###পথের খোঁজে##০৫#

আশীস কুমার মিশার প্রিয় খালাতো ভাই রাকীবের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাকীব আশীস বলতেই পাগল। মতিঝিল আইডিয়াল হাই স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে তারা প্রিয় বন্ধু। রাকীব এখন বিকম পড়ে, লেখা পড়ায় তার খুব একটা মন কখনোই ছিল না এখনও নেই। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় রাকীবের মধ্যে এক দারুন পরিবর্তন আসে। তবে সেটা হঠাৎ করে আসা পরিবর্তন নয় – খুব ধীরে ধীরে তৈরী হয়ে ওঠা এই পরিবর্তন।

আইডিয়াল স্কুলে প্রতিদিন ক্লাস শুরু হবার আগে ধর্মীয় তালিম দেয়া হোত পনের মিনিট। ধর্মীয় তালিম বলতে – ইসলামী তালিম। ভালো কথা শোনানো হোত হাদিস থেকে। রাকীব লক্ষ্য করতো – ভালো কথা অন্য ধর্মের গ্রন্থ গুলোতে থাকা সত্ত্বেও কখনো সে সব গ্রন্থ থেকে কোনও বানী শোনানো হোত না। বেচারা আশীসের জন্য মায়া হোত তার। তালিমের পুরো সময়টা আশীসের মতো অন্য যে দু চার জন ওই স্কুলে পড়তো – তাদের ভালো না লাগলেও সেগুলো শুনতে হোত – এটাই ছিল নিয়ম। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকেই রাকীব এগুলো সহ্য করতে পারতো না।। কিন্তু কিছু বলতেও পারতো না। রাকীব এটাও খুবই অপছন্দ করতো যে, একই স্কুলে শুধুমাত্র সংখ্যা লঘু হওয়ার কারনে, হিন্দু ধর্মীয় ক্লাস হোত সপ্তাহে একদিন- কখনো সেটাও হোত না; ইস্লামিয়াত ক্লাস কিন্তু প্রতিদিনই হোত। রাকীব বিশ্বাস করতো – শিক্ষার অধিকার সবার সমান – বর্ণ- লিঙ্গ এবং ধর্ম ভেদে। এগুলো নিয়ে একদিন সে তার ক্লাস টীচারকে প্রশ্ন করায় ভীষণ বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল তাকে। বেতের বাড়ি , বাবা মা কে স্কুলে তলব এবং গুড বিহেভিওর বন্ড সই পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এতসবের পরেও রাকীব তার প্রশ্নের কোনও উত্তর পায় নি স্কুল এর থেকে । যেটা পেয়েছে – সেটা হোল জবরদস্তি।

আরেকবার আইডিয়াল স্কুলের এক শিক্ষক দাবী করে বসলেন – তার কাছে গেলে তিনি মহানবী কে স্বপ্নে দেখিয়ে দিতে পারেন, বেহেস্তের বাগান দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে আসতে পারেন ইত্যাদি। তিনি ছিলেন বিজ্ঞ্যান এর টিচার কিন্তু এসব আজগুবি কীর্তি কলাপ শুরু করে দিলেন স্কুলে – প্রশাসন কিছুই বলল না তাকে । তো একদিন, রাকীব স্কুল টিফিনের সময়ে ওই শিক্ষকের এক শিস্য, নোমানকে জিজ্ঞেস করলো – সে কি কিছু দেখেছে না কি?

নোমান অতি উতসাহের সাথে হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালো। সে নবীজী কে এখনো দেখে নি , তবে বেহেস্তের বাগান দিয়ে কয়েকবার হেটে ফেলেছে।

রাকীব বলল – “ভাই আমার মনে হয় তোমার ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার -মানসিক ডাক্তার, সাথে তোমার ওই পীর বাবাকে ও । ”

নোমানঃ ” তোমার কি ধার না আমাদের মাথা খারাপ? “

রাকীবঃ ” হ্যাঁ। তোমাকে একটা খুবই সাধারন প্রশ্ন করি – লক্ষ্য করে দেখবা, মুসলমান সব সময় মুসল্মান নবীদের স্বপ্নে দেখে কখনও জিসাস – মানে ঈসা নবিকে স্বপ্নে দেখে না, কিংবা গউতম বুদ্ধ বা ঈহুদীদের নবী মুসা কে স্বপ্নে দেখে না । আবার উল্টাটাও ঠিক। আশীস কিন্তু কখনো আমাদের নবীজীকে স্বপ্নে দেখবে না সে দেখবে রাম বা কোনও সুন্দরী দেবী কে। তোমার কী মনে হয় না এই গুলা ডিলিউশন ছাড়া আর কিছু না !!! ? “

নোমানঃ ” তুমি তো ভাই আবিশ্বাসিদের মতো কথা বলতেছ। নবী আউলিয়াদের নিয়া বিদ্রূপ করার চেষ্টা চালাইতেসো। তোমার ভয়ঙ্কর শাস্তি হবে যদি তওবা না করো।”

রাকীব ঠিক বুঝে ঊঠতে পারলো না নবী আউলিয়াদের নিয়ে বিদ্রূপ সে কখন করলো । এ তো দেখি কথা না শুনে না বুঝেই উত্তর দিয়ে চলে গেলো- উত্তর ঠিক না – শাস্তির ভয় দেখিয়ে গেল। আসলে এটা তো বাংলাদেশীদের একটা কমন সমস্যা। এরা ঊত্তর দিতে পছন্দ করে, শুনতে নয়।

কলেজে ওঠার পর থেকে রাকীব হয়ে উঠলো একজন তুখোড় লেখক- ব্লগার । রাজনীতি আর ধর্মীয় উন্মাদনা বিরোধী লিখা হয়ে উঠলো তার মুল বিষয়। বক ধার্মিক গরিষ্ঠ বাংলাদেশে সে আস্তে আস্তে বেশ অপ্রিয় পাত্রে পরিনত হয়ে পড়ছিল।

কোরবানি ঈদের আগের রাতে রাকীব এসেছে মিশাদের বাসায়। একই গরু ভাগে কোরবানী দেয়া হয়েছে মিশাদের সাথে রাকীবের পরিবারের। মিশার চেয়ে বয়সে চার বছরের বড় রাকীব। রাকীবের পাগলামী মিশার বেশ পছন্দ, শুধু পছন্দ তা না – মিশার যা কিছু আপাতত ঔদ্ধত্যপূর্ণ চরিত্র তৈরী হয়েছে -সেটার পিছনে এই রাকীবের একটা দারুন ইনফ্লুয়েন্স রয়েছে , সঙ্গে মিশার বাবার সাপোর্ট । মিশার মা রাকীবকে খুব একটা পছন্দ করেন না। কবে কোন সমস্যা বাধিয়ে নিয়ে আসে এই ছেলে তার ঠিক নেই।

কিছুক্ষন পর অরেক কোরবানি দাতা – মিশার বাবার কলীগ কাজী হাশীম সাহেব এসেছেন । গরু কিনতে যাবে সবাই । মিশা গিয়ে রাকীবকে জিজ্ঞেস করলো – “রাকীব ভাই, তুমি গরু কিনতে যাবে?? হিই হিই হিই!!!”

রাকীবঃ হাসির কী হইলো ? তুই তো জানিসই আমি যাবো না।

মিশাঃ ঊই যে হাশিম চাচা আসছে, না যেয়ে পার বা না ; উনি তোমাকে জোর করে নিয়ে যাবেন

রাকীবঃ জোর করে নিয়ে যাবে কীভাবে? আমার ইচ্ছা হইলে যাবো নইলে যাবো না। আর বেশী জোর করলে এমন কিছু কথা বলব উনার সামনে , যে উনি আমাকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাক্ষান করে পালিয়ে বাঁচবেন ।

মিশাঃ খবর্দার বেয়াদপী করা চলবে না

রাকীবঃ বেয়াদবী করবো কেন ? আমি কী মূর্খ …বেয়াদবী করে তারাই .. শেষ করার আগেই মিশার বাবা, হাশিম সাহেব , সাথে আরো দু জন বেশ স্বাস্থবান হজুর চেহারার মানুষ রাকীবকে ডাকা শুরু করলেন গরু কিনতে যাবার জন্য। রাকীব অতি বিনয়ের সাথে যাবে না জানিয়ে দিল । তারাও চলে গেলেন। হাশিম সাহেব কিন্তু কোনও জড়াজুড়ি করেন নি। রাকীব মিশার দিকে তাকিয়ে হাসল।

রাকীব এবার মিশাকে বললঃ একটা নতুন লিখা দিয়েছি ব্লগে, কাল পাব্লিশ করবে।

মিশাঃ কিসের ঊপর লিখলা এবার?

রাকীবঃ মানব ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের এবং ধর্মের গড দের মাঝে মিল এবং পার্থক্য নিয়ে।

মিশাঃ বলো কী ! এদের মধ্যে পার্থক্যই তো সব, মিল কিছু আছে না কি?

রাকীবঃ মিল থাকবে না ক্যান ? এই ধর – একটা মজার মিল হচ্ছে – সকল ধর্মের গড দের একটা জিনিস চাই ই – সেটা হোল রক্ত । এক সময়ে মানুসকে বলি দেয়া হোত গড কে খুশী করতে। বিভিন্ন পশু বলী দেয়া হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই। ঈব্রাহীম নবী মানুষ বলি দেয়া বন্ধ করে চালূ করলেন পশু বলি দেয়া- যেটা ইসলামে কুরবানী দেয়া বলা হয়। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাখায় বলি দেয়ার প্রচলন আছে। – বলে না বলির পাঁঠা ?? হি হি হি । আবার যারা শয়তানের পুজারী- মানে শয়তান যাদের গড -তাদেরও কিন্তু রক্ত দিয়েই গডের মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়… মজার না!!! আরেকটা মজার সিমিলারিটী হচ্ছে – না, সব বলে দিলে পড়বি কি? পড়ে দেখিস।

মিশাঃ পড়ে দেখবো। আচ্ছা, একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। তুমি হয় তো বিষয় টা নিয়ে লিখতে পারবা ।

রাকীবঃ কি বিষয়?

মিশাঃ ব্যাভিচার খারাপ কাজ কেনো ? আমি জানি সকল ধর্মে এটা মহা পাপ, সামাজিক ভাবেও এটা খারাপ ; কিন্তু কেন? বিশেষ করে সেটা যদি উভয়পক্ষের সম্মতিতে হয়ে থাকে । তোমাকে এক্ষনি উত্তর দিতে হবে না , লেখা পড়া করে জানিও।

রাকীব হেসে বলে চললঃ শোন, মানুষের একটা খুব গুরুত্তপূর্ণ জিনিস আছে -যার নাম – ডিগনীটি; বাংলা ঠিক মনে করতে পারছি না। এখন ফীলসফীর বিভিন্ন স্কুল অফ থট এর মধ্যে আমার প্রিয় যেটা সেটা দিয়ে বলি- সেই ফিলোসফী অনুযায়ী মানুসের ডিগনীটির কারনে মানুসকে কেনা বেচা করা যাবে না , মানুসকে টুলস অফ ট্রেড বা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। কারন -মানুষ কোনও বস্তু নয় । মানুষ এর ব্যাক্তি স্বত্তা আছে, মন আছে , সম্মান বোধ আছে -ডিগনিটি আছে। শুধুমাত্র আনন্দ লাভ করার জন্য যখন মানুষ ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় – টেকনিক্যালী তখন তারা মানুসকে টুল অফ ট্রেড হিসেবে ব্যবহার করে। যখনই মানুষ মানুসকে তার প্রয়োজনের টুল হিসেবে ব্যবহার করবে , তখনই সে মানুষের ডিগনিটী কেড়ে নিচ্ছে। একই কারনে -দ্যাখ – আত্মহত্যা ইমমোরাল কাজ। কেননা , সে নিজকে- তার শরীরকে ব্যবহার করছে , কস্ট লাঘব করার জন্য । অরথাৎ তার নিজের বডী তার টুল অফ ট্রেড -আত্মহত্যা করার মধ্য দিয়ে নিজের ডিগনিটী নস্ট করে দিচ্ছে।

মিশাঃ হুম; খুবই ইন্টারেস্টিং। আবার যদি এভাবে দেখি – যে সবাই যদি ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে তো সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে ; মানুষ মানুসকে আর বিশ্বাস করবে না। সারা পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। আমার মনে হয় এ জন্যই ধর্ম গুলোতে বলে – ” অপরের প্রতি এমন আচরন করোনা যা তুমি চাও না কেউ তোমার সাথে করুক” – যাকে বলে ” দি গোল্ডেন রুল ” । তাই না ?

রাকীব একটু হেসে বলল – না , মোটেই তাই না। ” দি গোল্ডেন রুল ” এর সমস্যা হচ্ছে- এটা কন্সিকোয়েন্স বেইজড । কিন্তু মরালীটি কন্সিকোয়েন্স বেইজড হলে চলবে না। মরালীটির ব্যাপারে আমার ফিলসফীক্যাল ভিউ পয়েন্টের সাথে ধর্মের ভিঊ পন্টের এটাই মুল পার্থক্য । যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়- কন্সিকোয়েন্স যা -ই হউক না কেন? কোনো কোন দেশে এবরশন শাস্তি যোগ্য অপরাধ ।। আবার দ্যাখ – অ্যামেরিকার দিকে – বাচ্চা হৃদ যন্ত্র , মানে হার্ট বীট শুরু হবার পরও এবরশন করা যাবে – কোনও কন্সিকোয়েন্স নেই । কিন্তু আমি মনে করি এটা ইমমোরাল -কারন, ওই একটাই – মানুষ মানুষকে টুল অফ ট্রেড -হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে – তার নিজের আনন্দের স্বার্থে ।

রাকীব হটাৎ কথা ঘুরিয়ে ফেলল – আচ্ছা তোর মনির ভাইয়ের খবর কী ? এখনো যোগাযোগ আছে ?

মিশা উত্তর দেয়ার আগেই রাকীবের মোবাইল বেজে উঠলো । সে বের হয়ে গেল মিশাদের বাসা থেকে । রাকীবের এ রকম হুটহাট আচরনের সাথে মিশা আভ্যস্ত।

মিশা অনেকটা মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে রাকীবের কথা গুলো শুনছিল । মাঝে মাঝে তার একটু দুশ্চিন্তাও হয় রাকীব ভাইয়ার জন্য। বাংলাদেশ কেমন জানি আস্তে আস্তে অন্ধকার যুগের দিকে ধাবিত হচ্ছে । মিশার বাবা – জামান সাহেব ইদানিং বলেন -আমরা জাহেলিয়ার যুগে ঢুকে পড়ছি ; বড়ই অনুতাপ ও চিন্তার বিষয়।

চলবে…

পরবর্তী সংখ্যাঃ ৬/০৯/২০২০

Leave a comment