পশু (২০১১)

তোমার কি কখনো এরকম হয় যে নিজের ওপর নিজেই ভরসা করতে পারছো না? – চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল মুনীর।

শারমীন তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।

যেমন ধরো তোমার নিজের ওপর নিজেরই কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যেন অদৃশ্য কোন শক্তি তোমাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিচ্ছে – এরকম !

শারমীন এবার হাসল, স্নিগ্ধ সুন্দর হাসি – শুনেছি জীন বা পরীতে ধরলে এমন হয় – বলল সে।

মুনীর ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, মেয়েটা কৌতুক করছে কিনা। শেষে নিশ্চিত হয়ে সেও হেসে ওঠে – তুমি জানো না, আজকাল জীন-ভূতও দোয়া-তাবিজে বিশ্বাস করে না, ওদের মধ্যে অনেকেই এখন নাস্তিক হয়ে গেছে !

শারমীন মাথা নাড়ে।

সত্যি বলছি, খুব লজিক্যালি আমি জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করেছি। আগেকার দিনে জীন-পরীরা ছিল যথেষ্ট অজ্ঞ আর কুসংস্কারাচ্ছন – তারা মনে করত, দোয়া-তাবিজে হয়তো তাদের কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। দোয়া-তাবিজে তারা যে পালিয়ে যেত, সেটা দোয়া-তাবিজের গুন না, বরং ওরা পালাত সেসব জিনিসের প্রতি তাদের অমূলক ভয়ের কারণেই। পুরো ব্যাপারটাই সাইকোলজিক্যাল।

বলে মুনীর কিছুক্ষণ আড়চোখে শারমীনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর দুজনই একসংগে হেসে ওঠে।

কিন্তু হঠাৎ করেই মুনীর আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়, বিড় বিড় করে আগের প্রসংগ টেনে বলে – যাহোক, ঠাট্টা করছি না, আমার কিন্তু কয়েকবারই এমন হয়েছে। মনে হয়েছে, আমি যা করছি যেন একটা ঘোরের মধ্যে করছি, যেন দুনিয়া ওলোট-পালোট হয়ে গেলেও আমাকে সেটা করতেই হবে – সাধারণত নিষিদ্ধ কাজ কিংবা ধরো কোন অপরাধ করার সময় এমন হয়।

সাহিত্যে এটাকে বলে নিয়তি, ইডিপাস যে মহাপাপ করবে ওটা ছিল একান্তই তার নিয়তি – শারমীন মন্তব্য করে। 

কিন্তু শারমীনের এনালজি মুনীরকে নিশ্চিন্ত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না, বরং মেয়েটা তার কথা গুরুত্ব না দেয়াতে তাকে কিছুটা হতাশ বলেই মনে হয়।

ক্ল্যাসিক রহস্যগল্পগুলোতেও এটা আছে, যেমন ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড। তুমিও তো পড়েছ, তাই না ! সেই যে ভদ্রলোক দিনের বেলায় থাকত শান্ত-সুবোধ বিজ্ঞানী জেকিল হয়ে, আর রাতে সেই রূপ বদলে হয়ে যেত দুশ্চরিত্র মিস্টার হাইড ! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হলেও এটা কিন্তু মানুষের দ্বৈত স্বত্ত্বার চমৎকার একটা আখ্যান। 

মুনীর জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল না শারমীনের কথাগুলো সে ভালো করে শুনেছে। সেই কখন বিকেলবেলা সে এসেছে এখানে। সন্ধ্যাটা স্রেফ গল্প করে কাটানোর ইচ্ছে ছিল। তারপর সোয়া সাতটা থেকে শুরু হল অবিরাম বৃষ্টি, এখনো বৃষ্টি হচ্ছে – প্রচন্ড বৃষ্টি, মনে হচ্ছে পুরো শহরটা যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। শারমীন চানাচুর-মুড়ি মাখিয়ে এনেছে, সাথে চা। চমৎকার আয়োজন, কিছুটা নস্টালজিকও। কিন্তু মুনীর বুঝতে পারছে না, আজকে কিভাবে এখান থেকে বের হবে। বারান্দায় উঁকি দিয়ে সে দেখল, সামনের গলিতে এক হাটু পানি জমে গেছে।

সত্যি কথা বলতে কি, আজ সারাটা দিনই নানা কারণে মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল তার। ভেবেছিল সন্ধ্যার পর একটু গল্প-সল্প করলে ভালো লাগতে পারে। অথচ এখানে এসে তো সে একরকম আটকেই গেল।

মেজাজ খারাপ হবার অবশ্য যুক্তিসংগত কারণ আছে – সকালে একদল মৌলভী এসেছিল তার অফিসে, বলতে গেলে তাদের এনজিওর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একরকম হুমকিই দিয়ে গেছে তারা। তাদের এনজিওটা মৃত্যুদন্ড ধরনের বড় শাস্তিগুলো রোধ করার ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির কাজ করে, যে এলাকায় তারা এখন কাজ করছে তার কাছাকাছি একটা মাদ্রাসা থেকে এরা এসেছিল। ঐ এলাকায় এনজিও ক্যামপেইন করার বিষয়ে তারা তাদের তীব্র আপত্তি জানিয়ে গেছে।

তারা যা বলল তার মূল কথা হল – মানুষ যেহেতু একইরকম আছে, কাজেই আইন বদলানোর কোন দরকার নেই। যেহেতু সমাজে এখনো ধর্ষণের মত জিনিস আছে, যেহেতু মানুষ এখনো দুর্বলকে অত্যাচার করে, একে অন্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, সেহেতু মানুষ সভ্য হয়েছে এমন দাবী করা যায় না। এরা বলে – এই আইনগুলো হয়েছিল মানুষের শরীরের জন্য, আর মানুষ আজো সেই মধ্যযুগের মতই শারিরীক রয়ে গেছে। ধর্মের উদ্দেশ্য ছিল, এই আইনগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের আত্মাকে শরীরের উর্ধ্বে উত্তীর্ন করা। যেহেতু আমরা তা করতে পারি নি, সেজন্য ধর্মীয় আইন তুলে দিতে বলা হবে অন্যায়।

আশ্চর্য, এই যুগে এসে মৃত্যুদন্ডের মত পাশবিক আইনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কোন মানে হয় ! চুরির জন্য হাত কেটে ফেলা, রক্তের বদলে রক্ত, বিয়ের বাইরের সম্পর্ক এমনকি যদি সেটা দুর্ঘটনাবশতও হয় তার জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা করা – এসব তো চৌদ্দ-পনর শ বছর আগের নিয়ম। কেন সেগুলোকে আজো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা! 

এসব তর্কাতর্কির ফলেই সারাদিন আজ তার মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল।

শারমীন অবশ্য বলেছে যে সে এরকম একটা দর্শনের কথা শুনেছে। এরা বলে – প্রতিটি ব্যক্তির জীবনের মূল্য আছে ঠিকই, কিন্তু কেউ যখন হত্যা কিংবা ধর্ষণের মতো জঘন্য কোনো অপরাধ করে তখন সে তার নিজের ব্যক্তিত্বের অধিকার হারিয়ে ফেলে, ফলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ভুল হয় না। মুনীর বা শারমীন কেউই এই মতবাদের সাথে একমত হতে পারেনি, কিন্তু শারমীনের সাথে বিষয়টা আলোচনা করার পর মুনীরের মনটা একটু হালকা হয়েছে।

শারমীনকে এখনো তার সেই কলেজের দিনগুলোর মতই লাগে। সেই সময় এক বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন শারমীন লাল পাড় লাগানো সাদা শাড়ী পরে কলেজে এসেছিল। মুনীর বোকার মত হা করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে, শারমীন সেটা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসছিল। মুনীর একরাতে শারমীনকে স্বপ্নেও দেখেছিল – সেই সময় – শারমীন যেন একটা সাদা পরী, আর তার সাদা শাড়ীর আঁচলটা ডানা হয়ে গেছে। আশ্চর্য, সেই স্বপ্নের কথা মুনীরের এখনো মনে আছে!

মুনীর আবার জানলার বাইরে তাকাল। বৃষ্টি কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মুনীর সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওর বাসা এখান থেকে প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা। সে যদি ঠিক এই মুহূর্তেও বের হয়, তবুও এই বৃষ্টিতে রিক্সা পেতে যথেষ্ট কষ্ট হবে বলেই তার ধারণা। আর রাত বেশি হলে তো কথাই নেই। বেশ শীত শীতও লাগছে তার, বৃষ্টিতে ভিজতে একদম ইচ্ছে করছে না। এদিকে এখানেই বা কতক্ষণ থাকা যাবে !

শারমীন এ বাসাটায় বলতে গেলে একাই থাকে। জহুরুল ভাই প্রায়ই ঢাকার বাইরে কাজে যায়, কি একটা এনজিওতে কাজ করে ভদ্রলোক। জহুরুলও মুনীরকে বহুদিন ধরে চেনে, শারমীনের সাথে তার বন্ধুত্বকে ভদ্রলোক বেশ সম্মানের দৃষ্টিতেই দেখে।

ভালো কথা, তুমি কি তোমার সেই সাময়িকভাবে স্মৃতি হারানোর ব্যাপারটার কারণ বের করতে পেরেছ? – হঠাৎই শারমীন জিজ্ঞেস করে, যেন অনেকক্ষণ ধরে সে এটা নিয়েই ভাবছিল।

কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকে মুনীর – ও, সেই ঘটনা, হ্যাঁ, একজন সাইকায়াট্রিস্টের সাথে কথা বলেছি আমি। মনে হয়, এটা একধরণের অ্যামনেসিয়াই।

তাই ? – শারমীন বলে – কিন্তু সে ব্যাপারটা কি উনি বের করতে পেরেছেন, কেন শুধু বিশেষ একটা জায়গায় এসেই এটা হচ্ছে?

মুনীরকে আবার একটু অন্যমনস্ক মনে হয়, তারপর যেন একটু দ্বিধা নিয়েই সে বলে – আসলে, সত্যি কথা বলতে কি, এটা ঠিক সেভাবে বের করা যায় নি। হয়তো এটা একটা কো-ইনসিডেন্সই।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না – শারমীন যেন কথাটা হঠাৎ একটু জোর দিয়েই বলে।

মুনীর কি একটা চিন্তায় ডুবে যায় আবার – অন্যমনস্ক।

আর শুধু এ বাসায় এসেই কেন তোমার ঐ স্মৃতি হারানোর অসুখটা হচ্ছে, এটা নিয়ে তুমি কখনো ভাবোনি? 

শারমীনের এ প্রশ্নেরও সে কোন উত্তর দেয়না। 

গত মার্চ মাসে প্রথম ঘটে ঘটনাটা। মুনীর আড্ডা দিতে এসেছিল শারমীনের এখানে। লোড শেডিং আর ভ্যাপসা একটা গরম ছিল। ওরা দুজন সন্ধ্যার পর ছাদে চলে গিয়েছিল গল্প করার জন্য। মুনীরের এপর্যন্ত মনে আছে, কারেন্ট আসার পর ওরা নিচে নেমে এসেছিল। কিন্তু এরপর আর কিছু তার মনে নেই। পরদিন সকালে ঘুম ভেংগে দেখে, সে শারমীনদের ড্রইংরুমে শুয়ে আছে। মাঝখানে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো – অস্পষ্ট। 

সে শারমীনকেও জিজ্ঞেস করেছে – সেরাতে কিভাবে সে জ্ঞান হারাল, কোন খিঁচুনি হয়েছিল কিনা, গায়ে জ্বর ছিল কিনা, ইত্যাদি। কিন্তু মেয়েটা এ ব্যাপারে ওকে একটা কথাও বলেনি। শেষে মুনীর ধরে নিয়েছে, সে কোন কারণে অজ্ঞানই হয়ে পড়েছিল।

পরের বার একইরকম একটা ঘটনা ঘটে প্রায় মাস তিনেক পর, জুনের শেষ দিকে। সেবারও সন্ধ্যার পর কথা বলছিল সে শারমীনের সাথে, তারপর হঠাৎ করেই তার কোন স্মৃতি নেই। সকালে মুনীর আবিষ্কার করে – সে শারমীনের বিছানায় শুয়ে আছে। আরেকবার প্রিয় বান্ধবীকে এভাবে বিপদে ফেলে দেয়ায় সেদিন সে যারপরনাই লজ্জিত হয়েছিল।

দ্বিতীয়বার ওরকম ঘটার পর পরই এক সাইকায়াট্রিস্টের সাথে সে কথা বলেছিল। ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – তার এমন কোন অভ্যাস আছে কিনা যা তাকে প্রচন্ড আকর্ষণ করে কিন্তু সেটা আবার অনৈতিক। সে এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি, কারণ এরকম কোন কিছুর কথা তার নিজেরও জানা নেই। ডাক্তার এরপর তাকে একটা অষুধ খেতে দিয়েছেন, আর বলেছেন – এ অষুধ তার নিজের ভেতরের গোপন অনুভূতিগুলোকে বাইরে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে, অনেকটা নিজেকে নিজে আবিষ্কার করার মত। তখন সে নিজেই বুঝতে পারবে – কেন কি হচ্ছে। সে গত একমাস ধরে অষুধগুলো খাচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দু রাতের কোন গোপন কথাই তার মনের অতল গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসেনি।

আমার একটা জিনিস মনে হয়, জানো – শারমীন হঠাৎ করেই প্রসংগ পাল্টে বলে – নারী-পুরুষের সম্পর্কের মূল কারণটা শারিরীক, ঠিক যেমনটি ফ্রয়েড বলেছিল।

মুনীর কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে – শরীরকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু ওটাই সবকিছু নয়। আর তোমাকে আমি একেবারেই আলাদাভাবে দেখি। হেসো না, আমি খুব ছোটবেলা স্বপ্নে একটা পরী দেখেছিলাম। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, তুমি আমার জীবনের সেই পরী। জৈবিকতার উর্ধ্বের প্লেটোনিক একরকম অনুভূতি এটা, বিশ্বাস কর।

শারমীন তখনো হাসছিল, কিন্তু মুনীর ওর সে হাসির অর্থ উদ্ধার করার কোন চেষ্টা করল না।  

হাসতে হাসতেই শারমীন বলে – তুমি নিজের সম্পর্কে কতটুকুই বা জানো, বলো তো। সেই দুই রাতে তোমার আসলে কি হয়েছিল, তুমি তো এটাও বলতে পারো না, তাই না?

মানে ? কি হয়েছিল সে দু রাতে আমার ? – মুনীরকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখায়। 

অথচ আমি তখন ভেবেছিলাম যে তুমি সব জানো – শারমীন তার কথা শেষ করে।

মুনীরের কপালে ভাজ পড়ে।

আচ্ছা, তুমি আমাকে বল – তুমি কি অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখ না? একই ধরনের স্বপ্ন? বার বার?

মুনীরের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয় – তুমি কি করে জানো?

আচ্ছা, বলোতো, সেটা কি ধরণের স্বপ্ন ? – শারমীন উল্টো প্রশ্ন করে।

মুনীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর বলে – দেখি, আমি যেন একটা বাঘ হয়ে গেছি, বাঘ হয়ে এ শহরেরই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রায়ই দেখি এটা। কিন্তু তুমি এসব জানো কি করে ?

যদি বলি আমিও একই স্বপ্ন দেখি – শারমীনকে হঠাৎ বেশ গম্ভীর মনে হয়।

বাইরে বৃষ্টি মনে হচ্ছে আরো বেড়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে শারমীন ওর পাশে এসে বসল। হঠাৎ করেই যেন পরিবেশটাও তখন বদলে গেল।

তুমি ওয়্যারউলফের কথা শুনেছ? – শারমীন জানতে চায়।

ওয়্যারউলফ? সেটা আবার কি?

আমি অবাক হচ্ছি তুমি জানো না শুনে। ওয়্যারউলফ মানে নেকড়েমানব। পৃথিবীর অনেক মানুষই পূর্ণিমার রাতগুলোতে বাঘ হয়ে যায়। ইংরেজীতে বলে ওয়্যারউলফ, বাংলায় চন্দ্রাহত ।

তা তুমি এগুলো জানো কি করে? – মুনীর এবার উল্টো প্রশ্ন করে তাকে।

আদিকাল থেকেই এসব নানা কাহিনী প্রচলিত আছে পশ্চিমা দেশগুলোতে, আর তাছাড়া . . . – বলে হঠাৎ থেমে যায় শারমীন।

তাছাড়া কি?

তাছাড়া – একটু থেমে শারমীন বলে – কোন কোন রাতে তুমিও তো সেরকম হয়ে যাও !

তুমি কি করে নিশ্চিত হলে, আমি কোন কোন রাতে সেরকম হয়ে যাই? – মুনীর এবার বোকার মত হাসে।

শারমীন কিন্তু একটুও হাসে না, প্রায় শোনা যায় না এরকম ফিসফিস করে সে বলে – যদি বলি, ঐ দুরাতে তুমি সেরকমই হয়ে গিয়েছিলে!

মুনীর এটাকে তামাশা ভেবে স্বস্তির হাসি হাসে। শারমীন তবুও হাসে না, সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে মুনীরের চোখের দিকে।

মুনীর তখন কি মনে হতেই বলে ওঠে – আমি যদি সত্যি সত্যিই সে রাতগুলোতে পশুতে পরিণত হই, তাহলে তো তুমি আজ বেঁচে থাকতে না, তাই না?

এর কারণ হচ্ছে – হিস হিস করে কথাগুলো বলেই মেয়েটা তার গায়ে একটা খামচি বসিয়ে দেয়, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে, তারপর তার বাক্যটি শেষ করে – আমি নিজেও ওই রাতগুলোতে পশুতে বদলে যাই।

মুনীর প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও অল্পসময়ের ভেতর নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু তখন মেয়েটা তার গলায় কামড় বসিয়ে দেয়, ঠিক যেভাবে নেকড়ে তার শিকারকে কামড়ে ধরে।

আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। হঠাৎ করেই মুনীরের মনে হতে শুরু করল – তার শরীরে যেন কিছু একটা পরিবর্তন আসছে। মনে হতে লাগল – ওর শরীরের লোমগুলো পশুর লোমের মত বড় বড় হয়ে যাচ্ছে, আর দাঁতও যেন মুখ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে – ঠিক একটা নেকড়ের মত।

শারমীন তখন হাসতে শুরু করে, মুনীর বিস্ময়ভরা চোখে ওর হাসি দেখছিল।

আমি তো আগে থেকেই জানি, তুমি কি – শারমীন হাসতে হাসতেই বলে – তোমাকে বার বার ইংগিত দেয়ারও চেষ্টা করেছি, কিন্তু তুমি বুঝতে পারো নি . . .

মুনীর তখন নিজের শারীরিক পরিবর্তনগুলোকে থামানোর চেষ্টা করতে ব্যস্ত।

তুমি বুঝতে পারোনি যে তুমিও আমাদের দলেরই লোক, আমাদের মতই একজন . . . ওয়্যারউলফ – ততক্ষণে শারমীনের নিজের চেহারাও বদলাতে শুরু করেছে।

মুনীর যখন বুঝতে পারল যে শারমীনের কথাই সত্যি, অর্থাৎ সত্যি সত্যিই সে চিরদিনের মত আটকা পড়েছে একটা নেকড়েবাঘের শরীরে – তখন সে আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, কিন্ত সে আর্তনাদটা শোনাল নেকড়ের গর্জনের মতই।

প্রয়োজনে আমি আত্মহত্যা করব – সে বলল – তবু এই শরীর থেকে মুক্ত হব।

শারমীন হাসল, নেকড়ের হাসি – তোমার মৌলভী বন্ধুদের কাছে যাও, তারা যদি দয়া করে তোমাকে পাথর ছুড়ে হত্যা করে . . . জেনার জন্য . . . সত্যি কথা বলতে কি, মৃত্যু ছাড়া এটা থেকে মুক্তির আসলেও আর কোন রাস্তা নেই তোমার কিংবা আমার – শেষ কথাগুলো বলার সময় মেয়েটাকে একটু বিষন্ন দেখায়।

আহ, তাও যদি হত – মানুষ থেকে জন্তুতে পরিণত হবার কষ্টকর শারীরিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মুনীর ভাবল।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্বাভাবিক পূর্ণিমার রাতে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ঢাকা শহরের নিভৃত এক ফ্ল্যাটে পাশবিক আনন্দে মিলিত হয়েছিল একটি নেকড়ে বাঘ ও একটি বাঘিনী।

(রহস্য গল্প / মায়িন খান, ফেব্রূয়ারি ২০১১)

Leave a comment