অতীত

যতবার কবরস্থানে আসি ততবার আমার এই অস্বস্তিকর অনুভূতিটা হয়। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি যে অনুভুতিটা অনেকটা সরল অঙ্ক না মেলার মতো, কি যেন একটা মনের ভেতর খচ খচ করতে থাকে – আমি ধরতে পারিনা সেটা ঠিক কি।

আজ অবশ্য না এসে উপায় ছিল না। শত হলেও কবির ভাইয়ের বাবা মারা গেছে। কবির সাদেক আমার বস, তাকে আমি রিপোর্ট করি, ম্যানেজমেন্টও কেন যেন তাকে খুব পাত্তা দেয়, ফলে তাকে তোয়াজ করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।

অথচ বয়সে সে আমার খুব একটা সিনিয়র না, এমনকি সমবয়সীও হতে পারে, অথচ চাপার জোরে আজ সে কত উপরে উঠে গেছে। সে যখন জয়েন করে, তখন আমার পজিশনেই শুরু করেছিল। আমার তখন ওই পোস্টে সাত বছর হয়ে গেছে, আমি তাকে কত কিছু শিখিয়েওছি। কিন্তু কি তুঘলকি কান্ড, দুই বছর যেতে না যেতে সেই কিনা পেলো প্রমোশন, আর আমাকে রিপোর্ট করতে হলো তার কাছে। আমি নিশ্চিত তার কোনো জানাশোনা আছে কোথাও, সেই চ্যানেল সে কাজে লাগিয়েছে। হ্যা, সে প্রেসেন্টেশন জাতীয় জিনিস ভালো পারে – ওই চাপাবাজি আরকি, কিন্তু সেটার জন্য এতো কিছু !

আমি কবির ভাইয়ের দিকে তাকালাম। একটা জিনিস লক্ষ্য না করে পারলামনা, সেটা হলো তার মুখের অভিব্যক্তি। লোকটার বাবা মারা গেছে, সে দাফন-কাফনের কাজ করছে, অথচ তার মধ্যে কোনো মন খারাপের চিহ্ন দেখা যাচ্ছেনা।  বাবা-মা মারা গেলে মানুষ তো মাথা তুলতে পারেনা, অন্তত চোখ-মুখ ফোলা থাকে – সারারাত কান্না-কাটির চিহ্ন হিসেবে। আসলে এধরণের অনুভূতিশূন্য লোকই পারে চাকরি-বাকরিতে উন্নতি করতে – সম্ভবত এরা ভয়াবহ ধরণের আত্মকেন্দ্রিক বলেই কে কি ভাবলো এগুলা নিয়ে চিন্তা করে তাদের সময় নষ্ট করতে হয় না। আমি কোনোদিনই এর মতো স্বার্থপর টাইপের হতে পারবোনা, ফলে কোনোদিনই আমার আর প্রমোশন হবে না। 

আমার বাবা যখন মারা গেলো – মনে পড়ে – আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। যদিও জীবিত অবস্থায় তার আর আমার সম্পর্কের মধ্যে একটা টানাপোড়ন চলছিল, অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে তাকে অসুস্থ অবস্থায় আমি দেখতে পর্যন্ত যেতাম না – কিন্তু তার মৃত্যুর সাথে সাথে সেই বিভেদ ঘুচে যায়, ভীষণ ভেঙে পড়ি আমি। তিন-চার সপ্তাহ পর্যন্ত আমার সবকিছু কেমন বিস্বাদ লাগত।  তারপর অবশ্য সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসে। যাহোক এর দ্বারা কিন্তু বোঝা যায়, আমার মন নরম আর নরম লোকের পক্ষে অন্যকে ল্যাং মেরে পদোন্নতি নেয়া কোনোদিনই সম্ভব হবে না, আর আমিও সারাটা জীবন অন্যকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ বলেই কাটিয়ে দেব।

বাবা মারা যাওয়ার পর অবশ্য অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম আমি – একসময় সবকিছুই মানুষ মেনে নেয়, এমনকি মানুষ অতীতকে খুব সহজেই ভুলে যায় । আজ এখানে না এলে বাবার কথা মনেই পড়তো না। আসলে মৃত্যুর চেয়েও বড়ো ট্রাজেডি হচ্ছে বিস্মৃতি – একদিন যে মানুষকে ছাড়া কোনো কিছু চিন্তাই করা যেত না, একটা সময় আসে যখন সে মানুষের কথা এমনকি একবারও মনে আসে না।

ঠিক এসময় জাহিদকে এগিয়ে আসতে দেখে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। জাহিদ আমার অফিসের ভাই, তার সাথে আমার খুব মিলে, অনেককিছু শেয়ার করা যায় মন খুলে । ও কাছে আসতেই এটা ওটা বলে কবির ভাইয়ের প্রসঙ্গটা তুললাম।

ভাই একটা জিনিস লক্ষ্য করছেন? – আমি বলি – আবেগ যাদের কম তারাই বোধ হয় দুনিয়াতে উন্নতি করতে পারে।

কিরকম? – সে জানতে চায়।

এই যে কবির ভাই, তার নার্ভ দেখেছেন কতো শক্ত! কে বলবে তার বাবা মারা গেছে? একেই হয়তো বলে প্রফেশনালিজম।

জাহিদ মনে হয় আমার কথাটা পছন্দ করলো। সেটাই স্বাভাবিক, সেও আমার মতো কবিরকে দেখতে পারেনা। তার ব্যাপারটা অবশ্য পেশাগত বিদ্বেষ না, সে কবিরকে অপছন্দ করে মূলত কাজের কারণে – বস তাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেয়, একবিন্দু ফুরসৎ দেয় না সারাদিনে, পেপারটা পর্যন্ত পড়ার সময় পাওয়া যায় না।

চলেন একটা খোঁচা দিয়ে আসি – সে হঠাৎ বলে তারপর হাঁটা শুরু করে। আমি তার পেছন পেছন চলতে থাকি। কবির ভাই কার সাথে যেন কথা বলছিলো, আমাদের দুজনকে দেখে এগিয়ে এলো।

ভাই, মন বেশি খারাপ? – আমি বললাম। 

না ঠিক আছে – সে বলে। 

শেষ কয়টা দিন খুব কষ্ট গেলো, না? – জাহিদ বলে। 

মানে?

আপনি তো অনেক কষ্ট করলেন, সপ্তাহে তিনদিন করে ডায়ালিসিসে নিয়ে যাওয়া, অফিসের পাশাপাশি সময় দেয়া, এগুলি তো কম ঝামেলা না – জাহিদ যোগ করে। 

এখন কয়টা দিন একটু শান্তি করেন – কিছুটা তেল মারার মত করেই বলি আমি।

ও এই কথা – কবির মাথা নাড়ে – আমি তো সেই সময়টাকে সুযোগ হিসেবে চিন্তা করেছি, বাবাকে সময় দেয়া হচ্ছিলো না, তার অসুস্থতার কারণে তার সাথে সময় কাটানো গেল। আমরা কত কথা যে বলতাম হাসপাতালে যেতে যেতে – ছোটবেলার কথা, আত্মীয় স্বজন, রাজনীতি, আরো কত কি!

তার উত্তর শুনে আমি নিজে একটু হতাশই হলাম। লোকটা ধুরন্ধর, দেখা যাচ্ছে জাহিদের কথার ফাঁদ কেটে ঠিকই বেরিয়ে গেছে। আমরা কিছু স্বান্তনামূলক কথা বলে চলে আসতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কবির ভাই হাত ইশারা করে আমাদের থামালেন।

আশ্চর্য কি জানেন? – উনি জাহিদের কাঁধে হাত রেখে বললেন – আমি একদম ভেঙে পড়িনি, যেমনটা ভেবেছিলাম, এর কারণ কি জানেন?

কি?

আমার মনে হচ্ছে আমি তার সাথে আমার যে সময়টা সেটা নষ্ট করিনি। কাউকে হারানো তো কষ্টই, কিন্তু যখন আপনি দেখবেন আপনি সম্পর্কটাকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন তখন কষ্টের মধ্যেও একটা শান্তি খুঁজে পাবেন।

আরেকটা কথা – তিনি মলিন হেসে বললেন – সবাই ভাবছে আমার বাবা মারা গেছে, কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না । মানুষের জীবন এত মূল্যবান যে মৃত্যুর মাধ্যমে সেটার শেষ হয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব বলে আমি মনে করি।  আমি মনে করতে চাই আমার বাবার শরীরটা এখানে পড়ে আছে, অনেকটা পুরোনো ফেলে দেয়া কাপড়ের মতো, কিন্তু তার আত্মাটা অন্য কোনো জগতে চলে গেছে। আমি যেদিন এই দরজাটার ওপাশে যাবো, সেদিন আমি আবার বাবার সাথে কথা বলতে পারবো।

আমি ভাবলাম বসের কথা ভুল হলেও ঠিক। জাহিদ আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, তারপর যে যার রাস্তায় রওয়ানা দিলাম। আমি নিজে ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম পুরো ব্যাপারটা, শত হলেও কবরস্থান একটা খুব বিষন্ন জায়গা।

(ছোট গল্প /মায়িন খান, অক্টোবর ২০২০)

Leave a comment