুর চেয়েও দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছেন আমাকে। যখন জানিই তার কথা, কেন তাকে প্রতি মুহূর্তের ঘনিষ্ঠ হিসাবে মনে রাখিনি ? বরং অন্ধ সমাজের শিক্ষা দেয়া ভয়কে মুখ্য করে ধরে রেখেছি তার প্রথম পরিচয় হিসাবে। ভয়তো বাবাকেও করতাম, কিম্বা মাকেও, ভালোও কি বাসিনি তাদের ? খুব ভুল করেছি, আর এতে স্রষ্টার কোনই ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি যত হয়েছে আমার । প্রতি সেকেন্ডের ভালবাসাকে গ্রাহ্য করার কথা মনে পড়েনি, খুজে ফিরেছি নতুন নতুন সম্পর্ক। দোষ নেই কোন নতুন সম্পর্ক খোঁজায়, কিন্তু তাই বলে সবচেয়ে পুরাতন আর নিশ্চিতকে ভুলে! তাই আবারো বলবো, বড় কাঁচা আমি সম্পর্কের অঙ্কে!
যার জ্ঞান-বিশ্বাসে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই, সে এ রকম কোন সম্পর্কের কথা ভাব্বেনা, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে নিজেকে বিশ্বাসী হিসাবে জানে, এমনকি অন্যকেও তা জানায়, সে যখন সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের কথা বেমালুম ভুলে থাকে তখন তার বিশ্বাস ভিত্তিক কাজ সমাজের কাছে কতটুকু নিরাপদ, এ প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে উঠেছে আমার মনে। হতে পারে, পাঠক ভালো বলতে পারবেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুখে থাকুন

কি চায় মানুষ? অনেক কিছু! কিন্তু সব চাওয়ার মূলে একটাই চাওয়া – সুখ।
ধরুন, দুজন মানুষ। একজন চায় চিকিৎসক হতে, অন্যজন কৃষক – নিজের বা পরের জমিতে। প্রথম জনের সুখের পথ মিলে গেছে চিকিৎসক হবার পথের সাথে। দ্বিতীয় জনের সুখের পথ কৃষি কাজে। যদি প্রশ্ন করি, কে বেশি বুদ্ধিমান? সম্ভবত অনেকেই জবাব দেবেন, প্রথম জন। যদি ঘুরিয়ে প্রশ্ন করি, সুখি হবার পথ খোঁজায় কে বেশি বুদ্ধিমান? আরেকবার ভেবে দেখবেন কি?
চাওয়া মানুষের সহজাত ধর্ম। পাওয়া তার ওপিঠ। বুকে যন্ত্রণা থাকলে পিঠ, বা পিঠে যন্ত্রণা থাকলে বুক সুখে থাকে কি করে! চাওয়াকে ভালবাসুন, তবে এমনভাবে যেন পাওয়াটা ঠিক অতটা ভালো না হলেও সহ্য হয়। তাই, মাঝামাঝি ধরনের চাওয়া সুখি হতে খুবই সহায়ক। কিন্তু তাই বলে কি পরম চাওয়া থাকতে নেই? বোধ হয় না থাকাটাই উত্তম। আর যদি থাকেই, তারও একটা সুন্দর হিসাব থাকতে হবে।
ধরুন আমি খুব ভালো গিটার বাজানো শিখতে চাই। হতে পারে এতে দশ বছর সময় লাগবে। এই দশ বছর গিটার শেখার সব কিছুই আমি উপভগ করবো। শেখার আনন্দে দশ বছর কাটানোর মজাটা হতে পারে বোনাস; অনেকটা এমন যে, জিত বা হার যাই হোক না কেন অংশগ্রহণের একটা পুরষ্কার থাকছেই। এরপর সাধনার ফলাফল আকাংখা মত হলে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত সুখ, আর না হলে সাধনার আনন্দটাই হবে পাথেয়। কিন্তু কি হবে যদি বিশ্বের এক নম্বর গিটার বাদক হতে চাই? হয়ত সময় সেই একই লাগবে, কিন্তু তা হবে প্রত্তিক্ষা আর আশংকার; আর পরিশেষে ফলাফলটাও ভীষণ ভারী, সব অর্থেই ।
তাই, কেউ সুখি হতে সুদীর্ঘ পথে হাঁটা শুরু করলে তাকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে সেই সুদীর্ঘ পথটাও উপভোগ্য হওয়া চাই – শুধু পরিনতিটা নয়। ভাবুন কোন একজন শিল্পীর কথা যে চূড়ান্ত সফল হতে চায়। পথটা হয়ত সে উপভোগ করতেও পারে প্রচণ্ড উত্তেজনা আর আতংক নিয়ে । তারপর যদি সফল হয় তাহলে চরম সুখের আবেশে থাকবে কয়েটা বছর, তারপর ধীরে ধীরে এক ঘেয়ে হয়ে যায় সেই চরম অবস্থান । এরপর পরিবর্তন সহজ ভাষায় নিচে নামা, আর স্থায়ীভাবে পরিবর্তনহীন হলে তো কথাই নেই – জীবন থাকতেই মৃত্যুর মত, আর মৃতের সব অর্জনই প্রায় অন্যের ! তাই, সফলের চেয়ে বিফল হলে তবু কিছু আশা থাকে – হতে পারে আরও ভালো কোন সুখের পথ সে ধরতে পারবে। ভাববেন কি অদ্ভুত কথা। সত্যি, পথটা উপভোগ্য অ্যান্ড দূর থেকে গন্তব্যের রূপ স্বর্গীয় মনে হলেও অনেক সময়ই গন্তব্য কাছে থেকে সেরকম নাও হতে পারে। সাবধান!!
নিজেকে প্রশ্ন করুন, শুধুই সুখী হতে চান, নাকি বিশেষ কিছুর মধ্যে দিয়ে সুখ খুঁজছেন? যদি শুধুই সুখ চাই আপনার, তাহলে সন্তুষ্ট থাকার প্রশিক্ষণ নিন আর নিজের দিকে খেয়াল রাখুন; দেখবেন অনেক কম ঝামেলাতেই আপনি সুখি মানুষ। আর যদি কোন গন্তব্যের মধ্যে দিয়ে সুখি হতে চান, যা অনেকেই চায়, তাহলে ভেবে রাখুন দুটো জিনিসঃ
১) যে পথ পারি দিতে চান, তা ফলাফল ছাড়াই কততুকু উপভগ করতে পারবেন
২) যে পরিণতিতে পৌঁছতে চান, তা কতটুকু স্থায়ী
পথটা যদি ভালো লাগে আর সুখের পরিণতি যদি ক্ষণস্থায়ী না হয় তাহলে নেমে পড়ুন। সফল বা বিফল যাই হউন না কেন, ভালো থাকবেন, আর সফল হলে কাঙ্ক্ষিত সুখটাও পাবেন। তবে সাবধান, উপরের দুটোর যে কোন একটার অনুপস্থিতি আপনাকে অসুখি করে তুলতে পারে, কোন সন্দেহ নেই। আরও মনে রাখতে হবে, সুখ খুবই ব্যাক্তিগত ব্যাপার; তাই নিজে জানুন এবং ভাবুন। অন্য কেউ আপনাকে ভেবে দিলে বিপদ হবার সম্ভবনাই বেশি। না জানলে বা বুঝলে, আরও কিছু অপেক্ষা করুন জানতে বা বুঝতে। এখন বেছে নিন আপনার জীবনের পথ, আর সুখে থাকুন।
