পর্ব ১: সূচনা
অধ্যায় ১: মৃত্যুতে সবকিছুর শেষ হলে মানবজীবনের উদ্দেশ্য কি?
মুনিরের জীবনের আর মাত্র এক বছর এগারো মাস বাকি আছে। আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে গলায় অপারেশনের পর ডাক্তার আজাদ মুনিরকে বলেছিল যে সে এই পৃথিবীতে আর মাত্র দুই বছর বাঁচবে। সেই হিসেবে ওর হাতে দুই বছর থেকে এক মাস কম সময়ই আছে। ঘড়ির কাটা টিক টিক করে এগিয়ে চলেছে, মেডিক্যাল কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার সময় সেকেন্ডের কাটার সেই মৃদু শব্দই মুনিরের কানে যেন ঘন্টার উঁচু ধ্বনি হয়ে বাজতে লাগল।
মেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বড় সিঁড়িটা ওর চোখে পড়ল, মুনির সেটা ধরে সোজা দোতলায় উঠে গেল। সে হিস্টোপ্যাথোলজি বিভাগটা খুঁজছিল। বিল্ডিঙের ভেতরটা বেশ বড় আর খোলা-মেলা, ফলে বাইরের গরমের আঁচটা এখানে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। মুনিরের শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে, সে শরীর থেকে সেটা আলগা করে একটু স্বস্তি পেতে চাইল। এই নীল শার্টটা মুনিরের খুব পছন্দ, চার বছর আগে ঈদে বাবা এটা দিয়েছিল। শার্টটা কলারের কাছে ফেঁসে গেছে, কিন্তু সামনে থেকে দেখে ওটা বোঝার কোন উপায় নেই।
মুনিরের বয়স মাত্র উনিশ। ছোট-খাটো শ্যামলা ছেলে সে, বড় বড় চুল আর চশমা তার মধ্যে একটা ভালো ছাত্র ভাব নিয়ে এসেছে। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীও বলে যে সে স্কুল শিক্ষক বাবা আর স্কুল শিক্ষিকা মায়ের মস্তিস্ক পেয়েছে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সে, প্রাথমিক স্কুলে বৃত্তি পেয়েছিল, কোন কোচিং ছাড়াই নিজে নিজে পড়ালেখা করে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে – মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক দুই পরীক্ষাতেই।
দোতলার বারান্দা পার হয়ে একেবারে শেষ মাথায় ডিপার্টমেন্টটা খুঁজে পাওয়া গেল, দরজার ওপর বাদামি কাঠের বোর্ডে সাদা রং দিয়ে লেখা ‘প্যাথোলজি বিভাগ’। ভবনের এই কোণটা বেশ অন্ধকার, ডিপার্টমেন্টের দরজার উল্টাদিকেই পাবলিক টয়লেটের দরজা যার ভেতর থেকে জৈবিক এমোনিয়ার গন্ধ আসছে। মুনির এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডিপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ল।
হলঘরে ঢুকেই একপাশে দুইটা কাউন্টার, একটা খালি, অন্যটাতে কমবয়সী একজন মহিলা বসে টিকেট দিচ্ছে , সে সাদা একটা শাড়ি পড়া। কাউন্টারের সামনে কোন ভিড় নেই – হয় এই শহরে মানসিক রোগী নেই, অথবা লোকজন মানসিক রোগকে রোগই মনে করে না, কিংবা এই বিভাগের কথা মানুষ তেমন জানে না। মুনির পাঁচ টাকা দিয়ে একটা ‘সাধারণ’ টিকেট নিয়ে নিল।
আজ কেউ ওর সাথে এলে মুনিরের অস্থিরতা কিছুটা কম লাগত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকেই বলা হল না। বীথি সাথে আসলে সবচেয়ে ভালো হত, মেয়েটা ওকে খুব ভালো বোঝে – কিছু বলার আগেই বুঝে ফেলে সে কি বলতে চাচ্ছে। একবার সে অর্গানিক কেমিস্ট্রির একটা প্রশ্ন নিয়ে বীথির কাছে গেল, কিন্তু আলোচনার পুরোটা সময় মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে থাকলো। সে কি বুঝতে পেরেছিল যে রসায়নের সেই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার কোন দরকারই মুনিরের সেদিন ছিল না? বীথির এই মনের সব কথা পড়তে পাড়ার বিষয়টা মুনিরকে মাঝে মাঝে বেশ অস্বস্তিতেই ফেলে দেয়।
লম্বা কাঠের বেঞ্চে অপেক্ষা করতে করতে মুনির লক্ষ্য করল সামনের বেঞ্চে এক মহিলা ষোলো-সতর বছরের একটা মেয়েকে নিয়ে বসে আছে, মেয়েটা মহিলার কাঁধে মাথা রেখে বসেছে, চোখ বন্ধ। একটু পর পর সে কেঁপে কেঁপে উঠছে, তারপর আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছে। তার নিজের বেঞ্চের অন্যপাশে শুকনা-পাতলা একটা ছেলে ঝুকে বসে মোবাইল ফোনে কি যেন দেখছে আর আপন মনে হাসছে।
মুনির চশমাটা খুলে শার্টের কোনা দিয়ে সেটার কাঁচ পরিষ্কার করতে শুরু করল। মেটালের চশমাটা পুরোনো হয়েছে, রং একেবারেই জ্বলে গেছে। মুনির তবু খুশি যে এটা দিয়ে কাজ চলে যাচ্ছে। যতদিন খরচটা আটকে রাখা যায়, ততদিনই রক্ষা।
ডাক্তারের ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বীথির ফোলা ফোলা গোলগাল চেহারা আর বড় বড় দুটো চোখ মুনীরকে বার বার তাড়া করে ফিরতে লাগল। কিছুতেই সেই গোলাপি ঠোঁট-মুখ সে মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারছিল না, অথবা চাইছিল না। হ্যা, আজ ওর সাথে যদি বীথি ডাক্তারের চেম্বারে আসত, তাহলে মুনির হয়তো সমস্ত দুশ্চিন্তা ভুলে ওর দিকে তাকিয়েই দিনটা কাটিয়ে দিতে পারত।
মুনিরকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হল না, মিনিট পনরোর মধ্যেই তার ডাক এল। কাউন্টার থেকে কমবয়সী মহিলাটা তার নাম ধরে ডেকে তাকে ডাক্তার আজিজুল হকের রুমে যেতে বলল।
মুনির যা ভেবেছিল, ডাক্তার আজিজ সে তুলনায় অনেক কমবয়সী। ভদ্রলোক মোটা-সোটা, গোলাপি শার্টটার ওপরের বোতাম খোলা। মাথার ওপর সিলিং ফাঁটা শো শো শব্দ করে ঘুরছে, কিন্তু এর মধ্যেও তার কপালে ঘাম দেখা যাচ্ছে। ডাক্তার পুরোনো টেবিলের ওপাশ থেকে মুনিরকে বসতে ইঙ্গিত করলেন।
টেবিলের ওপর কাঁচ দেয়া, সেই কাচের নিচে নানারকম কার্ড আর ছবি রাখা, একপাশে ঠান্ডা চায়ের কাপ। ডাক্তার আজিজ একবার ফাইলের দিকে চোখ রাখলেন, তারপর কিছুটা সামনে ঝুকে এসে সোনালী চশমার ওপর দিয়ে মুনিরকে দেখতে লাগলেন।
‘মুনির চৌধুরী, আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো।’
‘আপনার তো কিছু টেস্টের রেজাল্ট এসেছে। আপনার সাথে কি আর কেউ এসেছে?’
মুনির বুঝতে পারল, খবর খুব একটা ভালো না, তা না হলে সরাসরি কেন তার সাথে কথা বলা যাবে না।
‘আমি একাই এসেছি। আমার ফ্যামিলি এখানে থাকে না।’
ডাক্তার তার সোনালী চশমা নাকের ওপর ঠেলে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।
‘আপনার অটোপ্সি রিপোর্ট দিয়েছে, ক্যান্সার স্প্রেড করে আপনার গ্ল্যান্ডের বাইরের অংশ পর্যন্ত চলে এসেছিল। সুতরাং এটা নিশ্চিত আপনি ডেঞ্জার জোনের বেশ ভিতরেই আছেন।’
‘কিন্তু সেই গ্লান্ড তো কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে।’
‘কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু যেটা দেয়াল পর্যন্ত চলে এসেছে, সেটা দেয়ালের বাইরেও কিছুটা চলে যেতে পারে।’
‘এসবি তো শুধু সম্ভাবনা। ক্যান্সার গলার বাইরে পর্যন্ত চলে গেছে তার তো কোন প্রমান নেই।’
মুনির বুঝতে পারছিল না কেন তার গলার স্বর উঁচু হচ্ছিল।
ডাক্তার আবার তার দিকে মাছের চোখের মত দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন।
‘ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই যখন বেশি হয়, তখন চিকিৎসা নেয়া দরকার হয়ে পড়ে।’
মুনির ভেতরে ভেতরে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করতে থাকল।
‘চিকিৎসার জন্য আমাকে কি করতে হবে?’
‘গুড পয়েন্ট। আমরা সাজেস্ট করি রেডিয়েশন দিতে, তারপর কেমো। আমাদের হাসপাতালে এগুলোর ব্যবস্থা নেই, আপনাকে প্রাইভেটে যেতে হবে।’
‘কত খরচ পড়তে পারে?’
‘সব মিলিয়ে পনর-বিশ লাখ। তবে আজকাল অনেকে ইন্ডিয়াতে গিয়ে চিকিৎসা করছে, খরচ বাংলাদেশের অর্ধেক পড়ে। কমও হতে পারে। আমি বলবো অন্তত রেডিয়েশনটা নিয়ে আসেন।’
মুনির ডাক্তার আজিজের সাথে কথা শেষ করে যখন রুমের বাইরে বেরিয়ে এল, তখন তার শরীর বেশ দুর্বল লাগছিল। মনে হচ্ছিল সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। আবহাওয়াটা মনে হয় শরীরের ওপর প্রভাব ফেলছে। কোথাও থেকে পানি খাওয়া দরকার।
মুনির কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে তার শরীরে ক্যান্সার আছে। প্রথমত যে গ্ল্যান্ডটা কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে তাতে যে ক্যান্সার ছিল সেটাই তো অবিশ্বাস্য। দ্বিতীয়ত সে ক্যান্সার আবার গ্ল্যান্ডের দেয়াল পার হয়ে গলা থেকে ফুসফুসে আর মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়বে, তাও অত অল্প সময়ের মধ্যে, সেটা মনে হয় না। আর ডাক্তাররাও অযথা মানুষকে ভয় দেখায়, তারা সবসময় সেফ সাইডে থাকতে চায়, অথচ সেটা করতে গিয়ে যে মানুষের পথে বসার অবস্থা হতে পারে সেটা তারা চিন্তা করে না।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সে যখন বাইরের কড়া রোদের ভেতর এসে দাঁড়াল, তখন তার মাথা রীতিমতো ঝিম ঝিম করছে। ওর মনে হল ও চোখেও সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা দেখছে।
মেসে ফিরে মুনির দেখে সজল খাবার ঘরে চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে আছে, দৃষ্টি মাটির দিকে। সজল মুনিরের এলাকারই ছেলে, মুনিরের চেয়ে দুবছরের ছোট, কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে তাকে মুনিরের চেয়ে বড় মনে হয়। তার বুকে লোম আছে, সেটা দেখানোর জন্যই কিনা কে জানে সে সবসময় শার্টের বুকের বোতাম খোলা রাখে।
সজলের বাবা কাস্টমসে কাজ করতো। কিভাবে কিভাবে অনেক টাকা বানিয়ে ফেলে, তারপর চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করে। ভদ্রলোক এখন একটা সাবানের ফ্যাক্টরি দিয়েছে। সজল তার বড় ছেলে, অনেক আশা করে ময়মনসিংহ পাঠিয়েছে কলেজে পড়ানোর জন্য। মুনিরের ওপর ভরসা করে একই মেসে ঘর ভাড়া করেও দিয়েছে।
মুনির সজলের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল, তারপর জিজ্ঞেস করল সে কি নিয়ে চিন্তিত। সজল বলল মুনা নামে তার এক মেয়ে তাকে চোখ দিয়ে ইশারা করেছে, সে বুঝতে পারছে না কেন। মুনিরের হাসি এল, সম্ভবত সারা দিনে এই প্রথম।
‘সব ইঙ্গিতকেই সম্পর্ক বলা যায় না!’ মুনির বলল, কিন্তু সজল উত্তরে কিছু বলল না।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে – ওই মেয়ে যদি তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চায়, তাহলে সে আবার তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। এই মুহূর্তে এটা চিন্তা করে কোন লাভ নেই।’
কিন্তু মুনিরের কেন যেন মনে হল সজল এটা নিয়েই বরং ভাবতে চাচ্ছে, ফলে তাকে চিন্তিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে মুনির নিজের ঘরে চলে এল, তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিল।
মুনিরের ঘরটা খুবই ছোট। একটা সিঙ্গেল খাটের গা ঘেঁষে একটা ভাঙা ছোট কাঠের টেবিল রাখার পর ঘরে আর কোন জায়গা নেই। চেয়ার নেই, খাটে বসেই সে টেবিলে কাজ করে। টেবিলের ওপর সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপটা তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। জানলার পাশে একটা আলনায় তার কাপড়গুলো রাখা। খাটের নিচে কিছু বই-পত্র আর তার কয়েকটা ব্যাগ আছে।
প্রায় মাস তিনেক হয় সে সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেছে, কিন্তু ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন করতে অস্বীকার করেছিল বলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এখনো ও জায়গা পায় নি। মেসে থেকে বাসে যাতায়াত করে করে ক্লাস করতে হয়। তিনটা টিউশনি করে এ ছোট্ট শহরটাই সে টিকে ছিল, তার মনে এ নিয়ে কোন ক্ষোভও ছিল না। বরং উচ্চাশা ছিল যে আর কয়টা বছর পড়ে ভার্সিটিটা শেষ করে কোনোমতে একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারলে বাবা-মায়ের মনের আশা পূরণ হবে, তারা শান্তিতে মরতে পারবে। কিন্তু ডাক্তারদের ঘোষণা করা এক আজব মৃত্যুদণ্ড আপাতত তার সব পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিয়েছে।
বিছানার ওপর পা ছড়িয়ে বসতেই মুনিরের আবার মনে পড়ে গেল ডাক্তারের কথা, রিপোর্টের কথা, আর বিশ লাখ টাকার কথা। কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে পর সে তার বাবাকে ফোন দিল। তিনবার রিং হতেই বাবা ফোন ধরলেন।
‘মুনির, বাবা, কেমন আছো?’
‘ভালো।’
‘সব ঠিক আছে?’
‘জি।’
‘তোমার গলায় আর কোন সমস্যা হয় নি তো?’
‘না, কোন সমস্যা হয় নি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। মানুষের জীবনে বিপদ আসে আবার কেটেও যায়। তারপরও সামনের কয়টা দিন ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ রাখবে। সাবধানের মার নাই।’
‘জি বাবা।’
‘নাও, তোমার মায়ের সাথে কথা বল।’
কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর মা ফোন ধরল।
‘কেমন আছিস বাবা মুনির।’
‘ভালো, মা।’
‘খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করিস তো? তুই তো দেখি দিন দিন আরো শুকিয়ে যাচ্ছিস।’
‘খাবার কোন সমস্যা নেই। তবে রুচি কমে গেছে।’
‘বলিস কি? রুচি কেন কমে যাবে?’
‘যেসব ওষুধ খাই সেগুলার সাইড এফেক্ট মনে হয়।’
‘ও। বাবা মুনির, কয়টা দিন বাসায় এসে ঘুরে যা না।’
‘আসব মা, আসব। আচ্ছা রাখি মা, একটু বেরোতে হবে।’
‘ঠিক আছে। ভালো থাকিস বাবা। তোর জন্য চিন্তা হয়, মাত্র অপারেশন হল। প্রতিদিন একবার ফোন দিবি, বুঝলি?’
‘দিব, মা। এখন রাখি।’
বাবা কিংবা মাকে কথাটা বলা গেল না। এটা অবশ্য একদিক দিয়ে ভালো – খবর শুনে তারা অস্থির হবে, জমি-জমা বিক্রি করবে, যদিও শেষ ফল শূন্য। তার যদি ক্যান্সার না থাকে, তাহলে তো ভালো। আর যদি ওই রোগ থেকেও থাকে, তাহলেও পয়সা খরচ করে সেটার কোন সমাধান হবে না, মাঝখান থেকে অযথা গুষ্টিশুদ্ধ সবার পেরেশানি। এর কোন মানেই হয় না। কিন্তু এটা সত্যি যে এই কথাটা কাউকে কারো সাথে আলাপ করতে পারলে মনটা একটু হালকা হত।
প্রায় মিনিট পাঁচেক ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মুনির বিথীকে ফোন দিলো। সেই বীথি, যার ঘন কালো চুল সুন্দর করে আঁচড়ে রাখে, আর মুনিরের মনের কথা বলার আগেই বুঝে ফেলে। বার দুয়েক চেষ্টার পর বীথি ফোন ধরল।
‘বীথি, সরি তোমাকে এসময় ফোন দিলাম। তুমি কি ব্যস্ত?’
‘কিছুটা। জরুরি কিছু, মুনির?’
‘না, তেমন জরুরি কিছু না।’
‘তাহলে এক কাজ কর, কাল দিনের বেলা কর। সময় নিয়ে কথা বলা যাবে। রাজি?’
‘রাজি।’
বীথি ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল।
মুনির ফোনটা পাশে সরিয়ে রেখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। অস্বস্তিকর চিন্তা থেকে বাঁচার একটা ভালো উপায় হচ্ছে ঘুম দেয়া। মুনির পায়ের কাচের জানলাটা খুলে দিয়ে তার সিঙ্গেল খাটটায় শুয়ে পড়ল, তারপর অল্পসময়ের মধ্যে ঘুমিয়েও গেল।
ঘুম থেকে উঠে মুনির দেখে আকাশের পশ্চিম কোণে কালো মেঘ, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বাইরে একটু একটু বাতাসও হচ্ছে। সে ভেবেছিল ঘুমালে সব কিছু ভুলে যাবে, কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সমস্ত দুশ্চিন্তা যেন দ্বিগুন হয়ে তার বুকের ওপর চেপে বসল। ঘরটা যেন কবর হয়ে তার পাঁজরের হাড়গুলোকে দুপাশ থেকে চেপে ধরতে লাগল।
ক্লাস এইটে পড়ার সময় এক সকালের কথা। স্কুলে যাওয়ার আগে মুনির অংক বাড়ির কাজ শেষ করছিল, হঠাৎ তার বাবা এসে বলল আজ স্কুলে যেতে হবে না, নানা বাড়িতে জরুরি দরকারে সবাইকে যেতে হবে আছে। বই-খাতা রেখে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে সে দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা কাঁদছে, আর বারবার নানীর কথা বলছে। পরে বাবা তাকে বলেছিল নানী মারা গেছে।
ওর স্পষ্ট মনে পড়ল – খবরটা শোনার পর ওর খারাপ লেগেছিল, কেননা নানী সবসময় তার জন্য তার পছন্দের ভাপা পিঠা বানিয়ে রাখতো। কিন্তু বাসে যেতে যেতে তার মাথায় নানীর চেয়ে মার কথাই কেন যেন বেশি করে আস্তে লাগল – নানী যদি মারা যায়, তাহলে মাও তো একদিন মারা যাবে, তখন তার আদর-যত্নের কি হবে। আর নানাবাড়িতে গিয়ে নামার পর যখন সে নানীর লাশটা দেখলো – সাদা কাফনে আপাদমস্তক মুড়িয়ে রাখা একটা শরীর – তখন সে মায়ের মৃত্যুর কথাও ভুলে গেল, জীবনে প্রথমবারের মত তার মনে হল – আমিও তো একদিন মারা যাব। মৃত্যুচিন্তার সাথে মুনিরের সেই প্রথম পরিচয়, আর আজ আবার – তবে অনেক বেশি তীব্র এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে।
মুনিরের দাদা ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। যেদিন তার মৃত্যু হয় সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাইকে তার কাছে আসতে বললেন, জরুরি তলব। সবাই এসে গেলে তিনি বললেন, তার মনে হচ্ছে তিনি আজই মারা যাবেন, সুতরাং সম্পত্তি ভাগ করে যেতে চান। সেদিন দুপুর পর্যন্ত তিনি বাটোয়ারা করলেন, বিকালে অসুস্থ বোধ করলেন, সন্ধ্যায় মারা গেলেন। মুনির তার দাদার মত শক্ত মানুষ হতে চায়, নিজের মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু কেন যেন সেটা সহজ হচ্ছেনা। হয় তো সে দুর্বল একজন মানুষ।
এটাতো ঠিক, আজ থেকে একশো বছরের মধ্যে মুনির এবং তার পরিচিত লোকজনের কেউই এই পৃথিবীতে থাকবে না। বাইশ শতকে দাঁড়িয়ে কেউই সামান্য এই কয়েকজন বাঙালির কথা মনে রাখবে না, পৃথিবী তার মত করে এগিয়ে যাবে। একদিন আমরা সবাই বিস্মৃত হব। কোনটা বেশি ভয়ঙ্কর – মৃত্যু না বিস্মৃতি?
একটাই স্বান্তনা – ওর যদি ক্যান্সার নাও হতো, তবুও তাকে একদিন না একদিন মরতে হতোই, একটা না একটা বিকেল আসতোই যেটা এই পৃথিবীতে তার শেষ বিকেল। আমাদের অস্তিত্ব যদি অনন্তকালের জন্য স্থায়ী নাই হয়, তাহলে বিশ বছর বাঁচা আর আশি বছর বাঁচার মধ্যে বস্তুত কোন তফাৎ নেই।
আরেকটা জিনিস – মুনিরের যদি ক্যান্সার না হতো, তবুও কিন্তু ওর জীবনের কোন একশো ভাগ নিশ্চয়তা ছিল না। প্রতিদিন পেপারে কত দুর্ঘটনার কথা আসে – কত যুবক রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, কত তরুণ বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেল। অসম্ভব না যে ক্যান্সারে মারা না গেলেও সে হয়তো এই বিশ বছর বয়সেই বাস একসিডেন্টে মারা যেতে পারতো। আবার এটাও সম্ভব যে তার ক্যান্সার হল, কিন্তু ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগেই সে ট্রেনে কাটা পড়ে বা এ জাতীয় কোন দুর্ঘটনায় মারা গেল।
কিন্তু – সবকিছুর পরও – এটা কিভাবে সম্ভব যে আজকে আমরা এই পৃথিবীতে আছি, আগামীকাল এখানে নাও থাকতে পারি? কোথায় যেন একটা হিসেবে মেলে না। মুনিরের যুক্তি বলে – যেহেতু মৃত্যুর পর কিছু নেই, মৃত্যু শুধু একটা ঘুমের মত যেখান থেকে কেউ জেগে ওঠে না, সেহেতু এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবুও কেন প্রচন্ড কষ্ট মনের ভেতর বার বার জেগে জেগে ওঠে তা সে কিছুতেই বের করতে পারছে না।
মৃত্যু যদি এতটাই স্বাভাবিক হয়, তাহলে ওর জীবনের কি অর্থ? মুনির জানে, সে যদি কোনোভাবে এই একটা প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারে, তাহলে সে মরলেও শান্তিতে মরতে পারবে। কিন্তু এই প্রশ্নটা ছোট হলেও উত্তরটা পাওয়া সহজ নাও হতে পারে। মুনির সিদ্ধান্ত নিল, সবকিছুর পরও সে এর জবাব বের করতে চেষ্টা করবে।
ওর কাছে এ প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে বের করা আসলে ক্যান্সারের চিকিৎসার চেয়েও জরুরি বেশি। কারণ ভীষণ ব্যয়বহুল থেরাপিগুলো ওর জীবনটাকে টেনেটুনে কিছুটা লম্বা করতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর বিষয়টার মুখোমুখি তাকে আজ হোক কাল হোক হতেই হবে।
অন্ধকার বাড়ার পর পর মুনিরের মনে হল তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দমবন্ধ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য সে ঘর থেকে বের হয়ে এল, তারপর একটা রিক্সা নিল হালিম মিয়ার ভাতের দোকানে যাবে বলে। রেস্টুরেন্টে গেলে কিছু মানুষ-জনের দেখা পাওয়া যাবে অন্তত। ডাল-ভাত খেয়ে এককাপ চা খেলে মনটাও ভালো হয়ে যেতে পারে। রিক্সা চলতে শুরু করতেই আকাশে মেঘের গর্জন শোনা যেতে লাগল, দূরে কয়েকবার বিদ্যুতও চমকাতে দেখা গেল। মুনির রিক্সাওয়ালাকে তাড়াতাড়ি চালাতে বলল।
অধ্যায় ২: আধুনিক জীবনের কোন মূল উদ্দেশ্য নেই?
মাহমুদদের চারতলা বাসাটার গেটে ঢুকে বেল বাজাতেই মাহমুদের সহযোগী আরিফ এসে দরজা খুলে দিলো, তারপর মুনির আর সজলকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
মাহমুদ ইউনিভার্সিটিতে তার দুই বছরের সিনিয়র। ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে ওদের দুজনের পরিচয়, তারপর কথা বলতে বলতে একসময় দেখা গেল বিভিন্ন বিষয়ে তারা একই ধরণের মত পোষণ করছে। এরপর থেকে এরা একজোট হয়ে কিছু জনসচেতনতামূলক প্রকল্প করার চেষ্টা করে আসছে – তার মধ্যে কিছু উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, আর কিছু এখনো টিকে আছে।
ওদের দুজনের যে দু’একটা প্রকল্প কিছুটা দাঁড়িয়ে গেছে, তার মধ্যে মাহমুদের অনলাইন চ্যানেল একটা। ইউটিউবে একটা চ্যানেল খুলে ও সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়, অনেকটা আড্ডার স্টাইলে। সাক্ষাৎকারের মূল বিষয় ধর্ম, আজকাল ধর্ম বিষয়ক আলোচনাগুলোর দারুন জনপ্রিয়তা। এই প্রোগ্রামটাও মোটামুটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে, ইন্টারনেটে ইদানিং ভালো হিট পাওয়া যাচ্ছে। মুনির অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট তৈরিতে মাহমুদকে সাহায্য করে, রীতিমতো পড়াশুনা করে আকর্ষণীয় সব প্রশ্ন তৈরী করে সে।
সাধারণ একটা ভাড়া বাড়ি এটা, একতলার ফ্ল্যাটের একটা অংশকেই সম্ভবত ষ্টুডিও হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সামনের ঘরে একটা পুরোনো সোফা, কম্পিউটার সহ একটা টেবিল আর একপাশে ধুলো জমা কয়েকটা ফুলদানি। মুনির সিঙ্গেল সোফাটা দখল করে ভ্যানগার্ড ম্যাগাজিনের একটা পুরাতন সংখ্যা উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল। সজল তখন স্মার্টফোনে ঘাড় নিচু করে রেখেছে।
ওদের চ্যানেলটা অন্য যে কোন ধর্ম-বিষয়ক চ্যানেল থেকে আলাদা। কোন মাওলানাকে ওরা কোনদিন প্রোগ্রামে আনেনি, কারণ মাহমুদ মনে করে এই ধরণের লোকজন অলরেডি কোন একটা এজেন্ডাতে কমিটেড। ওরা দাড়ি-টুপি নেই এরকম একজন মানুষকে নিয়ে খুব সাধারণ সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি – এই যেমন কেন সে ধর্ম মানে, খোদা কিরকম বলে সে মনে করে, সে জীন-ভুতে বিশ্বাস করে কিনা আর করলে এ সংক্রান্ত কোন অভিজ্ঞতা আছে কিনা, এসব। মানুষ ওদের এই ব্যতিক্রম এপ্রোচটা মনে হচ্ছে গ্রহণ করেছে, সাবস্ক্রাইবার গত মাসে এক হাজার ছাড়িয়েছে। এটা মাহমুদের জন্য একটা মাইলস্টোন।
মাহমুদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় বিরক্ত হয়ে মুনির উঠে দাঁড়াল, তারপর পাশের ষ্টুডিও রুমে গিয়ে উঁকি দিল। সজল তখনো বসার ঘরে একমনে ফোন টিপছে। এই রুমটা বেশ গুছানো – আলোর ব্যবস্থা করা আছে, ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে সবুজ রং করা দেয়াল কিংবা বোর্ড। কাচের টেবিলের পাশে আরামদায়ক চেয়ার রাখা, সামনে ক্যামেরা ফিট করা। মুনির ঘরের কোনায় ক্যামেরার পেছনে একটা চেয়ার নিয়ে বসল। তখনি মাহমুদ ঘরে এসে ঢুকল।
শুকনো মতো ফর্সা যুবক মাহমুদ, বড় বড় চোখ, হাড়গিলে চেহারা – ঢোক গিললে গলায় কণ্ঠার হাড়ের ওঠা-নামা দেখা যায়। বড় চুলগুলো আঁচড়ানোর ধরণের কারণে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, হয়তো এজন্যই বন্ধুরা তাকে কাকতাড়ুয়া মাহমুদ বলে ডাকে। কুশল বিনিময়ের পর মাহমুদ মুনিরকে মেডিক্যালের খবর জিজ্ঞেস করল। মুনির বলল যে তার শরীরে এখনো ক্যান্সার থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে তার দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
মাহমুদ কিছুক্ষন চুপ করে কি যেন ভাবল।
‘মরতে তো একদিন হবেই। আমাদের কাজ হল মারা যাওয়ার আগে জীবনটার পরিপূর্ণ ব্যবহার করে যাওয়া – সেটা যেমন কাজ করে, তেমনি উপভোগ করে।’
‘মাহমুদ ভাই, আমি বুঝতে পারছি না, এতগুলি টাকা খরচ করে চিকিৎসা করবো কিনা।’
‘আমার মনে হয় তুমি পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখো। হিস্টোরিক্যাল ডেটা অনুযায়ী চিকিৎসার ফলে যদি বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তাহলে তুমি অবশ্যই চেষ্টা করবে। আর যদি চিকিৎসা-করলেও-যা-না-করলেও-তা এরকম অবস্থা হয়, তাহলে বাদ দাও।’
‘আমিও তাই ভাবছি।’
‘বাকি জীবনটা বাঁচার মত বাঁচো। কাজ কর, ফুর্তি কর। যার ওপর তোমার নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটা নিয়ে চিন্তা করে ভারাক্রান্ত হওয়ার কোন দরকার নেই।’
মুনির এবার সোজা হয়ে বসে সরাসরি মাহমুদের চোখের দিকে তাকাল।
‘আমি একটা জার্নাল পড়ছিলাম – লেখক সেখানে বলতে চেয়েছে যে মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনের অবসান হয়, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত না। আপনি কি বলেন? এটা কি প্রমাণিত না?’
‘মুনির, এসবি ভুজুং ভাজুং। এরা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চায়, মৃত্যুর পর জীবন আছে। তুমি এটা মেনে নাও, তারপর বলবে সে জীবনে বেহেশত-দোজখ আছে। আসলে এরা অমীমাংসিত সমস্যাকে আশ্রয় করে মানুষের মনে হাবি-জাবি বিশ্বাসের বীজ ঢুকিয়ে দিতে চায়। কি ধরণের জার্নাল এটা?’
‘ফিলোসোফিকাল জার্নাল। দর্শন আর মনোবিজ্ঞান নিয়ে তারা লেখে।’
‘যা ভেবেছিলাম। অপবিজ্ঞান আর কাকে বলে। যুক্তিবাদী কারো কাছে এগুলি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরা একটা কবর খুঁড়ে দেখাক মৃত লোক বেহেস্তে হুরের সাথে মাস্তি করছে। দেখাতে পারবে? কোনোদিন না? এইসব বিশ্বাস মূলত মূর্খলোকের আবিষ্কার আর দুর্বল লোকের স্বান্তনার হাতিয়ার।’
মুনিরকে চুপ থাকতে দেখেই হয় তো মাহমুদ কণ্ঠ নরম করল।
‘শোনো মুনির, আমি বুঝতে পারছি, তোমার মনটা নরম হয়ে আছে। বড় কোন রোগ হলে, সম্ভাব্য মৃত্যুর সামনে দাঁড়ালে এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু তার মানে এই না যে তুমি তোমার নীতির সাথে সমঝোতা করবে। দুর্বল মানুষই এসব করে – যখন বিপদে পরে তখন শিক্ষা-দীক্ষা সব ভুলে যায়। কিন্তু আমি তো তোমাকে জানি, তুমি মোটেও সেরকম ছেলে না। তুমি খুবই শক্ত ছেলে, আশা করি মৃত্যুর ভয় তোমাকে ভুল দর্শনের দিকে নিয়ে যাবে না।’
মুনির মাথা নেড়ে হ্যা বলল।
‘মাহমুদ ভাই, আমি যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম তাকে নিয়ে এসেছি। আপনি চাইলে কথা বলে দেখতে পারেন।’
‘অবশ্যই। ওকে ভেতরে নিয়ে আসো। আমাদের কথা শুনুক, দেখি তার কি রিএকশন, সে কতটুক চটপটে।’
‘মাহমুদ ভাই, ও কিন্তু আমার অসুখের কথা জানে না।’
মাহমুদ মাথা নাড়লো। মুনির বসার ঘর থেকে সজলকে ডেকে এনে ভেতরে বসাল তারপর পরিচয় করিয়ে দিল। মাহমুদ আবার বলতে শুরু করল।
‘তারপর, যেটা বলছিলাম। মানুষ মূলত উন্নত একধরণের পশু ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু আমাদের সমস্যা হল আমাদের ব্রেনের সামনের অংশটা বড়, যে কারণে আমরা বিমূর্ত জিনিস সম্পর্কে ধারণা করতে পারি, শুধু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মনের ভেতর অতীতের একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারি কিংবা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্বাভাস করতে পারি। আমরা এমনকি জটিল শিল্পকলার চর্চাও করতে পারি।
কিন্তু এসবের একটা মূল্যও আমাদের দিতে হয়, আর সেটা হল আমাদের অহং। এই কল্পনা করতে পারাটাই আবার আমাদের মধ্যে তৈরী করে দিয়েছে একটা ভ্রম বা মায়া বা ইলুশন যে আমরা অন্য পশুদের চেয়ে আলাদা কিছু, যেন আমরা এত মূল্যবান যে মৃত্যু আমাদের শেষ করে দিতে পারে না।
কই, একটা কুকুর মারা গেলে আমরা তো বলি না যে তার পরকাল আছে, আরেক কুকুরকে কামড়েছিল বলে তার কবরের আজাব আছে। আমরা নিজেদের বিশেষ কিছু মনে করতে চাই, এজন্য এটা চিন্তা করতে ভালো লাগে যে মৃত্যুর পর কোনভাবে আমরা টিকে যাব। মিশরের ফারাওরা যেমন মৃত্যুর পর টিকে থাকার জন্য নিজেদের মমি বানিয়ে রাখতো। আমরা এখন জানি, সেটা কি হাস্যকর চেষ্টাই না ছিল। তো সেটা যদি হাস্যকর হয়, তাহলে কবরের জীবন, আখিরাত এগুলি কেন হাস্যকর হবে না? বল।
তুমি আমি এসব নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমি জানি তোমার ভেতর এসব ফালতু জিনিসকে মোকাবেলা করার শক্তি আছে। তোমার শুধু একটা সাপোর্ট দরকার। যখনি তোমার কোন কনফিউশন হবে, আমার কাছে চলে আসবে। বুঝেছ?’
মুনির মাথা নাড়ল, তার মাথাটা আপাতত ঠান্ডা হয়েছে। সজল এতক্ষন খুব হা করে তাকিয়ে মাহমুদের কথাগুলো শুনছিল, এবার সে হাত তুলল যেভাবে শিক্ষককে প্রশ্ন করার জন্য ছাত্ররা হাত তুলে। মাহমুদ মুচকি হাসল।
‘হ্যা সজল, বল। তোমার কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?’
‘ভাই, আপনে যে বললেন মানুষ আর জন্তু-জানোয়ার একই রকমের জিনিস, কিন্তু আমি তো ছোটবেলায় শিখছি মানুষের বুদ্ধি আর বিবেক দুইটাই আছে, পশু-পাখির বুদ্ধি আছে কিন্তু বিবেক নাই – এইজন্যই ধরেন মানুষ পশু-পাখিরে পোষ মানাতে পারে, কিন্তু পশু-পাখি মানুষরে পারে না। আমি শুনছি, এই বিবেকের কারণেই মানুষের হাশর হবে, আর পশু-পাখির বিচারদিবস সহজ হবে। তবে সেদিন বাঘকে হরিণ খাবে, যাতে করে কিনা দুনিয়ার জুলুমের শোধ-বাদ হয়ে যায়।’
মাহমুদ একদৃষ্টিতে সজলের দিকে তাকিয়ে ছিল, ফলে বোঝা গেল না সে সজলের বিশ্লেষণ বুঝতে পেরেছে কিনা। মুনির তাড়াতাড়ি বলল – ‘সজল, মাহমুদ ভাই অন্য জিনিস বুঝিয়েছেন। আমি পরে দরকার হলে তোমাকে বুঝিয়ে বলব।’
তারপর মুনির মাহমুদের দিকে ঘুরে বসল।
‘কিন্তু মাহমুদ ভাই, পশুর জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই। মানুষের জীবনও কি উদ্দেশ্যহীন?’
সজল এবারো হাত তুলল, কিন্তু মাহমুদ সেটা লক্ষ্য করল না কিংবা লক্ষ্য করতে চাইল না।
‘সার্ত্রে বলেছেন, মানুষ যন্ত্রণাদায়করকম স্বাধীন। তার জীবন উদ্দেশ্যহীন, কিন্তু চাইলে প্রত্যেকে নিজের নিজের আলাদা উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে পারে – কেউ হয় তো লেখক হতে চাইল, কেউ সমাজসেবক হতে চাইল।’
‘মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ইবাদত-বন্দেগী করা। তবলীগ জমাতের বয়ানে বলছিল।’ – সজল যোগ করল।
‘হ্যা, কারো কারো জীবনে সেটাও উদ্দেশ্য হতে পারে, কিন্তু সেটা হবে অন্যের বলে দেয়া উদ্দেশ্যকে নিজের উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয়া। দুর্বল মানুষ জীবনের জন্য এ ধরণের উদ্দেশ্য অনেক সময়ই বেছে নেয়।’
মাহমুদ মুনিরকে মনে করিয়ে দিল যে সত্যকে খুঁজতে হলে সবচেয়ে নিশ্চিত জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে নিশ্চিত জিনিস হল তার নিজের অস্তিত্ব – সুতরাং নিজেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, নিজের পছন্দকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, নিজ জীবনের অভিজ্ঞতাকে প্রথম সত্য বলে জানতে হবে – তাহলেই ব্যক্তিগতভাবে কাউকে সফল বলা যাবে।
সে বিকেলে মাহমুদের সাথে কথা বলে মুনির মনে কিছুটা হলেও জোর পেল। রিক্সায় ফেরার সময় সে সজলকে জিজ্ঞেস করল সে আসলেও মাহমুদের প্রোগ্রামে অংশ নিতে চায় কিনা।
‘ওদের প্রশ্ন কিন্তু অনেক কঠিন। আর ওরা তোমাকে বোকা বানিয়ে মজা নেবারও চেষ্টা করবে।’
‘আরে না মুনির ভাই, ওরা পারবে না। আমি যা জানি সেইটা বলবো, হইলে হইল না হইলে নাই। ওদের ডরানোর কি আছে?’
‘আচ্ছা সজল, তোমার এই প্রোগ্রামে যাওয়ার দরকারটা কি, বল তো?’
‘ভাই, এইসব প্রোগ্রামে গেলে প্রেস্টিজ বাড়ে। আপনে বুঝবেন না। এগুলি লাগে।’
রাতে মেসে ফিরে মুনির অসমাপ্ত কিছু ব্লগ নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করল, কারণ জীবনটা যতটুক সম্ভব অর্থপূর্ণ করা দরকার, যদিও লেখালেখি বেশিদূর আগাতে পারল না কোন কারণে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় সে বিছানায় শুয়ে পড়ল, কিন্তু ঘুম আসতে চাইল না। নানা চিন্তা তার মনে ভিড় করতে লাগল।
মাহমুদ ভাই বলল, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে ভালো কবিতা লেখা, বা সমাজসেবা করা, আবার কারো জন্য হয়তো ভালো ক্রিকেটার হওয়া। কিন্তু সেগুলো শেষপর্যন্ত কি উদ্দেশ্যে কাজে লাগবে, সেটা স্পষ্ট না। বোঝা গেল যে আমার কবিতা সমাজের কাজে লাগল, কিন্তু সমাজের সম্মিলিত উদ্দেশ্যটা কি হবে, যদি একেকজনের জীবনের উদ্দেশ্য একেকরকমের হয়। মুনির ঠিক মেলাতে পারে না – কোথাও একটা ফাঁক আছে, পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে তার কাছে। এ তো রীতিমত বিশৃঙ্খলা, আর মুনির বিশৃঙ্খলা পছন্দ করে না – সে বিশ্বাস করে অংকের মত শৃঙ্খলা থাকবে জীবনে, থাকতেই হবে।
মানুষ কষ্ট করে আয়-রোজগার করবে, তারপর আরাম করে সেটা ভোগ করবে, তারপর একদিন মরে যাবে? একটা পশুও কিন্তু তাই করে, কষ্ট করে শিকার ধরে তারপর সেটা মজা করে খায়, তারপর একদিন বয়সের কারণে না হয় আরেক পশুর শিকার হয়ে মারা যায়। মানুষের জীবন কি সত্যিই একটা কুকুর কিংবা বিড়ালের জীবনের মত অর্থহীন? নাকি জন্তু-জানোয়ারের জীবনেরও অর্থ আছে?
হয়তো জীবনটাই এরকম বিভ্রান্তিকর একটা যাত্রা। সে যদি আগামী এক বা দুই বছরের মধ্যে মরে যায়, মানুষ তাকে কয়দিন মনে রাখবে? আর যদি রাখেও, তাতে তার কি আসবে-যাবে? সে তো আর সেই মনে রাখা কিংবা না রাখাকে পরীক্ষা করে দেখতে আসছে না। মুনির জানে এটা স্বার্থপর একটা চিন্তা, এটা এমন একটা চিন্তা যেটা তার সমস্ত বিবেকের বাইরে, কিন্তু নিজের এই অনুভূতির দিকটাকে সে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারছিল না।
তবে হ্যা, সে যদি ভালো কিছু করে যেতে পারে, তাহলে তা মানবজাতির কাজে লাগল। সে যদি এভাবে চিন্তা করে যে, তার নিজের অস্তিত্ব পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের একটা অংশ মাত্র, তাহলেও কিছুটা স্বান্তনা পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যক্তি হিসেবে তার কোনো গুরুত্ব না থাকলেও সামগ্রিকভাবে মানবজাতির একটা গুরুত্ব আছে, আর তার কাজ হবে আমৃত্যু – মানে আর যে কয়টা বছর সে বাঁচে – মানবকল্যাণে কাজ করে যাওয়া।
মানবজাতি যদি একটা বিশাল বৃক্ষ হয়, তাহলে সে একটা পাতা – তার মতো অনেক পাতা হয় বাতাসে না হয় শুকনো হয়ে ঝরে যাবে, কিন্তু আবার নতুন পাতা গজাবে এই সামগ্রিক মানববৃক্ষে, আর এভাবেই এই বিশাল বৃক্ষ সময়কে পাশ কাটিয়ে টিকে যাবে। কিন্তু এই বৃক্ষ কি আসলেই টিকে যাবে?
আমরা যদি পৃথিবীর দিকে তাকাই, পাঁচ বিলিয়ন বছরের মধ্যে লাল দৈত্য হয়ে এই গ্রহকে গ্রাস করবে আমাদের এই সূর্যটাই। মানুষ হয়তো ততদিনে অন্যগ্রহে গিয়ে বসতি গড়বে, কিন্তু এভাবে কত দিন? সবাই জানে, নক্ষত্রগুলো সব মরে মরে যাবে, এই মহাবিশ্ব ক্রমশই হবে শীতল আর প্রাণহীন। এটা কোনো কল্পকাহিনী না, এটা বিজ্ঞান, এটাই বাস্তবতা। পালাবে কোথায় মানবজাতি? এই হতভাগ্য মুনিরের মতো তোমাদেরও একদিন ঝরে যেতে হবে মহাবিশ্ব নামের এক বুড়ো বৃক্ষের দুর্বল এক শাখা থেকে।
মানবজাতি চিরদিন টিকে থাকবে না, থাকতে পারে না। এজন্যই নাস্তিক নিৎসে-রাসেল বলেছিলেন – যেহেতু নাস্তিকতা সত্য, সেহেতু কিছুতেই কিছু যায় আসে না, জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই, মানবজীবন উদ্ভট।
জ্যঁ পল সার্ত্রে নিজে ছিলেন নাস্তিক, কিন্তু একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন তিনি। তার মতে প্রতিটা মানুষের মাঝে আছে ঈশ্বরকে খোঁজার এক অত্যাশ্চর্য প্রবণতা, কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর বলে কেউ নেই সেহেতু মানুষের আত্মার এই শূন্যতা পূরণের কোন উপায়ও নেই।
এই ফরাসি দার্শনিক মনে করতেন – মানুষ ভয়াবহরকম স্বাধীন, তাই তার জন্য সঠিক ধর্ম হবে নিজের প্রতি সৎ থাকা, আর ভুল ধর্ম হবে নিজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে অন্যের শিখিয়ে দেয়া বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকা। উনি মূলত নিজেকেই নিজে ঈশ্বর বানাতে বলেছেন।
মোটকথা, মুনিরের এই আদর্শ পুরুষেরা অনেক গবেষণা করে নাস্তিকতাকেই আদর্শ বানিয়েছেন, কিন্তু তার পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসেবে যে মানবজীবনে সর্বগ্রাসী ব্ল্যাকহোলের মতো চরম এক শূন্যতা আসে, সেটার কোন সমাধান তারা দিয়ে যাননি। মুনিরের ই-মেইলের অন্যপাশে এই তিনজন আদর্শপুরুষের একজনকেও আজ পাওয়া যাবে না, ফলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুনিরকেই তার নিজের জীবনের মূল উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে হবে – হাতে সময়ও হয়তো বেশি নেই।
মুনিরের ঘুম ততক্ষনে পালিয়ে দূরে কোথাও চলে গেছে – প্রথমে একশো থেকে উল্টোদিকে গোনা, তারপর একশো থেকে উল্টোদিকে শুধু বেজোড় সংখ্যা, সবশেষে উল্টোদিকে শুধু মৌলিক সংখ্যাগুলো।
এত চিন্তা একসাথে মাথায় ভিড় করলে ঘুম আসা আসলেও কঠিন। ঘন্টাখানেক বিছানায় এপাশ-ওপাশ করার পর শেষ রাতের দিকে মুনিরের একটু ঘুম এলো, কিন্তু বিভিন্নরকম দুঃস্বপ্ন দেখে অল্প সময় পরই সে আবার জেগে উঠল। এরপর প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে বাকি রাতটা সে জেগেই কাটাল।
অধ্যায় ৩: একমাত্র ঈশ্বরই পারেন আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে?
বড়রাস্তার মোড়টা ঘুরতেই মুনির শুনতে পেল কে যেন তাকে ডাকছে। রিকশাকে থামতে বলে সে ফিরে তাকিয়ে দেখে ইশা তাড়াহুড়ো করে তার রিক্সার দিকেই এগিয়ে আসছে। মুনির ইশাকে প্রাইভেট পড়ায় – ইংলিশ আর ম্যাথ – সপ্তাহে তিনদিন দুই ঘন্টা করে। ক্ষীণকায় মেয়েটার দীর্ঘ চুল, বড় বড় চোখে ছেলেমানুষি সরল চাহনি।
‘মুনির ভাই, আপনার সাথে জরুরি একটা কথা আছে। ভালো কথা, আপনি কি নতুন বাজারের দিকে যাচ্ছেন? গেলে আমাকে যদি একটু বাসার সামনে নামিয়ে দিতেন? মনে হয় বৃষ্টি আসবে, হেটে যেতে পারব না।’
ইশা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। সে জিলা স্কুলে পড়ে, ক্লাসে ছেলে-মেয়ে সবার মধ্যে সে ফার্স্ট হয়। কিন্তু তার মানে এই না যে সে সারাদিন পড়ার বই নিয়ে মুখস্তর প্রতিযোগিতা করে, বরং পাঠ্যবইয়ের বাইরের বিষয় নিয়ে তার আগ্রহ সীমাহীন – সে ফ্লাইং সসার বিষয়ক পেপারব্যাক যেমন আগ্রহ নিয়ে পড়ে, তেমনি আবার বাংলা অনুবাদে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসও ভীষণ পছন্দ করে।
মুনির যে ব্লগটা লেখে, ইশা সেটারও একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা। তাই বলে একরত্তি এই মেয়েটা তার লেখার অন্ধ কোন ভক্ত নয়, বরং সুযোগ পেলেই সে কমেন্ট বক্সে দীর্ঘ সব সমালোচনা যোগ করে – কখনো কঠিন যুক্তি দিয়ে, কখনো বা ভুলভাল বক্তব্য সাজিয়ে। প্রাইভেট পড়ানোর বরাদ্দ দুই ঘন্টার মধ্যে প্রথম দেড় ঘন্টা সে মন দিয়ে পড়ে, তারপরের আধাঘন্টা নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে মুনিরের মাথাব্যথা করে দেয়। তার প্রশ্নগুলোর মধ্যে জীন-পরীর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিষয়ক প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি আছে সাইন্স ফিকশন কাহিনীর বাস্তব সম্ভাবনা নিয়েও জিজ্ঞাসা।
মুনির ইশাকে রিক্সায় উঠে বসতে বলল। রিক্সায় উঠেই মেয়ে আবার কথা শুরু করল।
‘শোনেন, আপনাকে নিয়ে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি। আপনাকে সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।’
‘কি খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?’
‘দেখলাম কালো পাঞ্জাবি পড়া লম্বা মতো একটা লোক আপনাকে তাড়া করছে, আর আপনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। স্বপ্নটার মধ্যে খুব ভয়ের একটা কিছু ছিল।’
‘স্বপ্ন তো স্বপ্নই।’
‘আমি জানি, আপনি নাস্তিক, আপনার এসব বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। তবু আমার দায়িত্ব বলার, তাই বললাম। আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো, আপনার কোন বিপদ অলরেডি চলে আসে নি তো?’
এটা কি শুধুই একটা কাকতালীয় ঘটনা? আসলেও তো সে একটা বড়সড় বিপদেই আছে। মুনির অবশ্য কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল, যেন কথাটা শুনতেই পায়নি। ও জানে, কিছু না বললে এই মেয়ে দ্রুত অন্য প্রসঙ্গে চলে যাবে, তারপর সেটা নিয়ে অনর্গল কথা বলতে থাকবে।
‘শোনেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। বাবা একটা উদাহরণ বলেছিল আমাকে, সেটা আপনাকে বলি, তাহলে বুঝতে পারবেন।
আপনি যদি মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেন, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে যে কোথাও একটা বাঘ আছে। কিন্তু আপনি যদি বলেন যে ‘আমি বাঘ দেখিনি, সুতরাং বাঘ বলে কিছু নাই’, তাহলে আপনি বিপদে পড়বেন, কারণ বাঘ আপনাকে ধরবেই। সব কিছু প্রমান দিয়ে জানা যায় না, কোন কোন জিনিস ইঙ্গিত দিয়ে বুঝতে হয়।
আপনারও উচিত আমার কথায় বিশ্বাস করা মানে সাবধান হওয়া।’
মুনির হাসল।
‘তোমার সব স্বপ্নই কি সত্য হয়?’
‘সব স্বপ্ন সত্য হবে কেন? আমি কি বুজুর্গ নাকি? কিন্তু কিছু কিছু স্বপ্ন দেখার সময় আমার অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়, ঘুম থেকে ওঠার পর খুব মাথাব্যথা হয়, তখন বুঝতে পারি এই স্বপ্নটার কোন বিশেষ অর্থ আছে।’
রিক্সা ততক্ষনে ইশাদের পুরোনো দোতলা বাসাটার সামনে চলে এসেছে। ইশা মুনিরকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি কোথা থেকে শুরু হল ঝম ঝম বৃষ্টি, সাথে প্রচন্ড বাতাস।
‘আপনি ভেতরে চলেন। বৃষ্টি কমলে যাবেন। প্লিজ।’
মুনির না বলল, কিন্তু বৃষ্টির বেগ ততক্ষনে বাড়তে শুরু করেছে।
‘আপনাকে না নিয়ে আমি যাব না।’
কিছুটা দ্বিধার পর মুনির রাজি হল নামতে। রিক্সাওয়ালাকে টাকা ধরিয়ে দিয়ে সে দৌড়ে চলে এল নিচতলার বারান্দায়। এই কয়েক সেকেন্ডেই সে আধাভেজা হয়ে গেছে।
ইশাদের বাসাটা বেশ পুরাতন। বারান্দা পেরিয়ে কাঠের বড় দরজা, তারপর বসার ঘর। ঘরের মাঝখানে বেতের সোফা আর চায়ের টেবিল, একপাশে একটা বইয়ের আলমারি বোঝাই নতুন-পুরাতন বইয়ে। মুনির চশমা খুলে চুলের পানি ঝাড়তে লাগল। ইশা ওকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল।
এ ঘরের সিলিং বেশ উঁচুতে, উপর থেকে দীর্ঘ একটা রড দিয়ে ঝোলানো সবুজ রঙের একটা ফ্যান। হঠাৎ করে দেখে মনে হতে পারে ওটা খুলে পড়বে, কিন্তু ওটা দিব্যি নিরাপদে দুলে দুলে ঘুরছে। ঘরের দেয়ালগুলোও সবুজ রং দিয়ে চুনকামও, তবে সে রং পুরোনো হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় আস্তর ফেটে গেছে। ড্রইং রুমটা খুব একটা পরিবর্তন হয় নি, গত বছর মুনির এখানেই ইশাকে অংক আর বিজ্ঞান শিখিয়েছে।
ভেজা কাপড়ে ফ্যানের বাতাস লেগে যখন তার একটু শীত শীত করছে, তখন নজরুল ইসলাম ক্র্যাচে ভর করে ঘরে এসে ঢুকলেন।
‘মুনির, কেমন আছো?’
‘ভালো।’
‘ভালো করেছো এসেছ, আমার একা একা লাগছিলো, ইশাকে নিয়ে তোমার সাথে গল্প করা যাবে। আর শোনো, তুমি আজকে আমাদের সাথে ভাত খাবে, আমি ইশাকে বলে দিয়েছি। এই বৃষ্টির মধ্যে হুড়াহুড়ি করে বাসায় ফেরার কোন দরকার নেই।’
নজরুল সাহেব পঞ্চাশোর্ধ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দর্শনশাস্ত্র পড়ান। এক্সিডেন্টের পর অবশ্য তার বড় একটা সময় ছুটি নিয়ে থাকতে হয়েছিল, ইদানিং আবার পার্ট-টাইম কাজ শুরু করেছেন। ক্রাচ একপাশে রেখে তিনি সিঙ্গেল সোফাটায় বসে পড়লেন।
‘তুমি দেখি আজকাল ব্লগ লেখো। ইশা আমাকে দেখিয়েছে।’
‘জি।’
‘ইশা খুব মন দিয়ে তোমার লেখা পড়ে। আমিও কয়েকটা পড়েছি।’
‘থ্যাংক ইউ আংকেল।’
‘তোমার তো হাদিস-কোরানের খুঁটি-নাটি ভালোই জানা আছে। অনেক পড়াশুনা করে এগুলো লিখতে হয়, না?’
‘আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত কওমি মাদ্রাসায় পড়েছি – বাবার ইচ্ছা ছিল হাফিজ হব, তাহলে উনি নিজে কোন কষ্ট না করেই কেয়ামতের দিন মাথায় আলোর তাজ পড়তে পারবেন। তবে সেসব তো বহুদিন আগের কথা, তাই ব্লগ লেখার আগে আবার একটু ঝালাই করে নিই।’
‘তোমার লেখার স্টাইল ভালো, তুমি যুক্তি দিয়ে তোমার মত প্রকাশ কর। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তোমার উপসংহারে কোথাও ভুল হচ্ছে। তুমি কি বলতে পার কেন তুমি নাস্তিকতাকেই তোমার ব্লগের বিষয় বানিয়ে নিয়েছো?’
মুনির কাঁধ ঝাঁকাল।
‘আংকেল, আপনাদের কথা জানিনা। অন্তত আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বড়োরা সবসময় বলতে থাকে এটা কর ওটা কর, কিন্তু কখনো বলে না কেন করতে হবে। পড়ালেখার ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম, সেটা না করলে চাকরি-ব্যবসা কিছুই করতে পারব না। কিন্তু ধর্মের বিষয়টা একেবারেই গোলমেলে। ওটার বিষয়ে প্রশ্ন করতে গেলেও বেতের বাড়ি খেতে হত। এটা কেমন কথা? এসবের কারণেই আংকেল আমি ধর্ম বিষয়ে চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছি।’
নজরুল সাহেব সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
‘তুমি ঠিকই বলেছো। না বুঝে কোনকিছুকে মেনে নেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের ধর্মও কিন্তু আমাদের বারবার তাগাদা দিয়েছে বিবেককে ব্যবহার করতে।’
‘আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন আমি ঠিকভাবে চিন্তা করছি?’
‘অবশ্যই। দেখো, আমি ধর্ম বিশ্বাসী সাধারণ একজন মানুষ। আমি কোনো আলেম বা মুফতি না। আমি তোমাকে যা বলছি তা হলো ধর্ম সম্পর্কে একজন খুব সাধারণ মানুষের খুব ভেতরের একটা অনুভূতি। তোমার ইচ্ছা হলে আমার কথা তুমি গ্রহণ করতে পারো, ইচ্ছা হলে ফেলে দিতে পারো। কিন্তু আমি যা বলছি তা আমি নিজে অন্তত বিশ্বাস করি।’
মুনির সোজা হয়ে বসল।
‘আমি অবশ্য এরকম কখনো কাউকে বলতে শুনি নি।’
‘আমি শিক্ষক মানুষ তো, একটু বেশি কথা বলি – কিছু মনে কোরো না। আমার কি মনে হয় জানো? একজন ধার্মিক লোকের চেয়েও একজন নাস্তিক স্রষ্টাকে বেশি স্মরণ করে। হয়তো সে স্রষ্টাকে জানতে চায় বলেই প্রশ্ন করে। হতেও পারে নাস্তিকতা স্রষ্টার দিকে এগিয়ে যাওয়ার অন্য আরেকটা পথ – যদিও এ পথটা বিপজ্জনক, কারণ অর্ধেক পথ যাবার পর দিক হারিয়ে ফেলার ভয় আছে।’
আলোচনার এই পর্যায়ে ইশা এসে বলল যে টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। নজরুল ক্র্যাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তারপর ওদের দুজনকে নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে যেতে শুরু করলেন, যেন এরা দুজন তার দুই ছেলে-মেয়ে।
রাতের খাবার শেষ হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। মুনির উঠতে চাইলে নজরুল তাকে বললেন চা খেয়ে যেতে। যেহেতু সে বৃষ্টিতে ভিজেছে, এক চামচ মধু দিয়ে লেবু চা খেলে তার আর ঠান্ডা লাগার ভয় থাকবে না। ওরা আবার ড্রইং রুমে এসে বসল, ইশা কিছুক্ষনের মধ্যে তিন কাপ চা নিয়ে চলে এল, সে নিজেও ঠান্ডা লাগার ভয়ে মধু দিয়ে আদা চা খাবে।
চা হাতে নিয়ে মুনির একটা কথা বলার জন্য ইতস্তত করতে লাগল। তার অসুখের ব্যাপারটা কারো সাথে আলাপ করতে পারলে মনে শান্তি লাগত, কিন্তু কারো করুণা মুনির একদম পছন্দ করে না। শেষে সে একটা কিছু বলার সাহস করতে পারল।
‘আচ্ছা আংকেল, আমার তো গত মাসে গলায় অপারেশন হয়েছে। ওরা যদি অটোপ্সিতে খারাপ কিছু খুঁজে পায়, তাহলে তো এরকম হতে পারে যে আমি খুব অল্প বয়সে মারা যাব।’
নজরুল সাহেব ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন।
‘সেরকম কিছু কি ওরা বলেছে?’
‘ওরা এখনো সব পরীক্ষা শেষ করে নি। কিন্তু এটা একটা সম্ভাবনা তো অবশ্যই।’
ইশা চোখ বড় বড় করে কথোপোকথনটা শুনছিল। নজরুল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘আশা করি সেরকম কিছু হবে না। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে রক্ষা করবেন।’
‘কিন্তু আপনার আল্লাহ যদি আমাকে রক্ষা না করেন?’
নজরুল সাহেব চশমাটা খুলে শার্টের কোনা দিয়ে একবার মুছে নিলেন।
‘তোমার ব্লগ পড়ে যেটা বুঝেছি, ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে তোমার মনে ভালোরকম সন্দেহ আছে। কিন্তু সেটাই যদি হয়, তাহলে তোমার জীবনের অর্থ কি থাকল? ঈশ্বর বলে যদি কেউ না থাকে, তাহলে তোমার জীবনেরও কোন উদ্দেশ্য থাকে না। জীবনটা একেবারে উদ্দেশ্যহীন, উদ্ভট – এটা মেনে নিতে কি তুমি রাজি আছো?’
‘হয়তো আমার জীবন একটা মাছির জীবনের মতোই মূল্যহীন। হয়তো মানুষ একরকম উন্নত পশু ছাড়া কিছুই না, আর এজন্য তার জীবনের কোন মহৎ উদ্দেশ্য থাকারও দরকার নেই।’
নজরুল চশমাটা ঠিক করে নিয়ে মুনিরের দিকে ভালো করে তাকালেন।
‘নাস্তিকরা যখন ঈশ্বরকে সমীকরণ থেকে সরিয়ে দিল, তখন তাদের সরল অঙ্কটা ঠিক এভাবেই হঠাৎ করে জটিল হয়ে গেল, কারণ তাদের জীবন থেকে উদ্দেশ্য হারিয়ে গেল। আসল ব্যাপার হল, ঈশ্বর ছাড়া জীবনের উদ্দেশ্য বের করা প্রায় অসম্ভব। ঈশ্বরই জীবনকে উদ্দেশ্য দেন, যখন তিনি বিভিন্ন জিনিসকে বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি করেন।
এবার বলি যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তারা কিভাবে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পায়। একজন বিশ্বাসী মনে করে যে জগতের কোন কিছুই উদ্দেশ্যহীন না – একজন মানুষের জীবনের যেমন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে, তেমনি একটা মাছির অস্তিত্বেরও উদ্দেশ্য আছে। এমনকি দূরতম গ্রহাণুপুঞ্জের সৃষ্টিরও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে।’
‘আংকেল, আমাকে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যটা প্রথমে বলেন, তারপর অন্যান্যগুলো।’
‘মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরের নির্দেশ মানা। আর বাকি সব সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানুষকে সেবা করা। সূর্য সৃষ্টি হয়েছে মানুষকে তাপ দিতে, রাত সৃষ্টি হয়েছে মানুষকে বিশ্রাম দিতে, গম সৃষ্টি হয়েছে যাতে মানুষ খেতে পারে।’
‘যেসব জিনিস মানুষ খেতে পারে না, সেগুলো কেন সৃষ্টি হয়েছে?’
‘যেসব জিনিস থেকে মানুষ সরাসরি সেবা পায় না, সেগুলো থেকে তারা পরোক্ষভাবে সেবা পায়। কিভাবে পায়, সেটা সবসময় আমরা জানিও না। এই যেমন এতদিন আমরা জানতাম না যে দূর নক্ষত্রপুঞ্জ কেন তৈরী হয়েছে, কিন্তু এখন জানি ইউনিভার্সে একটা নক্ষত্রও যদি কম বা বেশি হত তাহলে সম্ভবত পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির পরিবেশই থাকতো না।’
মুনির না সূচক মাথা নাড়তে থাকলো, সে তর্কের ধরণটা ঠিক মানতে পারছে না।
‘আংকেল, আপনি বলছেন ঈশ্বর এই করেছে, ঈশ্বর সেই করেছে, কিন্তু ঈশ্বর যে আছেন তার প্রমান কি?’
‘মুনির, তার আগে তুমি বল যে তোমার অস্তিত্বের প্রমান কি?’
‘আংকেল, প্লিজ বুঝিয়ে বলেন, আমার অস্তিত্ব থাকবে না কেন?’
নজরুল সাহেব সোফার হেন্ডেলে ডান হাতটা রেখে বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন।
‘ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ করার আগে আমাদের আসলে নিজেদের অস্তিত্বকেই সন্দেহ করা উচিত।’
‘সেটা আবার কিরকম, আংকেল?’
‘ছোটবেলায় আমি একবার একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি দেখলাম যে আমি একটা পাখি হয়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছি। স্বপ্নের অনুভূতিটা এতটা জীবন্ত ছিল যে ঘুম ভেঙে আমি চিন্তা করছিলাম, কোনটা আসল সত্য – আমি স্বপ্নে পাখি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম, নাকি পাখিটা এখন স্বপ্নে দেখছে যে সে একটা মানুষ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।
তোমার কখনো এরকম হয় না যে স্বপ্নের ভেতর তুমি ভাবছো যে স্বপ্নের সেই জগৎটাই সত্য?’
‘আমার অনেকবার এরকম হয়েছে।’ ইশা পাশ থেকে যোগ করল। নজরুল সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
‘আমাদের একজন সাহাবী বলেছিলেন – জীবনটা একটা স্বপ্ন, মৃত্যুর মাধ্যমেই শুধু তুমি আসল জগতে জেগে উঠতে পারো।’
‘আপনি কি ‘ম্যাট্রিক্স’ মুভিটা দেখেছেন? সেখানে পুরো মানবজাতি ঘুমিয়ে আছে একটা বিশাল হিমঘরে, আর তাদের মন ঘুরে বেড়াচ্ছে ভার্চুয়াল একটা শহরে। ওরা জানেও না যে ওদের পুরো জীবনটা আসলে একটা কল্পনা। শুধু যাদের ঘুম কোন কারণে ভেঙে গেছে, তারাই বুঝতে পারে যে সবাই এতদিন স্বপ্ন দেখছিল।’
‘আমি মুভি দেখি না। ওগুলো মানুষকে বাস্তব থেকে আরো দূরে সরিয়ে নেয়।’ মুনির ইশার প্রশ্নের উত্তরে বলল।
‘যেটা বলছিলাম – তুমি যখন স্বপ্ন দেখছো তখন যদি তুমি বুঝতে না পারো যে ঐটা তোমার শুধুই মনের কল্পনা, তাহলে অসম্ভব কি যে তোমার এই জীবনটা দীর্ঘ একটা স্বপ্ন কিন্তু তুমি সেটা বুঝতে পারছো না?
মোটকথা আমরা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ওপর ঠিক ভরসা করতে পারি না, যতটা আমাদের চিন্তাশক্তি বা যুক্তির ওপর করতে পারি। আমাদের ইন্দ্রিয় আমাদের ভুল বোঝাতে পারে, যেমনটা স্বপ্নের ভেতর হয়, কিন্তু যুক্তি ভুল হতে পারেনা। মানুষ আশে-পাশের সবকিছুই ভুল দেখতে পারে, যেমন ড্রাগ নিলে মানুষ গায়েবি জিনিস দেখে বা শুনে, কিন্তু অংকের জগতে দুই আর তিন যোগ করলে সবসময় পাঁচই হবে।
দার্শনিক বার্কলে এই ধারণাটাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, বস্তুজগৎ বলে আসলে কিছু নেই, শুধু আছে মানুষ নাম কিছু ‘দর্শক’। মানুষ নামে এই দর্শকদেরও কোন শারীরিক অস্তিত্ব নেই, আছে শুধু মন যা কল্পনা করতে পারে বস্তুজগৎকে। চিন্তাই একমাত্র বাস্তবতা, আর জগৎ হল মনের ধারণাগুলোর একটা প্রতিফলন মাত্র।’
‘আপনি নেই, আছে শুধু আপনার মন, সেই মন একটা পৃথিবী কল্পনা করছে বলেই সেই পৃথিবীটা আছে। আবার আমিও একইভাবে আমার পৃথিবীটা কল্পনা করছি। কিন্তু আপনার আর আমার কল্পনা অনেক আলাদা, তাহলে আপনি যে জগৎ দেখছেন আর আমি যে জগৎ দেখছি সে দুটা তো আলাদা হওয়ার কথা। আমরা তাহলে কিভাবে একই জগৎকে একইভাবে দেখতে পাচ্ছি?’
‘অসীম ক্ষমতাধর কেউ একজন নিশ্চিত করছে যে আমরা সবাই একটা জগৎকে একইভাবে দেখছি, একই জিনিসকে একইভাবে অনুভব করছি, একই ওজনকে একইভাবে পরিমাপ করতে পারছি। অস্তিত্বের মূল হচ্ছে কেউ সেই অস্তিত্বকে অনুভব করতে হবে, বস্তুর মূল কথা হচ্ছে কেউ একজনকে সেই বস্তু পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা করতে হবে।’
‘আংকেল, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? তার মানে কেউই যদি চাঁদকে না দেখে, তখন চাঁদটা হঠাৎ নাই হয়ে যাবে? আমি যখন একা ঘরে ঘুমিয়ে যাই, তখন আমার নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে, যেহেতু আমি নিজে আমাকে অনুভব করছি না বা অন্য কেউও আমাকে ওই সময়টা দেখছে না?’
‘তুমি যখন ঘুমিয়ে যাও, তখনও তোমাকে একজন দেখে। মানুষ যখন চাঁদের দিকে তাকায় না, তখন একজন চাঁদকে দেখে রাখে, যে একজনের কোন ঘুম বা বিশ্রাম নেই। বার্কলে এরকমই মনে করতেন। তিনি মনে করতেন যে ঈশ্বর আছেন বলেই আমরা আছি, সুতরাং আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসে ঈশ্বরের কিছু যায় আসে না।
বার্কলে বলতে চাইলেন – ঈশ্বর কোন বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং ঈশ্বরের তুলনায় আমাদের অস্তিত্বই বিমূর্ত। ঈশ্বর আসলে তোমার আমার চেয়েও বেশি বাস্তব।
শোনো বাবা মুনির – ব্যাপারটা এরকম না যে আমরা ভাবছি বলে ঈশ্বর আছেন, বরং বিষয়টা উল্টো – ঈশ্বর আমাদের কথা ভাবছেন বলেই আমাদের অস্তিত্ব আছে।’
মুনির নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এরকম অদ্ভুতভাবে কেউ চিন্তা করতে পারে সেটা তার কাছে অকল্পনীয়।
‘আপনি যা বলছেন তা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব না, সুতরাং অন্তত আমার কাছে এটা এখনো অবিশ্বাস্য।’
নজরুল সাহেব হেসে মাথা নাড়লেন।
‘মুনির, তোমাকে বার্কলের তত্ত্বে বিশ্বাস করানোর জন্য এগুলো আমি বলিনি। আমি এগুলো বলেছি তোমাকে শুধু এটা দেখানোর জন্য যে বস্তুবাদ ছাড়াও গ্রহণযোগ্য দর্শন পৃথিবীতে আছে। বস্তুবাদ বেশি জনপ্রিয় বলে হয়তো তুমি এটা বেশি জেনেছ, এটাতে আস্থা রেখেছ। তার মানে এই না যে ঐটাই তোমাকে ধরে বসে থাকতে হবে।’
‘যে তত্ত্ব বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে, সেটা নিয়ে আমরা কেন আলোচনা করছি সেটা আমি বুঝতে পারছি না, সরি।’
‘মুনির, বার্কলের তত্ত্ব কিন্তু বিজ্ঞানকে অস্বীকার করছে না, এটা শুধু বলছে যে বাইরের জগৎ জ্ঞানের উৎস হতে পারে না। তুমি কি জানো, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীরা – বিশেষ করে কৃষ্ণগহ্বর গবেষকেরা – এও বলছেন যে বস্তু আর শক্তি মূলত তথ্য। অসম্ভব না যে দ্বাবিংশ শতকে গিয়ে বার্কলে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন।’
‘আংকেল, আপনি যেগুলো বললেন এগুলো প্রমাণিত কিছু না।’
‘বস্তুবাদও প্রমাণিত কিছু না। কোথায় লেখা আছে যে যা পরিমাপ করা যায় না, তা নেই। তুমি যদি পর্যবেক্ষণকেই জ্ঞানের একমাত্র উৎস বানিয়ে নাও, তাহলে তুমি বলবে যে পৃথিবীর সব কাকই কালো, কারণ কালো কাক ছাড়া আর কিছু তুমি জীবনে দেখই নি। কিন্তু সত্য তো এই যে সাদা কাকও আছে, বিরল কিন্তু আছে। তুমি নিজের পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতাকে সত্যের ওপর আরোপ করতে পারো না।’
মুনির উঠে দাঁড়াল। সে আজ আর তর্ক করবে না বলে ঠিক করেছে, এত কিছু আসলে ঠিক মাথাতে ধরছে না। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, মেসে ফেরারও এটাই ঠিক সময়।
সে রাতে বৃষ্টির পরের ভেজা বাতাস উপভোগ করতে করতে মুনির মেসে ফিরল। কিন্তু নিজের ঘরে ঢোকার সাথে সাথে অস্তিত্ববিষয়ক তর্ক-বিতর্ক আবার তার মাথায় খেলতে শুরু করল।
নিজের সম্পর্কে সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ সংবাদটা শোনার পর সে দুইজন মানুষের কাছ থেকে দুইরকম বার্তা পেয়েছে।
একজন ঘোর নাস্তিক বন্ধু তাকে বলেছে – মন হল ‘শূন্য শ্লেট’, বাস্তব অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। যেহেতু ব্যক্তির বাস্তবতা শুরু হয় তার নিজের জীবন থেকে, সুতরাং জীবনের উদ্দেশ্য প্রত্যেক মানুষকে নিজে নিজে বের করে নিতে হবে, ধর্ম-ঈশ্বর এসব অন্যের চাপিয়ে দেয়া অভিজ্ঞতাকে নিজের বলে চালিয়ে দিলে হবে না।
আর একজন আস্তিক ভদ্রলোক তাকে বলেছে ঠিক উল্টো কথা – জ্ঞানের উৎস হল মন আর তার ভেতরকার যুক্তি, বাস্তব অভিজ্ঞতা শুধু যুক্তিকে নিশ্চিত করতে পারে, নাকচ করতে পারে না। ঈশ্বর মানুষ কিংবা জগতের চেয়ে বেশি বাস্তব এক সত্ত্বা, ঈশ্বর জগৎকে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, আর মানুষের কাজ হল সেই উদ্দেশ্যকে খুঁজে বের করা আর মেনে নেয়া।
মুনির বিশ্বাস করতে চায়। তার বাবা-মা বিশ্বাসী ধার্মিক মানুষ, ধর্ম আর ঈশ্বরের ধারণা হাজার বছর ধরেই পৃথিবীতে টিকে আছে। এসব দর্শন অবান্তর হলে এতদিনে নিশ্চয়ই এগুলো সভ্যতা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেত।
কিন্তু তার মানে এই না যে মুনির বিশ্বাস থেকেই শুরু করবে। যদি সে তাই করে, তাহলে আর তার বিবেক-বুদ্ধির কি প্রয়োগ হল? অনেক চিন্তা-ভাবনার পর সে ঠিক করলো – বিশ্বাসকে সে প্রানপনেই খুঁজে দেখবে, কিন্তু তার খুঁজে দেখার পদ্ধতিটা হবে যুক্তির প্রয়োগ, সে কিছুতেই অন্ধভাবে কোনকিছু বিশ্বাস করতে প্রস্তুত না। সে ঈশ্বরের প্রশ্নটাকে অন্তত একবারের জন্য হলেও গুরুত্ব দেবে, কারণ সে মেনে নিতে পারছিল না এ পৃথিবীতে সে কোনো কারণ ছাড়াই এসেছে।
সে রাতে দর্শনের শিক্ষক নজরুল সাহেব আর দার্শনিক বার্কলের কথা চিন্তা করতে করতে মুনির একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। সারাদিনের লাগাতার পেরেশানির পরও কোন কারণে সে রাতে তার বেশ ভালো ঘুম হল।
(চলবে)
