সম্পর্ক
ছোট বেলা থেকেই আমি ভীষণ রকম আপনজন ভক্ত। সম্পর্ক আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। সম্পর্কের গুরুত্বটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি রকম হওয়াতে জীবনে খুব সামান্যই সম্পর্ক গড়েছি আমি। এক কথায় সম্পর্ক গড়ায় খুবই অসফল আমি। ভীষণ ব্যাক্তিগত আমার ভিতরের আমি। বলতে গেলে এতটাই ব্যাক্তিগত যে নিজেকে ছাড়া কাউকেই মনে ধরে না সত্যিকারের খোলামেলা ভাব বিনিময়য়ের জন্য। কখনো কখনো মনে হয়, বোধ হয় নিজেকেও খুব বেশী আপন মানি না আমি । তবে তার মানে এই না যে আমি মিশুক নই। মানুষের সাথে দারুন আন্তরিক ভাবে মিশতে পারি এবং ভালও লাগে । সমস্যাটা তৈরি হয় তখন, যখন কোন মেলামেশাকে শান্তভাবে নিজের কাছে সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে হয় । তাই বাবা মায়ের পর খুব অল্প কয়েকজনকেই কোন রকম ঘনিষ্ঠ উপাধি দিতে পেরেছি।
খুব ছোট বেলার কথা মনে পড়ে। কোন কিছু ভালো করে ভাবার ক্ষমতা হবার আগেই মা কে আপন মেনে নিয়েছি। খুব সহজ আর প্রাকৃতিক সমীকরণ, কোন পরিশ্রম করতে হয়নি, পরবর্তীতে এ নিয়ে কোন পরিতাপেরও প্রয়োজন পড়েনি। বাবা হুবহু তেমন ভাবে না হলেও একই রকমের এক প্রাকৃতিক সমীকরণের মধ্যে দিয়ে তাকে পাওয়া; বাবা ছিল এক প্রশান্ত নিরাপত্তার চিহ্ন যাতে আদর আর প্রশ্রয়ের মাখামাখি। সম্পর্ক গড়ায় পিছিয়ে থাকা আমি তাই বাবা মা সম্পর্ক দুটোর ওপর ভীষণ রকম নির্ভরশীল ছিলাম। তাইতো তাদের মৃত্যুর পর একেবারে তাদের মন থেকে মুছে ফেলেছি যাতে কোন কষ্ট না হয়। কিন্তু কষ্টে পড়েছি অন্য এক দিক দিয়ে। সম্পর্কের আকাল প্রায় দুর্ভিক্ষের পর্যায়ে চলে গেছে।
কপালগুণে পছন্দমতো বিয়েটা করেছিলাম বাবা মা জীবিত থাকতেই। ভয়াবহ সুখ দুঃখের দিন গুলোতে পাশে থাকা এই মানুষটা নিজের যোগ্যতায় প্রাকৃতিক সম্পর্কের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, আমার স্বীকৃতির কোন ধার ধারেনি। সন্তান কলিজার টুকরা, স্থায়িভাবে খেলার পুতুল করে নিয়েছি তাকে, কোন ভার বইতে দেই না, সম্পর্কের ভারও না। ফলে ভয়াবহ এক আকাল দেখা দিল পিতামাতার অনুপস্থিতিতে। বেচারা স্ত্রী আমাকে একা সামাল দিতে পাগল প্রায়। সমাধান ছাড়া জীবন চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়লো। এই সুযোগে বেশ কিছু ধান্দাবাজ ঘনিষ্ঠতার অসাধারণ অভিনয় করে কলিজায় আগুন লাগিয়ে দিল। ঠিক এমন একটা সময়ে একজনের কথা মনে পড়ে দারুন একটা শান্তি পেলাম। বুঝতে পারলাম, এই সম্পর্কটা আরও আগেই কাজে লাগান উচিত ছিল; যা হোক, ঠিক করলাম অন্তত এখন থেকে এটা মনে রাখবো।
জীবনের নানা রকমের বিপদে বহু জনের মুখাপেক্ষী হয়েছি। তবে একজন রয়েছে যার কাছে প্রতি বারই উপস্থিত হয়েছি। কতবার ঠিক কি কি রকমের সাড়া তার কাছে পেয়েছি এ আলোচনায় তা আনা সম্ভব নয়। তবে আজ, ঠিক এই মুহূর্তে পেছনে ফিরে তাকালে যখন অনুভব করি আমি ভালো আছি, ভালো মন্দ সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ভালই ছিলাম, বিশ্বাস করতে পারি ভালই থাকব আশা করি, তখন ভাবি, যে ভালো রেখেছে এতকাল এবং বিশ্বাস করি ভবিষ্যতেও রাখবে, তাকে হৃদয়ের দিক থেকে এতদিন ঠিক কোন পর্যায়ে রেখেছি? হ্যাঁ আমি সৃষ্টিকর্তার কথা বলছি, তাও শুধুমাত্র আস্তিকের জন্য, অন্য কারো ক্ষেত্রে নয়। পরিষ্কার বুঝতে পারি। ধর্মের যত মোটা আস্তরণই নিজের ওপর লাগাই না কেন, হৃদয়ে তাকে সামান্যই জায়গা দিয়েছি, তাও বেশিরভাগ বিপদের সময়। অথচ, খুব সামান্যতেই বুঝতে পারি তাকে সম্পর্কের জায়গা দেয়া খুব সহজ, আবার সবসময়ই কাছে কাছে।
তাই এখন যতবার সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ হয়, সবার আগে ভালো লাগে, ভালবাসা-স্নেহ উপলব্ধি করি। নিয়ম কানুনে আমি বরাবরই দুর্বল। তারপরও সে কখনো আঘাত করা তো দূরে থাক, কল্পনারও অতিত সব উপহার দিয়েছেন। ভালো সম্পর্কের নিয়ম ধরে ভুলভালের জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথা বেশির ভাগ সময়ই মনে থাকে না। তবু পরম মা, বাবা, কিম্বা যেকোনো ভালো বন্ধুর চেয়েও দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছেন আমাকে। যখন জানিই তার কথা, কেন তাকে প্রতি মুহূর্তের ঘনিষ্ঠ হিসাবে মনে রাখিনি ? বরং অন্ধ সমাজের শিক্ষা দেয়া ভয়কে মুখ্য করে ধরে রেখেছি তার প্রথম পরিচয় হিসাবে। ভয়তো বাবাকেও করতাম, কিম্বা মাকেও, ভালোও কি বাসিনি তাদের ? খুব ভুল করেছি, আর এতে স্রষ্টার কোনই ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি যত হয়েছে আমার । প্রতি সেকেন্ডের ভালবাসাকে গ্রাহ্য করার কথা মনে পড়েনি, খুজে ফিরেছি নতুন নতুন সম্পর্ক। দোষ নেই কোন নতুন সম্পর্ক খোঁজায়, কিন্তু তাই বলে সবচেয়ে পুরাতন আর নিশ্চিতকে ভুলে! তাই আবারো বলবো, বড় কাঁচা আমি সম্পর্কের অঙ্কে!
যার জ্ঞান-বিশ্বাসে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই, সে এ রকম কোন সম্পর্কের কথা ভাব্বেনা, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে নিজেকে বিশ্বাসী হিসাবে জানে, এমনকি অন্যকেও তা জানায়, সে যখন সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কের কথা বেমালুম ভুলে থাকে তখন তার বিশ্বাস ভিত্তিক কাজ সমাজের কাছে কতটুকু নিরাপদ, এ প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে উঠেছে আমার মনে। হতে পারে, পাঠক ভালো বলতে পারবেন।
