সীমানা পেরিয়ে

লেখক আর এক অজানা কুকুর

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এটা একটা প্রতীকী লেখা, আক্ষরিক অর্থে এটার পূর্ণ ভাব প্রকাশ পায়না I

পেশায় আমি শিক্ষক ছিলাম বেশ কিছু বছর। আর শেখানোর চেষ্টা আমার বরাবরই। নিজেকে শেখাই, এমনকি অন্যকেও। বেশিরভাগ শিক্ষা, যা নিয়ে আমি নাড়াচাড়া করি, আসে আধ্যাত্ম-দর্শন থেকে। আমি এগুলোকে খুব ভালবাসি, কারন এগুলো আমার জীবনে ভীষণ রকম উপকারে এসেছে। তবে এগুলোতে হালকা আনন্দের উপস্থিতি নেই বলে অন্যরা মুখ কাঁচুমাচু করে শোনে আর মনে মনে আমার গুষ্টি উদ্ধার করে; হয়তো কেউ কেউ আমাকে দেখলে পথ বদলে সরে যেতে চায়। কিন্তু কি করা! যাকে প্রাণ রক্ষাকারী ঔষধ হিসাবে চিনেছি, অন্যের না বোঝায় তাকে ছুড়ে ফেলি কিভাবে? বড় বিবেকহীন লাগবে নিজেকে।

যে ক’টা বিষয় নিজে শিখেছি আর অন্যকে শেখানোর চেষ্টা করেছি তার মধ্যে “সীমার মধ্যে থাকা” সবচেয়ে কঠিন আর ভীষণ জরুরী বলে মনে হয়েছে। যাকেই এটার কথা বলিনা কেন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের উসিলায় চাপড় খেতে হয়েছে। বুঝি, স্বাধীনতা বড়ই মধুর, কিন্তু প্রশ্ন হল স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যের সীমারেখাটা কোথায়? আদৌ কি তা আছে? চলুন, একটা খুব সহজ আর গাণিতিক উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।

ধরুন আপনার একমাত্র সন্তানের বয়স ১৮ মাস। আপনি পরিবার নিয়ে থাকেন একটা ডুপ্লেক্স বা দোতলা বাসায়। দোতলা থেকে একতলায় নামতে আপনাদের ১৫ টা সিঁড়ি পার হতে হয়। আপনাদের শোবার ঘর গুলো দোতলায়। ফলে আপনার ১৮ মাসের সন্তানও ঘুমায় দোতলায়। আপনি জানেন আপনার সন্তান একা সিঁড়ি দিয়ে নিরাপদে ওঠানামা করতে শিখেনি। তাই আপনি বাসায় অন্যদের অনুরোধ করে রেখেছেন, আপনার সন্তানকে একা সিঁড়ির কাছে যেন রাখা না হয়, কারন এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যা কেউই চায়না।

এখন ভাবুন কয়েকটা কাল্পনিক দৃশ্য।

সীমা

১)আপনার সন্তান সিঁড়ির কাছের ঘরটার দরজার ঠিক ভেতরেই বসে আছে, কেউ সাথে নেই।

২) আপনার সন্তান দরজা পেরিয়ে ঠিক সিঁড়ির আগেই বসে আছে, সাথে কেউ নেই।

২) আপনার সন্তান এক সিঁড়ি নেমে ওখানে বসে আছে।

৩) আপনার সন্তান দুই সিঁড়ি নেমে ওখানে বসে আছে।

৪) আপনার সন্তান তিন সিঁড়ি নেমে বসে আছে।

৫) আপনার সন্তান চার নম্বর সিঁড়ি নামতে গিয়ে কোন ভাবে বেসামাল হয়েছে।

৬) আপনার সন্তান পাঁচ নম্বর সিঁড়ি নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়েছে।

আমি পাষাণ হৃদয় নই। কিন্তু ডাক্তারি শিখতে তো লাশ কাটতেই হবে, তাইনা! তাই এবার আবার কল্পনায় ফিরে আসুন। আপনার সন্তানের নিরাপত্তার জন্য আপনি ঠিক কত নম্বরের পরিস্থিতি থেকে সতর্কতা স্বরূপ বাধা দিতে চাইবেন? আমি চাইবো এক নম্বরেই সতর্ক হতে, আর দুই নম্বরে অবশ্যই বাধা দিতে। আমার ব্যাখা, সন্তানের ব্যাপারে আমি বিপদ সীমার কাছেও যেতে চাইবনা। কেউ যদি বলেন তিনি ৩, ৪ বা ৫ নম্বরে বাধা দেবেন, আমি শ্রদ্ধা রেখে তাকে বলব, যে এক সিঁড়ি নামতে দেবার মানসিকতা রাখে, সে এক এক করে হয়তো পাঁচ সিঁড়ি নামতে দিতেও পারে, বিশ্বাস নেই। আর একমাত্র সন্তানের মত আপনজনের নিরাপত্তায় এভাবে ভাবা খুব বেশি অন্যায় বোধ হয় হবে না।

এবার আরেকটু পাষাণ কল্পনায় আসুন। মনে করুন, এর আগে আপনি একইভাবে কোন শিশুর দুর্ঘটনা দেখেছেন যার পরিনতি হৃদয়বিদারক ছিল। এ অবস্থায় যতই স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হউন না কেন, কোন ভাবেই আপনি এক নম্বর এর পর প্রশ্রয় দেবেন না। ১৮ মাসের শিশুরও স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে ১৮ বছরের মানুষেরও। চার পাশে বহু ঘটনা নির্ভরযোগ্য উপায়ে জানা থাকলে আর একটু চিন্তাশীল হলে আপনিও বুঝতে পারবেন, বিপদ ঠিক কোন পথ বেয়ে এসেছে। সে পথটা যদি বাদ্ধতামুলক কিছু না হয়, তার মধ্যে যদি দরকারি এমন কিছু না থাকে যা অন্যত্র পাওয়া যাবে না, সে পথ থেকে আপনি নিজকে এবং আপনার আপনজনকে দূরে রাখবেন এটাই স্বাভাবিক।

অনেক সময়ই আমি অনেককে তর্ক করতে দেখেছি, একটা দুইটা সিগারেট খেলে কিছু হয় না; কিম্বা এক আধ ঢোক মদে সমস্যা নেই; অথবা একবার দুবার সীমা অতিক্রম করে দেখা যেতেই পারে। এ জাতীয় চিন্তার জবাবে আমার একটাই মন্তব্য থাকবে, আর তা হল, যে সীমার বাইরে এক সিঁড়ি যাবে, সে এক এক করে সময় নিয়ে পাঁচ সিঁড়ি গেলে আমি অবাক হবোনা; আর পাঁচ সিঁড়ি পর যদি ভয়ংকর কিছু থেকেই থাকে তাহলে সিঁড়ি থেকে দূরে থাকতে কি এত সমস্যা, যদি সেখানে কোন দারুন কোন প্রয়োজন (যা ঐ বিপদের চেয়েও ভারী) না থাকে!

শরীরের চেয়ে মনটা অনেক বেশি পিচ্ছিল। প্রথমবার এক সিঁড়ির অভ্যাস দ্বিতীয়বারে দুই সিঁড়ির অভ্যাসে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। শরীরটাকে সামলে নেয়া প্রায় একই রকম হলেও, এক আর দুই সিঁড়িতে মন সামলানো একই রকম নয়। হতে পারে, তিন সিঁড়িতে গিয়ে মন অবাদ্ধ্য হবে, চার সিঁড়িতে শরীর, আর পাঁচে হয়তো জীবন!

তাই আমি ঐ শিক্ষার ভক্ত, যেখানে বিপদ সীমার কাছে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়, অতিক্রম তো দূরে থাক! আর তা করব নাই বা কেন, আমি যে প্রচণ্ড ভালবাসি – হোক নিজেকে, কিম্বা অন্য কাউকে। ভালবাসার জন্য ভীতু হতে ভয় করিনা আমি।

মো সামির হোসেন

হোম ওয়েব পেইজঃ http://masterdeathanddying.com/

Leave a comment