ক্যান্সার

প্রতিটা ধর্মেই এমন এক বা একাধিক চরিত্র উপস্থাপন করে যার মূল ধারণা শয়তানের সাথে মিলে যায়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই ধরণের চরিত্রগুলো যা করে তা হল সৃষ্টিকর্তা নির্দেশিত পথের বাইরে নিজেকে, এবং মূলত অন্যকে পরিচালিত করে। ধর্ম অধ্যুষিত সমাজে প্রায়শই শোনা যায়, বিশেষ করে অপরাধ মূলক কাজের প্রেক্ষিতে, যে, “আমাকে শয়তানে ধরেছিল, না হলে এ কাজ কেন করলাম?”। আবার এর বিপরীতে অনেক বিবেকবান এও বলেন, “শয়তানকে দোষ দিয়ে নিজের সংশোধনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা আরকি!”। শয়তান আছে কি নেই এ বিষয়ে আলোচনা করার আমার কোন ইচ্ছা এখানে নেই। শয়তান এর মত কেউ ঠিক কি পন্থায় কাজ করতে পারে তাও এখানে আলোচনা করবোনা; কারন, লোকে বলে, দানবের কর্মপন্থা বুঝতে হলে দানব হতে হয়, আমার শয়তান হবার কোন ইচ্ছা নেই। তবে সমাজ বা লোকালয়ে এ সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় আমার চোখে পড়েছে যেগুলো মানুষের কল্যানার্থে এখানে আলোকপাত করতে চাই।

ক্যান্সার নামের ভয়াবহ রোগটার নাম সবাই জানে। অনেকেই জানে যে এটা সরাসরি কোন জীবন্ত রোগবাহীর কাজ নয়। মানুষের শরীরের নিজস্ব অংশগুলো যখন জীবাণুর মত কাজ করে তখনই মূলত এই রোগটা হয়। ফলে মানুষ নিজের শরীরের অংশ ধ্বংস করতে বাধ্য হয়। কোন কোন সময় এই প্রক্রিয়াতে মানুষ নিজেই শেষ হয়ে যায়। ফলে এ রোগ এবং তার চিকিৎসা দুটোই খুব ঝামেলার। আধুনিক সমাজে কান্সারের দায় কিন্তু সরাসরি রোগির ওপর কখনই দেয়া হয় না, বরং, অনেক সময়, মনে করিয়ে দেয়া হয় রোগির ভুল সিদ্ধান্ত এই রোগের প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। প্ল্যাস্টিকের বোল বালতি থেকে শুরু করে প্রাণ রক্ষাকারী ঔষধ পর্যন্ত সবাইকেই খতিয়ে দেখা হয় ক্যান্সার রোগে তার কোন ভুমিকা আছে কিনা। আর কেনই বা হবে না, মানুষের কল্যান আর জীবন রক্ষার মত জরুরী আর কি আছে!

যখন কোন মানুষ ভুল ধরণের কোন কাজের সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা তাকে কোন না কোন ক্ষতির সম্মুখীন করে। অনেক ক্ষেত্রে তা অন্যের ক্ষতির কারণ হলে সামাজকভাবে শাস্তিরও ব্যবস্থা করা করা হয়। মুস্কিল হল, ভুল কাজ যতখন পর্যন্ত নিজের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে, ততক্ষণ এ ব্যাপারে কোন সামাজিক পদক্ষেপ থাকা খুব কঠিন। আর ব্যক্তি, সেইবা কিভাবে নিজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। অনেক সময় নিজের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি ব্যবস্থাগুলো উন্মাদনারও শামিল। সমাজ এরকম কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করলে ব্যক্তিকে মানসিক চিকিতসার দারস্থও করা হতে পারে, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার উপস্থিতি অনেকটাই কমে যায়।

অপরাধের উৎপত্তি বিচার করলে দেখা যাবে, অপরাধের শুরুটা অধিকাংশ সময়েই নিজের বিরুদ্ধে অপরাধের মধ্য দিয়ে হয়। যখন তা একটু বেশি পর্যায়ে যায়, তখন সমাজ বা অন্যকেও খতিগ্রস্থ করে। অনেক সময় এমন দেখা যায় যে, কিছু মানুষ শুধুই অন্যের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে চায়। এই লেখায় সে আলোচনায় যাবার কোন ইচ্ছা আমার নেই। অন্তত দৈনন্দিন জীবনে যাদের আমরা সাধারণ মানুষ হিসাবে দেখি, তাদের অপরাধ গুলো নিজের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এখন তাদের ঋণাত্মক কর্মকাণ্ড গুলোকে আমি ধরণ হিসাবে (কিন্তু তিব্রতা হিসাবে নয়) ক্যান্সারের সাথে তুলনা করতে আগ্রহী। এদের কতগুলোর তীব্রতা ক্যান্সারের মত, আবার কতগুলোর ক্যান্সারের চেয়ে কম বা বেশি। তবে প্রায় সবই আসে কোন না কোন ধরণের ভুল সিদ্ধান্ত বা চর্চা থেকে।

এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। আলোচনার খাতিরে বলছি, কেউ শয়তানের উপস্থিতি মানে আবার কেউ মানে না। আসলে শয়তান কথাটা বারবার বলায় প্রবন্ধের গতি খতিগ্রস্থ হতে পারে। শরীর বা মনের ক্যান্সারের কোন সরাসরি অথচ প্রাথমিক প্রভাবকেকে আমরা এখানে এজেন্ট বলতেই পারি। এখন বিজ্ঞানের খাতিরে যদি বলি, এই এজেন্টের কোন সরাসরি প্রমাণ এখনও মেলেনি, তবে তা নেই সে প্রমানও নেই। যারা বিশ্বাসী তাদের জন্য এ প্রমানের হয়তো প্রয়োজন নেই , আবার যারা অবিশ্বাসী তাদের জন্য হয়তো প্রমাণও সব সময় যথেষ্ট নয়। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি যারা দোল খায় তাদের সংখ্যা সম্ভবত অনেক; আর মূলত তাদের জন্যই এই লেখাটা।

আলোচনার খাতিরে ধরে নেই, এজেন্ট থাকার সম্ভাবনা ৫০/৫০। শরীরের ক্যান্সারের জন্য এটা বিরাট ব্যাপার। প্রায় সব মানুষ, যারা ক্যান্সার বোঝেন, হয়তো সিদ্ধান্ত দেবেন, এরকম সম্ভাব্য এজেন্টকে সত্য ধরে নিয়ে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখাটাই উচিত। প্রয়োজনে হয়তো প্রতিরোধক টিকাতেও আপত্তি করবে না অনেকে। ধরে নেই, মনের ক্যান্সারের জন্যও পরামর্শটা একই। মনের মধ্যে যে ক্যান্সার, তার এজেন্টের জন্য প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক ব্যবস্থার চিন্তা করাটা হয়তো কোন গোষ্ঠীর জন্যই খুব অযৌক্তিক হবে না। তবে বলে রাখা ভালো, কেউ যদি অযৌক্তিক মনে করেন, তবে তার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলব, এ লেখা তার বিরোধিতার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি।

ক্ষতিকর যেকোনো এজেন্টকে সবচেয়ে কার্যকরী করতে যা দরকার তা হল, তাকে সব দিক থেকে তাকে অদৃশ্য রাখা। অর্থাৎ তার উপস্থিতির প্রমাণ যদি প্রায় অসম্ভব হয়, তাহলে প্রতিরোধক আর প্রতিষেধকের আলোচনায় আসাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মনের এই ঋণাত্মক এজেন্টটি এরকম হওয়া আরও সহজ এবং বাঞ্ছনীয়। কারণ, মন নিজেই সব দিক থেকে প্রায় অদৃশ্য; আর এজেন্ট যদি কোনরকম দৃশ্যমান হয়ে মনের কাছে উপস্থিত হয়, দ্রুতই সমাজ তার ব্যবস্থা নিতে পারে, অর্থাৎ মানসিক ব্যধি হিসাবে তার চিকিৎসা করে, ফলে আক্রান্ত আর একা থাকেন না। সুতরাং এজেন্ট যদি চতুর এবং পরিশ্রমি হয় তাহলে সে নিজেকে অবান্তর বিষয় করে রাখতে চাইবে সাধারনের চোখে; শুধু শুধু তো ধরা দেবেই না। যেন, কেউ ভুলেও তার প্রতিরোধ নিয়ে বাস্তব সম্মত কথা না বলে; আর যে বলবে সে যেন সামাজিক ভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মুখমুখি হবার সম্ভাবনা রাখে। শুধুমাত্র যে বা যারা তাকে ভালবাসে, সে হয়তো তাদের কাছে ধরা দিতেও পারে। বাকি সবার জন্য কম পরিশ্রমে কাজ করতে তাকে সর্বাত্মকভাবে গোপন থাকতেই হবে।

ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, মনের ক্যান্সারের এজেন্ট সম্ভবত ঠিক এরকমই। আর এটার এরকম হবার দুটো বাস্তব ফলাফল বিশ্বাসী সমাজে দেখা দিতে পারে। এক, যারা একে বুঝতে পারবে, তাদের সহায়তা করার জন্য হয়ত খুব বেশি বন্ধু তারা চারপাশে পাবে না। দুই, কিছু মানুষ, যারা নিজের সংশোধন বা উন্নতির ব্যাপারে আন্তরিক নয়, তারা এজেন্ট, অর্থাৎ শয়তানের ওপর সব দোষ চাপিয়ে ভারমুক্ত থাকতে চাইবে। তাই, বিশ্বাসীর জন্য চিন্তা আর আচরনের ভারসাম্য আর নিখাদ সততা এ সমস্যা সমাধানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a comment