আদিম
১
“ওই লাল রং করা গাছটা আমাকে কিন্তু প্রায়ই অস্বস্তিতে ফেলে।” – দুপেয়ে পুরুষ প্রাণীটি পাশে বসে থাকা সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে – “কেন ওটার রং লাল? কেন ওটার ফল খাওয়া নিষেধ আমাদের জন্য?”
বাগানটি সবুজ আর সুন্দর। নারীটি একটি বিশাল বৃক্ষের ছায়ায় বসে দূরে লাল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে কিছু বলে না, শুধু পুরুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে একবার প্রশ্রয়ের হাসি হাসে।
সেদিকে তাকিয়ে পুরুষটির মুখ থেকে হঠাৎ করেই মেঘ সরে গিয়ে প্রাণের আলো ঝিকমিক করতে থাকে সেখানে, খুব উৎসাহ নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে সে – “শোনো হায়া, আসলে হয়েছে কি, আমি আজো চিন্তা করছিলাম আমরা দুজন এখানে কি করছি, আমাদের মতো আর কেউ কি এই জগতে আছে, নাকি আমরা দুজন একসাথে একা?”
হায়া এবার উত্তর দেয়, কোমল স্বরে – “ও এজন্যই বুঝি একটু আগে তোমাকে এতো বিষন্ন দেখাচ্ছিল, আদ?”
আদ কিছু বলে না, হাতের কাছ থেকে একটা ছোট্ট নুড়ি কুড়িয়ে দূরে ঢিল দিয়ে দেখার চেষ্টা করে সেটা কতদূর যায়।
“কেন এসব নিয়ে চিন্তা করো?” – হায়া কণ্ঠে কিছুটা প্রশ্রয় মিশিয়ে বলে – “তুমি আমি তো ভালোই আছি এখানে, তাই না? এভাবে থাকবো আমরা এখানে অনন্তকাল।”
“আমার কেন যেন মনে হয়” – আদকে হঠাৎ করেই আবার চিন্তিত মনে হলো – “ওই গাছটির সাথে আমাদের অস্তিত্বের কোনো সম্পর্ক আছে। হতেও পারে, ওই গাছের রহস্য ভেদ করলেই আমরা জানতে পারবো আমরা এই জগতে নিঃসঙ্গ কিনা।”
হায়া হেসে ওঠে – “আমি তো ওটা নিয়ে চিন্তাই করিনা, আদ। নিষেধ ব্যস নিষেধ, আমার এতো খুঁজে দেখার দরকার কি? আরো তো হাজার গাছ আছে, অন্য যেকোনোটাতেই আমরা খেলা করতে পারি, অন্য যেকোনো গাছ থেকেই আমরা ফল পেড়ে খেতে পারি।
হায়া প্রসন্ন মুখে আদের দিকে তাকিয়ে থাকে। চতুর্থ গ্রহের লালচে গোলাপি আলোতে হায়াকে অসম্ভব সুন্দর একটি সৃষ্টি বলে মনে হতে থাকে।
২
“এই জুটিটাকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল” – প্রধান বিজ্ঞানী লিও কৃত্রিম বাগানে বিচরণরত পুরুষ আর নারীর দিকে ইঙ্গিত করলেন – “কিন্তু ওরাও অন্য জুটিগুলোর মতোই আমাদের হতাশ করে চলেছে।”
সহকারী বিজ্ঞানী নিহা আরেকবার হলোগ্রাফিক রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিলো। লিও তার নবাগতা সহকর্মিনীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ফেরো প্রজাতির গড়পড়তা নারীদের তুলনায় নিহাকে দীর্ঘাঙ্গিনীই বলা যায়। হলোগ্রাম দেখার বিশেষ চশমায় তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিলো।
“কেন ওরা নিষিদ্ধ ফলের কাছে যাচ্ছে না, এ বিষয়ে আমার একটা ব্যাখ্যা আছে।” – নিহা বললো। চতুর্থ গ্রহের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান সংস্থায় নিজের অবস্থানকে সুসংহত করতে সে ভালোই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
“আমি পড়েছি আমাদের ডিএনএ মহাবিশ্বের চেনা জানা প্রজাতিগুলোর মধ্যে সবচাইতে স্থিতিশীল। অন্যান্য প্রাণীজাতির মধ্যে বুদ্ধিহীন প্রাণীরা নিয়ম সম্পর্কে অচেতন, আর বুদ্ধিমান প্রাণীরা নিয়ম মানতে অনিচ্ছুক – বিলিওন নক্ষত্রের এই গ্যালাক্সির সমস্ত বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে আমরা ফেরো জাতিই শুধু নিয়ম মেনে চলতে ভালোবাসি, যেটা আমাদের সভ্যতার সুদীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ। আমার বিশ্লেষণ বলছে, যেহেতু ওদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, ফেরো প্রজাতির সদস্য হয়ে ওরা এই নিষেধ অমান্য করতেই পারে না।”
লিও মৃদু হাসলেন। এই তরুণীটি ওদের শিক্ষার্থী দলের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী, সংগৃহিত তথ্যের ওপর ওর দখল নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। কিন্তু পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান নিয়ে তার এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।
“সবকিছুরই ব্যতিক্রম থাকে, নিহা। ডিএনএ-তে ব্যতিক্রম থাকে বলেই বিভিন্ন গ্রহের প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে বিবর্তন ঘটে। আমাদের ফেরো ডিএনএ-তেও ব্যতিক্রম ছিল, মিলিয়ন বছর ধরেই ছিল, আমাদের কাজ ছিল শুধু সেরকম ব্যতিক্রমী ডিএনএ-ধারী ফেরো-দের খুঁজে বের করা। আর তুমি তো জানোই, আমাদের জিন-বিজ্ঞান অত্যাধুনিক, যে কারণে আমরা বিবর্তনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি।”
নিহা এতক্ষন চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসে কথা শুনছিলো, লিও থামতেই সে একটু সামনে ঝুঁকে এলো – “লিও, যে জুটিটা আমরা দেখছি, তাদের দুজনই তাহলে ব্যতিক্রমী ডিএনএ বহন করছে? সেই ডিএনএ, যেটা একজন ফেরো-কে পবিত্র নিয়মগুলো ভাঙতে প্ররোচিত করে?”
“এ পর্যন্ত তেরোটি প্রজন্ম ধরে এধরণের ডিএনএ আমরা সংরক্ষণ করছি, সে দিক থেকে চিন্তা করলে ওদের মধ্যে নিয়ম ভাঙার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা। কিন্তু কেন যে ওরা এই গাছের কাছে যাচ্ছেনা, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।”
“যদি কখনোই ওরা লাল গাছের কাছে না যায়?”
“তাহলে আমরা আবার ক্লোন করবো পরের স্যাম্পল থেকে। আমাদেরকে চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। ওদের দুজনের ওপরই ফেরো প্রজাতির টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করছে।” – হলোগ্রাফিক মনিটর বন্ধ করতে করতে বললেন লিও।
লিও হলঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরও নিহা কিছুক্ষন অন্যমনস্কভাবে বসে রইলো। ও জানে, ফেরো জাতির কাছে নিয়ম-কানুন ধর্মের মতোই পবিত্র, ফলে ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না – কেন দুজন ফেরো দম্পতিকে ল্যাবরেটরির মতো পরিবেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় বানানো হয়েছে, আর কেনই বা প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে তারা নিয়ম-কানুন ভাঙবে আর সেটাই হবে তাদের এক্সপেরিমেন্টের সফলতা।
নিহা কি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো অনৈতিক প্রকল্পে জড়িয়ে গেলো! চিন্তিত মুখে সে আরেকবার প্রকল্পের তথ্যাবলীর দিকে তাকালো, সেখানে অনেককিছুই পরিষ্কার করে বলা নেই।
৩
নারীমূর্তিটি পুরুষটির হাত শক্ত করে ধরে ছিল আর ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো একটি বিশেষ দিকে।
আদ বললো – “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
হায়া বলে – “গেলেই দেখতে পাবে।”
পুরুষ অনুসরণ করলো নারীকে। একসময় ওরা এসে দাঁড়ালো লাল রঙের সেই গাছটির কাছে।
“আমরা এখানে কেন?” – আদ জানতে চাইলো ।
হায়া করুন স্বরে বললো – “তুমি জানো? সেদিনের পর থেকে আমি এই গাছটি ছাড়া আর কোনো কিছুর কথা চিন্তা করতে পারছিনা, কি যেন একটা মোহ আছে এই চিন্তাটাতে, কেন যেন ভীষণ ভালো লাগে এটার কথা চিন্তা করতে।”
আদ হেসে উঠলো – “বলো কি? আমি তো এটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।”
“তুমি রাগ করেছো?” – হায়া জানতে চাইলো সন্দেহ নিয়ে ।
“মোটেই না।” – আদ আশ্বস্ত করে হায়াকে – “আমার তো অনেক দিন থেকেই মনে মনে আগ্রহ, এই গাছটার কাছে আসবো। আশ্চর্য যে এই নিয়ম ভাঙার চিন্তাটার মধ্যে কি যেন একটা দুর্নিবার আকর্ষণ আছে, তাই না?”
“তোমার আর আমার কি অদ্ভুত মিল!” – হায়া প্রেমের চোখে তাকায় আদের দিকে – “যেন আমরা একই দেহে দুটি প্রাণ। শোনো, আমরা কিন্তু শুধু গাছটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকবো তারপরই চলে যাবো। কোনো ঝুঁকি নেয়ার একদম প্রয়োজন নেই, তাই না?” – বলে সে দুর্বলভাবে হাসলো।
পুরুষ নারীমূর্তিটিকে কাছে টেনে নিলো।
৪
কাজপাগল এই ফেরো পুরুষটিকে নিহা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। প্রচন্ড বুদ্ধিমান এই ফেরো-র সম্ভবত একটি খুব সুন্দর হৃদয়ও রয়েছে। শুধু শুধুই তো সে হলুদ নক্ষত্রটির একমাত্র বুদ্ধিমান প্রজাতির অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী হয় নি।
অবশ্য ওর এই প্রকল্পটির ব্যাপারে নিহা এখনো পরিষ্কার ধারণা করতে পারেনি। এর একটাই অর্থ হতে পারে, আর সেটা হলো তাকে সব তথ্য দেয়া হয় নি। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শাসক পক্ষের এ ধরণের গোপনীয়তা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু না।
কিন্তু কাজে সফল হতে হলে ওর তো প্রকল্পের মূল বিষয়টা জানতেই হবে। তাই সকালের সভায় সব আলোচনার শেষে সে লিও-কে সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললো – “মহামান্য লিও, আমাকে কি বলা যাবে, ল্যাবের এই দুজন ফেরো পুরুষ আর নারীর নিয়ম ভাঙতে শেখা এত জরুরি কেন?”
নিহা হয়তো ভেবেছিলো লিও প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন।
“কারণ নিয়ম ভাঙতে পারা সৃষ্টিশীলতার লক্ষণ। সৃষ্টিশীলতা না থাকলে, সমস্যাকে নিজে থেকে সমাধান করতে না জানলে এদের পক্ষে অন্য গ্রহে গিয়ে টেকা সম্ভব হবে না।”
সহকর্মিনীকে নিশ্চুপ দেখে প্রধান বিজ্ঞানী যোগ করলেন – “হ্যা, আমরা ওদের দুজনকে নতুন কোনো গ্রহে কলোনী বানিয়ে থাকার জন্য পাঠানোর পরিকল্পনাই করছি। তুমি তো জানো আমাদের এই গ্রহটি একেবারেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে। অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচার জন্য আজ ফেরো জাতিকে মাটির নিচের সুড়ঙ্গগুলোতে বিশেষ ধরণের স্থাপনা বানিয়ে বাস করতে হয়। বাইরে তাকিয়ে দেখো, শুষ্ক এই লাল বালু রাশি ছাড়া এ গ্রহপৃষ্ঠে আর কিছু নেই। কে বলবে মাত্র চার মিলিয়ন বছর আগেও এখানে সবুজ রঙের পানি ছিল, আকাশে গ্যাস ছিল, এমনকি উর্ধ্বাকাশে মেঘও দেখা যেত মাঝে মধ্যে!”
লিও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন – “ভূতত্ব বিভাগের পূর্বাভাস পরিষ্কারভাবে বলেছে, মিলিয়ন বছরের পুরোনো ফেরো সভ্যতা আর বেশি হলে দেড় হাজার বছর এই গ্রহে টিকে থাকতে পারবে। নিহা, এরা দুজনই ফেরো প্রজাতির শেষ আশা। এই এক্সপেরিমেন্ট বিফল হলে আমাদের চলবে না।”
নিহা লিওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো, সে দৃষ্টিতে বিস্ময় নাকি বিষন্নতা সেটা অবশ্য বোঝা গেলো না।
৫
লাল গাছটির মধ্যবর্তী একটি ডালে উঠে আসার পর নারী ও পুরুষ দুজনই স্বস্তির হাসি হাসলো, কারণ এখানে আসার ফলে কোনো সমস্যাই তৈরি হয়নি, ভেঙে পড়েনি গোলাপি ওই আকাশ ওদের মাথার ওপর।
হায়া একটি সুন্দর লালচে ফলের ওপর হাত রেখে বললো – “এটা খাওয়া নিষেধ, কিন্তু ধরতে তো নিষেধ নেই।”
আদ এবার বললো – “এটা গাছ থেকে খুলে ফেলতেও তো নিষেধ নেই, তাই না?”
হায়া রহস্য করে হাসলো, আদের বিস্মিত চোখের সামনে ছিড়ে ফেললো ফলটা গাছ থেকে, তারপর ওটা এগিয়ে দিয়ে বললো – “ঘ্রাণ নেয়াও কিন্তু নিষেধ নয়!”
আদকে একটু দ্বিধান্বিত দেখে হায়া নিজেই ফল মুখের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিতে চেষ্টা করলো – আশ্চর্য যে এর ঘ্রাণ অন্য ফলগুলোর মতোই তবুও কেন যেন ওর হৃদস্পন্দন অসম্ভব দ্রুত হয়ে গেছে ! কি আছে এই ফলের ভেতর? কেন সাধারণ একটা ফলের এতো আকর্ষণ? শুধু নিষিদ্ধ জিনিস বলেই কি দুর্বার এই কৌতূহল?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে হায়া ফলের কিছু অংশ মুখে দিয়ে ফেলেছে তা নিজেও বলতে পারবেনা । ওর বোধশক্তি ফিরে এলো তখনি, যখন শুনলো একটা অজানা শব্দ শুরু হয়েছে চারদিকে, যেন খুব খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
আদ আর হায়া দুজনেরই মুখ ভার হয়ে গেলো অজানা আশংকায়। আদ এবার ফলটি হাতে নিয়ে নিজেও মুখে দিলো, এরপর দৃঢ়স্বরে বললো – “তোমার যা হবে আমারও তাই হবে, এ অভিযান আমিই তো শুরু করেছিলাম।”
ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অজানা প্রতিফলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
৬
বিজ্ঞান কাউন্সিল এ হুলুস্থুল পরে গেছে, শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা সফল হয়েছে।
নিহার সাথে দেখা হতেই লিওর মুখ আরেকবার আনন্দে ঝলমল করে উঠলো – “তোমাকে অভিনন্দন নিহা, তুমি আমাদের প্রকল্পে সৌভাগ্য নিয়ে এসেছো।”
নিহাও স্মিতহাস্যে অভিবাদনের উত্তর দিলো। সংবাদ সম্মেলনের সময় হয়ে এসেছিল, সেজন্য দুজন প্রস্তুত হয়ে পাশের সম্মেলন কক্ষের দিকে হাটতে শুরু করল।
“এখন এই দম্পতিকে আমরা তৃতীয় গ্রহে অভিবাসী করবো। আমাদের মানদণ্ড অনুযায়ী ওরা নতুন গ্রহের বৈরী পরিবেশে জীবন শুরু করার জন্য প্রস্তুত। বিজ্ঞান কাউন্সিলের বিশ্বাস ওরা ওখানে খুব ভালোভাবেই টিকে যাবে, নতুন একটি বুদ্ধিমান ও সংবেদনশীল প্রজাতি শুরু করবে ওরা। জিনগত ভারসাম্য ওদেরকে করবে কাদামাটির মতোই নমনীয়, ফলে ওরা যেকোন পরিবেশেই সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।”
বিবর্তন ওর পড়াশুনার মূল বিষয় ছিল বলেই হয় তো নিহার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সে একটু ইতস্তত করে একসময় বলেই ফেললো – “মহামান্য লিও, একটি সমস্যা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় গ্রহের জীবজগতে তো অন্য এক ধরণের বিবর্তন হচ্ছে, এর মধ্যে এরা কিভাবে নিজেদের মেলাবে? ওদের বিবর্তন তো স্বাভাবিক দেখাবে না।”
লিও হাসলেন, অনেকটা যেন বিজয়ীর হাসি – “আমরা তৃতীয় গ্রহের বিবর্তনে আগেই হস্তক্ষেপ করেছি। সৌভাগ্যবশত ওদের প্রাণীজগৎ বিবর্তনের এমন একটি ধাপে আছে যে ওদের প্রায় বুদ্ধিমান একটি প্রজাতি দু পায়ে হাটতে শিখে গেছে। এই মুহূর্তে যদি এই দম্পতিকে নামিয়ে দিয়ে আশা যায়, তাহলে আমাদের দুজন মোটামুটি ওদের সবার সাথে মিশে যাবে।”
বিজ্ঞান কাউন্সিলের সাংবাদিক সম্মেলন খুব সাধারণ ঘটনা নয়, এক যুগে হয়তো একবার হয়। তাই সবাই এটাকে গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে দেখা গেলো। নিহা আর লিওকে সম্মেলন কক্ষে ঢুকতে দেখে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। নির্বাচিত তিনজন সাংবাদিক সংকলিত তিনটি প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। নিয়ম মেনে প্রথম সারির ডানদিক থেকে প্রথম সাংবাদিক তার প্রশ্নটি করলেন।
“আমরা শুনেছি, আপনাদের গবেষণাগারে এমন এক দম্পতির উৎপত্তি হয়েছে যারা নিয়ম ভাঙতে আগ্রহী। এটির সত্যতা নিয়ে সবিনয়ে জানতে চাইছি।”
“এটা সত্য।” – বিজ্ঞান কাউন্সিল এর মুখপাত্র হিসেবে বললেন লিও।
“আমাদের মিলিয়ন বছরের সভ্যতার ইতিহাসে নিয়ম ভঙ্গকারী এই প্রথম। অনেকেরই বিশ্বাস যে আমরা এদের রেখে আমাদের সংস্কৃতি কে কলুষিত করতে পারিনা, কারণ নিয়মের প্রতি অশ্রদ্ধা একটি প্রথম শ্রেণীর অপরাধ। এদের ব্যাপারে এখন করণীয় কি সে ব্যাপারে বিজ্ঞান কাউন্সিলের কোনো বক্তব্য আছে কি?”
“বিজ্ঞান কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এদের কে তৃতীয় গ্রহে নির্বাসন দেয়া হবে।”
এবার দ্বিতীয় সাংবাদিক উঠে দাঁড়ালেন – “এটা যেহেতু গবেষণার কারণে ঘটেছে, বিজ্ঞান কাউন্সিল এই অপরাধী তৈরির দায় নিতে আগ্রহী হবে, এটা কি জনগণ ধরে নিতে পারে?”
“এই প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী হিসেবে আমি এর দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করছি।” – হাসিমুখ লিও-কে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছিলো না যে এজন্য তার কোনো অনুতাপ আছে।
নিহা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো লিও-র দিকে। এই ফেরো ব্যক্তিটিকে ঘিরে তার বিস্ময় যেন কাটছেই না।
ডান দিক থেকে তৃতীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন – “আমরা ফেরো প্রজাতি একটি চমৎকার নিয়মানুবর্তী প্রজাতি, আমরা আমাদের নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে গর্বিত, ফলে আমরা কিছুতেই বুঝতে পারছিনা কি এমন প্রয়োজন হলো যে বিজ্ঞান কাউন্সিল একটি প্রজাতি তৈরির চেষ্টা করবে যেটা নিয়ম ভাঙার মতো বিধ্বংসী আচরণে আগ্রহী হবে?”
লিও মৃদু হেসে দৃঢ় কিন্তু শান্তস্বরে বললেন – “আমরা যা জানি, আপনারা তা জানেন না।”
সম্মেলন কক্ষে নেমে এলো নীরবতা। লিও সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি টানলেন।
সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর সম্মেলন কক্ষ থেকে বের হতে হতে লিও ফিশ ফিশ করে বললেন নিহার কানে – “ইচ্ছার স্বাধীনতা যে কত বড়ো অর্জন, সেটা যদি এই সাংবাদিকের দল জানতো!”
নিহা নিজের অজান্তেই কখন যেন লিওর হাত স্পর্শ করেছে – “লিও, আমি যদি আজ আপনার সাথে একান্তে বসে কথা বলতে চাই, আপনি কি রাজি হবেন?”
লিও হেসে ফেললেন – “অবশ্যই, আমি এখন আর কোনো প্রটোকলে বাধা নই। কিন্তু যেহেতু তুমি নিমন্ত্রণ করেছো, নিয়ম অনুযায়ী তুমিই প্রথমে আমাকে কোমল পানীয় খাওয়াবে আশা করি?”
নিহা হেসে সম্মতি জানালো। এই গ্রহে হয়তো আর বেশিদিন ফেরো জাতি টিকে থাকবে না, কিন্তু দীর্ঘ সভ্যতার পরম্পরায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর নান্দনিক প্রেমের যে সুন্দর দিকগুলো ওরা গড়ে তুলেছে, অস্তিত্বের শেষ দিনটি পর্যন্ত সেগুলোর চর্চা করার মধ্যে ক্ষতি তো কিছু নেই।
৭
নভোযান থেকে তৃতীয় গ্রহের ভারী বায়ুমণ্ডল ঘেরা ভেজা মাটিতে অবতরণ করতে করতে আদ নভোচারীটির দিকে তাকালো। হায়া ছাড়া আর কোনো প্রাণীকে এই প্রথম জেনেছে সে।
“আমরা কি অপরাধী? এটা কি আমাদের শাস্তি?” – হায়া হঠাৎ প্রশ্ন করলো নভোচারীকে।
নভোচারী হাসলো – “আমি একজন ‘পরিবহনকারী’ মাত্র, আমার কাছে এমন কোনো তথ্য নেই যাতে মনে হতে পারে আপনাদের কেউ ‘অপরাধী’, আমাকে শুধু বলা হয়েছে আপনারা এই গ্রহটিতে ফেরো জাতির ‘প্রতিনিধি’।”
ওদের দুজনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা গুলো জানিয়ে দিয়ে নভোচারী বিদায় সম্ভাষণ জানালো – “সুস্বাগতম নতুন বিশ্বে যেখানে আপনারা দুজন যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার জন্য স্বাধীন।”
হায়া ও আদ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলো নভোযানটির চলে যাওয়া, তারপর তাকালো দিগন্তের দিক। এটিও একটি বাগান, হয়তো আগের বাগানটির মতো সুসজ্জিত নয়, কিন্তু এই বাগানটি ওদের নিজস্ব সম্পদ আজ থেকে।

Nice
LikeLike