বজ্র আঁটুনি ফসকা গিরো

আমরা মানুষ। আমারা কেউই শতভাগ নই। আবার শতভাগ হতে চাওয়া মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্যও বলা যায়। মানুষ শতভাগ কখনই হতে পারে না, কিন্তু সব সময়ই তা হতে চায়, এটাই সম্ভবত মানুষের জীবনভর ছুটে চলার মূল কারণ। অন্যভাবে বলতে গেলে, মানুষ প্রাকৃতিক ভাবেই ভ্রান্তি প্রবণ, আবার ভুল সংশোধনই মানুষের প্রতিনিয়ত চাওয়া। চাওয়া আর পাওয়ার এই বৈপরীত্য কোন বিভ্রাট তো নয়ই, বরং সৃষ্টির সচলতার রহস্য। হয়ত শতভাগ কিম্বা নিখুঁত, থেমে যাওয়ারই আরেক রূপ।

কিন্তু তারপরও পূর্ণতার পানে ছোটা থামে না, থামা সম্ভবও না। প্রতিনিয়তই আমরা শিখে চলেছি শুদ্ধতার নতুন কোন মন্ত্র, আবার প্রতি পদক্ষেপেই হয়তো আমরা ভুলে যাচ্ছি জানা থাকা কোন তথ্য বা নিয়ম। তাই ভুল হবেই, আবার সংশোধনের চেষ্টাও থাকতে হবে। যখন ভুল হতেই থাকে অথচ সংশোধনের চেষ্টা অনুপস্থিত থাকে তখন আমরা বাস্তব ক্ষতির সম্মুখিন হই; আবার যখন সংশোধনের চেষ্টায় বাড়াবাড়ি হয়ে যায় তখন জীবন হয় কষ্টের।

আমাদের জীবনের যে দিক গুলো ভুলের পর ভুলে ভরে ওঠে সেগুলোর অধিকাংশই যন্ত্রণাদায়ক কিম্বা জটিল, যদিও অতি সহজ আর সাধারন দিক গুলোও এর মধ্যে প্রায়ই পাওয়া যায়। আজকের এই লেখায় এমন তিনটি সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই যা আমাদের বাস্তব জীবনে সংশোধনের অভাবে তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ নিচ্ছে এবং পরিনতিতে আমাদের কস্ট আর ক্ষতিই বাড়ছে। তবে আলোচনা শুরুর আগে মনে করিয়ে দিতে চাই, যা একজনের বিচারে ভুল, তা অন্যের বিচারে ভুল নাও হতে পারে। তাই, আমার আলোচনায় আমি যখনই কোন ভুলের কথা বলব, তা অবশ্যই হবে শুধু তাদের জন্য যারা একে যৌক্তিক ভাবে ভুল মানেন, যাদের যুক্তি ভিন্ন, তাদের জন্য নয়।

প্রেক্ষাপট ১ঃ পরকালে বিশ্বাসীর মৃত্যু নিয়ে প্রতিক্রিয়া – মৃত্যু কোন সময়ই সহজ কোন ঘটনা নয়, এটা সবার জন্যই সবচেয়ে ভারি এবং কঠিন ঘটনা, এ বিষয়ে কেউ হয়ত দ্বিমত পোষণ করবেন না। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে যখন কেউ মৃত্যুর পরের জীবনটায় বিশ্বাস করেন তখন মৃত্যু অনেকটা স্থায়ী বিদেশ যাত্রার মতও তো হতে পারে। কিন্তু তা হয় কি? তার শতকরা একভাগ হলেও কিন্তু মানুষ, যারা বিশ্বাস করেন, তারা অনেকটাই শান্তি পাবে, তাই না!

প্রেক্ষাপট ২ঃ দ্বিধা বিভক্ত সততা – আমরা যারা সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করি তারা সবাই কম বেশি উপাসনার প্রস্তুতি নেই। উপাসনাকালিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সুচিন্তিত কথাবার্তা, নির্ধারিত উঁচু মানের আচরণ, সততা – কমবেশি সবই আমরা ঠিকঠাক মতই করতে চেষ্টা করি; আর করবোনাই বা কেন, সৃষ্টিকর্তা বলে কথা! কিন্তু সেই একই মানুষ যখন নির্ধারিত ওই উপাসনা শেষে সমাজে মিশে যাই, তখন কি করি? কাজের, কথার, সততার আর আচরণের মানই বা কেমন হয়? যদি ভাল মান নিয়ে তখন খুব একটা মাথা ব্যাথা না থাকে, তার মানে কি এই যে নির্ধারিত উপাসনার বাইরে সৃষ্টিকর্তা অক্ষম হয়ে পড়েন, কিম্বা সৃষ্টিকর্তা সব সময় একই মান পছন্দ করেন না, নাকি আমাদের বিশ্বাস শুধু উপাসনার সময় থাকে, বাকি সময় আমরা অবিশ্বাসী!!

প্রেক্ষাপট ৩ঃ সন্তান আর মা-বাবার দু’রকম রিতিনীতি – সন্তান যখন কোন ভুল করে, মা বাবা শুধরে দেন। এটাই স্বাভাবিক। সন্তানকে বাবা মা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সততা, সুন্দর আচরণ এসবই শিক্ষা দিতে চান। একটু ভাবুন, একই জিনিস গুলো বাবা মা নিজেদের ওপর চাপিয়ে যদি তারপর সন্তানের ওপর চাপাতেন তাহলে কেমন হত? সম্ভবত দুনিয়া অনেক বেশি সুন্দর হত, আর শিশুরা হত ফুলের মত সুখী! ভেবে দেখুন, যে মা বাবা শুধু পড়তেই বলেন না, নিজেরাও পড়াশোনা করেন, তাদের শুধু সন্তান নয়, পরিবার এবং সমাজটাও শিক্ষিত হবে, এবং তা হবে খুব সুন্দর ভাবে।

উপরের তিনটা প্রেক্ষাপট আমাদের জীবনে খুবই নিয়মিত ঘটনার মধ্যেই পড়ে। হতে পারে প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিবারই আমরা ভুল আচরণটাই করি, কিম্বা ঠিকটা থেকে বহু দূরে থাকি। তারপর দিনের শেষে যখন এগুলোর ফলাফল হিসাবে কঠিন কিছু ঘটে, খুব সহজেই আমরা বলে ফেলি – কপালটাই খারাপ !

Leave a comment