স্বপ্ন

ছোটবেলা থেকেই জাহিদ জিনিস-পত্র হারিয়ে ফেলে। পছন্দের লাল স্টেডলার পেন্সিলটা টেবিলে রেখে ঘুমাতে গেল, সকালে উঠে দেখে ওটা উধাও। জ্যামিতি বক্সের ভেতর থেকে কাটা, ড্রয়ার থেকে গণিতের বাড়ির কাজের খাতা, খেলনা গাড়ির চার চাকার একটা, পছন্দের চেক চেক হাফপ্যান্ট, মৌজা জোড়ার একটা – হঠাৎ করেই হারিয়ে যেত জিনিসগুলো।

এসব জিনিস হারিয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু জাহিদের প্রাইমারি স্কুলের দিনগুলোতে এগুলো নিয়মিত ঘটতো, অন্য যে কারো চেয়ে অনেক বেশি করে হতো। ওর মা তাই একবার লালচুলের জটাধারী কবিরাজ সবুজ আলীকে বাসায় ডেকে আনলেন। সে জাহিদদের পাড়ায় ‘বাটি চালান’ দিতো, হারিয়ে যাওয়া জিনিস উদ্ধারে মানুষকে সাহায্য করতো – অবশ্যই তার নিজস্ব আধ্যাত্মিক নিয়মে।

সবুজ একটা তামার বাটি উল্টো করে মাটিতে রাখতো, বিড় বিড় করে কি এক মন্ত্র পড়তো, আর তখন একটা লাঠি দিয়ে সেটাকে ঠেলে নিয়ে যেত, কিন্তু দেখে মনে হতো লাঠিই বরং তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হারিয়ে যাওয়া জিনিসের দিকে। একবার ডাক্তার হাফিজের হারিয়ে যাওয়া প্রেশার মাপার মেশিন মনু মিয়ার রিক্সার গ্যারেজের পেছন থেকে বের করে দিয়ে সে এলাকায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল।

সবুজ প্রথমে সবকিছু শুনল ওর মায়ের কাছ থেকে, তারপর জাহিদের কোঁকড়ানো চুল আর বড় বড় চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষন, শেষে ওর মাথায় হাত রেখে পুরো সাত মিনিট কি যেন পড়ল। ওর মুখ থেকে রসুনের গন্ধ পাচ্ছিল জাহিদ, পুরো ব্যাপারটাই ছিল অস্বস্তিকর। সবশেষে সেই লোক চোখ খুলে বলল, এইটা বাটি চালান দিয়ে ঠিক করা যাবে না, কারণ জাহিদের সাথে জীন আছে, আর সেই জীনই  জিনিস লুকিয়ে রেখে ওকে পেরেশান করে। ও বড় হলে বা ওরা বাসা বদলালে এগুলি ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু ক্লাস সেভেনে উঠে জাহিদ দেখল, তার সমস্যা বরং আরো বেড়ে গেছে। তখন সে এসব জিনিস অবশ্য আর কাউকে বলতো না, কারণ সে জানতো এগুলো শোনার সাথে সাথে বন্ধুরা তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করা শুরু করে দিবে। রহিম তো একবার ক্লাসের মেয়েগুলোর সামনেই বলে বসল – ‘এই তোর কাছে নাকি পরী আসে!’

আত্মীয়রাও কম যায় না, জামাল মামা একদিন বসার ঘরে চা খেয়ে তাকে কাছে ডাকল,তারপর ঘরভর্তি লোকের সামনে বলে বসল – ‘সবসময় সূরা তিন কুল পড়ে শরীর বন্ধ করে ঘুমাবে, বুঝলে বাবা ! তাহলে আর তোমার ওপর খারাপ আসর পড়বে না।’  সুতরাং এসব বিষয়ে মানুষ যত কম জানবে ততই ভালো।

সবুজ কবিরাজ কিংবা জাহিদের আত্মীয় বন্ধুরা ওর সমস্যার সমাধান দিতে না পারলেও প্রকৃতি কিন্তু ঠিকই জাহিদের জন্য একটা স্বান্তনার ব্যবস্থা রেখেছিল। আর সেটা হল – ওর হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো জাহিদ ঘুমের মধ্যে ওর স্বপ্নগুলোর ভেতর ঠিকই খুঁজে পেতো। স্বপ্নে ও এই পৃথিবীর মতোই আরেকটা পৃথিবী দেখতে পেত, পার্থক্য শুধু এই যে ওই পৃথিবীতে ওর জিনিসগুলো হারিয়ে যায় নি।

ওর স্বপ্নের ওই পৃথিবীটা এই বাস্তব পৃথিবীটারই হুবহু একটা প্রতিচ্ছবি যেন, আর প্রতিদিন সে একই পৃথিবী দেখত – একেকদিন একেক রকম পৃথিবী না, যেরকম সাধারণত মানুষ স্বপ্নে দেখে থাকে। স্বপ্নের সেই পৃথিবীতে জাহিদ তার হারিয়ে যাওয়া ফিফা বল দিয়ে মন ভরে ফুটবল খেলতে পারত, কিংবা হারিয়ে ফেলা গল্পের বইগুলো স্বপ্নের ভেতর পড়ে নেয়ার সুযোগ পেত।

একবার সত্যজিৎ রায়ের ‘বাছাই বারো’ নামে একটা বই সে পিলু আপার কাছ থেকে নিয়ে এলো পড়ার জন্য, তারপর যথারীতি বইটা সে হারিয়ে ফেলল। ওই রাতে সে স্বপ্নে দেখে বইটা ঠিকই ওর বিছানার পাশের তাকে সাজানো। স্বপ্নের ভেতরই বইটা সে পড়া শুরু করল। প্রতিটা গল্প বিস্ময়কর আর সুন্দর। সে স্বপ্নের ভেতরই প্রথম চারটা গল্প পড়ে শেষ করে ফেলল।

পরদিন সে পাড়ার বইয়ের দোকানে গেল বইটা খুঁজতে, পিলু আপাকে তো ওটা ফেরত দিতে হবে। বিউটি বুক হাউসে সত্যজিৎ রায়ের বই সবসময় থাকে, এই বইটাও সে খুঁজে পেল, যদিও প্রাইমারি বৃত্তির জমানো টাকা দিয়ে কিনতে হল সেটা। ফেরত দেয়ার আগে কৌতূহলবশত বইয়ের পাতা উল্টে দেখতে লাগল সে আর তখনি আবিষ্কার করল প্রথম চারটা গল্প সে আগে থেকেই জানে, কারণ সে গতরাতে স্বপ্নে এই গল্পগুলোই পড়েছে।

এটা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, বরং তাকে পাগল ভাববে – তাই জাহিদ সতর্কতার সাথে ঘটনাটা এড়িয়ে গেল, কাউকে জানাল না, এমনকি তার মাকেও না। বিকেলবেলা বইটা পিলুকে সে ফেরত দিয়ে এলো।

এদিকে জাহিদ যত বড় হতে থাকল, জিনিস-পত্র হারিয়ে ফেলাও তার তত বাড়তে থাকল। মেট্রিক পাশ করার পর সে গুরুত্বপূর্ণ সব জিনিস হারাতে থাকল, যেমন পরীক্ষার এডমিট কার্ড, মোবাইল ফোন, দামি ক্যাসিও ঘড়ি। এসব জিনিস স্বপ্নে পেয়ে লাভ নেই, এগুলো বাস্তবেই ওর দরকার, তাই ওগুলো হারিয়ে সে বিপদেই পড়ে যেত। কিন্তু এসব দুর্ভোগ সে ভাগ্য হিসেবে মেনেও নিয়েছিল।

ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় সে একজন আস্ত বন্ধুকে হারিয়ে ফেলল। মামুন ছিল তার কলেজে সবচেয়ে ভালো বন্ধু, তার সাথে হাফপ্যান্ট পরা হিন্দি ছবির নায়িকাদের নিয়েও কথা বলা হত, এমনকি মাঝে-মধ্যে ওর বাসায় লুকিয়ে নীল ছায়াছবিও দেখা যেত। সেই ছেলে একদিন কলেজে আসা বন্ধ করে দিল, কোন যোগাযোগই নেই। জাহিদ নিশ্চিত ছিল, এটা তার সেই হারিয়ে ফেলার রোগেরই অংশ। অবশ্য স্বপ্নে মামুনের সাথে তার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

বছর দুয়েক পর জাহিদ জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে সোশলজিতে ভর্তি হয়েছিল। সেকেন্ড ইয়ারে লম্বা চুল, উঁচু নাক আর টানা টানা চোখের নুসরাতের সাথে গ্রূপ স্টাডি করতে করতে, লাইব্রেরি আর ক্যাফেতে একসাথে সময় কাটাতে কাটাতে সে বুঝতে পারল – ওরা একজন আরেকজনকে খুব পছন্দ করে। জাহিদ যখন কথা বলত, নুসরাত তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসত।

সেই নুসরাতও কেন যেন একদিন ভার্সিটিতে আসা বন্ধ করে দিল। কেউ কেউ বলে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জাহিদ সেসব কথা বিশ্বাস করেনি। সে জানত এটা তার দুৰ্ভাগ্যেরই অংশ, আর তাই এটা সে ঠান্ডা মাথায় মেনে নিয়েছিল। আর যেহেতু সে জানত যে ওর স্বপ্নের পৃথিবীতে নুসরাত কোনোদিনই হারিয়ে যাবে না, তাই নুসরাতের বিয়ে কিংবা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে ওর খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না।

জাহিদ কিন্তু আসলেও মামুন আর নুসরাতকে প্রায়ই দেখতে পেত তার ধারাবাহিক স্বপ্নগুলোতে, কখনো কখনো দুজনকে একই স্বপ্নে। সে তখন ওই স্বপ্ন নিয়েই সুখী হওয়ার চেষ্টা করত – “স্বপন যদি মধুর এমন, হোক সে মিছে কল্পনা, জাগিও না আমায় জাগিও না”। এভাবেই জাহিদের দিনকাল চলে যাচ্ছিল, কিন্তু একসময় ওর জীবন ঠিকই অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করল।

রুমানার সাথে বিয়ে হবার তিন মাসের মাথায় জাহিদ ওর বাবাকে হারাল, বনানী গোরস্থানে মজিদ সাহেবকে দাফন করা হল। মারা যাওয়ার চতুর্থ আর পঞ্চম দিন সে তার বাবাকে স্বপ্নে দেখল, পর পর দুইদিন দেখল, হুবহু একই স্বপ্ন – উনি যেন একটা জ্বলজ্বলে সাদা চাদর পরা, কিন্তু ডান পায়ের কাছটা হাঁটুর ওপর পর্যন্ত উঠে আছে, বেআব্রু সেই পা পুরো দৃশ্যটার সাথে বেমানান লাগছে, উনি বারবার সে পা ঢাকার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। জাহিদ স্বপ্নটা নিয়ে চিন্তায় পরে গেল, কারণ যে জানে তার স্বপ্ন অন্য সবার স্বপ্নে থেকে আলাদা।

শুক্রবার বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে জাহিদ বাবার কবর জিয়ারত করতে গেল। ওর বাবার কবরটা সীমানা দেয়ালের একদম কাছে ছিল, একটা বড়ই গাছের আড়ালে, ফলে দূর থেকে সরাসরি কবরটা দেখা যায় না। কাছে গিয়ে কিন্তু জাহিদকে থমকে দাঁড়াতে হল – কবরের পায়ের দিকটায় ডানদিকের অংশে মাটি একদম সরে গেছে আর বাঁশের অস্থায়ী চাটাইটাও বের হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন ঢাকায় অনেক বৃষ্টি হচ্ছে, এটাই হয়তো মাটি সরে যাওয়ার কারণ।

জাহিদ সাথে সাথে লোক ডেকে মাটি ভরাট করার ব্যবস্থা করে তারপর বাসায় ফিরল। সে রাতে সে আর বাবাকে স্বপ্নে দেখল না। রুমানা ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলল – স্বপ্নের সময় মানুষের আত্মা শরীর থেকে বের হয়ে যায়, তার মানে এটা খুবই সম্ভব যে জাহিদের সাথে সত্যি সত্যিই তার বাবার আত্মার যোগাযোগ হয়েছিল, আর এভাবেই উনি তাকে কবরের দুরবস্থার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

‘ঘুম আর মৃত্যু ভাই-বোনের মত, তফাৎ শুধু এই – মৃত্যুর পর আত্মা শরীরে ফিরে আসে না, কিন্তু ঘুম ভেঙে গেলে আত্মা শরীরে ফিরে আসে।’ – রুমানা বলেছিল।  সেই সময় রুমানার সাথে ওর দিনগুলো ছিল স্বাভাবিক, অন্য দশটা জুটির মতোই ওরা হাসি আর অভিমান মিশিয়ে দিন কাটাতো।

এরপর বহুদিন চলে গেছে, তবু জাহিদের মনে হয় এইতো সেদিনের কথা ওগুলো। রুমানা ছিল ছোট-খাটো মিষ্টি চেহারার একটা দারুন মেয়ে। ওদের ছিল প্রেমের বিয়ে, কিন্তু বিয়ের আগে জাহিদ রুমানার একটা সমস্যা ধরতে পারেনি। অবশ্য সমস্যা তো ওর নিজেরও ছিল।

বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যে জাহিদ লক্ষ্য করেছিল, রুমানা ওর ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করে – বিশেষ করে সে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর। প্রথম প্রথম এটাকে জাহিদ তেমন একটা গুরুত্ব দেয় নি, কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে সমস্যাটা ততই বেড়ে গেছে। একসময় দেখা গেল, রুমানা অফিসের সময়টাতে প্রতি ঘন্টায় অন্তত একবার কল করে, প্রায়ই আবার সেগুলো ভিডিও কল – যেন সে দেখতে পারে জাহিদ কোথায় কিভাবে আছে।

জাহিদ খুব চুপচাপ ধরণের লোক ছিল, যেরকম প্রযুক্তির লাইনের লোকেরা হয় সাধারণত।  কোনোদিন রোমান্টিক কথা বলা, অতর্কিতে বাসায় ফুল নিয়ে উপস্থিত হওয়া, কক্সবাজারের টিকিট কিনে সারপ্রাইজ দেয়া – এসব ওর মধ্যে ছিল না। হতেও পারে, এগুলোর ফলে রুমানার মনে ধারণা তৈরী হয়েছিল যে জাহিদ তার প্রতি মনোযোগী না। কিন্তু বিয়ের সাত বছরের মাথায় সমস্যাটা ভীষণ প্রকটই হয়ে দাঁড়াল। ততদিনে ওদের একটা মেয়ে হয়েছে, অনন্যার বয়স চারও হয়ে গেছে।

ওই সময়টা নিছক সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে রুমানা চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘর-বাড়ি মাথায় তুলত। নানা রকম সন্দেহ – নিজের বোনকে নিয়ে সন্দেহ, বান্ধবীকে নিয়ে সন্দেহ, এমনকি কাজের মেয়েকে নিয়েও সন্দেহ।

‘শালীর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে খুব মজা লাগে, তাই না? আমাকে খাওয়া শেষ, তাই ফ্রেশ জিনিসে হাত বাড়িয়েছো?’

‘তুমি যে ঐদিন ঝর্ণার বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলে, সেটা কিন্তু আমি ঠিকই দেখেছি।’

‘মিতা ভাবীর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই দেখছি তুমি রবীন্দ্রসংগীত শুনছো, সমস্যা কি?’

এরকম আরো কত কথা আর অসন্তোষ! কোন কোন অভিযোগের ইঙ্গিত ছিল ওদের নিয়ে বিছানায় শোয়ার দিকে।

আসলে কিন্তু এ অভিযোগগুলি ছিল একেবারেই ভিত্তিহীন, শুধুই দুয়ে দুয়ে চার মেলানো কল্পনা। কিন্তু তিনে আর একেও যে চার হতে পারে, এটা বোধহয় রুমানার মাথায় একেবারেই ছিল না।

আবার কোন কোন দিন চীৎকার করে করে একসময় যখন রুমানার মাথা ঠান্ডা হয়ে যেত, তখন তার মত ভালো মানুষ আর হয়ই না। জাহিদকে সে তখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, গালে চুমু দিয়ে দিতো – কিন্তু জাহিদ তখন আস্তে করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেত, মোড়ের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে তারপরই শুধু সে বাসায় ফিরতে পারত।

দিনের পর দিন এসব ঘটেছে, জাহিদের অনেকবারই মনে হয়েছে সে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যায়, কিন্তু যেতে পারে নি – যেতে পারে নি অনন্যার কথা চিন্তা করে। ছোট একটা মেয়ে, বাবা-মা আলাদা হয়ে গেলে কি ভীষণ কষ্টটাই না সে পাবে! আর আইন-আদালত করলে যদি আবার ওরা মেয়েকে চিরতরে মায়ের কাছে দিয়ে দেয়!

কিন্তু দিন সবসময় একরকম যায় না। আর মানুষের মন খুব বিচিত্র একটা জায়গা, সেখানে প্রতারণার সন্দেহ থেকেই কখনো কখনো প্রতারণার ঘটনার জন্ম হতে পারে – যদিও তখন এ তথ্যটা জাহিদ কিংবা রুমানা কারোই জানা ছিল না।

জাহিদ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে আইটি ম্যানেজার ছিল। পাশ করার পর থেকেই সে এই প্রতিষ্ঠানের সাথে আছে। আর বীথি সেখানে তিন-চার মাস আগে জয়েন করেছে ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে। কমবয়সী একটা মেয়ে, মাত্র পাশ করে বের হয়েছে – বেশি হলে পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে বয়স, মাঝারি উচ্চতা, বড় বড় চোখ, পাতলা গোলাপি ঠোঁট। শিক্ষিত-ভদ্র পরিবারের মেয়ে, খুব শার্প। মাঝে-মধ্যে কাজের পর এটা-ওটা বুঝতে জাহিদের কাছে আসতো।

জাহিদ ওকে সহকর্মীর বেশি কখনোই কিছু ভাবে নি, কিন্তু সমস্যা শুরু হল যখন রুমানা এক রোববার বিকেলে অফিসের গ্রূপ ছবিতে বিথীকে দেখে ফেলল। এর পর থেকে সে মেয়েটাকে নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করল।

‘এই চেংড়িটা কে? তোমার পাশে কেন দাঁড়ানো?’

‘এজন্যই আজকাল আর বাসায় আসতে ভালো লাগে, তাই না?’

‘ঐগুলি করার জন্য তোমরা কোন হোটেলে রুম ভাড়া কর?’

রুমানার এসব প্রশ্ন দিন দিন বেড়েই চলছিল।

রুমানা যখন এগুলি নিয়ে কথা বলত, জাহিদ প্রথম কিছুক্ষন চুপ করে সব শুনতো, কোন উত্তর দিতো না। তারপর একসময় যখন প্রশ্নের ধার বেড়ে যেত – অনেকটা আদালতের জেরার মত – তখন সে উঠে দাঁড়াতো, হাতের কাছে যা পেতো তাই ছুড়ে মারতো চারিদিকে – বসার টুল, জুতা, কাঁচের অ্যাশট্রে, সবকিছু। তখন রুমানা শুরু করতো চিৎকার আর অভিশাপ দেয়া। অনন্যা এসময় দরজার লাল পর্দাটা ধরে ওদের দুজনের কান্ড দেখত, আর মাঝে মাঝে কেঁদে দিত।

একবার জাহিদের ছুড়ে মারা গ্লাসের কোনা লেগে অনন্যার পা কেটে গেল। সেই শনিবার সকালে হতভম্ব জাহিদ নিজেই মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, কাটা জায়গায় তিনটা সিলাই লাগল, তার ওপর ব্যান্ডেজ। ওরা বাসায় ফেরার পর রুমানা মেয়েকে নিয়ে সাভারে ওর বাবার বাসায় চলে গেল। সে রাতটা জাহিদের নির্ঘুমই কাটল।

পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পর যে ব্যাপারটা ঘটল, সেটার জন্য জাহিদ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত জাহিদ যখন অফিসে ঢুকছে, তখন বীথি তার কিউবিকলে বসে কার সাথে যেন কথা বলছিল। এই সেই মেয়ে, যাকে ঘিরে রুমানা ওকে নিয়ে সন্দেহ করে ! এই সেই সহকর্মিনী, যাকে নিয়ে ওর ঘরে এতো অশান্তি যে প্রতিদিন বাসায় ওকে নিয়ে ভয়াবহ ভাঙচুর পর্যন্ত হয় ! কিন্তু ও কেন এই মেয়ের সাথে প্রেম করবে? কি আছে ওর মধ্যে? নাকি এরকম প্রেম আসলেও সম্ভব?

জাহিদ ঘুম ঘুম চোখে আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকাল। বীথি সেদিন একটা ফিরোজা রঙের শাড়ি পরে অফিসে এসেছিল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। জাহিদ নিজেও জানে না, কতক্ষন ওর দিকে সে তাকিয়ে ছিল – অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই শুধু সে চোখ সরিয়ে নিতে পেরেছিল। কেন এরকম হল, জাহিদ সেটা বুঝতে পারছিল না।

ঐদিনের পর থেকে জাহিদ লক্ষ্য করতে শুরু করল, একটু বাচ্চা বাচ্চা চেহারা হলেও আটোসাটো পোশাকে কেন যেন বীথিকে খুব আকর্ষণীয় লাগে দেখতে। এমনিতে জাহিদ যে মেয়ে দেখলেই যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, তা কিন্তু না। বরং অমিশুক হিসেবে তার বদনাম আছে, সে মানুষ-জন পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে, মেয়েদের আরো বেশি। অথচ বীথিকে দেখে কেন যেন মনে হত, এই মেয়েটাকে ওর চাইই চাই। ভয়াবহ একটা আকর্ষণ ছিল এটা, যেন ওকে না পেলে জাহিদের জীবনটাই অর্থহীন হয়ে যাবে।

ওর এই দুর্বার আগ্রহ খুব দ্রুতই একটা প্রচন্ড নেশায় পরিণত হল। জাহিদের চিন্তা ছিল পরিষ্কার – কাজের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ আছে, কিন্তু মনের ওপর তো কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। ওর মন যদি অন্যায় কোন চিন্তা করে, খারাপ কোন কিছু চায় – সেক্ষেত্রে সে কি করতে পারে! মনের ওপর তো জোর খাটানো যায় না।

একপর্যায়ে জাহিদ আড়াল থেকে মেয়েটাকে লক্ষ্য করা শুরু করল, এমনকি একদিন তার রিক্সা ফলো করে তার বাসা পর্যন্ত চলে গেল। এগুলো জাহিদের কাজ-কর্মেও যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এগুলিতে সে নিজের বিবেকের কোন দংশন অনুভব করত না – জাহিদের শুধু মনে হত, ওর এ চাওয়ায় অন্যায় কিছু নেই।

তারপর একদিন ও এমন একটা কাজ করল, যা করবে বলে কোনদিন সে কল্পনাও করে নি – পরিচিত একটা দোকান থেকে সে কিছু ঘুমের ওষুধ কিনে আনল, বিথীকে এই ওষুধ সে খাওয়াবে।  ওরা বলল, এটা বেশি পরিমাণে খেলে মানুষ অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। ওষুধটা সে যত্ন করে ড্রয়ারে রেখে দিল, তারপর ইন্টারকমে বিথীকে ফোন করল।

স্বাভাবিক কুশল বিনিময়ের পর সে বিথীকে তার রুমে আসতে বলল, বলল যে তার পাসওয়ার্ড নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে আর সেটা সার্ভারে বসেই ঠিক করতে হবে। মেয়েটা বলল যে সে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। জাহিদ তখন পিয়ন স্বপনকে দুই কাপ চা দিতে বলে দুরু দুরু বুকে বিথীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

ঘড়িতে তখন প্রায় সাতটা। বীথি প্রায়ই সন্ধ্যার পর কাজ করত, দেরি করে বাসায় যেত। অফিসে সে সন্ধ্যায় জাহিদ আর বীথি ছাড়া আর কেউ ছিল না, সবাই ততক্ষনে বাসায় চলে গেছে। সে সন্ধ্যায় জাহিদের নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না, সে ভাবছিল – আগে ওষুধ খাইয়ে ওকে অজ্ঞান করা যাক, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।

রুমে বীথি এলে পর জাহিদ ওকে চায়ের দুটা কাপের মধ্যে একটা এগিয়ে দিল। বীথি বলল সে চা খাবে না, কিন্তু জাহিদ বলল – এটা টেকনিক্যাল সমস্যা, সময় লাগতে পারে। তখন বীথি চা খেতে রাজী হল।

ওর একাউন্টটা ওপেন করে জাহিদ বীথিকে মনিটরে বসতে বলল, আর নিজে এসে বসল টেবিলের এপাশে। মেয়েটা যখন পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করতে শুরু করল, তখন জাহিদ তার কাপে বেশ কয়েকটা ট্যাবলেট মিশিয়ে দিল।

বীথি যখন ওর একাউন্টে করছিল, জাহিদ তার চায়ের কাপটাতে চুমুক দিচ্ছিল, আর বার বার মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিল – অন্যান্য দিনের মতই সেদিন সে টাইট একটা ড্রেস পরেছিল, জায়গায় জায়গায় সেটা তার চমৎকার শরীরটাকে জাপটে ধরে ছিল। জাহিদের মনে হচ্ছিল – ওকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলেও ওর জীবন ধন্য হয়ে যাবে। সে যেন ওই সন্ধ্যায় অন্য কোন মানুষ হয়ে গিয়েছিল।

জাহিদ যখন চোখ দিয়ে বীথির ঘাড়-পিঠ-চুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরীক্ষা করছিল, ঠিক তখনি ফোনটা বেজে উঠল। জাহিদ তাকিয়ে দেখে বাসা থেকে ফোন। মনে মনে রুমানাকে একটা গালি দিয়ে সে ফোনটা কেটে দিল। আবার ফোন। জাহিদ বুঝতে পারছিল না কি করবে, এই ফোন তো তার পরিকল্পনার অংশ ছিল না। ধরবে না ধরবে না করেও শেষ পর্যন্ত সে ফোনটা ধরল, রুমানাকে কিছু একটা বলে শান্ত করতে হবে।

ফোনটা কিন্তু অনন্যা করেছিল – ‘বাবা, তুমি আসার সময় আমার জন্য একটা শার্পনার কিনে আনতে পারবে?’

‘ঠিক আছে, আনব।’ – জাহিদ তাড়াহুড়ো করে বলেছিল।

‘বাবা তুমি কখন আসবে? আমার তো হোমওয়ার্ক করতে হবে।’

‘আসবো। তুমি এখন ফোন রাখো।’

ফোন কেটে দিয়ে জাহিদ বীথির দিকে তাকাল, আর তখনি অলৌকিক একটা কিছু ঘটে গেল। নিশ্চয়ই ওর মন ওর সাথে কোন খেলা খেলছিল, কিংবা হয়তো সে ভুল কাপ থেকেই চা খেয়ে ফেলছিল অর্থাৎ নার্ভাস হওয়ার কারণে হয়তো কাপ দুটোর জায়গা অদল-বদলই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে যেন দেখতে পেল বীথির বয়স কমে যাচ্ছে।

জাহিদ বুঝতে পারছিল না তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কিনা – কিন্তু যে যেন দেখতে পেল, বীথির বয়স কমতে কমতে ও একসময় স্কুলে যাওয়া একটা মেয়ের মত হয়ে গেল। জাহিদ প্রায় বিষম খেলাম, কারণ বীথিকে দেখতে তখন ঠিক যেন অনন্যার মতোই লাগছিল – হ্যা, অনন্যা, জাহিদের নিজের মেয়ে অনন্যা, সেই অনন্যা যে কিনা দিন দিন বড় হয়ে উঠছে। ওর একসময় এমনও মনে হল যে অনন্যাই ওর সামনে বসে কম্পিউটারে কাজ করছে।

ঠিক তখন জাহিদের মাথার মধ্যে কি যেন একটা ঘটল – এটা সাহসের অভাব না, এটা কোন ভয় বা আশংকা না, কেমন যেন প্রচন্ড মন খারাপ করা একটা অনুভূতি। ওর মনে হল, মেয়েটাকে সে কি আসলেও এভাবে চায়? আর মেয়েটাই বা কি কারণে জাহিদকে তার জীবনে চাইবে? জাহিদ একজন বিবাহিত পুরুষ, বীথির নিজেরও সম্ভবত একটা অ্যাফেয়ার আছে। জাহিদ কোন ক্ষমতাধর লোক না, কোন আকর্ষনীয় চরিত্রও না – এমন কোনকিছুই জাহিদের মধ্যে নেই যে কারণে বীথি তার সাথে প্রেম করতে চাইতে পারে। জাহিদ মূর্তির মত বসে ছিল বীথির সামনে।

পাসওয়ার্ড চেঞ্জ হয়ে গেলে বীথি ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাসল। জাহিদের মনে হল এতো নির্মল হাসি সে অনেকদিন কারো চেহারায় দেখেনি। কিন্তু তখনি আবার সে লক্ষ্য করল মেয়েটা চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়িয়েছে।

জাহিদ চট করে উঠে দাঁড়াল, হাত উঠিয়ে বিথীকে থামতে ইঙ্গিত দিল, তারপর বলল – ‘এটা খেয়োনা।’ বীথির চোখে প্রশ্ন দেখে সে যোগ করল – ‘আজকের চা-টা কেমন যেন, আমার ভালো লাগে নি। তোমাকে আরেকদিন খাওয়াবো।’ তখন মেয়েটা হেসে ফেলল, ও তো এমনিতেও প্রথমে চা খেতে চায় নি।

ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে জাহিদ আবার নিজের জায়গায় এসে বসল। ওর খুব ক্লান্ত লাগছিল। সেদিন সে আর কোন কাজই করতে পারল না, রাতে বাসায় ফিরল প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে। রুমানা ওকে দেখে অবাক হল, কিন্তু কিছু বলল না। সারা সন্ধ্যা জাহিদ চুপচাপ ড্রইংরুমে বসে রইল আর টিভিতে একটার পর একটা চ্যানেল ঘোরাল। রাতে বিছানায় যেয়ে রুমানাকে চেপে ধরল, কিন্তু ওর মনে হল ও যেন একটা প্রাণহীন বালিশকে ধরে চাপাচাপি করছে।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল জাহিদ, তারপর একসময় ঘুমিয়ে গেল। ঘুমিয়ে সে বিথীকে স্বপ্নে দেখল, যেন সুন্দর করে সাজানো একটা ড্রইং রুমে বসে সে মেয়েটার  সাথে গল্প করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেও সে স্বপ্নের রেশ লেগে থাকল জাহিদের মনে, যেন সত্যি সত্যিই জাহিদ বীথির সাথে কোথাও গল্প করছিল।

বিথীকে নিয়ে আসল ঘটনা কিন্তু তখনো শুরুই হয় নি জাহিদের জীবনে।

বিথীকে নিয়ে জাহিদের স্বপ্ন দেখার সেটা কেবলি শুরু। এরপর বহুবার সে বিথীকে স্বপ্নে দেখেছে, বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিন। কিন্তু সেগুলোকে সে তেমন গুরুত্ব দেয় নি, সে ভেবেছে মনের অপূর্ণ ইচ্ছা থেকে এসব দেখেছে। কিন্তু যেদিন অফিসের আরো কয়জন কলিগের সাথে বীথির বাসায় দাওয়াতে গেল, সেদিন ওখানে একটা জিনিস দেখে সে বেশ অবাক হল। চিনামাটির নীল-সাদা একটা ফুলদানি, হুবহু এই জিনিসটা জাহিদ ওর স্বপ্নগুলোতেও দেখেছে।

বিথীদের ড্রইংরুমটা জাহিদ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল। ঘরটার সবকিছু খুব চেনা চেনা লাগছিল – অথচ জাহিদ এই ড্রইংরুম আগে কখনো দেখিনি, এমনকি কোন ছবিতেও না। একসময় সে বুঝতে পারল, স্বপ্নে আসলে সে ঠিক এই ড্রইংরুমটাই দেখেছিল – সেই বড় ফুলদানি, সেই জলরং করা গ্রামের রাস্তার পেইন্টিং, সেই সাদা সোফা আর কাঁচের সেন্টার টেবিল, দুপাশে মানুষ সাইজের দুটা গোলাপি আলোর ল্যাম্প। কিন্তু যে বাসায় জীবনে কোনদিন সে আসেনি, সেই বাসা সে হুবহু একইরকমভাবে কিভাবে দেখল তার স্বপ্নে?

আরেকদিন স্বপ্নে বিথীর কাছে তার একটা গোপন কথা জেনেছিল জাহিদ – মেয়েটা নাকি ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পিঠে ব্যথা পেয়েছিল, পিঠে এখনো একটা দাগ রয়ে গেছে। পরদিন অফিসে যাবার পর কথায় কথায় বিথীর কাছে জানতে সে জানতে চেয়েছিল, বীথি সত্যিই ছোটবেলায় কখনো গাছ থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছিল কিনা।

উত্তরে বীথি বলল – সে আসলেও এরকম একটা ব্যথা পেয়েছিল, এমনকি তার পিঠে এখনো এর দাগ রয়ে গেছে। ও জানতে চাইল – জাহিদ এটা কি করে জানল। জাহিদ হেসে বলেছিল – সে এটা ‘স্বপ্নযোগে’ এটা জেনেছে। ওর উত্তর শুনে বীথি খুব হেসে উঠেছিল।

আজ পর্যন্ত স্বপ্নগুলোর কোন ব্যাখ্যা জাহিদ খুঁজে পায় নি। তবে এক বুধবার বিকেলে সে বাসায় ফিরে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখল। জাহিদের মনে পড়ল, বিথীকে নিয়ে যে স্বপ্নগুলো সে এতোদিন ধরে দেখেছে, সেগুলোর মধ্যে পরিষ্কার একটা ধারাবাহিকতা আছে। যেমন, প্রথমদিন স্বপ্নে দেখেছিল ড্রইংরুমে বিথীর সাথে বসে গল্প করছে। পরেরবার দেখল, যেন কোথাও বেড়াতে গেছে – ঢাকার বাইরে কোথাও, কোন একটা গ্রূপের সাথে। তারপর মাস তিনেক পরের একটা স্বপ্নে ওরা দুজন যেন কোন একটা বাসায় একা – একটা সোফাতে পাশাপাশি হাত ধরে বসে। যেন একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, দিন-ক্ষণ হিসাব করে করে।

এরপর থেকে তো জাহিদ প্রতিদিন ওকে স্বপ্ন দেখে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম – জাহিদ রাতে কাজ সেরে বাসায় এসে শুয়ে পড়ে, আর তখন ঘুমানোর পরই ওর আরেকটা জীবন শুরু হয়ে যায়। আর জাহিদের সে জীবনটাও কিন্তু খুব স্পষ্ট ধরণের স্মৃতির তৈরী – সেখানে পরিষ্কার ঘটনা আছে, সেখানে জাহিদের একটা চাকরী আছে, বাসা আছে। একেকদিন একেক বাসা না, যেরকম সাধারণ স্বপ্নে ঘটে থাকে। এ স্বপ্নগুলোতে জাহিদের বাসাটা প্রতিদিন একই বাসা। বাসার জন্য আজ রাতে যদি একটা টবের গাছ কিনে আনে, পরেরদিনের স্বপ্নে সেটাকে সে সেই স্বপ্নের বাসাটার কোথাও না কোথাও সাজানো দেখতে পায়। ঘটনাগুলো সব একের পর এক ঘটছে, যেন আরেকটা জীবন জাহিদের – অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।

রোকন হুজুর ছিলেন জাহিদদের পারিবারিক বন্ধু, তাহাজ্জুদের নামাজ পরে পরিচিতদের সবার নাম ধরে ধরে দোয়া করা ছিল তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। জাহিদের স্বপ্নের কথা শুনে তিনি বললেন – এই দুনিয়াটাই তো নকল, মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা আসল দুনিয়ায় জেগে উঠতে পারব। যেখানে আমাদের যাত্রা হওয়া উচিত নকল থেকে আসলের দিকে, সেখানে উল্টো আরো অবাস্তব স্বপ্নের নেশায় জড়ানো খুব ভুল কাজ হবে, পরকালের থেকে মনোযোগ আরো দূরে সরিয়ে নেয়া হবে। রোকনউদ্দিন জাহিদকে উপদেশ দিলেন স্রষ্টার কাছে অন্তর থেকে সাহায্য চাওয়ার জন্য।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স পড়ায় জাহিদের বন্ধু সৌমিক। সে জাহিদের ঘটনা শুনে বলেছিল – প্যারালেল ইউনিভার্স বলে একটা ধারণা বিজ্ঞানের দর্শনে আছে, অর্থাৎ পাশাপাশি বয়ে চলেছে একইরকম কিছু ইউনিভার্স। ইউনিভার্সগুলো একটা আরেকটার হুবহু প্রতিচ্ছবি যেন, শুধু কিছু ছোটখাটো বিষয়ের দিক দিয়ে এরা আলাদা। যেমন এই ইউনিভার্সে জাহিদ আইটিতে সফল এক পেশাজীবী, অন্য ইউনিভার্সে হয়তো সে এই একই ঢাকা শহরে একজন ব্যর্থ সংগীতশিল্পী বা হারিয়ে যাওয়া নেশাখোর কোন যুবক।

এসিস্টেন্ট প্রফেসর সৌমিক কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল – হতেও পারে, মনের জোরের কারণে মানুষের আত্মা এক ইউনিভার্স থেকে পাশের আরেক ইউনিভার্সে চলে যেতে পারে। হয়তো আমাদের আত্মা একটাই, কিন্তু জীবন অনেকগুলো – যাদের মনের শক্তি খুব বেশি, তাদের আত্মাই শুধু বিফলতার ইউনিভার্স ত্যাগ করে চলে যেতে পারে ব্যক্তিগত সফলতার অন্য এক ইউনিভার্সে।

বিয়ের পনরো বছরের মাথায় জাহিদ আর রুমানার মধ্যে দ্বন্দ চরমে উঠল। ওরা ততদিনে একই বাসায় কিন্তু আলাদা ঘরে থাকতে শুরু করেছে। জাহিদের কাজ ছিল শুধু রুমানার ধরিয়ে দেয়া ফর্দ অনুযায়ী বাজার করা, আর রুমানার কাজ ছিল রান্না করে ফ্রিজে রেখে দেয়া। এ ব্যাপারে অদৃশ্য একটা বোঝা-পরা যেন হয়ে গিয়েছিল ওদের দুজনের মধ্যে। অনন্যা তখন ক্লাস সেভেনে কেবল উঠেছে।

এসবের মধ্যেও জাহিদ তার ধারাবাহিক স্বপ্নে বিথীকে দেখে যাচ্ছিল, এমনকি সেই অন্য পৃথিবীতে এক শুক্রবার সন্ধ্যায় বীথির সাথে তার এনগেজমেন্টও হয়ে গেল।  এই স্বপ্নগুলোর কারণেই রুমানার সাথে সমস্ত ঝগড়া-ঝাটির পরও জাহিদ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন বলে মনে করতো। ওর শুধু একটাই ভয় ছিল, যদি স্বপ্নটা কোনদিন শেষ হয়ে যায়!

এভাবেই ওর দিনকাল চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এক মঙ্গলবার রাতে সবকিছু চিরদিনের জন্য বদলে গেল ওদের তিনজনের জন্যই।

সে সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়ার পর জাহিদ অনন্যাকে হোমওয়ার্ক দেখাচ্ছিল, ডাইনিং টেবিলে। হঠাৎই কি হল, রুমানা ঘরে ঢুকে জানতে চাইল সিংকে প্লেটগুলো কেন পড়ে আছে। জাহিদ বলতে চেষ্টা করল, সে হোমওয়ার্কগুলো দেখিয়ে দিয়ে তারপর সেগুলো ধুয়ে ফেলবে, কিন্তু রুমানার চিৎকারের কারণে কিছুই বলতে পারল না। এদিকে রুমানার অভিযোগের ধারা দ্রুতই বর্তমানের সমস্যা থেকে অতীতের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দিকে ঘুরে গেল।

প্রায় বিশ মিনিটের মত রুমানা একটানা চিৎকার করল, হতে পারে সেদিন তার ব্লাড প্রেশার বেশি ছিল তাই সে বুঝতেও পারে নি যে সে বার বার একই কথা বলে চলেছে। কিন্তু শেষে সে যখন মেয়ের সামনে বলে বসল জাহিদ কাজের মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, তখন জাহিদ ঝট করে উঠে দাঁড়াল, সেসময় ওর চেয়ারটা পেছনে ছিটকে পড়ল।

জাহিদ গেস্টরুমের দিকে যেতে শুরু করল, যেখানে সে রাতে ঘুমাতো। যেতে যেতে সে বলল আজ সে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিবে, আর তাতে রুমানা সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। ওই ঘরে জাহিদ সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচ রাখে। সে কি সত্যিই ওই দেয়াশলাই আনতেই ঘরে গেল?

জাহিদ ওর রুমে ঢুকতেই রুমানা দৌড়ে গিয়ে ওই ঘরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল, তারপর ওটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিল। নিজ ঘরে বন্দি জাহিদ তখন ভেতর থেকে এত জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল, যেন ভেঙেই ফেলবে। শেষে সে বলল, সে নিজের ঘরেই আগুন লাগিয়ে দিয়ে আজ আত্মহত্যা করবে। কিন্তু রুমানা কোন ঝুঁকি নিতে চাইল না, সে বরং স্টোর থেকে একটা তালা এনে দরজাটায় লাগিয়ে দিল যেন অনন্যা রাতে বাবাকে দরজা খুলে দিতে না পারে। কিছুক্ষন পর জাহিদের রুমে আর কোন আওয়াজ পাওয়া গেল না। সবকিছু চুপ চাপ।

পরদিন ছিল মেঘলা একটা দিন। ঘোলাটে আলোর সে সকালে রুমানা ভয়ে ভয়ে জাহিদের ঘরের তালা খুলল, তারপর দরজা অল্প একটু ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করল ভেতরে জাহিদ কি করছে, কিন্তু প্রথমে সে কিছুই দেখতে পেল না ফলে দরজা সে আরেকটু খুলল। ওর পেছনে তখন অনন্যা, গতরাতের ঘটনার পর সে আজ স্কুলে যায় নি।

দরজা পুরো খুলে ফেলার পরও জাহিদকে দেখা গেল না। রুমানা ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে চারিদিকে তাকাল, কোথাও জাহিদ নেই। সে কাঠের বাদামি রঙের আলমারিটার দরজা খুলে দেখল, যদিও সে জানত ওখানে জাহিদের লুকিয়ে থাকার কোন উপায় নেই। ঘরে সত্যিই জাহিদ নেই। কিন্তু ওর তো পালানোর কোন উপায় নেই, কারণ দরজা বাইরে থেকে বন্ধ, আর জানলায়ও গ্রিল দেয়া।

সেই যে জাহিদ উধাও হয়ে গেল, আজ পর্যন্ত কেউ তাকে আর খুঁজে পায় নি। চব্বিশ ঘন্টা পর পুলিশকে জানানো হয়েছিল, থানায় ডাইরি করা হয়েছিল। কিন্তু কোন কিছুতে কোন লাভ হয় নি। ঢাকার একটা অনলাইন ম্যাগাজিনে জাহিদের ঘটনা নিয়ে একটি ছোট-খাটো প্রতিবেদনও হয়েছিল, কিন্তু আস্ত একটা মানুষ কি করে শূন্যে মিলিয়ে গেল সেই ধাঁধা আজ পর্যন্ত কেউ সমাধান করতে পারে নি।

ওর বন্ধুরা অবশ্য বলাবলি করত যে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। রুমানা হয়তো একা একাই বরং ভালো থাকতে পারবে। মাত্র হাই স্কুল শুরু করা একটা মেয়েকেও আর বাবা-মায়ের কুৎসিত ঝগড়া দেখতে হবে না প্রতিদিন। এটা একেবারে মন্দ কিছু না।

জাহিদের ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই থেকে গেছে। পুলিশ বলে, কেউ রাতে লুকিয়ে ওর দরজার তালা খুলে দিয়েছিল, যদিও এরা বলতে পারে নি যে এরপর লোকটা তাহলে কোথায় গেল। রোকন হুজুর বলে, খোদার নাম নিয়ে দরজা-জানলা বন্ধ না করলে জীন-পরী বন্ধ ঘর থেকেও মানুষকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। জাহিদ যাকে স্বপ্নে দেখতো, সে আসলে বীথির রূপ ধরে আসা কোন খন্নাসি, যার খপ্পরে জাহিদ পড়েছিল কিন্তু আর বের হতে পারে নি।

জাহিদের অন্তর্ধানের যেদিন এক বছর পূর্তি হল সেই দিন বিকেলে আইজাক সিঙ্গারের রহস্য গল্পের বইটা খুঁজতে গিয়ে অনন্যা ওই গেস্টরুমে জাহিদের গলার স্বর শুনতে পেয়েছিল। ওর মনে হচ্ছিল জাহিদ অনেক দূরে কোথাও কথা বলছে, শব্দটা খুব ক্ষীণ ছিল কিন্তু অনন্যা নিশ্চিত ছিল ওটা ওর বাবারই কণ্ঠস্বর ছিল। অনন্যা যখন মাকে ডেকে আনল, ততক্ষনে অবশ্য শব্দের উৎসটা বিলীন হয়ে গেছে, ঠিক যেভাবে এক বছর আগে ওর বাবা উধাও হয়ে গিয়েছিল ঠিক এই গেস্টরুম থেকেই।

সেই অপার্থিব কণ্ঠস্বর শোনার পর অনন্যা কিন্তু একদম মন খারাপ করেনি, কেননা কথার সাথে সাথে ওর বাবার হাসিও নাকি সে শুনতে পেয়েছিল। সে বোধ হয় ধরেই নিয়েছিল সে তার বাবা কোথাও না কোথাও সুখে-শান্তিতে আছে। অনন্যা দাবি করে, এখনো খুব একা একা কোন দিনে সে মন খারাপ করে বসে থাকলে সে টের পায় কেউ ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যেন ওকে সাহস দেয়ার জন্যই। তখন ওর মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।

এদিকে জাহিদই কিন্তু ইতিহাসে প্রথম ব্যাক্তি না যে শূন্যে মিলিয়ে গেছে। ১৮৮০ সালে ডেভিড লাঙ্গ নাম এক আমেরিকান কৃষক তার স্ত্রী-কন্যা আর দুইজন ঘোড়সওয়ারের চোখের সামনে উধাও হয়ে গিয়েছিল, মাঠের এক পাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে নি। হতেও পারে, পৃথিবীর কোন কোন জায়গায় হঠাৎ করেই উদয় হয় এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীতে চলে যাওয়ার দরজা, বিজ্ঞানের ভাষায় ওয়ার্মহোল। জাহিদের স্বপ্ন গুলো হয়তো এরকম মহাজাগতিক শর্টকাটেরই ইঙ্গিত ছিল।

আসলে সমাধানের অযোগ্য সমস্যার মুখোমুখি হয়ে জাহিদের মত কেউ কেউ যদি জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েই শান্তি পায়, তাহলে সমাজের অসুবিধাটা কি ! বাস্তব জীবনে নিগৃহীত হয়ে কত কবি শব্দের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে শান্তি খুঁজে পেয়েছেন ! কষ্টকে উত্তীর্ণ করে বেঁচে থাকা কত লোক ক্রিকেট খেলা দেখে আজো মুক্তির আনন্দ পায় !

এমনিতেও আমাদের এই পৃথিবীটা হয়তো ভিন্ন বাস্তবতার আরেক পৃথিবীর ছায়া মাত্র, যেমনটা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলো দাবি করে থাকে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে জাহিদের স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যাওয়াটা আসলে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা না – মহাকালের তুলনায় সত্তর বছরের প্রৌঢ়ের বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু, আর চল্লিশ বছরের যুবকের অকস্মাৎ অন্তর্ধান দুটোই সমান তুচ্ছ। আমরা শুধু এই কামনা করি – যুগে যুগে জাহিদরা শান্তিতে থাকুক, সেটা এই পৃথিবীতেই হোক কিংবা অন্য কোন অবাস্তব জগতেই হোক।

Leave a comment