মাত্রা

(বিজ্ঞান কল্প গল্প’)

দেশী একটা সফটওয়্যার ফার্মে কাজ করত রাশেদ। ওদের কাজ ছিল বিভিন্ন গেম তৈরী করে দেশে কিংবা দেশের বাইরে বিক্রী করা। বেশ লাভজনক ব্যবসা, দেশের বাইরের বাজারও মন্দ নয়। রাশেদ স্পেশালিস্ট প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করত ওখানে। ওর বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ছিল ভিস্যুয়াল ইফেক্টের ওপর। এই যেমন, রেসিং গেমের মধ্যে গাড়ী কিংবা রাস্তা ছাড়াও আশ-পাশের পরিবেশের ছবি বানাতে হয় – ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি। ওর কাজ ছিল ওগুলোকে অন্যান্য দেশের সফটওয়্যারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মত মানসম্পন্ন করে তৈরী করা।

এবং রাশেদ তার ক্যারিয়ারে ছিল সফল একজন প্রোগ্রামার। তার হাতের কাজ ছিল অসাধারণ, তার মেধার ওপর কোম্পানীর আস্থা ছিল ষোল আনারও বেশী। বরং সহকর্মীরা তাকে আধ-পাগল লোক হিসেবেই জানত, কেননা সে নিজের কাজ ছাড়া আর সব ব্যাপারে ছিল উদাসীন, অন্যমনস্ক।

নিজের কাজের ব্যাপারে সে একটু বেশী রকমই আগ্রহী ছিল, প্রায় অবসেশনের পর্যায়ে পড়ত ওটা। সেটা আর ওর পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং নেশা হয়ে গিয়েছিল। ও সারাদিন পড়ে থাকত তার ল্যাপটপ নিয়ে, আর সারারাত পড়ে থাকত ভিস্যুয়াল ইফেক্ট বিষয়ক পড়াশুনায়। সে চূড়ান্তরকম অসামাজিকও হয়ে পড়েছিল এসব কারণে।

কিন্তু ২০০৪ এর মার্চ মাসে একটা নতুন খেয়াল চাপে তার মাথায়। ও সবসময়ই চেয়েছে এমন কিছু করতে যা অন্য কেউ কোনদিন করেনি এ দেশে। এবার সে তার নিজের গেমগুলোকে বাস্তবতার আরো কাছাকাছি নিয়ে যেতে চাইল, অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক গেমে আপগ্রেড করার পরিকল্পনা শুরু করলো।

আসলে সে বাস্তবতার সাথে গেমের জগতের তুলনা করছিল। সে চিন্তা করে দেখল, গেমের জগত আর বাস্তব জগতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল – গেম দ্বিমাত্রিক, আর বাস্তব জগত বহুমাত্রিক। গেমের দুইটি মাত্রা স্ক্রীনের দুই মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর বাস্তব জগতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছাড়াও গভীরতা বলে একটি মাত্রা আছে, সময় বলে আরেকটি মাত্রা আছে, ইত্যাদি।

এসব নিয়েই সে পড়াশুনা করছিল, বিশেষ করে ত্রিমাত্রিক ভিডিওগেমের লেটেস্ট ভার্সনগুলো নিয়ে সে গবেষণা করছিল। তবে এরমধ্যেই সে আরেকটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার মাথায় ঢুকে গেল, আমাদের জগৎটা যদি বহুমাত্রিক হয়, আর ত্রিমাত্রিক গেমও মানুষই তৈরী করতে পারে – তাহলে অসম্ভব কি যে , আমাদের দৃশ্যমান এ জগৎটা অন্য কারো তৈরী করা বহুমাত্রিক গেম না!

খুব ভালোভাবে ভাবনাটা ঢুকে যায় তার মাথায়। আর যেহেতু সে ছিল অসামাজিক, তাকে তার  বিচ্ছিন্ন চিন্তা কিংবা ধারণা থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনারও কেউ ছিলনা। সে সমস্ত কাজ-কর্ম ফেলে ওটা নিয়েই মেতে রইল কয়েকদিন।

এরমধ্যে এপ্রিলের ১০ তারিখে সে দু:সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে সিদ্ধান্ত নিল যে সে পরীক্ষা করে দেখবে, এই পুরো জগৎটা বহুমাত্রিক জটিল একটা গেম কিনা। আর যেহেতু একটি মডেলের ভেতরে থেকে কিংবা তার অংশ হয়ে কোনদিনই সেই মডেলটিকে যাচাই করা সম্ভব না, সুতরাং এটা পরীক্ষা করার পথ একটাই – মডেল এর বাইরে চলে যাওয়া, অর্থাৎ মৃত্যু। সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল।

রাত ১২ টার সময় সে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক ঘুমের বড়ি খেয়ে বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল এবং একসময় সত্যি সত্যিই ঢলে পড়ল এক গভীর অতল ঘুমে।

সে যখন জেগে উঠল, তখন দেখল – চারিদিক অন্ধকার। তাহলে সে মারা যায়নি! কিন্তু এতো অন্ধকার যে কিছুই এর ভেতর আঁচ করা যাচ্ছিলনা। আর তার শরীরটাও সম্ভবত: অবশ হয়ে গেছে, সে কোন কিছু অনুভব করতে পারছিলনা। শুধু চিন্তা করতে পারছিল।

অনেকক্ষণ ছিল সে এভাবে, মনে হল অনন্তকাল। তারপর দু’টা খুব ছোট আলোর বিন্দুকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। ওগুলো উড়ছিল, অনেকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার মত, কিন্তু ওগুলো ঝিঁ ঝিঁ পোকা ছিল না।

স্বাগতম।

কেউ কথা বলছে শূণ্যের ভেতর থেকে। না, মনে হল আলো দু’টার সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে।

আমি এখন কোথায়? – রাশেদ জিজ্ঞেস করল।

তোমার চেতনা এখন চতুর্মাত্রায় – একটা যুগল কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল।

আমি কি মৃত?

তোমার আত্মা শরীর থেকে মুক্ত হয়েছে, আর এজন্যই তুমি প্রবেশ করতে পেরেছ এই চতুর্মাত্রিক চেতনার জগতে।

অর্থাৎ আমি মৃত !

তোমার এই অবস্থা সাময়িক নাকি স্থায়ী এব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই । ঘুমের ভেতরেও আত্মা শরীর থেকে মুক্ত হয়, তখন সেটা হয় সাময়িক, আর সেটা হলে আত্মা একসময় শরীরে ফিরে যায়। অন্যদিকে মৃত্যু আত্মাকে শরীর থেকে চিরতরেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

এতক্ষণে রাশেদ বুঝতে পারল, অন্তত এই মুহূর্তে ওর কোন শরীর নেই। সম্ভবত: ওর আত্মাটা একটা শূণ্যতার ভেতর ঝুলে আছে।

তোমরা কারা?

আমরা একধরণের সৃষ্টি যারা চারটি মাত্রাকে একসাথে অনুভব করতে পারে ।

রাশেদ কিছুক্ষণ চিন্তা করল – চতুর্থ মাত্রাটা তো সময়, তার মানে চতুর্মাত্রিক এই জগতে আমি ইচ্ছা করলেই অতীত বা ভবিষ্যতে যেতে পারব, তাই না?

সময় এখানে একটি আলাদা মাত্রা। সুতরাং ত্রিমাত্রিক জগতের অতীত বা ভবিষ্যৎকে এখান থেকে উপলধ্বি করা নিশ্চয়ই সম্ভব।

ত্রিমাত্রিক চেতনার জগৎ কি চতুর্মাত্রিক চেতনার জগৎ থেকে আলাদা?

জগৎ একটাই, একেক ধরণের অস্তিত্ব একেক মাত্রা কে অনুভব করে শুধু। মানুষ অনুভব করতে পারে তিনটি মাত্রা কে, আর আমরা একসাথে চারটি মাত্রা কে অনুভব করতে পারি।

শুনে ভালো লাগলো যে আমার এক ধরণের আপগ্রেড হয়েছে, যাই হোক এখন আমি সময়ের ভেতর ঘুরে-ফিরে দেখতে চাই – সেই পরিচয়হীন কালেরই একপর্যায়ে রাশেদ বলে। সে একজন বৈজ্ঞানিক, তাকে তার প্রকল্পের শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতেই হবে।

আলো দু’টি উধাও হয়ে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল দৃশ্যপট, লোকজন একটা লাশ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মুখটা খুব চেনা, ওটা রাশেদ প্রায় প্রতিদিনই আয়নায় দেখেছে।

রাশেদ অতীতের কথা ভাবল, তখন পেছনের দিকে ঘটতে শুরু করল ঘটনাটা। লাশ নিয়ে ওরা পেছনে হাটতে লাগল, রাশেদের মুখ থেকে ঘুমের ট্যাবলেটগুলো বেরিয়ে এলো, রাশেদ কম্প্যুটারে কাজ করছে, বই পড়ছে, স্কুলে যাচ্ছে – যখন আরো ছোট, রাশেদের বাবা-মা-দাদা।

এবার ভবিষ্যৎ দেখতে হবে। খুব দ্রুতগতিতে দৃশ্যপট বদলাতে লাগল, বসতিগুলোর ধরণ পাল্টে যেতে লাগল। আধুনিক অদ্ভুত সব আকৃতির স্থাপত্য দেখতে পেল রাশেদ। ও বুঝতে পারল, ওর সময় থেকে হাজার বছর এগিয়ে গেছে সে।

ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা – সেই মহাধ্বংস। ও দেখল পূর্বদিক থেকে আগুনের একটা হলকা দৌঁড়ে আসছে – কোন গ্রহাণুপুঞ্জ আঘাত করেছে ভূ-পৃষ্ঠে, কিংবা কোন অস্বাভাবিকরকম শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বোমা। সবাই মরে যাচ্ছে, শহরগুলোর পতন ঘটছে, লাখ লাখ বছরের মানবসভ্যতা তুলোর মত উড়ে উড়ে ঝরে পড়ছে – যেন এর কোন মূল্যই কখনো কারো কাছে ছিল না।

এটাই কি সেই তথাকথিত কেয়ামত! এই কি তাহলে সবকিছুর শেষ!

রাশেদ তখন হঠাৎ করে বুঝতে পারল – অতীত আর ভবিষ্যৎ আসলে কতগুলো স্ন্যাপশটের মত, একটার পর একটা সাজানো আছে এবং যা ঘটার তা ঘটবেই। অতীত বলো আর ভবিষ্যৎ বলো, জন্ম বলো আর মৃত্যু বলো – সব আসলে ঘটে গেছে।

ভাগ্য মানেই পূর্বনির্ধারিত, এবং মানুষ যথারীতি মূল্যহীন।

রাশেদ বুঝতে পারল, কেয়ামত ভবিষ্যতের কোন ঘটনা নয়।

কেয়ামত ঘটে গেছে।

সে গভীরভাবে প্রার্থণা করতে লাগল, যেন এটি একটি দু:স্বপ্ন হয় এবং একটু পরই যেন সে ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারে।

Leave a comment