
এক দেশে ছিল এক রাজা। সত্যিকার অর্থেই সে ছিল। অর্থাৎ, সে এখন নেই। আছে তার রাজত্ব, রানী আর তিন সন্তান – আদিম, আদম আর উদাম। সন্তান জন্মের ঠিক আগে দিয়ে রাজা এক ঋষিকে স্বপ্নে দেখতেন, বারবার। তিনিই নাম গুলো ধরিয়ে দিয়েছেন রাজাকে। আদিমের জন্ম সবার প্রথম আর উদামের জন্ম সবার শেষে। তাই, আদিম বড়, আদম মেঝ আর উদাম ছোট। একদিন, যখন তাদের বয়স কুড়ির আশেপাশে, তারা এক সাথে জঙ্গল ভ্রমণে যাবে ঠিক করল। কিন্তু ঝামেলা বাধালো রানী। সে তিনজনকে ডেকে বসাল। তারপর তাদের কাছে বলল, এখন তাদের একজনকে শীঘ্রই রাজার ভার নিতে হবে। তাই জঙ্গল ভ্রমনে সফলতমকেই সম্ভবত রাজার দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। প্রাসাদের পাশেই নদী, নদী বয়ে গেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। তিনজনকে রানী জানিয়ে দিল, তারা যার যার মত সাঁতরে জঙ্গলে পৌঁছাবে, এ হবে তাদের রাজকীয় শক্তির পরিচয়। জঙ্গলে প্রত্যেকে সে দিনটা একা কাটাবে, নিজের খাবার নিজে খুঁজে খাবে, তারপর পরের দিন একা সাঁতরে আবার প্রাসাদে ফিরবে। প্রাসাদে ফিরে তারা রানীর আয়োজন মাফিক ব্যবস্থায় পরবর্তী কাজ গুলো করবে, যদিও তারা জানেনা সেগুলো ঠিক কি ।
যেমন কথা তেমন কাজ। জঙ্গলে প্রথম গিয়ে পৌঁছল উদাম। বয়সের উঠতি গতি তার শরীরেও। কিন্তু অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে। ক্ষুধার যাতনায় এদিক ওদিক খাবারের সন্ধান করতে শুরু করল সে। কিছুদূর এগিয়ে দেখতে পেল একটা বাঘ হরিণ ধরে কামড়ে খাচ্ছে। সে ভাবল, সেও একই কাজ করবে, প্রথম কোন পশু ধরবে, তারপর কামড়ে খাবে। কিছু সময় পশুর খোঁজে ঘোরাঘুরির পর দেখতে পেল একটা শুকর ছানা, মনের সুখে আজেবাজে খাচ্ছে। বনের রাজার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল উদাম তার ওপর, তারপর এক এক করে খাবারের আয়োজন পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। খাবার পর পেটও ভরল। ভালো ঘুম হল, না, একটু বেশিই ঘুম হল। এক ঘুমে রাত, তারপর সকাল। উদাম জেগে উঠেই ঠিক করল প্রাসাদে ফিরবে, সাঁতরে।
ওদিকে উদামের পরপরই পৌছাল আদিম। সাঁতরে জঙ্গলে উঠার সময় তার মাথায় এক বুদ্ধি এলো। শরীর তার মোটা তাজা। মাত্র এক দিনের খাবারের অভাব তার কোনই সমস্যা করবেনা। ঠিক করল গাছে চড়ে, দিনটা পার করবে। তারপর পরদিন সকাল সকাল সবার আগে ফিরবে প্রাসাদে। ক্ষুধা তার পেটেও ছিল। কিন্তু রাজা হবার স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে ওটাকে মেরে ফেলল সে। ঘুম খুব ভালো হলনা খালি পেটে, তার ওপর অলস গাছে চড়ে থাকায় শরীরেও তেমন ক্লান্তিও ছিল না। পরদিন সকাল সকাল উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল আদিম নদীতে। রাজত্বের স্বপ্ন মাথায় নিয়ে সাঁতরে চলল প্রাসাদের দিকে।
বেচারা আদম জঙ্গলে পৌছুলো ঠিকই, কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না এর পর কি করা উচিত। ক্ষুধা তারও ছিল। কিন্তু পশু কামড়ে খাওয়ার মানসিকতা ছাড়া। বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সে ফল খুঁজল, যেটা খেতে পারবে। বেশ কিছু সময় ঘোরাঘুরির পর গোটা দশেক ফল পেল, তাও দু’তিন জাতের। কিছু স্বাদে ভালো, কিছু আবার না। খাওয়ার কিছু সময় পর পেটের মধ্যে ব্যাথাও হল। ব্যাথা কমাতে জঙ্গলে একবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিল আদম। সব মিলে একটা সাধারণ দিন কাটিয়ে সন্ধা হল। ক্লান্ত আদম কখন গাছের গুড়ির ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো টেরও পেলনা। সকালে ঘুম ভাংতেই বাধ্য আদম ফিরে চলল প্রাসাদে, সাঁতরে। মনে প্রশ্ন, রাজা হবার যোগ্যতা আসলে কিসে?
প্রাসাদে প্রায় একই সময়ে তিনজন হাজির হল। রানী তিনজনকে প্রাসাদের তিনটা কক্ষে পাঠালেন। সাথে একজন করে বিচক্ষণ মানুষ দিলেন। বিচক্ষণদের প্রত্যেককে একটা করে বিশেষ শব্দ শিখিয়ে দিলেন রানী, গোপনে, যা ভেতর থেকে বললেই শুধু মাত্র ঐ কক্ষ থেকে বের হবার দরজা প্রহরী খুলে দেবে, নাহলে না। যার যার কক্ষে ঢুকে গেলো আদিম, আদম আর উদাম। সাথে প্রত্যেকের একজন করে বিচক্ষণ লোক। ভেতরে ঢুকার পর প্রহরীরা দরজাগুলো বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল।
প্রত্যেক বিচক্ষণ ব্যাক্তি সাথের রাজকুমারকে বলল, “আপনার জঙ্গলের অভিজ্ঞতার আলোকে আপনার রাজা হবার যৌক্তিকতা উপস্থাপন করুন।” উদাম দু’ এক কথা বলে সুবিধা না করতে পেরে চড়াও হল বিচক্ষণ ব্যাক্তির ওপর। এক পর্যায়ে বাক বিতণ্ডায় উত্তেজিত উদাম দেয়ালে মাথা ঠুকে দিল তার সাথের বিচক্ষণের। বিচক্ষণ মরে গেল, উদাম বন্দি হল সেই কক্ষে। দরজা খোলার গোপন শব্দটা জানাই ছিলনা তার।
আদিম তখনও কৌশলে তার সাথের বিচক্ষণকে হাত করার চেষ্টা করছে, আবার মনে সন্দেহ বিচক্ষণের মনোভাব আর সততা নিয়েও। শেষমেষ সে বিচক্ষণকে গোপনে বিপুল অর্থ দেবার শপথ করল, যদি সে রাজা হয়। গোপন শব্দ ব্যাবহার করে বিচক্ষণ আদিমকে নিয়ে বের হয়ে এলো। তারপর রানীর কক্ষ হয়ে আদিম সোজা জেলে।
আদম জানেনা কিভাবে রাজা হতে হয়। তাই সে বিচক্ষণকে বলল, তাকে রাজা করা হলে সে তার কাজ ঠিকমতো বুঝে নেয়ার আর সে অনুযায়ী করার চেষ্টা করবে, কিন্তু এর বেশি তার তেমন কিছু বলার নেই। ঘর থেকে বের হয়ে এলো আদমও। অন্য দুজনের অনুপস্থিতি আর নিজের তেমন কোন খারাপ বৈশিষ্ট্য না থাকায় রানী তাকে রাজা ঘোষণা করলেন।
রাজা হবার পর আদম বুঝতে পারল, কোন বিশেষ কাজ বা বৈশিষ্ট্য তাকে রাজা করেনি। সে রাজা হয়েছে পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর বড় ভুল থেকে বেঁচে থাকার কারণেই।
