###পথের খোঁজে##০৪#

মনিরের সাথে প্রায়ই তার কলিগদের বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক হয়। মনির লক্ষ্য করেছে বিভিন্ন পেশার এথিকাল কোড অফ কন্ডাক্টই অধিকাংশ আন -এথিকাল কাজের জন্য দায়ী। এর মুল কারন হচ্ছে -একটা ত্রূটিপূর্ণ মোরাল ফিলোসফি- ইউটিলিটিরিয়ান ফিলোসফি। এটিকে সংক্ষেপে এভাবে বলা যায় – যেকোনো ডিসিশন নীতিপরায়ন হবে যদি সেই ডিসিশন কুফলের চেয়ে সুফল বেশি বয়ে আনে। এখান থেকেই জনপ্রিয় “কস্ট -বেনেফিট এনালাইসিস” ধারনার উদ্ভভ।

সাইক্লোন ইয়াসী উত্তর কুইন্সল্যান্ড লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এটা কলার সীজন। কিন্তু কলার ফলন তোলার আগেই সব শেষ। মনির একটা ডিপারট্মেন্টাল চেইনের হেড অফিসের সিনিয়র এনালিস্ট। কাল মিটিং এ ডিসিশন নিতে হবে কলার দামের ব্যাপারে। ঝড়-বুশ ফায়ার-সাইক্লোন -ভুমিকম্প বা অন্য যে কোনও ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই মূল্য নির্ধারণ করার মিটিং শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো হু হু করে মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয় না এই দেশে।

মনিরের মন খুব একটা ভালো নেই আজকে। সকাল থেকে কয়েক দফায় কলার দাম নির্ধারণ মিটিং করেও কোন ডিসিশন হয় নি । মনে হচ্ছে ডিসিশনটা ডিমান্ড- সাপ্লাই ভিত্তিক হবে । অফিসের আরেকজন প্রাইসিং এনালিস্ট আছেন – ব্রিটিশ মহিলা। তার নাম কারেন । এই মহিলা অক্সফোর্ড এর বিজনেস গ্রাজুয়েট। ইংরেজীতে তার সাথে তর্ক করে পারাটা ইংরেজদের জন্যও কঠিন .. সেখানে মনিরে কোনও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারেন এর মতে -কলার দাম কতো হবে – তা বাজারই ঠিক করে দিবে। কেননা এটা মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগ । এই খারাপ সময়ে দাম বেশী মনে হলে মানুষ কলা না খেলেই তো হয় । অফিসের সবাই মাথা নেড়ে সাই দিয়ে ফেলেছে কারেনের যুক্তিতে। মনির সেটা দেয় নি। কিন্তু কিছু বলেও নি। কারেন রসিকতা করে মনিরকে বলল –

– হেই “নেগেটিভ ন্যান্সী”, চুপ করে আছো কেন? কোনও সমস্যা ? -সবাই হো হো করে হেসে উঠলো মিটিংয়ে। মনির মৃদু হাসি দিয়ে আর কথা বাড়ায় নি । আগামীকাল ফাইনাল ডিসিশন হবে ।

বাসায় ফেরার পথে কিছু কেনা কাটা করার জন্য সে একটা ডিপারট্মেন্টাল স্টোর ঢুকেছে । টুক টাক জিনিস কেনার ফাকে সে কলার দামটাও দেখছে । এক কেজী কলার দাম ১৬ ডলার! দু একজন মানুষ কলা কিনছে … কিন্তু অধিকাংশ মানুষই চোখ দিয়ে একবার দামটা দেখছে আর অতি দ্রুত বেগে সেখান থেকে অন্য দিকে সরে যাচ্ছে। কারেনের কথা হয় তো ঠিক – মার্কেট ই প্রাইস ডিক্টেট করবে – ফ্রী ইকোনমী… ফ্রী মার্কেট… ফ্রী উইল ।। অনেকটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল মনির।

পথের খোঁজে #৪# সৈয়দ কল্লোল

পেছন থেকে এক ভদ্র লোক মনিরের কানে এসে বলল- কাউন্টার ফ্রী হয়েছে -এখন তার পালা টাকা দেয়ার। মনির সামনে এগুলো এবং কাউন্টারে তার বাজার গুলো যখন চেক আউট হচ্ছিলো – তখন পাশের কাউন্টারে এক বৃদ্ধার আগমন ঘটলো । বয়স কম পক্ষে ৯০ হবে তার। কোনও ভাবে সে হাটতে পারছে.. কুজো হয়ে। মনিরের খুব মায়া হয় এমন বয়স্ক মানুষ দেখলে -তার নিজের বাবা -মা এর কথা মনে পড়ে। কখনো সখনো মনটাও খারাপ হয়ে পড়ে। মজার বিষয় এই বুড়ী ৬টি কলা কিনছে এই দুর্দিনে ! কলা হয়তো বা তার অতি প্রিয় ।। আবার তার মেডিক্যাল নীড হতে পারে । কিন্তু যখন টাকা দেয়ার সময় হোল , বুড়ির মুখটা শুকিয়ে আসলো । বেচারী বয়স্ক মানুষ! কলার দাম যে এতো সেটা সে খেয়াল করে নি । বেচারী প্রথমে ৪ টি কলা সরিয়ে দাম জানতে চাইলো ২ টি কলার। সেটাও তার পক্ষে কেনা অসম্ভব ছিলো হয়তো । এবার একটা কলার দাম জানতে চাইলো সে। এরই মধ্যে মনিরের চেক আউট শেষ, কিন্তু সে একটা সাইডে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিল। বৃদ্ধার হাত কাপা দেখে মনির বুঝতে পারলো উনার হয় তো ডায়বেটিস আছে ; অথবা একটা অনাকাঙ্খিত সমস্যায় পড়ে লজ্জায় – অপমানে তিনি কাপছিলেন। বুড়ী শেষ পর্যন্ত কোনও কলা না কিনেই মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছেন । মনিরের খুব ইচ্ছে হোল উনাকে ৪ টা কলা কিনে দেয়ার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে উঠলো না। বুড়ী হয় তো আরো অপমানিত বোধ করবেন তাকে ফ্রী কলা সাধলে। ভিক্ষা ব্যাপারটা সবার জন্য নয়।

মন খারাপ করে মনির বাসায় ফিরলো। ডিনার শেষ করে এক গ্লাস রেড ওয়াইন নিয়ে সে বারন্দায় বসেছে। আজ অমাবস্যা মনে হচ্ছে । আকাশে তারা ঝিক ঝিক করছে। বুড়ির কথা মনে পড়ছে বার বার। সাথে কারেনের ফ্রী মার্কেট যুক্তি। বুড়ির ইচ্ছে অথবা প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কলা কিনতে পারলো না। যাদের অনেক টাকা আছে -তারা ঠিকই কলা নিয়ে বাসায় ফিরছে – তাহলে এই অসহায় বুড়ির ইচ্ছের মূল্য থাকল কোথায় ফ্রী মার্কেট ফিলসফীতে! ফ্রী মার্কেট আসলেই কী ফ্রী ?

তার মাথায় আবার ঘুরপাক খেতে শুরু করলো কয়েকদিন আগে কারেনের সাথেই তার বিতরক হয়েছিলো “সারোগেশন” বিজনেস নিয়ে। কারেন বলেছে – কেউ যদি অন্যকে জোর না করে , দু পক্ষই যদি স্বাধীন ভাবে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সারোগেশন এরেঞ্জমেন্টে যায় -তাহলে সমস্যা কী ? একটা ফ্যামিলী সন্তান পেলো, অন্যজন পেলো টাকা। ঊঈন ঊইন সিচুয়েশন ফর অল !

কারেনকে মনির জিজ্ঞেস করেছিল – সারগেশনের দুই পক্ষই কি আসলে স্বাধীন ? ভারতের যে গরীব মহিলা সারোগেট মা হতে রাজী হোল আর উন্নত বিশ্ব থেকে আসা তার ক্লায়েন্ট এর অর্থনৈতিক অবস্থা কী সমান ? কারেনকে মনির জিজ্ঞেস করেছে একটা উদাহরন দেখাতে , যেখানে একজন মিলিওনার মহিলা ভারতের কোনও গরীব পরিবারকে সন্তান দেয়ার জন্য সারোগেট মা হতে রাজী হয়েছে? তাহলে স্বাধীন ভাবে ডিসিশন নেয়া হচ্ছে কোথায় ? ফ্রী মার্কেট ফিলসফী কি আসলে শোষনেরই আরেকটা অস্ত্র নয়? কারেন কোনও উত্তর দিতে পারে নি … “নেগেটিভ ন্যান্সী” বলে ঠাটটা করে সরে গিয়েছিলো। কারেনের চেহারাটা ভেসে উঠলো তার মনে । মহিলা সুন্দরী কিন্তু কোথায় একটা পিশাচীর ছায়া আছে…

মনির তার তৃতীয় গ্লাসে প্রথম চুমুক দিতেই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো । প্রায় অবশ শরীরে কোনও মতে ফোনটা বের করে সে দেখলো -বাংলাদেশ থেকে ফোন এসেছে । মিশা’র কল। ফোনটা মিউট করে দিয়ে সে বিড় বিড় করে বলল – অনেকদিন হয়েছে মিশা কে ফোন দেয়া হয় নি । ওকে একটা ফোন দেয়া দরকার।

চলবে…

পরের পর্বঃ ২৯/০৮/২০২০

Leave a comment