খুব সকালে স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল মনোয়ারের। অচেনা চেহারার এক বয়স্ক লোক তাকে যেন মনে করিয়ে দিয়ে বলছেন, “তার সাথে ভাল যোগাযোগ রেখো”। আজকে দিয়ে পরপর তিন দিন সে একই স্বপ্ন দেখছে। ঘুমটা ভয় বা অশান্তিতে ভাঙ্গেনি। হতে পারে খুব সকালে আযানের আওয়াজে, ফজরের নামাজের সময়, ঘুমটা ভেঙেছে। কোথায় যেন ভেতরটা খালি খালি লাগছে তার। বেশি কিছু না ভেবে অজুটা সেরে নিল সে। হোস্টেলের আরও কিছু ছেলে নামাজ পড়তে উঠেছে। কিন্তু মনোয়ার অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা। কাছের মসজিদটাতে সে জামাতের সাথে নামাজ পড়ে, সম্ভব হলে ফজরের নামাজটাও। বড় একটা জামা গায়ে চাপিয়ে চুল আঁচরে টুপিটা নিয়েই হাঁটা দিল সে। জামাত শুরু হতে বেশি সময় বাকি নেই। নামাজ পড়ে তারপর স্বপ্নের কথাটা একজন পরিচিতের সাথে আলাপ করবে সে, হতে পারে তার পরামর্শ কাজে লাগবে।
জামাতের সাথে দু’রাকাত পড়ে মনোয়ার আরও দু’রাকাত বাড়তি নামাজ পড়ল, মৃত বাবার জন্য দোয়া করল। দিনে পাঁচবারই সে এ দোয়া করে, মন থেকে স্রস্টার কাছে বাবার জন্য ভাল কিছু চায়, চোখের পানি ফেলে দোয়ার সময়, পূর্ণ অনুভুতি নিয়ে বাবার জন্য দোয়া করে সে। নামাজ শেষে তাকিয়ে দেখল আজম সাহেব দরজার কাছে চলে গেছেন। আজম সাহেব তার পরিচিত। কলেজে ইতিহাস পড়ান। মাঝে মাঝে মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। তাকে আজ স্বপ্নের কথাটা বলবে বলে ঠিক করেছে মনোয়ার। উঠে দাড়িয়ে কিছুটা দৌড়ের মত করেই আজম সাহেবের কাছে গেল মনোয়ার।
-আসসালামু আলাইকুম আজম সাহেব
-আরে মনোয়ার, ওয়ালাইকুম আস সালাম। কেমন আছ? পড়াশোনা কেমন চলছে?
-আলহামদুলিল্লাহ্। আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই, সময় হবে?
-নিশ্চয়ই, চা খাবে? চা খেতে খেতে কথা বলি?
-খুব ভালো আইডিয়া আজম সাহেব।
চা বানানোর সময়টুকুতে মনোয়ার আজম সাহেবকে তার স্বপ্নের কথাটা বলল। সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলা মনোয়ারের একটা গুন – অন্তত বন্ধুরা তাই বলে।
-চা খাও, একটা কাপ মনোয়ারের দিকে এগিয়ে দিলেন আজম সাহেব।
-ধন্যবাদ।
-তোমার বাবা তো নেই, আই মিন ইন্তেকাল করেছেন বেশ আগে, তাই না?
-জী, সাত বছর আগে। মা আছেন।
-মায়ের সাথে যোগাযোগ কেমন তোমার?
-প্রতিদিন ফোনে কথা হয়, দু সপ্তাহে একবার বাড়ি যাই। মা চান মাসে একবার যাই, পড়ায় আরও মন দেই, কিন্তু মন মানে না, প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে। ট্রেনের টিকেট আরও একটু কম খরচ হলে প্রতি সপ্তাহেই যেতাম।
-হুম… । তুমি বলছ, স্বপ্নটা তোমার ওপর কোন ভয় বা আতংকের ছাপ ফেলেনি, তাহলে ভাবছ কেন এটা নিয়ে?
-ভাবছি, কারণ একই জিনিস আমি বার বার দেখছি। তাও রোজ সকালে, প্রায় একই সময়ে!
-তা বুঝেছি। আচ্ছা তুমি কি তোমার কোন আত্মীয়, বন্ধু বা বান্ধবীকে দূরে সরিয়ে রেখেছ, আই মিন যোগাযোগ রাখছনা?
-ওরকম হলে ভালই হত, মানে, আমি এতটা নিঃসঙ্গ হতাম না। একমাত্র আত্মীয় মা, দুজন বন্ধু হোস্টেলেই থাকে, আমার রুমমেট। আর বান্ধবী? আমার মত মাদ্রাসা টাইপ পোশাকের ছাত্রদের কাছে মেয়েরা ওভাবে ঘেঁষেনা। প্রতি নামাজের পরই মুনাজাত করি যেন আল্লাহ্ আমার এ নিঃসঙ্গ জীবনটা পালটিয়ে দেন।
-আমাকে একটু ভাবতে দাও। কাল এই সময় আবার কথা বলি? – হঠাৎ করেই হাসি মুখে আজম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
-নিশ্চয়ই, ধন্যবাদ আপনাকে। – মনোয়ারও উঠে হাত বাড়িয়ে দিল।
-আসসালামুয়ালাইকুম, বলেই আজম সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন, মনোয়ারের জবাবের অপেক্ষা না করেই।
অগত্যা সালামের জবাব বিড়বিড় করতে করতে মনোয়ার হোস্টেলের দিকে হাঁটা দিল। আজ সকাল সকাল মাকে ফোন দেবে, পারলে এ সপ্তাহে একবার বাড়িও যাবে। হতে পারে মায়ের সাথে তার যোগাযোগটা আরও বাড়ানো প্রয়োজন, এ জন্যই আল্লাহ্ তাকে এ স্বপ্ন বার বার দেখাচ্ছেন। অনেকটা ফুরফুরে মনে তাই দিনটা শুরু করল মনোয়ার। সকালে দুটো ক্লাসের পর পরের ইয়ার এর পরিক্ষার জন্য বাকি দিন আর ক্লাস হল না। দুপুরের নামাজ শেষে ভাত খেয়ে হালকা ঘুম পেল মনোয়ারের, হতে পারে রাতের ঘুমটা ভাল হয়নি। তেমন কাজও নেই। আরামে শরীরটা এলিয়ে দিল বিছানায়। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বুঝতে পারেনি মনোয়ার, আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গায় বুঝল আসরের সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসল মনোয়ার। ভাবল, আরামে আরামে বেশ গাফিলতিই করছে জীবনের সাথে।
আসরের নামাজটা মসজিদে পড়ল মনোয়ার। আজ গভির রাত অবধি পড়াশোনা করবে ঠিক করেছে সে। দিনের ঘুমটাকে কাজে লাগাবে। নামাজের পর খুব দ্রুত বেশ কিছু তাসবিহ পড়েই উঠে দাঁড়াল সে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল আজম সাহেব উৎসুক মনে মনোয়ারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
-খুব ব্যস্ত নাকি মনোয়ার?, আজম সাহব এগিয়ে এসে বললেন।
-না, আসসালামু আলাইকুম আজম সাহেব।
-ওয়ালাইকুমাসসালাম। চল, বাইরে একটু কথা বলতে বলতে হাঁটি। – বলেই এগিয়ে গেলেন আজম সাহেব, মনোয়ার পেছনে পেছনে।
-সকালে তোমার কথায় মনে হয়েছে, নিঃসঙ্গতা তোমার জীবনের একটা বড় সমস্যা।
-আসলে, জী, তা ঠিক; আবার বর্তমান সমাজে ধার্মিক লোকজনের অনেককেই এরকম নিঃসঙ্গতা মেনে নিতে হয়।
-হুম। তোমাকে সব সময়ই আমি চলার ওপর দেখেছি, মানে ব্যস্ত। এরকমটা হলেও কি নিঃসঙ্গতা বেশি কাজ করে?
-আসলে, ব্যস্ততা বলতে, ক্লাস, খাওয়া, গোসল, পড়ালেখা আর পাঁচ বেলা জামাতে নামাজ পড়া। সময় দ্রুতই কাটে। তবে নিঃসঙ্গ।
-ঠিক বুঝলাম না। তোমার ক্লাসে স্টুডেন্ট কয় জন, আই মিন, রেগুলার যাদের সাথে ক্লাস কর?
-ধরুন শ’ খানেক।
-আচ্ছা, যখন নামাজের জন্য মসজিদে আস, তখন তো নিয়মিতই অনেকের সাথে দেখা হয় তাই না?
-জী, তা হয়, কিন্তু সালাম জবাবের বাইরে তেমন কথা হয় না, আর আমি নামাজের পর বেশ কিছু আমল করি, ডানে বামের লোকজন তার মধ্যেই চলে যায়।
-হুম। নামাজ পড়তে কেমন লাগে?
-নামাজ তো ফরজ। সহি নিয়ম মেনে, শুদ্ধ তেলাওয়াত সহ নামাজ পড়াও বেশ কঠিন কাজ।
-তা বুঝলাম, কিন্তু কেমন লাগে তা কিন্তু বললে না!
-অবশ্যই ভাল, আর এটা তো ফরজ, ভাল লাগা বা না লাগার সুযোগ নেই।
-বুঝেছি। আরও ভেঙ্গে বলতে হবে। আচ্ছা, তোমার মায়ের সাথে যে যোগাযোগ রাখো, সেটা কি ফরজ?
-জী, সেটাও ফরজ, বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য।
-গুড। ওটা কি এঞ্জয় কর? ভাল লাগে মায়ের সাথে যোগাযোগ?
-জী, নিশ্চয়ই, খুব ভাল লাগে, শরীরে প্রান ফিরে পাই যেন! ওটাই আমার একমাত্র আনন্দের কাজ বলতে পারেন।
-তার মানে, মায়ের সাথে যোগাযোগ ফরজ হলেও আনন্দ পাও, কিন্তু নামাজে তা পাও না!
-না, তা না, নামাজ তো অন্যরকম ফরজ, মানে ধর্মীয় কাজ।
-আরবিতে নামাজকে যেন কি বলে, মনোয়ার?
-স’লাত – শুদ্ধ করে উচ্চারণের চেষ্টা করল মনোয়ার।
-এর মানে কি?
-মানে নামাজ। আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, আকিমুস সালাত, মানে নামাজ প্রতিষ্ঠা কর।
-ঠিক, কিন্তু কি প্রতিষ্ঠা করছ তা বুঝতে তো অর্থটা জানা জরুরি, অন্তত যারা পড়ে, জানে, অর্থাৎ শিক্ষিত।
-জী তা ঠিক।
-আমার জানা মতে সালাত যে আরবি শব্দ তার বাংলা প্রতিশব্দের একটা হল যোগাযোগ।
-ও আচ্ছা! যোগাযোগের ক্ষেত্রেই তো আমরা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলি।
-ঠিক। যোগাযোগটা কার সাথে?
-অবশ্যই আল্লাহ্র সাথে।
-রাইট। তাহলে তুমি বলছিলে মায়ের সাথে যোগাযোগ তোমাকে আনন্দ দেয়, কিন্তু নামাজ, মানে স্রস্টার সাথে যোগাযোগ তোমাকে আনন্দ দেয় না, তাই না?
কিছুটা অবাক হয়ে আজিম সাহেবের দিকে ঘুরে তাকাল মনোয়ার। ভদ্রলোক খারাপ কিছুই বলেননি, কিন্তু নতুন, বেদায়াত এর গুনাহর ভয় হল তার। তার সাথে এও ভয় হল, সে বোধ হয় ঠিক ঠাক মত মুসলিম হতে পারেনি!
-আমরা নামাজের নিয়ম, নিয়ত, ফরজ, সুন্নত, নফল সবই পড়েছি, কিন্তু এরকম কোন কিছুতো আমাদের ধর্ম ক্লাসে শেখায়নি! – মনোয়ার এবার জোরের ওপরই বলল।
-মায়ের সাথে যোগাযোগে যে তুমি খুশি হও, এটা কি কোথাও শেখানো হয়েছিল, নাকি এমনিতেই অনুভব কর?
-অবশ্যই এমনিতে।
-তাহলে স্রস্টা কি তার চেয়েও আপন আর ভালবাসার নন, কি শিখেছ ধর্ম পড়ে?
-জী তা ঠিক। – লজ্জা পেয়ে মনোয়ার মাথা নিচু করে ফেলল।
-লজ্জার কিছু নেই মনোয়ার, আমারও এক সময় এই বোধ ছিল না। খুব সহি শুদ্ধ নামাজ পড়তে চেষ্টা করতাম, কিন্তু স্রস্টার সাথে যোগাযোগের কোন মানসিকতা ছিল না। আল্লাহ্ রহমান-রাহিম, এরপরও আমার নামাজ টিকে থেকেছে, আমি আরও ভাল করে বোঝার সুযোগ পেয়েছি। আর মায়ের মত করে আন্তরিক ভাবে যোগাযোগ করলে রাস্তার একটা পশুও তোমার নিঃসঙ্গতা ঘোচাবে। সেখানে দিনে পাঁচ বার মসজিদে গিয়ে অন্য অনেকের সাথে যখন তুমি স্রস্টার সাথে যোগাযোগ করবে, তখন তো তোমার ঈদের আনন্দ অনুভব হবে, তাই না!
মনোয়ার শুধু তাকিয়ে শুনল, মুখে কোন কথা এলোনা।
আর সামান্য কিছু কথা বলেই আজম সাহেব বাজার করার জন্য ছুটলেন। মাথা নিচু করে মনোয়ার হাঁটা ধরল হোস্টেলের পথে। স্বপ্নের কথা সে প্রায় ভুলেই গেছে, তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার তার জীবনে ঘটে চলেছে, অথচ কোন দিন টেরও পায়নি। কাগজে কলমে যা দেখেছে আর শিখেছে, তার পাশাপাশি যে অনুভুতি দিয়ে শেখা দরকার ছিল তা পিছিয়ে পড়েছে। “তবু ভাল, আল্লাহ্র রহমতে আজিম সাহেব কথা গুলো বলেছেন” ভাবতে ভাবতে মনোয়ার এগিয়ে গেল। ভেতরে হালকা শিহরণ, ভাল লাগছে – মাগরিবের সময় স্রস্টার সাথে যোগাযোগ হবে ভেবে!
