(অনু গল্প)
বিরল জনপদে একবার একটা অদ্ভুত পায়ের চিহ্ন দেখা গেলো। এমন চিহ্ন কেউ কোনোদিন দেখেনি এ জনপদে, ফলে লোকজন বিশেষ করে প্রৌঢ়রা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো।
চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছিলো এটা কোনো বিশেষ ধরণের প্রাণীর। কিন্তু কেউ নিশ্চিত হতে পারছিলো না। শেষে নবী নামের একজনকে ডাকা হলো, কারণ এই লোক বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করার সুবাদে নানান রকম অজানা বিষয়ের জ্ঞান রাখতো। আর তাছাড়া সে একজন পরোপকারী ব্যক্তি, চেনা অচেনা সবাইকে সাহায্য করতে ভালোবাসে, কোনো প্রতিদানের আশা করে না। এসব কারণে অর্থবিত্তহীন হওয়া সত্ত্বেও নবীর একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল সমাজের সবগুলো পর্যায়ে।
নবী এসে ভাল করে পদচিহ্নটি পরীক্ষা করলো, তারপর তার মতামত জানালো যে এটা সম্ভবত একটা বাঘের পায়ের চিহ্ন। সবাই নড়ে চড়ে বসলো কথাটা শুনে, কারণ এ এলাকায় বাঘ একদমই দেখা যায় না।
বেশির ভাগ লোক নবীর কথা অস্বীকার করল। নিতান্ত ভালো এই মানুষটির পরীক্ষিত চরিত্র আর স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা যেন এক্ষেত্রে কোনো কাজেই আসলো না। অস্বীকারকারীদের যুক্তি ছিল এই যে এই এলাকায় বাঘ কখনো দেখা যায়নি। এমনকি তাদের বাপ্-দাদাও দেখেনি কখনো। সুতরাং শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ঘরে লুকিয়ে থাকার অথবা লাঠি-বন্দুক জোগাড় করে টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এই প্রথম দলটির নেতৃত্বে ছিল স্থানীয় শীর্ষ ব্যবসায়ী হাশিম আলী। দুদিন পরেই সে এলাকাতে একটা মেলার আয়োজন করেছে, যেখানে তার সমস্ত মাল-সামান বিক্রি হবে। সে কিছুতেই চাচ্ছিলোনা যে মেলাটা পিছিয়ে যাক। আর সে ভালো করেই জানতো যে গরিব অভাগা নবীর কথার চেয়ে সমাজে তার কথার মূল্য অনেক বেশি।
বিজ্ঞানের চেতনায় আলোকিত একটি দল, যাদের বেশির ভাগই ছিল স্থানীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক, একটা নতুন সম্ভাবনার কথা জানাল। তারা মত দিলো যে, বিশেষ ধরণের বায়ুপ্রবাহের সাথে ভূগর্ভস্থ পানির ক্রিয়া মিলিয়ে মাটিতে এরকম চিহ্ন সৃষ্টি হওয়া তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। এ সম্ভাবনাটি যদিও ক্ষীণ, তবুও সেটি গ্রহণ করা একজন নিরক্ষর লোকের অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করার চাইতে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। মোটকথা আমরা যা দেখিনি তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে পারি না। প্রথম দলটি, যারা নবীকে মানতে চায়নি, তারা এই দ্বিতীয় দলটিকে সমর্থন জানালো আর ধন্যবাদও জানালো বিজ্ঞানের কল্যাণকে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য।
একটি ছোট দল অবশ্য নবীর কথা বিশ্বাস করল। তারা বললো যে নবী লোকটা কোনোদিন মিথ্যা কথা বলেনি, কাউকে ধোঁকা দেয়নি, তাই তার কথা বিশ্বাস করে যায়। আর তাছাড়া লোকজনকে সাবধান করার বিনিময়ে তার কোনো পার্থিব লাভ নেই, কেউ নবীকে এর বিনিময়ে টাকা দিচ্ছেনা। তৃতীয় এ দলটি কয়েকদিন বাসায় লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো, যদিও ওরা জানতো যে এই বাড়তি সাবধানতার কারণে তারা কয়েকদিন কাজে যেতে পারবেনা এবং সম্ভবত তাদের এই কয়টা দিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে উপোসই থাকতে হবে। তবু তারা তাদের এবং ছেলে-মেয়ের জীবনকে মূল্য দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চাইলো। সবগুলো চিহ্ন যখন একটি বিশেষ দিকেই ইঙ্গিত করছে, তখন বিশ্বাস করার জন্য সেটাই যথেষ্ট।
বলাবাহুল্য সে রাত্রে বাঘ আবার এসেছিলো ওই গ্রামে। কয়েকটা গবাদি পশুর ওপর আক্রমণও করেছিলো। সৌভাগ্যক্রমে কোনো মানুষ মারা যায়নি, ফলে পরেরদিন সবাই মিলে পরামর্শ করে সমস্যাটার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলো।
তবে এখনো সেখানে দুটো দল রয়ে গেছে, তাদের একদল বলে যে যা দেখা যায় না – যেমন আত্মা কিংবা ঈশ্বরের ধারণা – তার অস্তিত্ব মানতে আমরা রাজি নই, আর অন্যদল বলে যে বিশ্বাস তো না দেখা জিনিসকেই করতে হয় – আমাদের জন্য চিহ্ন বা ইঙ্গিতই যথেষ্ট।
(মায়িন খান, আগস্ট ২০২০)

This has encouraged me to write on reliability as a humane issue. Thank you!
LikeLiked by 1 person