“হুজুর, এতদিন পুলাপাইন ভোলোগে লিখসে, এখন তো শুনতেসি একটা বই বাইর করসে”।
চালতা হুজুর খুব বিরক্তি ভরে জিজ্ঞেস করলেন তার প্রধান খাদেমকে –“ বইয়ের নাম কি?”
প্রধান খাদেমঃ বইয়ের নাম -ফেসবুক।নামের মানে কী তা জানি না – বইয়ের নাম দিসে ইংরাজীতে কিন্তু বই লিখসে বাংলায়!
হুজুর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন নীরবে বসে রইলেন। পুরো ঘরে সাথে সাথে নেমে এলো পিন পতন নীরবতা।
হাশেম সাহেব দেখা করতে এসেছেন চালতা হুজুরের সাথে; হাশেম সাহেবের ছোট বোন হুজুরের দ্বিতীয় স্ত্রী। হুজুরের ঘরে বসে আলাপ আলোচনা শুনছিলেন । হাশেম সাহেবকে চালতা হুজুর বেশ পছন্দ করেন তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক বলে। তাছাড়া হাশেম সাহেব ইংরেজীতেও খুব ভালো- অনর্গল কথা বলে যেতে পারেন। মাঝে মাঝে হাশেম সাহেব কোরান আর হাদিসের ইংরেজী বয়ান দিয়ে ফেলেন, অনেকটাই নিজের অজান্তে – তখন চালতা হুজুরের আশ পাশের সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে- হুজুরের বুকটা ভরে যায় গর্বে । এছাড়া চালতা হুজুরের কোনও পরামর্শ দরকার হলে সব সময়ে হাশেম সাহেবকে ডেকে পাঠান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি।
সারা দেশে ব্লগারদের নিয়ে যে তান্ডব চলছে, তার পিছনে চালতা হুজুরের দল এবং আরো কিছু রাজনৈতিক ইসলামি দলের অবদান রয়েছে। গত সপ্তাহে তারা ঢাকা ঘেরাও দিয়েছিল। সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়ে পড়েছিল। সেজন্য সরকার কিছু লোক পাঠিয়েছে চালতা হুজুরের কাছে সমস্যা সমাধান করার প্রয়াসে। হাশিম সাহেবকে ডাকা হয়েছে সেজন্যই।

হাশিম সাহেব মিশার বাবা জামান সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন তার সঙ্গে আসার জন্য। হাশিম সাহেব কিছুটা জানেন রাকীবের ব্যাপারে। তাই উনি জামান সাহেবকে সাথে আনতে চেয়েছিলেন যাতে জামান সাহেব সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করতে পারেন এবং রাকীবকে শাসন করতে পারেন। হাজার হোক, নিজেদের -পরিচিত আপনদের সন্তান তো! তাদের রক্ষা করতে হবে বিপদ থেকে।
জামান সাহেব পীর -ফকীর পছন্দ করেন না। সেজন্য তিনি আসেননি। হাশিম সাহেব তাকে এও বলেছেন- পীর -ফকীর পছন্দ করা না করার সময় এটা না, মাঝে মধ্যে অপছন্দের কাজ করতে হয় বৃহত্তর স্বার্থে । জামান সাহেব বলেছেন কী একটা সমস্যায় পড়েছেন, পুরোটা খুলে বলেন নি, খালি বলেছেন -রাকীব গতকাল বাসায় ফেরে নি। হাশিম সাহেব জামান সাহেবকে আশ্বস্ত করে বলেছেন – বাসায় না ফেরাই ভালো। কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকুক। বলা তো যায় না । মানুষ যখন ভীড়ের মধ্যে থাকে, তখন সে তার ব্যক্তি স্বত্তা হারিয়ে ফেলে, অনেক সময় হিংস্র জানোয়ারে পরিনত হয়, খুন খারাবি করতে দ্বিধা করে না। কারন তখন তার আচরন প্রভাবিত হয় ভীড়ের আচরণ দ্বারা। ইংরেজীতে “মব মেন্টালিটী” বলে এটাকে । – ব্যাপারটা বিপদজনক। তাই খালি রাকীব না, অন্য সবগুলার উচিৎ কয়েকদিন গা ঢাকা দেয়া। জামান সাহেব আসেন নি।
হাশিম সাহেব রুমের নীরবতা ভাংতে চাইলেন না। যে কোনও সময় সরকারী মুখপাত্র এসে পড়বে। বরং এই সুযোগে টেবিলে রাখা পত্রিকাটা পড়া যায়।
পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম –“ বিচী পড়ে গেলো অর্থ মন্ত্রীর “ । মানে কী ! হাশিম সাহেব হাসি চেপে রাখতে পারছেন না । পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। ঘটনাটা এমন – মন্ত্রী সাহেব গিয়েছেন এক অনুষ্ঠানে। মঞ্চে টেবিলে রাখা লিচু খাচ্ছিলেন। লিচুর বিচীটা হাত ফস্কে পড়ে গেছে- এই আর কি! হাশীম সাহেব মনে মনে বিরক্ত হয়ে ভাবছিলেন – ভারতীয় অপ-সংস্কৃতির প্রভাবে এখন পত্রিকা পড়া মুশকিল হয়ে গেছে। কি সব লিখে… আর যা ই লিখে – লেখার ধরন দেখলে গা শিরশির করে উঠে রাগে!মুখে খালি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! কাজের বেলায় সব নকল আর ভারতীয় যতো খারাপ জিনিস আছে- সেগুলার অনুকরন!
দুই বিশাল দেহী ভদ্রলোকের আগমন ঘটলো হুজুরের ঘরে। দু জনই বয়সে হাশিম সাহেবের চেয়ে ছোট হবে। এদের হাতে ওয়্যারলেস রেডিও , একটু পরপর টুট টুট করছে আর কী সব কথা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছে। লম্বা সালাম দিয়ে তারা হুজুরের ডান পাশে রাখা খালি চেয়ারে বসে পড়লো; কোনও অনুমতি বা ভদ্রতার তওয়াক্কা না করে। হাশিম সাহেব নিজের পরিচয় দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, কিন্তু এরা তাতে পাত্তা দিলেন না। এদের দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়া, হাতে সময় নেই। চেয়ারে বসেই সোজা কাজের কথা শুরু করে দিলো তারা।
হাশিম সাহেব লক্ষ্য করলেন কথা মুলতঃ একজনই বলছেন।
“হুজুর, আমাদের হাতে বেশী সময় নাই। আপনারা ঢাকায় যে তান্ডব করছেন, ক্ষয় ক্ষতি করছেন, তাতে সরকার খুবই বিরক্ত। সরকার চাইলে আপনাদের হাজতে ঢুকাইয়া দিতে পারে, কিন্তু সেটা সরকার চায় না। তাছাড়া ওইসব পুলাপাইনের একটু শিক্ষা হবার দরকার আছে। আজকে লিখতাসে নবী আউলিয়া নিয়া কালকে লিখবে সরকার নিয়া। দেখেন না চীন দেশে এই জন্য এইসব পুলাপাইনরে সোজা ট্যাঙ্কের তলায় ফালাইয়া দিয়ে মারে! লিবিয়া, ইরান , আরবেও তো তাই করে।“ একটূ থামলেন ভদ্রলোক।
চালতা হুজুর চোখ খুলে এদের দিকে এক নজর তাকালেন, তারপর আবার চোখ বন্ধ করলেন।
“হুজুর, আমরা দুই একটা ব্লগারদের শোয়াইয়া দিমু। এরপর আর কোনো ঝামেলা সরকার সহ্য করবে না। সেইটা পরিস্কার জানানোর জন্যই আমাদের এখানে আসা। বুঝাইতে পারসি ক্লিয়ারলী? আপনার দলের লোকজনদের সাবধান কইরা দিবেন ; আর মনে রাইখেন আপনি নিজেও – এই দেশে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করলে আপনাদেরও মাফ করা হবে না … ”—এই শক্ত কথাগুলো কী নিরবিকার আর শান্ত ভাবেই না বলে যাচ্ছে এই লোক- হাশিম সাহেব অবাক হয়ে খেয়াল করছিলেন।
চালতা হুজুর এবার কথা বললেন।
“বাবা, ওরা তো বাচ্চা মানুষ, শোয়াইয়া দিবেন ক্যান? মায়ের কোল খালি করলে আল্লাহ মাফ করবেন না । একটু ধমক ধামক -চড় থাপ্পড় দিলেই তো হয়। আর শোনেন বাবা – আমরা ফকীর মানুষ, আল্লাহ বিল্লাহ নিয়া থাকি। আমাদের ক্ষমতা যাবার কুনো লোভ নাই। নবীর নামে কুকথা লিখছে- তাই প্রতিবাদ করছি । আমার কোনও লোক তো তান্ডব করে নাই, করবেও না । বাবা রে … মানুষ জ্যাতা করার সামর্থ্য আমার নাই… তাইলে শোয়াইয়া দেই কোন সাহসে??? এই সব দুনিয়াদারী নিয়া আমার কাছে আসছেন ক্যান.. . কে পাঠাইসে আপনাদের? “ হুজুর আবার চোখ বন্ধ করলেন।
এবার চুপ করে থাকা ভদ্র লোক কথা বললেন – “ আপনার সাহস না থাকলেও আমতলা হুজুর তো দেখলাম বেশ খুশী! আমাদের জন্য দোয়া করলেন। ঊনার সমর্থক তো আপনার চেয়ে অনেক বেশী ।“ হাশিম সাহেব ঠিক বুঝতে পারলেন না কেনো এই ভদ্রলোক আমতলা হুজুরের প্রসঙ্গ টানছেন। আমতলা হুজুর করেন রাজনীতি… তার ভগ্নিপতি তো সেটা করেন না।
চালতা হুজুর কোনও কথা বলছেন না। চোখ তার বন্ধ। এক খাদেম চা নাস্তা নিয়ে আসলেন মেহমানদের জন্য। তারা কিছু না খেয়ে চলে গেলেন।
চালতা হুজুর হাশিম সাহেবকে বললেন –“ ওরা মারবে মানুষ- আর দোষ দিবে আমাদের… বুঝলা কিছু?যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় সবাইকে সাবধান কইরা দেও – কেঊ যেনো ঘর থিকা বাহির না হয়। ? আল্লাহ মাফ কইরা দিয়েন আমাদের…কোনও মায়ের কোল যেন খালি না হয়.. আমীন”
হাশিম সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে ঊঠানে এসে দাঁড়ালেন। মিশার বাবা, মিশা আর রাকীবের কথা মনে পড়তে থাকলো তার। ওদেরকে ফোন দিয়ে ব্যাপারগুলো জানানো দরকার। জামান সাহেবকে কয়েকবার ফোন দিলেন, কিন্তু কথা হোল না। মিশার সাথে হাশিম সাহেব কখনো সালাম আদান -প্রদান ছাড়া কোনও কথা বলেছেন বলে মনে নেই তার। মেয়েটার জামা কাপড় ঠিক নেই, কথা বার্তাও খুব একটা সুবিধার না -এমনটি শুনেছেন এর তার কাছে। মিশাকে ফোন দিবেন কী না ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত ফোন দিয়েই ফেললেন।
অনেক অনেকদিন পর আজ মনিরের সাথে ফোনে কথা হবে মিশার। মিশা ই সময়টা দিয়েছে মনিরকে আজ সন্ধ্যা ৭.৩০ এ। মনির মিশাদের পাশের বাসায় থেকে বড় হয়েছে। মনিরের বয়স যখন চার, তখন সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মা মারা যান। একই স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতো সবাই। মনিরের বাবা মা চলে যাবার পর আর কেঊ ছিলো না তার। তখন থেকেই সে মিশাদের পাশের বাসার খালাম্মাদের সাথে থাকতে শুরু করেছিল। অনার্স শেষ করে সে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী জীবন শুরু করে। মিশা মনির ভাইকে একসময় রোমান্টিক সঙ্গী হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল । কিন্তু মনির খুব একটা সাড়া দেয় নি। ব্যাপারটা ইনসাল্টিং , কিন্তু মিশার ধারনা মনির ভাই যদি ফিরে এসে তাকে চায়- সে না বলতে পারবে না।
অনেক কথা আছে- মনির ভাইকে বলতে লাগবে। বিশেষ করে রাকীবের কথা। রাকীবের এক ভাই অস্ট্রেলিয়া থাকে, মনির তাকে কখনো দেখে নি। আপন ভাই হলেও রাকীব তার সাথে খুব একটা ক্লোজ না। দেশের এখন যা অবস্থা – রাকীবকে বাইরে পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়। মনির ভাই হয় তো পরামর্শ দিতে পারবেন। এছাড়া অনেকদিন ভালো নতুন বই পড়া হয় নি। জন স্টুয়ারট মীলের বই ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। মনির ভাই কে নতুন বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে হবে।
ফোন বেজে উঠলো মিশার। কিন্তু মনিরের ফোন না.. তার অতি অপ্রিয় মানুষ- হাশিম চাচার ফোন। হাশিম চাচাকে মিশার ভীষণ অপছন্দ তার। সে চালতা হুজুরের ভক্ত; খালি যে ভক্ত তা না, জোর করে সে তার বোনকে বিয়ে দিয়েছে চালতা হুজুরের সাথে। চালতা হুজুর বেহেস্তে গেলে তার জন্যও সুপারিশ করবে ।
মেজাজটা অনেকটাই খারাপ হয়ে গেল মিশার। ফোন বেজে চলছে… মিশা ধরে নি ফোনটা । মনিরের ফোনের অপেক্ষায় বসে রইলো সে।
…চলবে…
