এ বুলবুলি বাংলা বুলবুলি না, এমনকি কোন একক শব্দও নয়। ইংরেজি শব্দ “বুল” আর “বুলি” মিলে এই বুলবুলি। বুল এখানে বিশাল একটা পরিমান আর বুলি কথাটার মানে হল তর্জন। সমস্যা হল, তর্জন কথাটার মানে আমার জানা নেই। ডিকশনারী থেকে পেয়েছি। তবে ইংরেজি বুলি শব্দটার অর্থ আমি জানি, বুঝি। কারণ, আমার জীবনের প্রথম ৪০ বছরে আমি বোধ হয় লক্ষাধিক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি যেগুলোর প্রত্যেকটাকেই বুলি বলা যায়। তাহলে আসুন, খটমটে অনুবাদের বদলে ঘটনা, তাও আবার সত্যি ঘটনা দিয়েই বুলি বুঝে নেই। তবে যারা ভালো করেই বোঝেন, তারা ভুল বুঝবেননা যেন, আমি কাউকে তর্জন করার কোন চেষ্টা করছিনা !
জীবনের প্রথম বুলি পেয়েছি প্রাথমিক স্কুলে। সত্য কথা বলতে কি, শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ছিল বুলি করা। টিটকিরি, অপমান, অসম্মান হল শিক্ষায় উন্নতির কোমল পদ্ধতি, আর কঠোর পদ্ধতি হল বেত্রাঘাত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পর্যন্ত একটানা এই কোমল পদ্ধতি চলেছে। সাদা হাফ হাতা টি শার্ট পরার অপরাধে আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক দেড়শ ছাত্রের ক্লাসে আমাকে বলেছিলেন, “ইউ, গেঞ্জি বয়, তুমি দাড়াও!” বাকিটা না হয় নাই শুনলেন! একবার এক ছাত্রি ভাইভা পরিক্ষায় মানব যোনিপথের আকার ভুল বলাতে তার বিলাত ফেরত অধ্যাপক বলেছিলেন, ” ওখান দিয়ে কি ট্রেন যাতায়াত করে যে এতো বড় হতে হবে?”। শিক্ষকের এই ইঙ্গিতে বেচারা ছাত্রি বুঝে নিয়েছিলেন, পরিক্ষায় পাশ হবে না!
শিল্পমনের প্রথম পরিচয় হিসাবে যখন দেশি সঙ্গিতের বদলে পাশ্চাত্য সঙ্গিত শোনা শুরু করলাম, তখন আত্মীয় মহলে রসিকতার যে ঝড় উঠল তাতে বেঁচে থাকাই দায়। গান শুরুর সাথে সাথে শুরু হয়ে যেত চারপাশের সরব সমালোচনা, কখনো কখনো গানের চেয়ে উঁচু আর দীর্ঘ সে সব রব। অথচ দেশি সঙ্গীতের ব্যাপারে আমার সম্মানের করপন্য কখনই ছিল না। বয়স যখন পনেরো ছুই ছুই, হাল ফাশনের পোশাকের বাসনা সবে জাগতে শুরু করেছে। সৎ চাকুরীজীবী বাবার পয়সা ছিলনা দামি মার্কেট থেকে কিনে দেবার। গার্মেন্টসের কল্যাণে ততদিনে রিযেকটেড পোশাক বাজারে সস্তায় পাওয়া যায়। খুব খায়েশ করে ছাই রঙের একটা ঢিলাঢালা প্যান্ট কিনলাম যার হাঁটু বরাবর দুটো দৃশ্যমান পকেট আছে। এক সন্ধায় এক আত্মীয়ের বাসায় আড্ডায় পিতৃতুল্য একজন বললেন, “একটা ছুরি হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেই ছিনতাইকারী মনে হবে!” খুব রস করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন আরও বহুকথা, অংশ নিয়েছিলেন অন্যরাও। আমি তখনও হাসতে পারিনি, এখন পারিনা; সব সময়ই এটা আমার কাছে বর্বর আচরণের উদাহরন। হ্যাঁ, এগুলো সবই বুলির উদাহরন যা আমাদের সমাজে শুধু নিষ্পাপ আর জনপ্রিয়ই না, প্রয়োজনীয়ও।
হতে পারে, সামাজিক জনপ্রিয়তার কারণে এমন কাজগুলোকে বুলির মত কিছু নাম না দিয়ে বরং সমালোচনা কিম্বা মন্তব্য বলা হয়; আর শিক্ষা তো এর ওপরই দাঁড়িয়ে, শিক্ষক-শিক্ষিকা এটা ছাড়া অসহায়। হয়ত এ জন্যই যখন উন্নত বিশ্বে যখন চাকুরির শুরুতেই বুলি থেকে সাবধান করার জন্য ট্রেনিং দেয়া হয়, তখন আমাদের সমাজের অফিসারস ক্যান্টিন এ বুলি হল আনন্দের প্রধান মাধ্যম। লেখাটা শেষ করব এমন একটা ঘটনা দিয়েই। তখন আমি নিজেও অধ্যাপনা করি, তবে খুবই নবীন। আমার একজন সম্মানিত সহকর্মী, যিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে ডক্টরেট করেছেন, আমার কোমরের ব্যাগ (বেল্ট ব্যাগ) দেখে আরেকজন সহকর্মীকে দেখিয়ে বললেন, “এখন পিস্তল বের করবে”; বলেই দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
আমিও কম যাইনি, সমাজের যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর কবে যে নিজেও এতে যোগ দিয়েছি বুঝতেও পারিনি। তবে ঘরের বাইরের মানুষের সাথে এই অসভ্যতার অভ্যাস না থাকায় বাসাতেই প্রাকটিস করেছি। তবে এখন আমি ভালো হয়ে গেছি, অন্তত চেষ্টা করছি। আপনিও হতে পারেন ! না, আমি আপনার নেশা আসক্ত ছাত্র বা সন্তানকে বলছিনা, বলছি আপনাকে! দেখবেন আপনার ছাত্র বা সন্তান আপনাকে দেখে ভালোটা ঠিক শিখবে!
