শেখ সাহেবের মূর্তি মজিদ মিয়ার সাথে প্রথমবার যখন কথা বলে, তখন সে ভাস্কর্যটার মাথার অংশটা রং করছিল।
শীতের দুপুর, আকাশে রোদ ঝক ঝক করছে। সে বাঁশ আর দড়ি দিয়ে মই বানিয়ে ‘শেখ সাহেবের’ কাঁধের ওপর কেবল উঠে বসেছে। মূর্তিটা পনেরো হাতেরও বেশি উঁচা, বিশ হাতও হতে পারে, নিচে আবার এক মানুষ সমান উঁচু বেদী। সব মিলিয়ে মজিদের মনে হচ্ছিলো সে চারতলার বেশি উঁচুতে উঠে গেছে। বাঁশের ওপর নিজেকে ঠিকমতো বসিয়ে যেই না রঙের বালতিতে ব্রাশটা চুবিয়েছে অমনি কে যেন বলে উঠলো – “এই মজিদ, ভালো কইরা রং কইরো, ফাঁকি দিও না।”
সে আশে-পাশে তাকালো, রমিজ্যা এখনো নিচে বসে আছে। নবাবজাদাকে গালি না দিলে কাজ শুরু করবে না। বিড়িতে একটা টান দিয়ে সে চোখের কোনা দিয়ে একবার উপরের দিকে তাকালো। কিন্তু তাহলে কে বললো কথাটা?
হয়তো মনের ভুল, এই ভেবে মজিদ যখন সাদা রঙের প্রথম পোচটা দিলো, তখনি আবার আওয়াজ – “মুখের উপর দুই পোচ দিও, মানুষ কিন্তু মুখটাই দেখে।”
মজিদ এবার সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। এটা ঠিক যে সে ছোটবেলায় মাঝে-মধ্যে গায়েবি আওয়াজ শুনতো, জীনে ধরার কারণে বেশ কয়েকবার কবিরাজের ঝাড়ুর বাড়ি আর ধোঁয়ার ফুঁকও খেতে হয়েছে, কিন্তু আজকের এই আওয়াজটা যেন অনেক বেশি স্পষ্ট। মজিদ রঙের বালতি ঝুলন্ত অবস্থায় রেখেই তাড়াহুড়া করে নিচে নেমে আসে। রমিজ তার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে – “কি বস, নাইমা আইলেন?”
“তুই উপরে যা, আমার মাথা ঘুরাইতেছে। বহুত দিন পর উপরে উঠলাম তো।”
রমিজ হাতের বিড়িটা একপাশে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তর তর করে উপরে উঠে গেলো। কম বয়সে সে নিজেও এরকম বানরের গতিতে বাঁশ বেয়ে উঠে যেতে পারতো, কিন্তু এখন মনে হয় শরীরটা একটু ভারী হয়ে এসেছে। মজিদ অবশ্য এখনো নিজেকে সুঠামদেহীই মনে করে, সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা আর পরিশ্রমী শরীরের দিকে এখনও ‘ছেড়ি’রা আড়চোখে তাকায় বলে তার ধারণা।
সেদিনের পর থেকে শুরু করে ভাস্কর্যের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত মাঝখানের কয়েকটা দিন মজিদ ‘শেখ সাহেব’কে আর কোনো কথা বলতে শোনে নি।
মজিদকে যখন শামীম কন্ট্রাক্টরের লোকেরা ভাস্কর্য রং করার কাজটা দিলো, তখন সে যারপরনাই উত্তেজিত হয়েছিল। এটা তো তার কাছে বিশাল সম্মানেরই ব্যাপার। সে নয়নকে ডেকে বলতে পারবে – “বুজছো নয়ন, ওই যে শেখ সাহেবের মূর্তিটা দেখতেছো, এইটা কিন্তু তোমার বাবা রং করছে। তুমি তোমার ক্লাসে গিয়া বলতে পারবা।”
মজিদ জানে, নয়ন এটা কোনোদিনই করবে না। ও বন্ধু-বান্ধবকে বলতে চায় না যে তার বাবা রঙের মিস্ত্রি। ক্লাস ফাইভে পড়ে তো, তার ইদানিং বেশ মান-ইজ্জতের জ্ঞান হয়েছে। এটা অবশ্য কোন ব্যাপার না, আজকালকার ছেলে-পেলে এরকমই। তাছাড়া নয়নটাই নিজে থেকে যা একটু পড়াশুনা করে, স্বপনটা তো একদমই সেরকম হয় নি। মেট্রিক ফেল করার পর ছেলেটা আর পড়ালেখাই করলো না। গত দুই বছর ধরে মজিদ জানেও না তার ছেলে কোথায় কোথায় সময় কাটায়। এদিকে কন্ট্রাক্ট ধরার ছুটাছুটি আর রাজনীতির খোঁজ-খবর রাখার পর ঘরের প্রতিটা খুঁটি-নাটি বিচার করার সময়ই বা তার কোথায়!
মজিদের ধারণা তার বড় ছেলে নিয়মিত নেশা করে। সে টের পায়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না, কারণ জমিলাই তাকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে। একবার মজিদ ছেলেকে চড় মেরেছিলো, সেই নিয়ে ঘরের মধ্যে জমিলার কি হুলুস্থুল – “ছেলে আমার, তুমি ওর গায়ে হাত দেওয়ার কে? ছেলে যখন হইছে, কয়দিন পালছো? সারাদিন তো আড্ডাবাজি কইরে বাইরে কাটাইছো। এখন খবরদার ঘরের মধ্যে মাতব্বরি করতে আসবা না।” মজিদ সেদিন ভীষণ অসহায় বোধ করেছিল। শয়তান স্বপনটা এক কোনায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলো।
ভাস্কর্যের বিলের প্রথম কিস্তির টাকা ঘরে আনার দিনও একইরকম ঘটনা ঘটলো। মজিদ বালিশের নিচে পাঁচশো টাকা রেখেছিলো, পাঁচটা একশো টাকার নোট – তার স্পষ্ট মনে আছে। ওজু করে ফিরে এসে দেখে টাকা নেই। ঘরে স্বপন আর জমিলা ছাড়া আর কেউ ছিল না, বোঝাই যায় স্বপন টাকাটা সরিয়েছে। সে পাশের ঘরে গিয়ে ছেলেটাকে ধরলো – “ওই, তুই টাকা সরাইছস ক্যান? বাইর কর, অহনি বাইর কর।”
“আব্বা, আমি কিছু নেই নাই।” স্বপন নির্বিকার।
“তুই নেস নাই তো জীনে নিছে? ঘরে জীন-ভুত আছে?”
“কইলাম তো আমি নেই নাই।”
“মনে করছস আমি কিছু জানি না? নেশার লগে অহন চুরিও ধরসস?”
“আমি নেশা করিনা।”
মজিদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা, একটা চড় বসিয়ে দিলো ছেলের গালে – “হারামজাদা আবার মুখে মুখে কথা কস!”
তখনি পাশের ঘর থেকে জমিলা দৌড়ে আসলো। শুকনা-পাতলা মহিলা, কিন্তু চিৎকার শুরু করলে সারা পাড়া এক হওয়ার অবস্থা – “ছেলের গায়ে হাত তুললেন ক্যান আপনে? পাইছেনটা কি? আপনে দেখসেন ও টাকা নিছে? তাইলে ক্যান ওর গায়ে হাত দিলেন? বাইর হন আপনে, ঘরের থেকা বাইর হন, অহনি।”
মজিদ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। তার নিজের ঘর থেকে তাকে বের হয়ে আসতে হবে? তাও আবার নিজের ছেলেকে শাসন করার কারণে? অবিশ্বাস্য! কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে মজিদ শেষ পর্যন্ত ঘর থেকে বের হয়েই গেলো।
ঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে, শীতের রাত বলে রাস্তায় লোকজন কমে এসেছে, সোডিয়াম লাইটের হলদেটে আলোয় পোস্টার শাটা দেয়ালগুলো কেমন বিবর্ণ দেখাচ্ছে। ও বড় চৌরাস্তার মোড়ে এসে রাস্তা পার হয়ে যেই না এজি অফিসের সামনে পৌঁছেছে, অমনি কে যেন বলে উঠলো – “মজিদ মিয়া, কই যাও?”
সে চারদিকে তাকালো, আশে পাশে কেউ নেই। সে তখন শেখ সাহেবের মূর্তির ঠিক নিচে দাঁড়ানো।
“মজিদ মিয়া, তোমার মনটা একটু উদাস মনে হইতেছে?”
এবার মজিদ কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সে স্ট্রিটলাইটের আলোয় মূর্তির দিকে মাথা তুলে তাকালো, সাদা মূর্তিটা দিনের বেলায় যেমন দেখা যায় তার চেয়ে কিছুটা অন্যরকম দেখাচ্ছিল, কিন্তু সে কোনো নড়াচড়া দেখতে পেলো না। শেষপর্যন্ত অবশ্য কৌতূহলের কাছে তার ভয়ের ব্যাপারটা হার মানলো। বেদীর ঠিক নিচে থেকে মূর্তির মাথাটা দেখা যায় না, সে একটু পিছিয়ে গিয়ে উপর দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় বললো – “আসসালামু আলাইকুম। আপনি কি শেখ সাহেব বলতেছেন?”
“ধুরো বোকা, আমি শেখ সাহেব হইতে যাবো ক্যান? উনি তো মারা গেছেন।”
“তাইলে আপনে কে? আমারে কি জীনে আসর করলো নাকি!”
“তুমি মিয়ার ব্যাটা চোখের সামনে কি দেখতেছো?”
“আমার মনে হয় মাথাটা গেছে। মূর্তি কেমনে কথা বলে?” – মজিদ এখন আর উঁচু স্বরে কথা বলছে না, আস্তে কথা বললেও কোনোভাবে সে মনের ভেতর মূর্তির উত্তরগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
“মজিদ, তুমি কিন্তু বল নাই, তোমার মন ক্যান খারাপ?”
মজিদ কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর একসময় বলেই ফেলে তার ঘরের সমস্যার কথা। সবকিছু বলে, কোনো কিছু বাদ দেয় না।
‘শেখ সাহেব’ সব কিছু মন দিয়ে শুনে, তারপর বলে – “তোমার তো যেনো তেনো সমস্যা না, তোমার সমস্যা তো ভয়াবহ। ধৈর্য ধরা ছাড়া তোমার তো আর কোনো উপায় দেখি না।”
মজিদ মনোযোগী ছাত্রের মতো মাথা নাড়ায়।
“মজিদ শোনো, তোমার আরো কথা বলা দরকার। মনে রাখবা, কথার মধ্যেই সমস্যার অর্ধেক সমাধান। তোমার যখনই মন খারাপ হবে, আমার কাছে চলে আসবা, মন খুলে কথা বলবা, দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কথাগুলো শুনে মজিদের মনটা সত্যি সত্যিই ভালো হয়ে গেল। শীতের সাথে সাথে তখন কুয়াশা বাড়তে শুরু করেছে, সাধারণ একটা পাতলা শালে ঠান্ডা মানতে চাইছে না, তাড়াহুড়ায় সে সোয়েটারও পরে বের হয় নি। তবুও শেখ সাহেবের কথা শুনতে তার ভালো লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো সারা রাত কথা বলে।
“মজিদ, অনেক রাত হয়েছে। তুমি শীতে কাঁপতেছো, যাও বাসায় চলে যাও। কালকে আবার কথা হবে।”
কথাটা মজিদের মনে ধরলো। সে লম্বা করে একটা সালাম দিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলো। রাস্তায় লোকজন একদমই নেই। বাসায় পৌঁছে সে দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখলো বাইরের দরজা খোলাই আছে। তাহলে কি জমিলা ওর জন্যই দরজা খোলা রেখেছে? ঘরে ঢুকে অবশ্য দেখলো সব অন্ধকার, যে যার খাটে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। শুধু বদমাইশ স্বপনটাকেই কোথাও দেখা গেল না। মজিদের মনটা আবার দমে গেল।
পরদিন জোহরের নামাজ সে জামে মসজিদে পড়লো, তারপর জামাতের পর বসেও থাকলো। নামাজ শেষে মুসল্লিরা যখন একে একে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন সে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। কুশল বিনিময়ের পর বললো – “হুজুর, কালকে রাত্রে শেখ সাহেবের মূর্তির নিচ দিয়ে যাইতেছি, তখন কে যেন আমারে ডাক দিয়ে কথা বলতে চাইলো।”
“বল কি?” – মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক চোখ বড় করে তাকালেন – “তুমি উত্তর দেও নাই তো?”
“মাথা খারাপ?” – মজিদ নিজের গালে আলতো করে চপেটাঘাত করে বলে – “তওবা, আমি তো ডরেই অস্থির।”
“তুমি ঠিক কাজ করছো। এগুলি শয়তানের ডাক, এগুলিতে কান দিবা না। মূর্তি-ভাস্কর্য এগুলি তো খোদার নাফরমানি, এইজন্য এইগুলির ঘাড়ে শয়তান বাসা বান্ধে। তুমি ওই মূর্তির ধরে-কাছেও যাবা না, খবরদার। দিনের বেলায়ও না।”
মজিদ বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লো।
“আইচ্ছা, তুমিই না ওই মূর্তির কন্ট্রাক্ট নিছিলা?”
“না না হুজুর, আমি তো খালি রং করছি। কন্ট্রাক তো নিছে শামীম সাহেব।”
“ও বুজছি।” মজিদ জানে শামীম সাহেবের নাম শুনলে হুজুর বেশি কিছু বলবে না, শামীম কন্ট্রাক্টর মসজিদ কমিটির প্রেসিডেন্ট। সুরমা দেয়া চোখ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রেখে হুজুর বিড়বিড় করে কি যেন পড়লেন, তারপর বললেন – “এখন বুঝলাম কেন তোমারে শয়তান টার্গেট করছে। তোমারে দোআ কইরা দিছি। কিন্তু শোনো মজিদ, তোমার এই মূর্তি-ফুর্তির কাজ নেওয়া ঠিক হয় নাই।”
“পেটের দায়ে করি হুজুর। যেই কাজ পাই ঐটাই করি। তখন তো আর এইসব ভাবি নাই।”
“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন খাস দিলে খোদার কাছে মাফ চাইয়া নাও। তিনি গাফুরুর রাহিম। আর কোনোদিন এইসব করবা না।”
মজিদ সে রাত্রেই আবার ‘শেখ সাহেবের’ কাছে গেল। মূর্তি তাকে হুজুরের কথা মতো চলতে উপদেশ দিলো। মজিদ “আচ্ছা” বললো, তারপর বেদীর নিচে অনেক্ষন বসে থাকলো, যেন তার যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। শেষে ‘শেখ সাহেব’ তাকে বললো যে মন খুব বেশি উতলা হলে সে মাঝে-মধ্যে এখানে দেখা করতে আসতে পারে, এতে হয়তো খুব একটা দোষের কিছু হবে না।
এরপর থেকে মজিদ প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই মূর্তির কাছে আসতে শুরু করলো। মনের সব কথা সে খুলে বলতো ‘শেখ সাহেবের’ কাছে। নয়নের কথা, সে কেন মজিদকে স্কুলে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় না। স্বপনের কথা, কেমন করে চোখের সামনে ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেল, তার কি দোষ ছিল, এসব। জমিলার কথাও প্রায়ই আলোচনায় আসতো, কেমন করে দিনের পর দিন তার পরিবার তার উপর ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠলো। কেউ হয় তো জাদু করেছে, নাহলে তার চেহারা দেখলেই কেন জমিলার মাথায় রক্ত চড়ে যাবে, কেনই বা সামান্য সব বিষয় নিয়ে জমিলা প্রতিদিন ঘর-বাড়ি মাথায় তুলবে!
শেখ সাহেব স্পষ্ট কোনো কিছু বলে না, কিন্তু মন দিয়ে মজিদের কথা শোনে, আর স্বান্তনা দেয়। ওর এটাই ভালো লাগে, ওর এতেই মনটা হালকা হয়ে যায়। আলোচনা শেষে প্রতিদিনই সে উৎফুল্ল মনে বাসায় ফেরে। কয়েকদিনের মধ্যে তার ভেতর হাসি-খুশি ভাবটা ফিরে আসতে শুরু করে। আশে-পাশের লোকজন সেটা খেয়ালও করতে থাকে। এই যেমন এক সকালে রমিজ্যার সাথে সে বিড়ি টানছিলো, ছোকরা তাকে বলে – “বস মনে হয় বড় ফুর্তিতে আছেন?”
আরেকদিন শামীম কন্ট্রাক্টর তাকে একই কথা বললো – “কি মজিদ, তোমারে খুশি খুশি লাগতেছে?” সে “না স্যার, কিছু না” বলে চলে আসলো। শামীম সাহেব তার বিলের সতেরো হাজার টাকা দুই মাসের বেশি সময় ধরে আটকে রেখেছে, তারপরও তাকে দেখে মজিদের মনে কোনো রাগ জাগল না। তার মনে হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন দেনা-পাওনা হতেই পারে।
জমিলা অবশ্য ব্যাপারটা ভালো ভাবে নিলো না। একদিন সকালে দরজায় বসে সে শীষ দিচ্ছিলো দেখে পেছন থেকে প্রায় তেড়ে এলো মহিলা – “কয়দিন ধইরাই দেখতেছি আপনি বড় মৌজে আছেন। আবার কার লগে ঢলাঢলি শুরু করছেন? সস্তা মাগি পাইছেন, না? কয় টাকা দেন? ঘন্টা চুক্তি, না মাস চুক্তি?”
নয়ন পড়া বন্ধ করে সব শুনছিলো। সে বড় হচ্ছে, এগুলি নিশ্চয়ই সব বুঝে। মজিদের লজ্জার সীমা থাকলো না। আলোচনা মাত্রা ছাড়ানোর আগেই সে দ্রুত পালিয়ে গেল। নারায়ণের দোকানে গিয়ে বসে চা দিতে বলে ঘটনাটা মনে মনে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলো। সে খুব করে চাইলো জমিলার ওপর মেজাজ চড়াতে, কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে প্রতিবার সে রাগ করতে ব্যর্থ হলো। বার বার তার মনে হলো, জমিলাকে সে ভালো কোনো জীবন দিতে পারে নি। তাছাড়া মহিলারা কাছের লোকের ওপরই সব রাগ ঝাড়বে, এইটাই তো স্বাভাবিক।
এদিকে শহরে তখন গন্ডগোল বাড়ছিল। সে শুনেছে হুজুররা কোনো কারণে খেপে উঠেছে। পরে সে রমিজের কাছে বিস্তারিত শুনলো যে হুজুররা নতুন এই ভাস্কর্য উদ্বোধন করতে দিবে না, মূর্তি বানানো ধর্মে নিষেধ আছে। এমনকি তারা এটা ভাঙচুরও করতে পারে। রমিজ ওয়াজ-মাহফিলে এসব কথা-বার্তা শুনেছে।
ভাঙচুরের কথাটা শুনে মজিদ শংকিত হয়ে পড়ল। শত হলেও এটা তৈরির একটা অংশ সে, এটার কেউ ক্ষতি করলে তার বুকে লাগবে। আর তাছাড়া ‘শেখ সাহেব’কে ভেঙে ফেললে প্রতিদিন কে তার কথা শুনবে! সে তো আর সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কেউ না যে, ঘন্টার পর ঘন্টা তার প্যানপ্যানানি কেউ একজন শুনবে, তারপর স্বান্তনা দেবে, যেটা ‘শেখ সাহেব’ তার সাথে করে।
সে তখনি ছুটে গেল কন্ট্রাক্টর শামীমের অফিসে। শামীম সাহেব বের হচ্ছিলেন, তাকে প্রথম না দেখার ভান করলেন। উনি সাদা জিপ গাড়িটার চকচকে দরজাটা খোলার আগেই মজিদ দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেললো।
“মজিদ, আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো। আমার একটা জরুরি কাজ আছে।”
“স্যার, এটা আরো বেশি জরুরি। হুজুররা নাকি শেখ সাহেবের মূর্তি ভাইঙ্গা ফেলবে?”
শামীম কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যেন কিছুই জানেননা, তারপর বললেন – “তুমি কোথায় শুনছো এই কথা?”
“মসজিদে ওরা বলাবলি করতেছিলো। ওয়াজ মাহফিলে নাকি ঘোষণা দিছে।”
শামীম সাহেব গাড়ির দরজা খুললেন – “ভাঙলে ভাঙবে। তোমার আমার কি?”
মজিদ হা করে তাকিয়ে রইলো শামীমের দিকে। তার বিল আটকে রাখা নিয়েও সে বোধ হয় এতটা অবাক হয়নি।
শামীম গাড়িতে ঢুকে গেলেন, যাবার আগে কি মনে করে কালো কাঁচের জানলাটা অল্প নামিয়ে বললেন – “শোনো মজিদ, চিন্তা কইরো না। ডিসি সাব বলছে এইটা ভাঙলে আমরা এইরকমই আরো বড় আরেকটা বানাবো। টাকা বরাদ্দ করাই আছে। আর তুমি তো জানোই, রঙের কাজটা তুমিই পাবা।”
ভোঁ করে গাড়িটা চলে গেল, শুকনো ধুলো এসে লাগলো মজিদের চোখে-মুখে। কিন্তু সে কিভাবে মানুষকে বোঝাবে যে সে আরো বড় মূর্তি চায় না, ঠিক এই মূর্তিটাই তার প্রয়োজন, অন্য কোনো কিছুতেই তার চলবে না।
আসরের পর মজিদ গিয়ে ধরলো রাজ্জাক সাহেবকে। মাওলানা তার কাঁধে হাত রেখে বললেন – “কে তোমারে বলছে শেখ সাহেবের মূর্তি ভাঙবে? শোনো, যে দেশে আছো সেই দেশের আইন তোমারে মানতে হবে, এইটাই ইসলামের বিধান। পোলাপান গরম হইছে, মনে হয় সমাবেশ করবে, চিল্লাপাল্লা করবে, তারপর চইলে আসবে। মূর্তি ভাঙার কোনো প্ল্যান নাই।”
মজিদ অবশ্য আশ্বস্ত হতে পারলো না, কিন্তু আলাপ করার মতো আর কাউকে খুঁজেও পেলো না। শেষ পর্যন্ত রাত্রে গিয়ে ‘শেখ সাহেব’কেই সব ঘটনা খুলে বললো – “হুজুর বলছে, আপনেরে ভেঙে ফেলা দরকার, কেননা মানুষ নাকি আপনেরে মূর্তি পূজা করবে। আচ্ছা, এইটা কি ঠিক মানুষ আপনেরে পূজা করবে?”
“আরে ধুর, মানুষ কি অত বোকা নাকি যে আমারে পূজা করবে? মানুষ পূজা করবে টাকারে, নাইলে ক্ষমতারে, আর কিছু না হইলে মান-সম্মানরে। এই যেমন তোমার শামীম কন্ট্রাক্টর, ও তো মনে করে টাকা দিয়া সব কিছু করা সম্ভব। তারপর যারা আমারে বানাইছে, তারা আবার ছুটতেছে ক্ষমতার পিছনে। তারা মনে করতেছে নেতার মূর্তি বানাইলে মানুষ ওদের বেশি চিনবে-জানবে, বেশি চান্দা দিবে, বেশি ভোট দিবে, এই আর কি।”
এইখানে এলে এজন্যই মজিদের মনটা শান্ত হয়, এইসব জ্ঞানের কথা জানা যায়, শোনা যায়। শেষে সে বলে – “তাইলে দেখা যায়, হুজুররাই ঠিক লাইনে আছে, তারা দুনিয়াবী কোনো কিছুর পিছনে নাই।”
“কে বলছে নাই? উনারাও তো মান-ইজ্জতরে খুব বড় করে দেখে। যার যত বড় হুঙ্কার, তার তত বেশি ইজ্জত।”
মজিদ মাথা নাড়লো, সত্যিই জানার কোনো শেষ নাই।
সে রাত্রে বাসায় ফিরে মজিদ যা দেখলো তার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না। জমিলা সমানে বমি করছে, নয়নটা পাশে অসহায়ের মতো বসে সেটা দেখছে। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে জমিলাকে ধরতেই নয়ন বললো বমির সাথে রক্তও যাচ্ছে।
জমিলার শরীরটা প্রায়ই খারাপ থাকে, তার উচিত ছিল অনেক আগেই ওকে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। সে সেটা করে নি, স্বামী হিসেবে সেদিক দিয়ে সে ব্যর্থ। চোখের সামনে নয়নটা বখে গেলো – মারপিট করা ছাড়া সে আর কি করেছে, কয়দিন ছেলেটার সাথে বসে ঠান্ডা মাথায় কথা বলেছে? বাপ হিসেবেও সে নিশ্চয়ই ব্যর্থ।
মজিদ উঠে দাঁড়ালো। আজকে তাকে কিছু একটা করতেই হবে। সে বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালো স্কুটারের জন্য। রাত তখন সাড়ে এগারোটা বাজে, তারপর আবার শীত, কোথাও কোনো কিছু দেখা গেলো না। সে দৌড়ে গেলো জমির আলীর গ্যারাজে, যদি কোনো ড্রাইভার দেরি করে আসে গাড়ি জমা দিতে।
প্রায় আধাঘন্টা পর যখন সে গাড়ি নিয়ে ফেরত আসলো, তখন জমিলা দুর্বল হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। নয়ন একটা ময়লা বালিশ পুটলি করে তার মাথার নিচে দিয়ে হাতপাখা দিয়ে মাকে বাতাস করছে।
মজিদ আর সিদ্দিক ড্রাইভার মিলে জমিলাকে গাড়িতে তুললো, ওর শ্বাস ততক্ষণে বেশ দুর্বল হয়ে এসেছে। মজিদ সিটের একপাশে বসলো, আধশোয়া জমিলার মাথা তার কোলে। প্রায় বাইশ বছর আগের কথা, এরকম এক শীতের রাতেই জমিলার সাথে সে রিক্সায় চড়ে বেড়াতে বের হয়েছিল। কুয়াশা আর ঠান্ডার মধ্যে নতুন বিয়ে করা বৌয়ের সাথে বেড়াতে বের হয়ে তার সে কি ভালো লাগা! দিন কত দ্রুত চলে যায়!
হাসপাতালের কাছাকাছি যখন ওরা চলে এসেছে, জমিলা ক্ষীণস্বরে কি যেন বললো। মজিদ প্রথমে ভাবলো সে পানি চাচ্ছে। কিন্তু মুখের কাছে কান নিতেই সে শুনলো জমিলা বলছে – “আমি মনে হয় বাচুম না। আপনের সাথে অনেক মেজাজ করছি। কিছু মনে রাইখেন না।”
মজিদের চোখে পানি চলে এল, কেন সে জানে না, অনেকদিন পর তার এরকম হলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো – “আমি থাকতে তোমার কোনো চিন্তা নাই।”
বহু ঝামেলা করে জমিলাকে জরুরি বিভাগে ভর্তি করে সে যখন বের হলো, তখন রাত তিনটা বেজে গেছে। একবার বাসায় যাওয়া দরকার, নয়নটা বাসায় একা, কিছু টাকা-পয়সাও আনতে হবে।
হাসপাতালের গেটটা পার হতেই চাঁদের আলোয় সে দেখলো তিন-চারটা রিক্সা সামনে দাঁড়িয়ে আছে, শেষ রাতের ক্ষেপের আশায়। কিছু লোক আছে এরা শুধু রাত্রেই রিক্সা চালায়। একটু এগিয়ে যেতেই মজিদ দেখলো গেটের পাশটায় একটা কমবয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেটা মনে হলো একবার তার দিকে তাকালোও। কি মনে করে সে ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেলো।
বজ্জাত স্বপনটা দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে এখানে সে কি করছে ! তাকে হাতে-নাতে ধরার জন্য এগিয়ে যেতেই কেন যেন মনে হলো ছেলেটা কাঁদছে। আজ আশ্চর্য সব ঘটনাই ঘটছে! কাছে যেতেই স্বপন তার দিকে আড়চোখে তাকালো। সে কাছে যেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেটার কান্না এতে বেড়ে আরো গেলো। কিন্তু এটা ঠিক আছে, বদমাইশটার একটু কান্নাকাটি করার দরকার আছে।
ফেরার পথে বড় চৌরাস্তার মোড়ে সে রিক্সা থেকে নেমে গেলো। ‘শেখ সাহেব’কে নতুন পরিস্থিতিটা জানানো দরকার। বলা দরকার যে সে তার জীবনের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছে, এখন থেকে সে তার জমে থাকা কাজগুলো সব শেষ করবে, তার ঘরের সব সমস্যাগুলোর সুন্দর সমাধান করবে।
মজিদ ‘শেখ সাহেবের’ বেদির নিচে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে ডাকলো। একবার, দুবার, অনেকবার, অনেকক্ষন ধরে। কিন্তু সে রাতে কোনো বিচিত্র কারণে ‘শেখ সাহেব’ সত্যিকার মূর্তির মতোই বেদির ওপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন, একবারের জন্যও তার ডাকে সাড়া দিলেন না।
(ছোট গল্প / মায়িন খান, জানুয়ারী ২০২১)
