১.
তিনটা ছেলে পেছন পেছন আসছে দেখে রাফিজ দ্রুত পা চালাল। সন্ধ্যার সময় বাজারের দোকানগুলোতে ওরা লাইট জ্বালানো কেবল শুরু করেছে। এই সময় জিনসের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পড়া চাপ দাড়িওলা তিন যুবক পিছু নিলে যে কারো ভয় পাবার কথা। আর রাফিজের তো ভয় পাওয়ার কারণ আছেই।
গতকাল যে ব্লগটা রাফিজ পোস্ট করেছে, এটা সম্ভবত তারই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ও তো ছদ্মনামে ব্লগ লেখে, ওরা কি করে জানবে যে রাফিজ ইমতিয়াজই সেই নাস্তিক ব্লগার ‘অরণ্যে রোদন’?
আর তাছাড়া কালকের ব্লগে সে গুরুতর কিছু লেখে নি। সে শুধু জ্যঁ পল সার্ত্রে-কে উদ্ধৃত করে লিখেছে যে ধর্মের উচিত নয় মানুষের ওপর জীবনের অর্থ চাপিয়ে দেয়া, বরং প্রত্যেকে নিজের বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে নেবে। ব্লগটা সে শেষ করেছে বার্ট্রান্ড রাসেলকে উদ্ধৃত করে, বলেছে যে – যা দেখা-শোনা যায় না, তাকে বিশ্বাস করাও ঠিক না। কেউ যদি প্রমান ছাড়া ঈশ্বর, ধর্ম, পরকাল এসবে বিশ্বাস করে, তাহলে সে একসময় টেলিপ্যাথি, ভুত, জাদু এসবে কুসংস্কারেও বিশ্বাস করতে শুরু করবে – শেষপর্যন্ত এ পৃথিবীতে যৌক্তিক চিন্তার কোন জায়গা থাকবে না।
এগুলো লেখায় ভুল কি আছে? তার তো চিন্তার স্বাধীনতা আছে, তাই না!
রাফিজ ভয়ে একসময় দৌড়াতে শুরু করল। বাজার থেকে বের হয়ে রিক্সা খুঁজতে থাকা কিছু মুরুব্বি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ছেলেগুলোকে যখন আর দেখা যাচ্ছে না, তখন রাফিজ দৌড় থামাল। ততক্ষনে সে চলে এসেছে ‘জলিল মিয়ার রকমারি চা’-এর দোকানের সামনে। সে দোকানের একদম ভেতরের দিকের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল, এখানে তাকে অনুসরণ করে সন্ত্রাসীদের আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
চায়ের অর্ডার দিয়েই সে লক্ষ্য করল, সাদা চুল সাদা দাড়ির এক বৃদ্ধ সোনালী ফ্রেমের চশমার আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য করছে। রাফিজ চোখ সরিয়ে নিল, কিন্তু বৃদ্ধ একটা কালো লাঠিতে ভর দিয়ে হেটে একেবারে তার সামনে এসে বসে পড়লেন।
‘আমার নাম খিজির। বাবা, তোমাকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে।’ রাফিজ হাসল, কিন্তু কোন উত্তর দিল না। ভদ্রলোক এবার অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন – ‘মানুষের উচিত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়া। জোর-জবরদস্তি একদমই ভালো না।’
‘আপনি সত্যি তাই মনে করেন?’ – রাফিজ এবার লোকটার প্রতি মনোযোগী হয়।
‘অবশ্যই।’
‘কিন্তু সেটা যদি ধর্মের বিরুদ্ধে হয়?’
লোকটা হাসল, ওর পান খাওয়া দাঁতগুলো তখন দেখা যাচ্ছিল – ‘মানুষ আসলে ধর্মের বিরোধিতা করে না, তারা আসলে নিজেরই বিরোধিতা করে। খোদা তো ধর্মকে আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ করেই দিয়েছেন।’
রাফিজ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, এ সম্ভবত আরেকজন ধর্মপ্রচারক – শেষ বয়সে দীনের দাওয়াত দেয়ার কাজে ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে, কিছুক্ষন পর মসজিদে যাওয়ার আহবান জানানো শুরু করবেন হয় তো।
‘কেউ যদি নাস্তিক হয়, মানে খোদাকে বিশ্বাসই না করে?’ – কিছুটা খোঁচা দেয়ার জন্যই যেন রাফিজ বৃদ্ধকে প্রশ্ন করে।
বৃদ্ধ খিজির আবার হাসেন – ‘আমার কি মনে হয় জানো? একজন ধার্মিক লোকের চেয়েও একজন নাস্তিক স্রষ্টাকে বেশি স্মরণ করে। হয়তো সে স্রষ্টাকে জানতে চায় বলেই প্রশ্ন করে। হতেও পারে নাস্তিকতা স্রষ্টার দিকে এগিয়ে যাওয়ার শুধুই অন্য আরেকটা পথ।’
‘আমি যদি একজন ঈশ্বরকে বিশ্বাসই না করি, তাহলে কিভাবে তার দিকে এগিয়ে যাবো?’
‘প্রার্থনা, দোয়া মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে স্রষ্টার কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।’ – বৃদ্ধ তার লাঠিটার ওপর থুতনি রেখে বললেন, তারপর কি মনে করে রাফিজের দিকে একটু ঝুকে এলেন, যেন কোন গোপন কথা বলবেন এভাবে – ‘শোন বাবা, তোমাকে আমি একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই, কিভাবে একজন নাস্তিকও খোদার দিকে মুহূর্তের মধ্যে এগিয়ে যেতে পারে।’
তারপর প্রায় শোনা যায় না, এমনভাবে ফিস ফিস করে বললেন – ‘তুমি এক মুহূর্তের জন্য ধরে নেবে স্রষ্টা বলে কেউ আছে, তারপর মনে মনে বলবে – খোদা আমাকে পথ দেখাও। এতেই হয়ে যাবে।’
রাফিজ কিছুক্ষন ভুরু কুঁচকে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে – ‘আপনি সত্যি বলছেন?’
‘তুমি পরীক্ষা করেই দেখো একবার। আচ্ছা আমি এখন উঠি, তোমার মতো আরো কয়েকজন ছেলের সাথে আমার দেখা করতে হবে। খুব জরুরি।’
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, তারপর দ্রুতই দোকান থেকে বের হয়ে গেলেন। চায়ের দাম দিয়ে বাইরে এসে রাফিজ এদিক-ওদিক খিজির সাহেবকে খুঁজলো, কিন্তু আশে-পাশে কোথাও তাকে দেখতে পেল না। বৃদ্ধের মনে হয় সত্যিই কোন জরুরি কাজ পড়ে গেছে।
একটা খটকা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে। খিজির সাহেব জানল কিভাবে রাফিজ নাস্তিক আর সে বাকস্বাধীনতা নিয়ে ভাবছিল? পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন! এই লোকও কি জানে সে আসলে ‘ব্লগার অরণ্যে রোদন’? নাকি রাফিজের কোথাও ভুল হচ্ছে। ছোটবেলায় নানী বলত, মাগরেবের সময় বাইরে বেরোলে সন্ধ্যাভ্রম হয়, মানুষ জেনেশুনে ভুল রাস্তায় চলে যায়। কিন্তু রাফিজ তো আসবে বিশ্বাস করে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিজ রাস্তায় নামল। কিন্তু কেন যেন ওর মনে বৃদ্ধের সেই কথাটা ঘুরে-ফিরে আসতে লাগলো – স্রষ্টার অস্তিত্ব জানার জন্য সহজ একটা পরীক্ষার কথা বৃদ্ধ বলেছিলেন। বৃদ্ধ কি তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিল? যাহোক রাফিজ ভেবে দেখল – এটা পরীক্ষা করে দেখা যেতেই পারে, ক্ষতি তো কিছু নেই। আর তাছাড়া সে তো জানেই এ পরীক্ষার ফল কি হবে, সুতরাং অসুবিধা কি! রাফিজ আকাশের দিকে হাত তুলে বলল – ‘খোদা বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তাহলে আমাকে আপনার অস্তিত্বের প্রমান দিন প্লিজ।’
সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, কিছুই ঘটল না। সে জানতো কিছু ঘটবে না, তবু বুড়ো লোকটা বলেছে বলেই সে এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটা চালিয়েছে। যাই হোক না কেন, প্রমান তো হয়ে গেল ঈশ্বর বলে কেউ নেই, তাই না কি!
এসব ভাবতে ভাবতে যখন সে রাস্তা পার হতে গেল – হয়তো তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল বলেই – সে খেয়াল করলোনা যে একটা মিনিবাস দ্রুতগতিতে ওরই দিকে এগিয়ে আসছে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে রাফিজ ইমতিয়াজ নিজেকে আবিষ্কার করল ফুটপাতের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সারা শরীরের ব্যথা ভীষণভাবে বেড়ে যাওয়ার আগেই তার তার দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো।
২.
যতদূর চোখ যায় – মানুষ আর সাদা চাদর, সাদা চাদর আর মানুষ। উত্তর দিকে, দক্ষিণ দিকে, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দিগন্ত পর্যন্ত খোলা প্রায়ান্ধকার মাঠে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ শুয়ে আছে – সার বেঁধে শুয়ে আছে। এগুলো কি লাশ! না, কারণ মাঝে মধ্যেই নড়ে উঠছে এরা, কারো কারো মুখে হঠাৎ করে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে হাসি – ঘুমের মধ্যেই।
এসবের মধ্যেই আস্তে আস্তে আড়মোড়া ভেংগে জেগে উঠল রাফিজ ইমতিয়াজ। অবাক হয়ে তাকালো সে চারদিকে। অসংখ্য নগ্ন ঘুমন্ত মানুষের সারির মধ্যে সে একাই জেগে উঠেছে। সে নিজেও নগ্ন, শরীরটাকে অনুভব করতে পারছেনা যদিও।
শরীরের অসাড় ভাবটা যখন কেবল দূর হয়ে এসেছে, তখন সে অনুভব করল – কেউ একজন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চমকে ফিরে তাকাল সে – যদিও একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে অস্পষ্ট একটা অবয়ব ছাড়া কিছুই সে ওখানে দেখতে পেলনা। অবশ্য এ অবয়বটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট আর উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। রাফিজ সেটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ওর মনে পড়ল, ছিটকে পড়ার আগে আকাশি-নীল রঙের একটা মিনিবাসকে ওর দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসতে দেখেছিল। এটা কোন অদ্ভুত হাসপাতাল নয়তো! কিন্তু একই দিনে একই এলাকায় এতোগুলো দুর্ঘটনা কি করে ঘটা সম্ভব !
‘তোমার যাবার সময় হয়েছে’ – পাশ থেকে কেউ বলে উঠল। অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এতোক্ষণে। রাফিজ লক্ষ্য করল, আপাদমস্তক সাদা পোশাক পড়া লোকটার দুধসাদা দাড়ি আর পাকা চুল।
‘আপনি কি খিজির সাহেব না?’ – রাফিজ জানতে চাইল।
অবয়বটা কোন উত্তর দিল না। শুধু ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল – নি:শব্দে।
‘আমি কি জীবিত?’ – হঠাৎ জেগে ওঠা সন্দেহ নিয়ে রাফিজ জিজ্ঞেস করে অবয়বটিকে।
‘জীবিতরা ঘুমন্ত, একমাত্র মৃত্যুই জাগাতে পারে মানুষকে।’ – এই প্রথম অবয়বের গম্ভীর কন্ঠস্বরটি শুনতে পেল রাফিজ।
‘ঘুমন্তরা কি জীবিত?’ – সে উল্টো প্রশ্ন করে। অবয়বকে নিরুত্তর দেখে সে যোগ করে – ‘আমি কি ঘুমন্ত ছিলাম? এখন কি আমি জেগে উঠেছি? আপনি আসলে কে বলুন তো?’
তখন অবয়বটির মুখ দেখতে পেল রাফিজ। খুব সুশ্রী মুখমন্ডল ওটার – মেয়েদের মত কোমল, শিশুদের মত পবিত্র, এবং একজন পুরুষের মতই প্রখর। তার চাহনির সাথে একটু আগে চায়ের দোকানে দেখা হওয়া বৃদ্ধের অনেক মিল।
‘হে মানুষ, আমি তোমার জন্য নিযুক্ত একজন দেবদূত, আর তুমি এইমাত্র ঘুম থেকে জেগে উঠেছ – মৃত্যুর মাধ্যমে।’
রাফিজ তখন বুঝতে পারল, সে একটা স্বপ্ন দেখছে। তাহলে অ্যাক্সিডেন্ট করে সে এখন কোমায় চলে গেছে সে! নাকি অ্যাক্সিডেন্টের চিন্তাও স্বপ্নের মধ্যেই ঘটছে!
‘এরা সবাই তাহলে জীবিত, আর শুধু আমিই মৃত?’ – রাফিজ তীর্যকভাবে প্রশ্ন করল।
‘সবসময়ই কেউ না কেউ জেগে উঠছে, আমরা তাকে পুনরুত্থানের মাঠে নিয়ে যাই – মৃতকে ঐ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াই আমার মত সৃষ্টির কাজ।’
‘জীবিতরা এখানে কি করে? তাদের তো পৃথিবীতে ঘুরে-ফিরে বেড়ানোর কথা।’
‘তারা পৃথিবীতেই ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে – তাদের সম্মিলিত স্বপ্নে।’
‘এরা সবাই স্বপ্ন দেখছে?’ – রাফিজ অবাক হয়।
‘জগৎটা তো একটা স্বপ্ন, যেখানে এরা একজন আরেকজনের সাথে দেখা করে।’ – ফেরেশতাবেশী উত্তর দেয়।
রাফিজ উত্তর শুনে চুপ হয়ে যায়। তখন ফেরেস্তাবেশী হাটতে শুরু করে, রাফিজ তাকে অনুসরণ করতে থাকে।
ওরা দু’জন হাটতে হাটতে একসময় লাখো কোটি ঘুমন্ত মানুষকে পার হয়ে আসে। দুই বিশাল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে গেছে এক সরু পায়ে হাটা পথ। তার ওপাশে যেতেই চোখে পড়ে বিশাল আরেকটি মাঠ। এ মাঠেরও কোন শেষ দেখা যায় না, আর সারা মাঠ জুড়ে গো-ধূলির বিষন্ন একটা আলো। সেই মাঠের মাঝামাঝি ওরা গিয়ে দাঁড়াল – রাফিজ, আর তার ডানপাশে সেই দেবদূত। তারপর তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, অনেকক্ষণ – যেন হাজার বছর। শেষে রাফিজ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল – ‘এখন আমি কি করব? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?’
‘তুমি এখন সৃষ্টি করবে।’ – বলল সেই অবয়ব।
রাফিজ কিছুই বুঝতে পারল না। ‘কি সৃষ্টি করব?’ – প্রশ্ন করল সে।
‘জগৎ সৃষ্টি করবে, নতুন নতুন।’
‘আমি জগৎ সৃষ্টি করব কিভাবে? আমি তো স্রষ্টা না।’
‘মানুষ, তুমি যা চাও, এখানে তাই হবে – তুমি যা ভাববে, তাই এখানে বাস্তব হবে।
এটা পৃথিবীর মত অন্যের তৈরী করা কোন স্বপ্ন নয়, ঐ স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এটা প্রকৃত বাস্তবতা। এখানে তোমার স্বপ্ন তুমি নিজেই তৈরী করে নেবে, তারপর সেই স্বপ্নের জগতে বাস করতে থাকবে – অনন্তকাল।
মৃত্যু তোমাকে পৃথিবী থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, স্বপ্নের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছ তুমি – এখন শুধু সৃষ্টি আর সৃষ্টি।’
রাফিজ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ এভাবে, তারপর সে একটু মাথা খাটাতে শুরু করল। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে হয়তো এ রহস্যের কোন কিনারা করা যাবে।
‘যদি আমি স্বর্গ তৈরী করতে চাই, তাহলে আমাকে কি করতে হবে?’
‘যারা বিশ্বাস করে তারাই কেবল স্বর্গ তৈরি করতে পারে।’ – সফেদ সেই অবয়ব বলে – ‘পৃথিবীকে যারা সুন্দরভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল, এইখানে তাদের স্বপ্ন তারা বাস্তবায়িত করার সুযোগ পাবে।’
‘আর যারা পৃথিবীতে কুৎসিৎ চিন্তা করেছে আর মানুষের ক্ষতি করেছে?’
‘তারা চাইলেও স্বর্গ তৈরী করতে পারবে না।’ – বলে এই অদ্ভুত জীব – ‘তারা পার্থিব জীবন কাটিয়েছে বিকৃতির ধ্যানে – এখানেও তারা যন্ত্রণাময় কুৎসিৎ একটা জগৎ ছাড়া আর কিছুই তৈরি করতে পারবে না। কারণ সুন্দর ভাবে চিন্তা করতে এমনকি সুন্দর স্বপ্ন দেখতেও তারা অভ্যস্ত নয়। আর তাদের তৈরী করা যন্ত্রণাময় জগতে তাদেরই থাকতে হবে – চিরকাল।’
‘আমি তো এদের কারো দলেই পড়ি না।’ – রাফিজ বলে।
‘কিভাবে?’ – অবয়ব সম্ভবত: তার অপার্থিব জীবনে এই প্রথম অবাক হয়।
‘আমি ছিলাম অবিশ্বাসী, স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস ছিল না আমার, বিশ্বাস ছিল শুধু নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিতে। আমার বুদ্ধিতে যা আসে নি, তা বিশ্বাস করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না কোনদিন।’
‘হে অদ্ভুত মানুষ, তার মানে কি তুমি জীবনে কোন স্বপ্নই দেখো নি – না সুন্দর, না কুৎসিৎ!’
‘পৃথিবীতে আমি বাস্তববাদী ছিলাম।’
‘কিন্তু এটাই তো বাস্তব, আর পৃথিবীটাই তো অবাস্তব একটা ছায়া।’
‘তখন তো সেটা জানতাম না।’
মাঝে বেশ কয়েক শত বছরের নীরবতা।
‘তাহলে তো তুমি কোন জগৎই তৈরি করতে পারবে না,’ – অবয়ব তার আশংকা প্রকাশ করল – ‘কারণ কোন জগতের স্বপ্ন তুমি দেখোই নি কোনদিন।’
রাফিজ চুপ হয়ে গিয়ে আবার চিন্তা করতে লাগল। এভাবে কেটে গেল আরো এক হাজার বছর। রাফিজ একসময় লক্ষ্য করল, ওর আশে-পাশে কেউ নেই। ওকে এখানে পৌঁছে দেয়া পর্যন্তই ছিল অবয়বের দায়িত্ব। এখন সে নিজেই তার নিজের একমাত্র সহায়।
রাফিজ খুব মন দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল একটি জগৎ তৈরী করতে। কিন্তু সে যতবারই চেষ্টা করতে যায় – তার মনে হয়, এটা একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না, যা একটু পরই শেষ হয়ে যাবে। সে যতবারই চেষ্টা করে – তার মনে হয়, মৃত্যুর পর মানুষের অস্তিত্বই সম্ভব নয়, ফলে তাকে থেমে যেতে হয় প্রতিবার।
সুতরাং প্রতিবারই সে ব্যর্থ হল একটি স্বপ্ন তৈরী করতে, যেন ব্যর্থ হতে থাকবে অনন্তকাল। আর ওর মনে হল, এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে তার চারপাশে বিরাজ করতে থাকবে অদ্ভুত এই শূণ্যতা – সীমাহীন। শূন্যতাও এতো ভয়াবহ হতে পারে ! রাফিজের মনে হল – কতই না ভালো হতো, যদি সে কোনদিন জন্ম না নিত।
সেই সীমাহীন ফাঁকা মাঠের মধ্যে অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে রাফিজ এক সময় ঈশ্বরের নাম জপতে শুরু করল। এভাবে আরো এক হাজার বছর পেরিয়ে গেল। এই হাজার বছরে সে বার বার প্রার্থনা করে শুধু একবারের জন্য আগের পৃথিবীতে ফিরে যেতে চেয়েছে।
৩.
রাফিজ চোখ খুলে দেখে সে একটা সাদা ঘরে সাদা বিছানায় সাদা চাদর গায়ে শুয়ে আছে, চারিদিকে সাদা আর হলদেটে বিভিন্নরকম যন্ত্র-পাতি। সাদা এপ্রোন পরা একজন অল্পবয়স্ক ডাক্তার চার্টে কি যেন লিখছিল, আর আকাশি রঙের জামা পড়া একজন নার্স বড় একটা স্ক্যানার সরিয়ে কি যেন খুঁজছিল।
ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের ডান দিকে রাফিজ দেখলো, সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা সাদা সোফায় বসে আছেন আর তার দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। তিনি যেন জানতেন যে রাফিজ এখনই জেগে উঠবে।
এই খিজির সাহেবই কি তাকে রাস্তা থেকে হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করেছেন? কিন্তু এরকম ইমার্জেন্সি রুমে উনি কেন থাকবেন? রাফিজের বাসার লোকজন কেন এখানে নেই? লোকটা যখন তার কালো ছড়িতে ভর দিয়ে রাফিজের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলেন, ওর তখন কেন যেন মনে হল খিজির সাহেবকে ডাক্তার বা নার্স কেউই দেখতে পাচ্ছে না, শুধু ওই দেখতে পাচ্ছে। ওর কেন এরকম মনে হল, সেটা সে জানে না।
বৃদ্ধ খিজির একসময় রাফিজের বিছানার একেবারে কাছে এসে দাঁড়ালেন, তারপর তার মাথায় হাত রেখে বললেন – ‘এখন তোমার কেমন লাগছে, বাবা রাফিজ?’
‘ভালো।’ – রাফিজ ক্ষীণস্বরে উত্তর দিল, তারপর কি মনে হতেই বলল – ‘আমি তো খোদার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম, বিনিময়ে পেলাম এই একসিডেন্ট। খোদার এটা কিরকম বিচার !’
বৃদ্ধ হাসতে শুরু করলেন, বাচ্চাদের অন্যায় আবদার শুনে বড়োরা যেভাবে হাসে অনেকটা সেভাবে। অনেকক্ষন তিনি এভাবে দুলে দুলে হাসলেন, তারপর শেষে বললেন – ‘তোমার দোয়া তো কবুল হয়েছে, তুমি বুঝতে পারো নি?’
রাফিজ নির্বাক চোখে খিজিরের দিকে তাকিয়ে রইল।
‘শোনো ছেলে, তুমি তো এতদিন শাস্তিরও অযোগ্য ছিলে। বিপদ কখনো কখনো ঐশ্বরিক গ্রহণযোগ্যতার লক্ষণ, আর কোন কোন ঐশী জ্ঞান শুধু বিপদের হাত ধরেই আসে।’
রাফিজ আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ডাক্তারকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে থেমে গেল। ওকে চোখ খুলতে দেখে ডাক্তার আর নার্স দুজনেই ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল, যেন এটা ওরা একদম আশা করে নি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল তাদের ছুটাছুটি, দেখে-শুনে মনে হল এরকম রোগীর জেগে ওঠা ওদের জন্য খুব বিস্ময়কর কোন ঘটনা।
ডাক্তার আর নার্স রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পর রাফিজ এদিক ওদিক তাকিয়ে বৃদ্ধ লোকটাকে খুঁজলো, কিন্তু কোথাও তাকে সে আর দেখতে পেল না – লোকটা যেন একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। রাফিজ হাসপাতালের লোকজনের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেল। বাইরে তখন আষাঢ় মাসের অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
