সত্য অবলম্বনে গল্পঃ সময়ের অতিথি

অফিস যেতে কখনই ভালো লাগে না সামাদের। স্কুলে যেতে ঠিক যেমন লাগত না। শুধু ঘরে থাকতে ভালো লাগে তার। ঘরের মানুষদের মাঝখানে আর কি। তবে ঘরের মানুষদের ঠিক পাশে কখনই সে থাকতে ভালবাসে না। একটু দূরে, যেখান থেকে সবার আওয়াজ পাওয়া যায়, প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে দেখাও যায়। মানুষের খুব বেশি নৈকট্যও যেন ভালো লাগে না তার, কিম্বা দীর্ঘ সংস্পর্শ। মাঝে মাঝে সামাদ ভাবে, এটা তার একটা মানসিক সমস্যা, চিকিৎসা করানো দরকার।

চিকিৎসা অবশ্য পর্যাপ্তই চলছে। তবে সামাদের নয়, তার বাবা মায়ের। দুজনই আলজাইমার রোগের রুগি। মা শেষ পর্যায়ে, আর বাবা শেষের ঠিক আগের পর্যায়ে। নিজাম দুলাভাই গতকাল সামাদকে বুঝিয়ে বলেছে কেন এই অবস্থায় অতিরিক্ত চিকিৎসা রোগীর কষ্ট আরও বাড়াতে পারে। নিজাম দুলাভাই প্যালিয়েটিভ মেডিসিনের ডাক্তার। তার কথা সামাদের অসহ্য লেগেছে। উনি কি বলতে চান? মা শেষ পর্যায়ে বলে তার বেশি চিকিৎসা করানো ঠিক না! এসব আলাপের পর রাতে ঘুম হয়নি বললেই চলে। এটা সামাদের আরেকটা সমস্যা, একবার রাগ হলে সেটা ভারি ট্রাক্টরের মত এগোতেই থাকে। একমাত্র সমাধান ভালো ঘুম। ঘুম থেকে উঠে অনেকটাই কেটে যায় রাগ, যেন অনেকটা মৃগী রোগ।

অফিসে সামাদের কুখ্যাতি আছে নিয়মিত অনুপস্থিত থাকার। সপ্তাহের শেষ তিন দিনের অন্তত একদিন। কিন্তু অনেকের অনেক অনিয়ম কোন রকম অভিযোগ ছাড়াই ম্যানেজ করায় কেউ সামাদকে খুব একটা সমস্যায় ফেলেনা। অভ্যাসটা খারাপ সে বুঝতে পারে, কিন্তু ছাড়তে পারেনা। আজ সকালে বউ অফিসে ফোন করে বলেছে, সামাদ যেতে পারছে না। তারপর ছেলেকে নিয়ে স্কুলে গেছে বউ। স্কুল ছুটির পর ছেলেকে নিয়ে ফিরবে সকাল দশটার পর। সামাদের মাথার কাছের টেবিলে নাস্তা রেখে গেছে, যদি খেতে চায়। মা অসুস্থ হবার পর থেকে বউ যেন মায়ের দায়িত্বগুলোও বুঝে নিতে চাইছে, সামাদ বুঝতে পারে। কিন্তু সব চাপ তার মাথায়, তাই বউ এর প্রশংশা করার সময় বা শক্তি সামাদের নেই।

মা আজ সকাল সকাল জেগেছে। হুইল চেয়ারে করে খাবার টেবিল পর্যন্তও এসেছে, বাবার সাথে একত্রে নাস্তা করতে। ঘুমের মধ্যেও সামাদ বুঝতে পারছে; খাবার ঘর তার বিছানা থেকে সামান্য দূরত্বে, মাঝখানে একটা দেয়াল মাত্র। অসভ্য বৃষ্টির মতই সামাদের ঘুম একটু গভীর হয় আবার একটু সময় সে ঘুমের মধ্যেই আশেপাশের আওয়াজ শুনতে পায় সামাদ। হঠাথ ফোন বেজে উঠল সামাদের অফিস ডেস্কে। এপাশ থেকে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বড় ভাই বলল,

বাবার খিঁচুনি হচ্ছে, সামাদ।

বল কি ? এটা তো কখনই ছিল না।

বাবার সাথে কেউ নেই, তুমি কি আসতে পারবে?

আসছি। বলেই সামাদ বেরিয়ে পড়ল। পথটা কিভাবে পার হল সামাদ জানেনা। যখন বুঝতে পারল তখন সে হাসপাতালে, বাবার কাছে।

সামাদ দেখতে পেল, তার বাবা হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে। সামাদ তার পায়ের দিকটায়। বাবার গলা ফুটো করে মোটা পাইপের মত কি যেন লাগানো। মুখে আর নাকেও নল। বাবার চোখ বন্ধ, না ঠিক বন্ধ না, এক দশমাংশ খোলা, বেহুঁশ পড়ে আছে হাসপাতেলের বিছানায়। বেশ দামি হাসপাতাল, এত দামি হাসপাতালে সামাদ কখনো যায়নি। তাও আবার রুমের মধ্যে বাবা একা, অন্য কোন রোগী নেই। হালকা করে কোরআন এর সুর ভেসে আসছে কানে।

ঘুম ভেঙ্গেই সামাদ বুঝল, বাবা মা কেবলই নাস্তা শেষ করলেন। বউ প্লেট গ্লাস সরিয়ে নিচ্ছে। দশটার বেশি বাজে। ছেলে বাথরুমে গান গাইতে গাইতে হাত মুখ ধুচ্ছে। সামাদ ভয়ংকর একটা অনুভুতির মধ্যে আছে। বাবাকে নিয়ে স্বপ্নটা ভয়াবহ। মাকে নিয়ে এমন দেখলে তাও কিছুটা ব্যাখা করতে পারত। বউ চা হাতে ঘরে ঢুকল। হাতে পানির ছাপ লেগে আছে।

তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, সামাদ বলল।

বল।

ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখেছি। বাবাকে নিয়ে।

কি দেখেছ?

আলাপ করতে চাইনা, শুধু জেনে রাখ ভয়াবহ।

কি লাভ জেনে রেখে?

লাভ ক্ষতি হলে বলব। না হলে, ভুলে যাওয়াই ভালো।

ঠিক আছে।

খুব খারাপ লাগছে, ভয় ভয় লাগছে।

আল্লাহকে স্মরন কর, সাহায্য চাও, শান্তি চাও।

হ্যাঁ। বলেই সামাদ পাশে বসে থাকা বউ এর কাঁধে মাথাটা ভর দিয়ে রাখল। তার কাপড়ে একটা পরিচিত গন্ধ, গন্ধটার নাম বোধ হয় আশ্রয় কিম্বা শান্তি।

……

পরের সপ্তাহটা ভয়ংকর কাটল সামাদের। অফিসে যাওয়া এক রকম বন্ধই হয়ে গেল, অন্য রকম সময় হলে সামাদ বেশ খুশিই হত। বাবা হাত পা নাড়তে পারছেন না। দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হল। এম্বুলেন্স খুঁজে পেতে বেশ সমস্যা হল। শেষ মেশ ইউনাইটেড হাস্তাপাতালে নেয়া হল পাকে চক্রে। ডাক্তার দেখে দ্রুত পরিক্ষা নিরীক্ষা করলেন, বললেন হিউজ হেমোরেজ। কিডনি সমস্যা চরমে থাকায় চট করে অপারেশন সম্ভব নয়। রাতটা দেখেতে হবে। মা খুব বেশি অসুস্থ থাকার অসিলা দিয়ে বড় বোনকে রেখে এলো সামাদ বাবার সাথে। আসলে এই অবস্থা তার জন্য এতই কঠিন যে সে নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করছে; তাও খুব কুৎসিত স্বার্থপরের মত।

পরের রাতে বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হল। সোজা সিসিইউ, তারপর স্পেশাল আইসিইউতে। শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখতে যন্ত্র লাগানো হল, আর্টিফিশিয়াল লাইফ সাপোর্ট। দিনের পর দিন পার হয়ে সপ্তাহ গড়াল। বাবার অবস্থা একই রকম, উন্নতি বা অবন্নতি নেই। নতুন সপ্তাহে সামাদ অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল এক শনিবার সকালে। বেশ সকাল সকালই অফিসে পৌঁছল। এদিকে বড় বোন সকালে বাসায় এসেছে, হাসপাতালে বাবার কাছ থেকে। এক সপ্তাহ সেই ছিল বাবার সাথে। সামাদ বা বড় ভাই যাবে এখন বোনের পরিবর্তে।

সকাল সকাল ডেস্কের ফোন বেজে উঠল। সামাদ বুঝল ডিরেক্টর সাহেব। ফোন ধরতেই ওপাশে বড় ভাই এর গলা।

বাবার খিঁচুনি হচ্ছে সামাদ।

বল কি ? এটা তো কখনই ছিল না।

বাবার সাথে কেউ নেই, তুমি কি আসতে পারবে?

আসছি। বলেই সামাদ বেরিয়ে পড়ল। পথটা কিভাবে পার হল সামাদ জানেনা। যখন বুঝতে পারল তখন সে হাসপাতালে, বাবার কাছে।

সামাদ দেখতে পেল, তার বাবা হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে। সামাদ তার পায়ের দিকটায়। বাবার গলা ফুটো করে মোটা পাইপের মত কি যেন লাগানো। মুখে আর নাকেও নল। বাবার চোখ বন্ধ, না ঠিক বন্ধ না, এক দশমাংশ খোলা, বেহুঁশ পড়ে আছে হাসপাতেলের বিছানায়। বেশ দামি হাসপাতাল, এত দামি হাসপাতালে সামাদ কখনো যায়নি। তাও আবার রুমের মধ্যে বাবা একা, অন্য কোন রোগী নেই। হালকা করে কোরআন এর সুর ভেসে আসছে কানে। সেই ওটা মোবাইলে চালিয়ে রেখেছে, ডাক্তারের অনুমুতি নিয়ে। মনে আশা, হয়তো বাবা শুনতে পাবেন, শান্তি পাবেন।

এর পর প্রতিদিন একটা করে নতুন ঘটনা ঘটতে থাকলো। সবই ঋণাত্মক, বাবার সুস্থতার জন্য। ঠিক দু’সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর বাবা মারা গেলেন। যন্ত্র খুলে ফেলা হল। সাদা কাপড়ে মুড়ে দিল হাসপাতাল বাবাকে। তারপর আবার এ্যাম্বুলেন্সে করে বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে চলল সামাদ। অনেকটা দুই সপ্তাহ আগের মত। তফাৎ শুধু বাবা নড়ছেন না। একা সামাদ লাশটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। রাস্তা খারাপ। বড় ভাই এ্যাম্বুলেন্সের পাশে পাশে হোন্ডা নিয়ে। মাথায় হেলমেট নেই। বার বার চোখ মুছছে, বাতাস না কান্না বোঝা কঠিন। রাত একটার অন্ধকারে রাস্তা বড়ই নিরিবিলি। বাসায় সবাই শেষ পর্যায়ের অসুস্থ মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। বাবার মৃত্যুতে সেই দুশ্চিন্তায় একটু ভাটা পড়বে, মন্দের ভালো, সামাদ ভাবল। আর হ্যাঁ, এবার বউকে স্বপ্নের কথাটা বলা যায়, যা হবার হয়েই তো গেছে, আর ভয় করে লাভ কি! অনেক বছর পর বাবাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে সামাদ। পাছে বাবার শরীর এ্যাম্বুলেন্সের ঝাঁকুনিতে গড়িয়ে যায়। বড় ভাইয়ের হোন্ডা, ঠিক পাশে পাশে, এ্যাম্বুলেন্সের সাথে সাথে।

Leave a comment