লেখক

ফেরেশতা আর শয়তান যে শুধু আধ্যাত্মিক জগতের দুই বাসিন্দা না – বরং দোকানের অন্ধকার কিংবা স্ট্রিটলাইটের নিচেও যে এদের অবাধ বিচরণ থাকতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্যের মত গুরুতর বিষয়েও যে এরা প্রায়ই প্রভাব বিস্তার করে – সে সম্পর্কে প্রথম ধারণাটা আমি পেয়েছিলাম এক রহস্য গল্পের লেখকের কাছ থেকে।

লোকটার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল গ্রীষ্মের উষ্ম এক দুপুরে। আমরা বসে ছিলাম আমার বইয়ের দোকানের পেছনের দিকের অন্ধকার কোনাটায়, যেখানে ছোট কাঠের টেবিলটাতে বসে আমি টাকা-পয়সার হিসাব করতাম আর সামান্য কয়টা টাকা ড্রয়ারে তালা দিয়ে রেখে কল্পনা করার চেষ্টা করতাম – আমার এতো টাকা যে সেগুলো তালা দিয়ে রাখতে হয়।

লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবেনা, কিন্তু মাথায় টাক পড়ে গেছে। মুখভর্তি দাড়িতে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।

‘আমি যা জানি সেটা আমাকে এক্সপ্রেস করতেই হবে।’ – কথোপকথনের একপর্যায়ে বলল লোকটা – ‘আমি ঐ ইতিহাসবিদের মত হতে চাইনা, যে পাঁচ বছর ধরে গবেষণা করে নতুন কিছু বের করার পরদিনই মারা গেল – কাউকে কিছু জানিয়ে যেতে পারলনা।’

আমি হাতের পান্ডুলিপিটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। মনে হল, কিছু ছোটগল্প আছে এতে – মাঝে মাঝে শিরোনামের মত দেখা যাচ্ছে।

‘জানেন, আমার মাথার ভেতর হাজার হাজার লোক কথা বলে। এদের কথা লিখে না ফেলা পর্যন্ত আমার কোন শান্তি নেই।’ – সে বলে চলল।

‘এরা কারা?’

‘আমার চারপাশের লোকজন। যাদের সাথে নিয়মিত দেখা হয়, কথা হয়। তারপর লেখকরা যাদের বই পড়ি। তারপর মনে করেন গায়ক, যাদের গান শুনি। শুধু গান না, চীৎকার, আর্তনাদ, হাসি – সব আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি।’

এই লোকটার কথা আগেও শুনেছি আমি, এদিকে তার বেশ ঘোরাঘুরিও আছে। তবে কেউ তাকে পাত্তা দিতনা – অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। একটু মনে হল গাঁজার গন্ধও পেলাম গা থেকে।

‘ঠিক আছে, আমি আপনার পান্ডুলিপিটা রাখলাম। অবসর পেলে পড়ে দেখব। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি বেটার কোন পত্র-পত্রিকায় ট্রাই করে দেখেন।’

‘একবার বলেছি না ভাই, পত্রিকাওলাদের পেছনে ঘুরে বেড়াবার সময় আমার নাই। ঐসব তাবেদারী আমার দ্বারা হবেনা।’

‘আচ্ছা, আমি এটা রাখছি। অনেক ধন্যবাদ।’

‘আপনাকেও।’

লোকটা উঠে চলে গেল। আমি প্যাকেটটা নিচের ড্রয়ারে রেখে দিলাম। তারপর একদম ভুলে গেলাম ওটার কথা।

প্রায় মাস দুয়েক পরের কথা। সেদিন কারেন্ট ছিলনা আমাদের বইপাড়ায়। গরমে ঘামতে ঘামতে ভাবলাম, টেবিলটা গুছাই। নিচের ড্রয়ারে হাত দিতেই আজে-বাজে কতগুলি কাগজ বেরিয়ে এল। ওগুলো সাফ করতে গিয়েই খামটা হাতে পড়ল। সেটা ছিল গ্রীষ্মের অলস একটা দুপুর, দোকানে কোন কাস্টোমারের টিকিটি নেই। কিন্তু সেই জন্য না, আমি পান্ডুলিপিটা পড়তে শুরু করলাম লেখকের চমৎকার হাতের লেখার জন্য।

গল্পগুলো একটু অন্যরকম। গতানুগতিকতার বাইরে – ফিকশন ধরণের, অথবা ফ্যান্টাসিও বলা যায়। গল্পগুলোতে বারবার আধ্যাত্মিক জগতের কথা আর ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপার ঘুরে-ফিরে এসেছে। আমি ওটা ভালো একটা জায়গায় তুলে রেখে দিলাম।

লোকটা আমার কাছে আবার এলো এরও প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পরে। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, আমার নিজের ব্যবসার অবস্থাই ভালো না, এমন পরিস্থিতিতে আমি তার বই প্রকাশের ঝুঁকি নিতে পারিনা, যদি না সে নিজে এর পুরো খরচটা বহন করে।

‘একটা পয়সাও এই মুহূর্তে দেয়া সম্ভব না আমার পক্ষে, তাই রয়্যালটির দাবীও করবনা আমি। তবে আপনার ব্যবসা এ বইয়ে ভালোই হবে – এটুক নিশ্চয়তা দিতে পারি’ – সে বলল।

আমি তাকে আমার অপারগতার কথা জানিয়ে দিলাম। সত্যি বলতে কি, ঐ সময়টা আমি ব্যবসাটা ছেড়ে দেবার কথাও ভাবছিলাম। আমি তাকে বললাম, যে দেশে বৃহত্তর অংশ নিরক্ষর, সেদেশে বইয়ের চেয়ে জুতার ব্যবসায় লাভ বেশী। তাছাড়া এধরণের কাহিনী বাজার খাবে কিনা তাও দেখতে হবে।

‘আপনার কি মনে হয়?’ – লোকটা আমাকে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘প্রতিষ্ঠিত লেখক ছাড়া বাজারে রহস্যগল্প চালানো কঠিন।’

‘দেখেন, আপনার না পোষালে আমার বাধ্য হয়েই অন্য কোথাও যেতে হবে, কিন্তু আমি সেটা চাচ্ছিনা। কারণ, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে, আপনার মধ্যে একটা রেয়ার ধরণের ওপেননেস আছে। আপনার সাথে কাজ করা আমার জন্য সহজ হতো। যাক, সবই ভাগ্যের ব্যাপার। দেখা যাক, কি হয়।’

সে সেদিন চলে গেল। আমাকে আরো দু’সপ্তাহের সময় দিয়ে গেল। আমি অবশ্য একটু দ্বন্দ্বে পড়েছিলাম – কোনভাবে যদি এটাকে মার্কেট করা যায়, যেহেতু জিনিসটা সম্ভবত: ভালো, তাহলে আবার আমার ভাগ্য খুলে যাবে। অবশ্য ভাগ্য নিয়ে জুয়া খেলা হয়ে যায় এটাতে। সবশেষে আমার মনে হল আরেকবার হলেও আমার তার লেখাগুলো যাচাই করা উচিত। সেরাতে গল্পগুলো নিয়ে আবার বসলাম। এবার ওগুলোকে আরেকটু অর্থবহ মনে হল – যেন খোলস ছেড়ে বের হয়ে এল এক অর্থ থেকে আরেক অর্থ। মনে হল মৌলিকত্ব আছে লেখায়। আমার দ্বন্দ্ব আরো বেড়ে গেল।

পরের সপ্তাহেই লেখক ভদ্রলোক আরো এক বান্ডিল কাগজ নিয়ে হাজির। এটা নাকি তার দ্বিতীয় সেট গল্প। আমি যথারীতি আমার ব্যবসার দৈন্যদশার কথা বললাম।

‘আমার এগুলো প্রকাশ করা খুবই প্রয়োজন। আমি যা জেনেছি তা সবাইকে জানিয়ে যেতে চাই। দরকার হলে এগুলো এখন আপনার জিম্মায় থাকবে, আমার মারা যাবার পর আমার সহায়-সম্পত্তি থেকে ওটা প্রকাশের ব্যবস্থা করে যাব।’

‘আপনি অন্যদের কাছে যাচ্ছেন না কেন?’ – আমি জানতে চাইলাম।

‘আপনার কাছে যখন চলেই এসেছি, তখন যা হবার আপনার মাধ্যমেই হবে। এটাই আমার কাজের তরিকা।’

আমি ভদ্রলোককে বসতে বলে চা আনতে পাঠালাম। তারপর বললাম – ‘দেখেন, সত্যি কথা বলতে কি – ব্যবসাটা নিয়ে খুবই ফ্রাস্ট্রেশনে আছি। আমার আর্থিক অবস্থাও খুবই খারাপ। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। সারাজীবনে এমন বিপদে পড়িনি কখনো। এদিকে বাজারে ধারের পরিমাণও দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।’

‘আপনি চিন্তা করবেন না, বিপদাপদ আসেই আবার কেটেও যায়’ – লোকটা বলল।

‘আপনি ভবিষ্যৎ জানেন নাকি?’ – আমি ঠাট্টা করে বললাম।

‘না, তবে এ ধরণের ব্যাপারে জানা আছে’ – লোকটা স্বাভাবিকভাবেই বললো।

তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলল – ‘আমার বইটা বের করেন। বলছি, আপনার অবস্থা ফিরে যাবে – কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না।’

ওর কথাটা কেমন যেন শোনালো।

আমার ব্যবসার অবস্থা কয়েকদিনে আরো খারাপ হল। দোকানভাড়া যখন তিন মাসের মত বাকী পড়ল, তখন আমার মাথায় আকাশ ভেংগে পড়ল। কোনদিক থেকেই সুবিধা করতে পারছিনা। পাওনাদাররা ঘোরাফেরা করছে। আমি পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোকানের বাইরে বাইরে সময় কাটাতে লাগলাম। অসময়ে আসি, তারপর আবার পলাতক।

এভাবে দিন চলছিল। এরমধ্যে একদিন ঐ লেখক ভদ্রলোক আবার এলো আমার দোকানে। কিছু বই খুঁজছিল সে, কোনদিন নামও শুনিনি। সে বলল, এগুলো অদৃশ্যের জ্ঞানসংক্রান্ত বই। সে আরো বলল, তার কাছে নাকি কিছু মারেফাতী বই আছে – ওগুলোর সর্বোচ্চ স্তর অদৃশ্যের জ্ঞান, আর সর্বনিম্ন স্তর যাদুবিদ্যা ও ইন্দ্রজাল।

‘আলো আর অন্ধকার থাকে পাশাপাশি – ভাই বোনের মত। এ বইগুলো অদৃশ্যের জ্ঞানের বই, কিন্তু এগুলো থেকে ইচ্ছে করলেই বের করে নেয়া যায় অন্ধকার জগতের বিদ্যা। সত্যিকার সাধকরা মারেফাত শিখে নেয়, আর যাদুবিদ্যা অবহেলায় ছুড়ে ফেলে দেয়।’ – সে গম্ভীর মুখে বলল।

‘আপনি কি করেন?’

‘আমি তো শুধু নিষিদ্ধ বিদ্যাকে শিল্পের কাজে ব্যবহার করছি, নিজেকে এক্সপ্রেস করতে ব্যবহার করছি। শয়তান আমাকে পৃথিবীর দিকে টানে, ফেরেশতারা টানে খোদার দিকে। নিজের ভেতর এই টানাটানিটা উন্মুক্ত করে দিয়েছি আমি, কেননা ওটা থেকে বেরিয়ে আসে শিল্প। শিল্প তো হলো বেহেশতের উচ্ছিষ্ট।’

‘আপনি যাদুবিদ্যা জানেন নাকি?’ – দুষ্টুমি করে বললাম।

‘কিন্তু তাকে মোটেই হালকাভাবে নিতে দেখলাম না ব্যাপারটা – আমি যখন লিখতে বসি, বইগুলোর যেকোন একটা পছন্দমত নিয়ে বসি। তারপর পড়তে শুরু করি, পড়তে পড়তে একসময় হঠাৎ বইয়ের অক্ষরগুলি উধাও হয়ে যায় – বিভিন্ন দৃশ্য আসতে থাকে চোখের সামনে। বিভিন্ন ঘটনা, অদ্ভুত সব ঘটনা, যা আমি নিজে কখনো দেখিনি। এমন সব জায়গা, যেখানে আমি কখনো যাইনি। আমার মাথায় তখন প্রচন্ড চাপ পড়ে। তখন আমি লিখে ফেলি ওসব। সকালে এলোমেলো ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করি, আর দৃশ্যগুলো সাজাই।’

একটু থামল সে।

‘এগুলো কেন হয়, জানেন? কারণ, শয়তান যখন দেখে – আমি অদৃশ্যের জ্ঞান অর্জন করে ফেলছি, সে তখন চেষ্টা করে – যেন আমাকে ঐ কাজ থেকে বিরত রাখা যায়। বিরত রাখার জন্য সে আমাকে গল্পের প্লট দেয় – কারণ সে জানে আমি গল্প লিখতে ভালোবাসি। আমার বেশির ভাগ গল্পের প্লট এভাবেই পাওয়া।’

তাকে আমার কাছে মাদকাসক্ত বলে মনে হচ্ছিল।

‘আমিও, যখনই প্লটের দরকার হয়, ঐ বইগুলো নিয়ে বসে যাই – শয়তানের সাথে খেলতে শুরু করি। আপনিও এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন আপনার ব্যবসায়, উপকার পাবেন।’

আমি তার কথা কিছুই বুঝতে পারলামনা।

সে গলার স্বর নিচু করে প্রায় ফিস ফিস করে বললো – ‘আপনি আমার মতোই করবেন, মানে ধর্ম কর্ম বাড়িয়ে দেবেন, দেখবেন আপনার ব্যবসা ফিরে যাবে। ধর্ম থেকে আপনাকে ফেরানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে শয়তান, ফলে আপনার কোম্পানি থেকে ছাপা বই বিক্রি হতেই থাকবে। আর সে বইটা যদি আমারটা হয় তাহলে আমিও মাঝখান থেকে লাভবান হব, আর আপনি তো লাভবান হচ্ছেনই – উইন-উইন সিচুয়েশন। কি বলেন আপনি?’

আমি তার দিকে দ্বিধান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলাম।

ঐদিনের পর আমি মসজিদে যাতায়াত শুরু করেছিলাম, তবে সেটা ওই লোকের পরামর্শের কারণে যতটা না, তার চেয়ে বেশি এজন্য যে পাওনাদার থেকে পালানোর জন্য মসজিদের চেয়ে ভালো জায়গা আর হয়না। আর সময়টা যখন খারাপই যাচ্ছে, সেটাকে আখিরাতের কাজে লাগালে ক্ষতি কি!

এদিকে আমার এক বন্ধু ছিল তাবলীগ জামাত করতো, তার খুব চেষ্টা ছিল কিভাবে আমাকে তাদের চিল্লায় নেয়া যায়। সে আশা করছিল, আমাকে চিল্লায় নিলে তার যে সোয়াব হবে তা তার সমস্ত গুনাহের ঘাটতি মেটানোর জন্য যথেষ্ট হতে পারে, কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আমি বেশ বড়ো রকমের পাপী। আমি তাকে বলতাম – সবাই যদি চিল্লায় যায় তাহলে দোকান দেখবে কে, উৎপাদনের কি হবে, এসব। তো মসজিদে যাবার ফলে সে আমাকে আরো ভালোভাবে পেয়ে বসল, আমার তখন ফুটন্ত উনুন থেকে জ্বলন্ত কয়লাতে গিয়ে পড়ার অবস্থা।

সে কিন্তু এমনিতে ছেলে ভালোই ছিল – আমাকে ভালো ভালো কথা বলত, স্বান্তনা দেয়ার পুরো চেষ্টা চালাত। ব্যবসার দুরবস্থার কারণে আমারও তখন মন নরম, ফলে আমিও তার কথা শুনতে শুরু করলাম। সে একদিন এক হুজুরের কাছে আমাকে নিয়ে গেলো, হুজুরের দোয়াতে যদি ব্যবসার কিছু গতি হয়। হুজুর দোআ করলেন ঠিকই, কিন্তু উপদেশ চাওয়াতে যা বললেন, তাতে একটু হতাশই হলাম। তিনি বললেন – ‘ভাই, আপনে তখনই এসব পাবেন যখন এসব না চাইতে জানবেন।’ তিনি আমাকে শেখালেন – যেহেতু রিজিকের মালিক খোদা, তাকে খুশী করতে পারলেই রিজিক নিশ্চিত হবে।

‘আর এজন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে বোধ হয়?’ – আমি বললাম।

তিনি হাসলেন – ‘চেষ্টা করাটা তাঁকে খুশী করার সবচেয়ে ভালো উপায়, কারণ তিনিই সেই খোদা যিনি চেষ্টা করতে বলেছেন, আর তিনিই নবীকে রিজিক দিয়েছেন পরিশ্রমের বদলে।’

ভদ্রলোক শেষে বললেন যে পরিশ্রম হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো ও কার্যকর দোআ। কিন্তু কেন যেন উত্তরটা আমার মনে ধরলনা। যাহোক, আমি এরপর থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়া শুরু করলাম – এই ভেবে যে, এটাও তো একধরণের পরিশ্রমই।

সেই দিনগুলো আমার জন্য ছিল আসলেও খুব কঠিন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। আর যাদের হাতে টাকা চলে গেছে তারা বই পড়ে না। ফলে বইয়ের ব্যবসা মানেই লোকসান। কিন্তু বাপ-দাদার ব্যবসা বলে ছাড়তেও পারছিনা, আর অন্য ব্যবসারও লাইনঘাট জানা নেই। আমি সমানে খোদাকে ডাকতে লাগলাম, কিন্তু কোন বড়ো ধরণের সাড়া তখন পাচ্ছিলামনা।

সেই লেখক ভদ্রলোক আবারো এলো আমার ব্যবসার খবর নিতে – দু’দিন যেতে না যেতেই। আমি বললাম, গতকাল কয়েকটা অর্ডার পেয়েছি কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য।

আমার ধারণাও বললাম ওকে – হয়তো ফেরেশতারা অদৃশ্য থেকে আমার কাজে সাহায্য করছে, যেহেতু আজকাল আমি ধর্ম-কর্মে বেশি করে সময় দিচ্ছি। কিন্তু তাকে আমার ব্যাখ্যা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখলাম।

‘কিন্তু আমার কাছে এর চেয়েও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে’ – সে বলল – ‘আমি বরং মনে করি, শয়তানই আপনাকে সাহায্য করছে।

আপনাকে আগেও বলেছি, আপনি সম্ভবত আমার কথা পাত্তা দেননি – শয়তান জীন এসব ব্যবসাতে সাহায্য করে, যেন মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকে আর খোদাকে ভুলে যায়। আরে, দুনিয়া জুড়ে তো চলছে এই খেলাই। কেউ খোদার পথে এগুলে শয়তান তাকে দুনিয়াবী কাজে যেচে সাহায্য করতে থাকে, ব্যবসার উন্নতি হয়, চাকরীতে প্রমোশন হয়। তখন আবার মানুষ ফিরে আসে দুনিয়াবি কাজে, শয়তানের উদ্দেশ্য সফল হয়। আপনি কি খেয়াল করেছেন, তাসের নতুন খেলোয়াড় কার্ড ভালো পায়! এসব তো সেই পুরাতন পদ্ধতি।’

আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বুঝতে চেষ্টা করলাম, কে আসলে খেলছে আমার সাথে – শয়তান, নাকি এই লেখক নিজে।

সেই রাত্রে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, ঐ দাড়িওয়ালা টাকমাথা লেখক আপাদমস্তক কালো পোশাক পরে তার বই বিক্রী করছে একটা মেলার ভেতর। এরকম স্বপ্ন যে কেউই যে কাউকে নিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু আমি ভয় পেলাম যখন পর পর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখলাম।

লোকটা ঐসময় আরো নিয়মিত আসতে শুরু করলো আমার দোকানে। একদিন বললামও স্বপ্নটার কথা তাকে, কিন্তু অবাক হলাম তার প্রতিক্রিয়ায়।

‘আমি বলেছিলাম না’ – সে বলল – ‘আপনার আর আমার মধ্যে কোথাও একটা কানেকশন তৈরী হয়ে গেছে। এখন আমাদের একজনের ভাগ্য অন্যজনের সাথে জড়িয়ে গেছে।’

আমি চুপ করে রইলাম।

‘আপনি আমার বইয়ের কাজে হাত দিন, সব সমস্যা কেটে যাবে। আপনি লাভবান হবেন।’

আমি নিশ্চিত হলাম, সে আমাকে কোন যাদু বা তাবিজ করেছে। আমার ব্যবসার মন্দার কারণও হয়তো যাদু টোনা। ও আমাকে ওর গুপ্তবিদ্যা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে। আমার দুশ্চিন্তা শতগুণে বেড়ে গেল।

এদিকে আমার দোকানে তার আনাগোনা আরো বেড়ে গেল, আমি আতংকিত হয়ে থাকি সবসময়। এর সাথে যোগ হল দু:স্বপ্ন। বিচিত্র সব দু:স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম আমি। ডাক্তার দেখালাম, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও গেলাম। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ কিছু ওষুধ দিলেন আমাকে – ওষুধে ঘুম বেড়ে গেল অসম্ভব, আর ঘুমের সাথে বাড়ল দু:স্বপ্নও।

সেই হুজুরের কাছে গেলাম আবার, যার কাছে তাবলীগি বন্ধু নিয়ে গিয়েছিলো আগেরবার। উনাকে যখন বললাম যে শয়তান আমার পেছনে লেগেছে, উনি বললেন – শয়তানের কোনো ক্ষমতা নেই, আমরাই শয়তানকে মনের ভেতর জায়গা দিয়ে শক্তিশালী করে তুলি। উনি আরো বললেন যে মানুষের ভেতরও শয়তান আছে, আমার উচিত বরং তাদের থেকে সাবধান হওয়া। এবারো তার কথা-বার্তা আমার মন মতো হল না বলে কথা না বাড়িয়ে ফিরে চলে এলাম।

এভাবে চলতে চলতে একসময় আমি হার স্বীকার করলাম, অধৈর্য হয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে তার বই প্রকাশ করব – সীমিত সংখ্যক কপি হলেও।

সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথে দু:স্বপ্নের আনাগোনা কমে গেল। আমি নিশ্চিত হলাম, আমি এই যাদুবিদ্যা জানা লেখকটি দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছি – যদিও আমার কিছুই করার ছিলনা এখানে।

কিন্তু তারপরই আমার অবস্থার পরিবর্তন হল – হঠাৎ করেই, আশ্চর্যজনকভাবে।

বইটা প্রকাশের পর প্রচারের সামান্যই আয়োজন করলাম, কিন্তু মোটামুটি ব্যবসা করল প্রথম সংস্করণটা। প্রথম সংস্করণের টাকাটা যখন উঠে এলো, দ্বিতীয় সংস্করণের বেলায় একটু প্রচার চালালাম – হু হু করে বিক্রী হয়ে গেল সবগুলো কপি।

পরে অবশ্য লেখক একসময় আমার কাছে স্বীকার করেছিল, প্রথম প্রকাশের পর সে নিজ উদ্যোগে কিছু ভাড়াটে লোককে দিয়ে বইটির নামে বেশ অপপ্রচার চালিয়েছিল যে বইটি নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে ‘গভীর আঘাত’ হেনেছে। এমনকি সে নগরীর একটা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মার্কেটের সামনে নিজের বইয়ের প্রচ্ছদও পোড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল। এরকম একটা বিতর্ক সৃষ্টির পর বইয়ের বিক্রী ঠেকায় কে! আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হল যে, এই লেখক ভদ্রলোকটি শয়তানের সাথে বেশ শক্ত গাঁটছড়াই বেঁধেছে।

যা হোক, আমার তখন চিন্তা করার সময় নেই, বই বের করছি আর বিক্রী হচ্ছে। এক মংগলবার ছয়মাসের দোকান ভাড়া বাকী মিটিয়ে এলাম। তারপর তার অন্য বইটা বের করার কাজে হাত দিলাম।

পত্র-পত্রিকায় তখন ভদ্রলোকের নাম আর প্রশংসা শুধু। নিজের দুষ্টবুদ্ধি ব্যবহার করে সে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠাই পেয়ে গেল। কিন্তু লোকটা একদিকে ভালো, অনেক ভালো ভালো প্রকাশণী তাকে ডাকলেও সে আমাকে ছেড়ে যায়নি। বরং কথা দিয়েছে, তার সব বইই সে আমার প্রকাশনী থেকে বের করবে। লোকটা সত্যিই দুর্বোধ্য।

এদিকে সে যাত্রা আমার ব্যবসাটাও বেঁচে গেল। অবশ্য আমার তাবলীগি সেই বন্ধু এসে আমাকে অভিযোগ করত, আমি নাকি দুনিয়া নিয়ে আবার মেতে উঠেছি। ঐ ভদ্রলোককে ও বলত শয়তানের এজেন্ট, আর তার লেখাও সে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেছিল।

স্বীকার করি, এই বইটার ব্যবসা ভালো হওয়ায় লেখক ভদ্রলোক যেমন অদৃশ্যের জ্ঞানচর্চা থেকে সরে এসেছে, সেরকম আমিও সরে এসেছি ধর্ম-কর্ম থেকে। শয়তান আমাদের দু’জনকেই দু’টা ভালো কাজ থেকে বিরত রাখতে পেরেছে – অন্তত: সামনের কয়টা দিনের জন্য। কিন্তু আমার এসবে কিছুই যায় আসেনা। শয়তান আর ফেরেশতার দ্বন্দ্বে যদি আমার ব্যবসার লাভ হয়, তাহলে আমার আর অসুবিধা কি! শত হলেও মানুষ সৃষ্টির সেরা – সে শয়তান এবং ফেরেশতা উভয়কেই ব্যবহার করবে তার ব্যবসার জন্য, এ আর আশ্চর্য কি!

(মায়িন খান, ফেব্রূয়ারি ২০০৯)

One thought on “লেখক

Leave a comment