অপরাধ বোধ

খুব ছোট বেলায় উঁচু মানের মানুষ হতে একটা বিশেষ অনুভূতির আশ্রয় নেয়া শুরু করি আমরা। সেটা হল অপরাধ বোধ। অনেক সময়ই মনে পড়ে না কে এটা প্রথম শিখিয়েছিল। হয়তো প্রথম অপরাধ বোধের স্মৃতি ছিল অহেতুক মিথ্যা বলা কেন্দ্রিক। মা শিখিয়ে দিলেন, মিথ্যা বলতে নেই, সৃষ্টিকর্তা অখুশি হবেন। পরামর্শ দিলেন তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবার। চার কি সাড়ে চার বছর বয়সী শিশু দরজার ওপারে গিয়ে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছে স্রষ্টার কাছে – কি শাশ্বত সে অপরাধ বোধ! সেই যে শুরু, আর থামেনা। কিন্তু তার সবটাই কি জরুরী? আর যদি সবটা জরুরী না হয়, তাহলে কোনটা নয় এবং কেন?

অপরাধ বোধ অনুভূতিটাকে আগে একটু বিশ্লেষণ করে নেয়া যাক। অপরাধ করেছি, এই ঋণাত্মক অনুভূতিটাকেই আমরা বলি অপরাধ বোধ। তাই অপরাধ বোধের প্রথম শর্ত হল একটা অপরাধ প্রথম হতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে আরো বড় একটা প্রশ্ন জুড়ে যাবে, অপরাধ মূলত কি – খুব সাধারনভাবে? যা করা নিষেধ বা ক্ষতিকর বা অনুচিত, তাই অপরাধ। কিন্তু মুশকিল হল, এই নিষেধটা কার? যে কোন ধর্ম মানে না, তাকে ধর্মীয় নিষেধের কথা বলা অর্থহীন। যার ভালো মন্দ বোধ আছে তাকে উচিত অনুচিতের পথ ধরে নিষেধের কথা বলা চলে। এর চেয়ে এক ধাপ সংকীর্ণ যার বোধ, সে অন্তত দেশের আইন অনুযায়ী বিধি নিষেধ মেনে চলতে পারে। একেবারেই আদিম যারা – ব্যাথা, যন্ত্রণা, দুঃখ বা ভয়ের সুবাধে তারা বিধি নিষেধের ধারণা পেতে পারে।

নিষিদ্ধ কিছু যখন ঘটে যায়, তখনই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ধরা যায়। এখানে মনের ইচ্ছার গুরুত্ব খুবি বেশি। অর্থাৎ, যে অপরাধ আমি করেছি তাকে কি আমি অপরাধ জেনেই করেছি? যদি তাই হয়, তবে কেন করেছি – ওই কাজের পেছনের আনন্দ পেতে, নাকি শুধুই অপরাধের আনন্দ পেতে? যদি প্রথম কারণে করে থাকি, তাহলে প্রশ্ন হল, অপরাধ ছাড়া এই আনন্দ পাওয়ার উপায় কি ছিল না? তবে দ্বিতীয় কারণে অপরাধ করে থাকলে এর বিশ্লেষণ বেশ কঠিন, যা এই লেখায় আমি এড়িয়ে যেতে চাই। যা হোক, যদি কারো অনুভূতিতে এটা আসে যে, সে ওই অপরাধ করার মধ্যে দিয়ে একটা ভুল কাজ করেছে যা তার করা ঠিক হয়নি, তখনই সে অপরাধ বোধে ভুগছে বলা যেতে পারে। 

অপরাধ বোধ নিয়ে এর পর কি করা যায় সে আলোচনার আগে যা ভাবা জরুরী তা হল, অপরাধ সংঘটনের সময় ঠিক কোন ইচ্ছাটা কাজ করেছিল অপরাধীর ভেতরে।

ধরুন, একজন অবিবাহিত পুরুষ লুকিয়ে কোন মহিলার ব্যাক্তিগত গণ্ডির ভেতরের কাজ কর্ম দেখছে যা তার অধিকারের বাইরে। তার ভেতরের উদ্দেশ্য হয়ত যে কোন প্রকারে নিজের যৌনতাকে প্রশ্রয় দেয়া। এরপর যদি সে অপরাধ বোধে ভুগে তাহলে তার প্রতি প্রথম প্রশ্ন হবে, বৈধ ভাবে এটার কি কোন উপায় ছিল, অর্থাৎ যৌনতার প্রশ্রয় বৈধ ভাবে কি দেয়া যেত? যদি জবাব হাঁ হয়, তাহলে ভাবতে হবে কেন তা বৈধ ভাবে করা হল না, কিম্বা কিভাবে তাকে বাস্তবে সম্ভব করা যেত। আর জবাব না হলে, প্রশ্ন থাকবে, বৈধ পথ না থাকলেও ওই অনুভূতিটা কেন বৈধ হবে? এরপর ভাবতে হবে, যে অপরাধ সে করেছে, তার বাস্তব মন্দ দিক কি? শারিরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, এবং সম্ভাব্য অন্য সকল দিক থেকে। এতে যদি সৃষ্টিকর্তা বা সমাজের আইনের লংঘন হয়ে থাকে, যা হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাহলে এর পরের ধাপে তা নিয়ে কাজ করতে হবে। 

সব অবস্থায় যা বাদ্ধতামূলক তা হল, অপরাধীকে তার ব্যক্তিগত অভিমত বিষয়ে  ভাবতে উৎসাহিত করা। অর্থাৎ, সে কি ভাবছে? যা করেছে তা কি অপরাধ? যদি জবাব হাঁ হয়, তাহলে আবার প্রশ্ন করতে হবে, সে এর পুনরাব্রিত্তি করতে আগ্রহি কিনা। এটার জবাব যদি না হয়, তাহলেই কোন না কোন মাপকাঠি ধরে অপরাধ বোধকে প্রশ্রয় দেবার সুযোগ থাকে। সুযোগ থাকে সমাধানের চিন্তা করার। যদি অপরাধী মনে করে যে তার কাজটা খারাপ কিছু ছিলনা , তাহলে অপরাধবোধের দিকে আগানোর চেষ্টা শুধু জটিলতাই বাড়াবে। আবার, অপরাধ জেনেও যদি সেটা পুনর্বার করার আগ্রহ থাকে, তাহলে অপরাধ বোধের নাটককে কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয়, এমনকি যদি তা আপনার নিজের মধ্যেও হয়। শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের অবস্থানে থেকেই এ ধরনের অপরাধির জন্য ব্যাবস্থা নেয়া সম্ভব, অন্য কোন অবস্থান থেকে নয়। তাই নিজের অপরাধের ক্ষেত্রে সতর্ক হউন, প্রশ্ন করুন, আপনি নিজে কতটুকু এর জন্য কর্তৃপক্ষ?  

অপরাধ বোধ এক ধরনের নৈতিক শাস্তি হলেও, বাস্তবের নিরিখে এটা কোন শাস্তি নয়। তাই সতর্ক থাকতে হবে, ভালো মানুষ তৈরি করতে যত্রতত্র অপরাধ বোধের ব্যাবহার করে শাস্তি চালু রাখার চেষ্টা করাটা খুব ভুল। কারণ, অনেক সময়ই এতে অপরাধীর চিন্তাধারা বা অনুভুতিকে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে কষ্টে ফেলার চিন্তাটাই বড় হয়ে উঠে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় নিজ বা অন্যের অপরাধের সমাধা হল, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কষ্ট ছাড়া আর কোনই পাওয়া নেই এতে। 

সমস্যা হল, আমরা অনেক সময়ই নিজেকে অপরাধ বোধ দিয়ে বিচারের চেষ্টা করি; আর এতে যদি ওপরের ঐ অংশগুলো না থাকে তাহলে তা নিজেকে কষ্ট দেয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না। ফলে সব অপরাধের শেষে নিজেকে কষ্ট দেবার অপরাধটাও প্রতিনিয়তই আমরা যোগ করতে থাকি, যার জন্য সামান্য অপরাধ বোধও কখনো আমাদের মধ্যে জাগে না, কারণ আমরা তা জানিই না। আর দৃষ্টির আড়ালে অপরাধের উপস্থিতি অপরাধ বোধের অভাবের চেয়েও বিপজ্জনক – হোক তা নিজ কিম্বা অন্যের জন্য। 

Leave a comment