রিহানা

প্রায় ১০ বছর পর বাংলাদেশে আসা । ২০১৯ সাল । ১০ বছর আগের আমি আর এখনকার আমার মধ্যে একটা বড় পার্থক্য হচ্ছে – এখম আমি সিরিয়াস এমেচার ফটোগ্রাফার। বাংলাদেশে আসার সময় তাই আমার অতি বিশ্বস্ত Nikon D610 ক্যামেরা এবং সাথে দুইটি লেন্স নিয়ে এসেছি। একটা ৫০ মিলি আরেকটা ৭০-৩০০ মিলি।

বাংলাদেশের ভ্যাপসা গরমের কথা একদম ভুলেই গেছিলাম । এরই মধ্যে কয়েকবার ক্যামেরা হাতে বেরিয়েছিলাম -কিন্তু ভ্যাপসা গরমের ধাক্কা সামলাতে না পেরে সোজা বাসায় ফিরে এসেছি। রাস্তার ওপারেই ধানমন্ডি লেক ; অথচ প্রথম এক সপ্তাহে যাওয়া হয়ে উঠল না ।

গতকাল ছিল রোজার ঈদ। ব্রিস্টি হয়েছে এবং তার রেশ এখনো আছে। ব্রিস্টি নেই, কিন্তু আকাশ মেঘলা, ঠান্ডা। ভাবলাম আজকেই ধানমন্ডি লেক কভার করবো।

লেকের মাঝের ওভাল- যেখানে সাধারনত অনুষ্ঠান হয় – সেখানে গিয়ে দেখলাম মানুষ গিজ গিজ করছে। দারুন! সবাই ঈদের নতুন পোশাক পরা – রঙ ঊপচে পড়ছে যেন! একটা জিনিস খুবই মজার – বয়স নির্বিশেষে সবাই সেলফী তোলায় ব্যস্ত। পাশাপাশি বসা থাকা মানুষগুলো একে অন্যের সাথে কথা বলছে কম … সম্ভবত টেক্সট করে ভাব বিনিময় করছে! সেটা স্বাস্থ্যের জন্য মনে হয় ভালো। কথা বললেই মুখ খুলতে হয় – মুখ খুললেই ধুলো প্রবেশের সম্ভাবনা!

একদল ১৬-১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়ে ছবি তুলছে। ওদেরই একজন বন্ধু ক্যামেরা ম্যান- একটা ক্যানন ই ও এস হাতে। গ্রূপ ছবি তোলার জন্য সবাইকে দাড় করিয়েছে। সবার মুখে হেলে পড়া সূর্য । তাদের মুখ আলোকিত হয়েছে দারুন ভাবে। কিন্তু সবার চোখ আর ভ্রূ কুচকে আছে- সূর্যের আলো সরাসরি পড়ায়। – এই দৃশ্য আমি বহুবার দেখেছি দেশ কাল পাত্র ভেদে। বহুবার ফটোগ্রাফারদের শুধরেও দিয়েছি। আর এরা তো আমার দেশের মানুষ! আমার ভাগ্নের বয়সী । এক ধরনের স্নেহ অনুভব হোল। ওদের কে যেয়ে বললাম কীভাবে ছবিটা তুলতে হবে। সবাইকে সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে দাড় করালাম -(জাস্ট উল্টা )। ফটোগ্রাফারকে বললাম ক্যামেরার ফ্ল্যাশ অন করে দিতে। সে বলল -দিনের বেলায় ফ্ল্যাশ ??? আমি তাকে অল্প কথায় বুঝিয়ে দিলাম ফ্ল্যাশ ব্যবহারের সাথে দিন -রাতের কোনও সম্পর্ক নেই। সে কোনও কথা না বাড়িয়ে আমার কথা আনুযায়ী ছবি তুলল । ছবি দেখে আমি বললাম -আরেকটু এডজাস্টমেন্ট করতে হবে। গ্রূপটার মাঝে দু জন মেয়ে ছিলো যারা কিছুটা ওভার ওয়েট। প্রতিটা লেন্স -সেটা হোক মবাইল ফোন ক্যামেরা কিংবা ডিএসেল আর – একটা মেকানিকাল সমস্যা থাকে – যেটা কে বলে -ডিস্টরশন। কম দামী লেন্সে সেটা ভয়াবহ রকম থাকে। এই সমস্যার কারনে গ্রূপ ছবিগুলোর একদম দুই কর্নার এ যারা থাকেন – তাদের চেহারা বাড়তি চ্যাপটা দেখায়- অনেক বেশী ভারী- বাল্কী দেখায় । তো আমি এই ফটগ্রফারকে বললাম সবচেয়ে পাতলা দু জনকে ফ্রেমের দুই প্রান্তে রাখতে। ছবিটা তোলার পর কম্পেয়ার করে ক্যামেরায় দেখিয়ে বললাম – ব্যাপারটা সে ধরতে পেরেছে কি না । সে দারুন অবাক হয়ে বারবার মাথা নাড়াতে থাকলো। এবার তাকে বললাম একই ছবি ফ্ল্যাশ ছাড়া তুলতে। আমার আর কিছু বলতে হয় নি–সে ই আমাকে বলল- এটা কিছুই হয় নি ভাইয়া।

কিছুক্ষন ধরে হাঁটছিলাম আর মনে মনে সাব্জেক্ট খুজছিলাম ছবি তোলার। অনেক ফটোগ্রাফার আছেন -একটা যায়গায় আসা মাত্রই ছবি তোলা শুরু করে দেন। আমি সেটা পারি না। আমি চেষ্টা করি স্টোরি বেজড ছবি তুলতে।

স্টোরী পেয়েও গেলাম। অনেক ফেরী ওয়ালাদের মাঝে একজন কে দেখলাম সে বেলুন বিক্রী করছে। সাথে বাবল। তার সেই বাবল বাতাসে উড়ে উড়ে অনেকদুর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। অনেক গুলো ছোট্ট ছেলে মেয়ে সেই বাবলের পিছু ছুটছে।

আমি লোকটার ছবি তোলার জন্য প্রথমে তার আনুমতি চাইলাম। ভদ্র লোায় খুবই অমায়িক – আমার মতো ই বয়স হবে। সে অনুমতি দিয়ে দিল খূউবই আনন্দের সাথে । আমি তার ছবি তুল্লাম একটু দূর থেকে । এবার ভদ্র লোক আমার কাছে এসে বলল – ” ভাইয়া আমার মেয়ের একটা ছবি তইলা দিবেন ?” বলেই সে অপেক্ষা না করে তার মেয়েকে ডেকে কাছে নিয়ে আসলো। মেয়ের নাম রিহানা। আমি প্রায় জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলাম – মেয়ের নাম রিহানা কি এমেরিকান পপ সিঙ্গার রিহানা কে অনুসরন করে ? কিন্তু আর আগালাম না। রিহানার ছবিও তুললাম। বাবার মতই হাসি খুশি মেয়ে রিহানা। ক্লাস ফাইভ এ পড়ে। বাবা আমাকে বলেছে -মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। খুবই ভালো লাগলো । পশ্চিমা দেশ গুলোর বাবা মা তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোনও স্বপ্ন দেখে বলে মনে হয় না।

যা ই হোক, ছবি তোলা শেষ করে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম- তখন রিহানার বাবা এসে বলল -“ভাইয়া , পারলে আমারে একটা ছবি দিয়া যাইয়েন। আমি আমার বাসায় দেয়ালে ঝুলাইয়া রাখবো। কতজনে ছবি তুইলা নিয়া যায়- কেউ কখনো দেয় না”।

আমি সন্ধ্যার সময় বিডিআর এর মোড়ে একটা ভালো ফুজী ফিল্ম এর স্টুডিও পেয়ে গেলাম। সেখানে ছবি প্রিন্ট করলাম। রিহানার বাবা আর রিহানার জন্য ৫ টি ছবি ১২ / ৮ সাইজ করে প্রিন্ট করলাম।

পরের দিন আবারো লেকের পাড় গেলাম হাতে একটা খামের মধ্যে ছবি গুলো নিয়ে। কিছূক্ষন পর রিহানার বাবা কে পেয়েও গেলাম। তার হাতে ছবি গুলো দিলাম। খাম খুলে ছবিগুলো দেখে খুশীতে তার যে চেহারা হয়েছিল – সেটা সারা জীবন আমার মনে থাকবে। আমার পক্ষে সেটা লিখে বর্ণনা করা অসম্ভব বলে সেদিকে আর গেলাম না।

লোকটা এবার আমাকে আমার ছেলের জন্য কিছু উপহার দেয়ার জন্য জড়াজুড়ি করতে লাগলো। আমি তাকে বললাম দরকার নেই ; কিন্তু তাতে তার মন একটু খারাপ হোল বলেই মনে হোল। একটা চাবি দেয়া লাইট জ্বলা- নেভা ঘোড়া দেখিয়ে তাকে বললাম- এইটা দিতে পারেন। সে খূবই খুশী হোল, সাথে তার পছন্দের আরো একটা খেলনা জুড়ে দিতে চাইল।

আমি আবার হাটা শুরু করলাম; চাবি দেয়া ঘোড়া আমার হাতে। অনেকটা দূরে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালাম রিহানার বাবার দিকে – সে একটু পর পর খামটায় ঊকি ঝুকি দিচ্ছে। মুখে তৃপ্তির হাসি। আমার মুখেও সেই হাসি সঞ্চালিত হোল।

আবেগে অনেকেই আমাকে প্রায়ই ফটোগ্রাফী কম্পিটিশন করে পুরস্কার জেতার জন্য অনুরোধ করে। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই আমার পুরস্কার।

-সৈয়দ কল্লোল ২০২০

One thought on “রিহানা

Leave a comment