নাস্তিক সমাচার (৬)

অধ্যায় : ঘটনাসমূহ পূর্ব-নির্ধারিত, তাহলে ঈশ্বর কেন পাপের জন্য শাস্তি দেন?

সোমবার দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মুনিরের মনে পড়ল হলে নাম লেখানোর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে এই সপ্তাহান্তেই। বেলা এগারোটার দিকে সে রওয়ানা হল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। অনেকদিন পর ওই এলাকার দিকে বাসে যেতে যেতে তার মাথায় সুন্দর কিছু গান ঘুরতে শুরু করল, সে এমনকি নিজে নিজে কিছুক্ষন গুন গুনও করল।

ভার্সিটির হলে কাজ শেষ করে বেলা তিনটার দিকে যখন সে ফিরতি বাস ধরল, তখন ভিড় কম বলে সে উঠেই মাঝখানের দিকে একটা সিট পেয়ে গেল। বাস চলতে শুরু করার পর সময় কাটানোর জন্য সে আশে-পাশের যাত্রীদের লক্ষ্য করতে শুরু করল।

পেছনের সিটে কমবয়সী কয়েকটা মেয়ে বসেছে, ওরা কি নিয়ে যেন ফিসফাস করছে আর একটু পর পর হেসে উঠছে। ওর পাশের সিটে এক ভদ্রলোক একটা ছেলেকে নিয়ে বসা, ছেলেটার কোলে স্কুলব্যাগ। ওর সামনের সিটে ভার্সিটির কিছু ছেলে উঁচু গলায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে তর্কাতর্কি করছে। একেবারে সামনে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত যে পাঁচটা সিট, সেখানে লুঙ্গি পরা কয়েকজন লোক বসা, এদের একজন আবার সিগারেট ফুঁকছে। মুনির শংকিত হতে শুরু করল, কারণ সিগারেটের গন্ধ নাকে আসা মাত্র তার আবার কাশি শুরু হবে।

চলন্ত বাসেই সে ধরে ধরে সামনে এগুতে শুরু করল। লোকটাকে অনুরোধ করবে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলতে। ও আগেও দেখেছে, ওর অসুস্থতার কথা সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে বেশির ভাগ মানুষই বিনা তর্কে হাত থেকে বিড়ি ফেলে দেয়। কিন্তু দুইটা সিট সামনে এগুনোর পরই মুনিরকে থমকে যেতে হল, কারণ ওর চোখ পড়েছে সামনের ডানদিকের সিটটায়। ওখানে কালো পাঞ্জাবি পরা একজন লোক বসা – লোকটার গায়ের রং কালো, গোলগাল মুখে চাপদাড়ি, মাথায় সাদা গোল টুপি। লোকটা একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল।

মুনির ঘুরে আবার তার সিটে ফিরে এল, কেন এল তা সে নিজেও জানে না। সিটে ফিরে বসার পর সে মনে মনে নিজের আচরণের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। এই লোকটার সাথে তার দুইটা আশংকা জড়িত। প্রথম আশংকা হল অনলাইনের হুমকি – সে ধরেই নিয়েছে হুমকিটা ইসলামিক কোন উগ্র গোষ্ঠী থেকে আসছে, আর অসম্ভব না যে এই লোকটা সেরকম কোন গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। কিন্তু সাথে সাথে এটাও তো সত্য যে এই বিশেষ লোকটাই যে তার ক্ষতি করার জন্য তাকে অনুসরণ করছে, এমনটা ভাবার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই।

দ্বিতীয় আশংকাটা মুনিরের নিজের কাছেই হাস্যকর – কোন সন্দেহ নেই, কালো পাঞ্জাবির ব্যাপারে ইশার স্বপ্ন আর সাবধানবাণী কোনোভাবে তার মস্তিষ্কে ছাপ ফেলেছে তারপর মনের ভেতরে কোনভাবে আসন গেড়ে বসেছে। 

একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে মুনির অসম্পূর্ণ কিংবা অমূলক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু মানুষের ডিএনএর ভেতরে সম্ভবত টিকে থাকার প্রবল কোন আকাঙ্খা কাজ করে, আর সেটা নিশ্চিতভাবেই কুসংস্কারকে খুব গুরুত্বের সাথেই নেয় – সমস্ত যুক্তি ও শুভচিন্তার বিপরীতে গিয়ে মুনির তার সিটে জড়ো-সড়ো বসে থাকল। সিগারেটের ধোয়ার রেশ ততক্ষনে বাসের এদিকটায় আসতে শুরু করেছে, ফলে মুনিরের কাশিটাও শুরু হয়ে গেল।

প্রায় বিশ মিনিট মুনির এভাবেই তার সিটে বসে থাকল আর একটু পর পর কেশে উঠল। লোকাল বাস বার বার থেমে আর লোক উঠিয়ে তার নিজস্ব গতিতে চলছিল। শেষপর্যন্ত বড়বাজারের মোড়ের কাছে বাস আসতেই মুনির তাড়াহুড়ো করে বাস থেকে নেমে গেল। কালো পাঞ্জাবি তখনো বাসের সেই সামনের দিকেই বসা। বাস থেকে নেমে ফিরে তাকিয়ে মুনিরের একবার মনে হল লোকটা আরেকবার ওর দিকে তাকিয়ে কে যেন দেখছে।

হালিম মিয়ার ভাতের দোকানে আজকে হালিম মিয়াকে পাওয়া গেল। সে দোকানের মালিক, কিন্তু তাবলীগের চিল্লায় সময় দেয়ার কারণে সবসময় কাউন্টারে বসতে পারে না। মুনিরকে দেখে সে হাসিমুখে সালাম দিল।

‘ভালো আছেন ভাইয়া? আপনেরে কিন্তু গত জুমায় মসজিদে দেখি নাই। পরের দিকে আসছিলেন বোধ হয়?’

‘আমি গত জুমায় মসজিদে যাই নি, হালিম ভাই।’

‘অসুবিধা নাই। আপনারা তো ছাত্র মানুষ, কত ব্যস্ত। এই জুম্মা মিস হইছে, আগামী জুম্মায় যাবেন।’

মুনির কিছু বলল না। হালিম মিয়ার সাথে তর্ক করা অর্থহীন। সে বহুবার ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছে যে সে এইসবে নেই, কিন্তু এই লোক নাছোড়বান্দা।

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মুনিরের মনে পড়ল, সাতটার সময় মাহমুদ ভাইয়ের লাইভ প্রোগ্রাম নজরুল সাহেবের সাথে। সে ঘড়িতে দেখলো সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। সে প্রোগ্রামটা মিস করেছে। অবশ্য অসুবিধা নেই, রাতে ইউটিউবে ঢুকে দেখে নেয়া যাবে। কিন্তু আটটা না বাজতেই মাহমুদের ফোন এলো।

‘মুনির, নজরুল সাহেবের আট নাম্বার উত্তরটা তুই দেখেছিস? ভাবছি এর রিএকশনটা কিরকম হবে।’

‘ভাই আমি প্রোগ্রামটা অল্পের জন্য মিস করেছি। আট নাম্বার প্রশ্নটা কি ছিল?’

‘আমি ডারউইনবাদ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। আমি আশা করছিলাম, উনি বলবেন ডারউইনবাদ একটা থিউরি মাত্র, এর মধ্যে মিসিং লিংক আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তিনি কি বললেন জানিস? তিনি বললেন যে বিবর্তনবাদ সত্য হতে পারে, কোরানে নাকি আর বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। আমি তো হতভম্ব, কিন্তু লাইভ প্রোগ্রামে কিছু বলতেও পারছি না।  তুই তো জানিস মোল্লারা এইটা কোনোভাবেই মানতে পারবে না। আমার আসলে উচিত ছিল উনাকে ঐটাতে পয়েন্ট কেটে নেয়া, তাহলে অন্তত ইস্যুটা প্যাসিফাই হত, কিন্তু ওই মুহূর্তে মাথায় জিনিসটা আসে নি। বড় একটা ভুল হয়ে গেল রে মুনির, বড় একটা ভুল হয়ে গেল।’              

মাহমুদ ফোন রাখল। মুনির আবার চিন্তায় ডুবে গেল। একেতো অসুখ-বিসুখ, তার ওপর যোগ হয়েছে উগ্রবাদীদের যন্ত্রনা। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি মনে হয় নানাভাবে মুনিরকে হেনস্তা করেই ছাড়বেন।

রাতের খাবারের পর থেকে মুনিরের কাশিটা আবার বাড়ল। সমস্যাটা হল, কাশি শুরু হলে চলতেই থাকে। মনে হতে থাকে, যেন বুকের ভেতরে আর গলার কাছে চুলকাচ্ছে আর কাশলেই শুধু সেই সুড়সুড়ি একটু কমবে। রাত এগারোটার পর মুনির ঘরের লাইটটা বন্ধ করে দিল। স্ট্রিটলাইটের আলো জানলা দিয়ে ঘরে আসছিল বলে ঘরের ভেতরে আবছা অন্ধকার হয়ে ছিল। খাটে বসে সে জানলা দিয়ে একচিলতে তারাভরা আকাশ দেখতে পাচ্ছিল।

মুনির তার নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবছিল – কি কি ঘটনা ঘটতে পারে তার মৃত্যুর পর। প্রথমে নিশ্চয়ই তার নিশ্চল শরীরটা সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়া হবে, তারপর মানুষ সেটাকে একটা খাটিয়াতে উঠিয়ে টেনে নিয়ে যাবে, শেষে একটা কবরের ভেতর রেখে মাটি চাপা দিয়ে চলে আসবে। ফিরে আসার পর সবাই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে যার নিজের কাজে, এদিকে কবরের মধ্যে পচতে শুরু করবে মুনিরের শরীরটা।

মুনির নিজের হাতের দিকে তাকালো, শরীরটা পুরোপুরি পচে যাবার পর এই হাতটার শুধু হাড়গুলোই থাকবে, এমনকি বহু বছর পর হাড়গুলোও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে। যে চোখ দিয়ে এই হাতটাকে এখন সে দেখছে, সেই চোখও মৃত্যুর পর অকেজো হবে, এই অক্ষিগোলক দুটায় বিরাজ করবে অন্ধকার – না, অন্ধকারের চেয়েও ভয়াবহ একটা জিনিস, শূন্যতা।

আচ্ছা, এই যে মুনির নামে একজন চোখ দিয়ে নিজের হাতটাকে দেখছে, এই মুনিরটা আসলে কে? মুনির মানে কি মুনিরের শরীর, নাকি শরীরের ভেতর আরেকটা অস্তিত্ব? এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মুনির যদি শুধু শরীরটার নাম হয়, তাহলে মৃত্যুর সাথে সাথে তার অস্তিত্বও শেষ হয় যাবে – বিজ্ঞান কিন্তু এটাই বলে। কিন্তু এই বেঁচে থাকা যতই যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন, মুনির নিজের অস্তিত্বটাকে ভালোই বাসে – সুতরাং মৃত্যুর মাধ্যমে এই প্রিয় অস্তিত্বটার বিলীন হয়ে যাওয়া কেন যেন সে মেনে নিতে পারে না। অথচ সে জানে, তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে, সুতরাং এই প্রশ্নটাকে আর বেশিদিন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

আজ একাকী এই রাতে অবশ্য মুনির নিজেকে সেই প্রশ্নটার মুখোমুখি করতে চাইল না, কারণ খুবই অস্বস্তিকর এক অনুভূতি এটা। এসব চিন্তা এড়ানোর জন্য তাই সে কোনো একটা বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করার সিদ্ধান্ত নিলো। মানুষের ইচ্ছাশক্তি আসলেও স্বাধীন কিনা সেটা নিয়ে পড়াশোনা করা যেতে পারে, কারণ এটা এমন একটা ধাঁধা যা বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি।

সে তার ব্রাউসারে জমিয়ে রাখা এ সংক্রান্ত কিছু আর্টিকেল পড়া শুরু করল। কিন্তু যতই পড়ছিল, ততই সে বুঝতে পারছিল যে মানুষের আসলে ইচ্ছার কোনো স্বাধীনতা নেই। যে অপরাধী, তার অপরাধের কারণ সে নিজে নয়, বরং তার ডিএনএ এবং তার পরিবেশ। এই দুটো জিনিস মানুষকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে তার আসলে নিজেকে বদলানোর কোনো সুযোগই থাকে না।

একজন মাদক ব্যবসায়ীর ছেলে বড় হয়ে খুনি মাফিয়া হয়েছে, কারণ সে ভালো জীবন কি তা জানেই না। আবার একজন কলেজ শিক্ষকের মেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ব্যারিস্টার হয়েছে, আর সে চাইলেও একটা মানুষ হিসেবে অনেক নিচে নামতে পারবে না কারণ সে মন্দ কি তাই ভালো করে শিখে নি। এই যখন বাস্তবতা, তখন কেন সেই খুনি ব্যক্তিকে দোষারোপ করা হবে, আর কেনই বা ব্যারিস্টার সেই মহিলাকে বাহবা দেয়া হবে – মুনির কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না। সবকিছু তো আগে থেকেই ওদের দুজনের জন্য নির্ধারণ করা ছিল।

এটা শুধু মনোবিজ্ঞান কিংবা জীববিজ্ঞানের কথা না, এমনকি পদার্থবিজ্ঞানও ইঙ্গিত করছে যে কি ঘটবে তা পূর্ব নির্ধারিত। আইনস্টাইন দেখিয়ে গেছেন, দৈর্ঘ-প্রস্থ-উচ্চতার মতো সময়ও আরেকটা মাত্রা। এই বিশ্বজগত একটা ‘ব্লক ইউনিভার্স’ – এখানে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সিনেমার স্নাপশটের মতো একটার পর একটা সাজানোই আছে, অর্থাৎ ‘বিগ ব্যাং’-এর মাধ্যমে জগৎ সংসার শুরু হওয়া থেকে ‘বিগ ক্রাঞ্চ’-এর মাধ্যমে বিশ্বজগত শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটা ঘটনা ইতোমধ্যে নির্ধারিত হয়ে আছে, আমাদের কাজ শুধু অপেক্ষা করা আর দেখা যে ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য কি জমিয়ে রেখেছে।

এমনকি ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টে কখন ইলেকট্রনকে পর্যবেক্ষণ করা হবে সেটাও নির্ধারিত হয়ে আছে, যেমন বিজ্ঞানী বেল ধারণা করেছিলেন। সময় দৈর্ঘ-প্রস্থের মতোই স্থির, সময় নদীর মতো বয়েও চলে না, সম্ভবত আমাদের চেতনাই বরং সময় নামের স্থির মাত্রাটির মধ্য দিয়ে শুধু একদিকে এগিয়ে চলে।

নজরুল সাহেবকে কাল প্রশ্ন করতে হবে, বিশ্বজগত যদি ভবিষ্যৎকে নির্ধারিত করেই রাখে, তাহলে পাপের মধ্যে মানুষের দোষ কোথায় আর পুণ্যের মধ্যেই বা মানুষের গুণ কোথায়। এর দ্বারা কি প্রমাণিত হয় না যে বেহেস্ত-দোজখের ধারণা অবান্তর? যে পাপের জন্য দায়ী না, সে কেন পাপের শাস্তি ভোগ করবে? যার ভাগ্যে পুন্য কাজ লেখাই ছিল, সে কেন তার পুণ্যের জন্য পুরস্কার পাবে? মানুষের যদি স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করার সুযোগই না থাকে, তাহলে সে কেন তার কাজের জন্য দায়ী হবে?

দার্শনিক হ্যারি ফ্রাঙ্কফুর্ট অবশ্য বলেছিলেন যে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আর ঘটনাপ্রবাহের পূর্বনির্ধারিত হওয়ার মধ্যে তেমন কোনো সংঘর্ষ নেই, আমাদের শুধু ধরে নিতে হবে যে মানুষ তখনি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে পারে যখন ওটা তার জন্য পূর্বনির্ধারিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – কেউ হয়তো লীগকে পছন্দ করে ভোট দিল, সে যে লীগকে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করবে, সেটাও আসলে পূর্ব নির্ধারিতই ছিল।

মুনিরের হঠাৎ মনে পড়ল, নজরুল সাহেব একদিন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন – এমনকি নাস্তিক মানুষের মস্তিষ্কের গভীরেও নাকি একটা মানসিক কম্পাস থাকে, যে কম্পাসটা তাকে ঈশ্বরের দিকে টানতে থাকে, মানুষের কাজ হল নিজেকে শুধু ঈশ্বরের দিকে উন্মুক্ত করে দেয়া। আর নিজেকে ছেড়ে দেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে দুনিয়ার সংস্কারগুলো থেকে, ছোটবেলা থেকে শিখে আসা জিনিসগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করে হৃদয়কে অনুসরণ করা।

মুনির ভাবল, এটা কি আসলেও সম্ভব? তার নিজের মধ্যেও কি ঈশ্বরকে খোঁজার গোপন কোন তাড়না আছে? সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলো – সে আজ স্রষ্টা বা ঈশ্বরকে ডাকবে, মন থেকেই ডাকবে। ডাকবে এজন্য না যে সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, বরং এজন্য যে সে পরীক্ষা করে দেখতে চায় ঈশ্বর আসলেও তার প্রার্থনার কোনো জবাব দেন কিনা। ঈশ্বরের জন্য তার প্রশ্নটা ছিল – নিজের জীবনের ওপর যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই, সেই পাপীকে ঈশ্বর কেন শাস্তি দেবেন?

লাইট নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে অন্ধকার সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থেকে মুনির ঈশ্বরকে কল্পনা করার চেষ্টা করতে শুরু করল, যদিও অল্প কিছুক্ষন পরেই তাকে হাল ছেড়ে দিতে হল – ঈশ্বর বলে যদি কেউ থেকেই থাকে তাহলে তো সে সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরণেরই হবে, সুতরাং তাকে কল্পনা করার চেষ্টাও হবে অবান্তর। শেষপর্যন্ত সে শুধু ঈশ্বরের যে কয়টা নাম জানে সেগুলো জপতে জপতে ঘুমিয়ে পড়ল।

সে রাতে সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। সে দেখল যে একজন যৌনকর্মী নারী আর একজন পুণ্যবতী মহিলা মারা গেছে, তারপর তাদেরকে এক উজ্জ্বল দিনে একটা ধূসর প্রান্তরে মৃত্যু থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। একপর্যায়ে ভীষণ উজ্জ্বল কিছু লোক ওদেরকে ঘিরে ধরল, তারপর যৌনকর্মী নারীটাকে নিয়ে গেল প্রচন্ড উত্তপ্ত কালো আগুনের এক কুন্ডের কাছে – আগুনের ভেতর নিক্ষেপ করার জন্য। অন্যদিকে পুণ্যবতী নারীটাকে ওরা সরিয়ে নিয়ে গেল এক রঙিন বাগানের পাশে – বাগানের সুবাতাস তাকে তৎক্ষণাৎ শান্তি দিতে শুরু করল।

উজ্জ্বল পোশাকের লোকগুলো যখন যৌনকর্মী নারীকে আগুনে ফেলতে গেলো আর পুণ্যবতীকে বাগানে প্রবেশ করাতে, ঠিক তখনি অদৃশ্য থেকে আওয়াজ এল – ‘তোমরা থামো, কিসের হিসেবে তোমরা ওদের দুজনকে দুটো আলাদা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছো?’

লোকগুলো বলল – ‘কর্মের হিসেবে। এই মহিলা সারাজীবন কুকর্ম করেছে, যার তার সাথে সহবাস করেছে, এমনকি সেটাকে রোজগারের উপায় বানিয়েছে, তাই তার জন্য আজ আগুন আর শাস্তি। আর ওই মহিলা সারাজীবন ভালো কাজ করেছে, দিনের বেলা মানুষকে সাহায্য করেছে, আর রাতের বেলা প্রার্থনা করে কাটিয়েছে, তাই তার জন্য আজ বাগান আর শান্তি।’

আবার আওয়াজ এল – ‘কর্মের হিসাব হয়েছে, কিন্তু উদ্দেশ্যের হিসাব এখনো বাকি আছে। প্রতিটি কর্মের পেছনে ওদের নিয়ত কি ছিল, তা হিসাব করার আগে ওদেরকে গন্তব্যে নেয়া যাবে না।’

উজ্জ্বল পোশাকের লোকগুলো মহিলা দুজনকে ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, এবার অন্য একদল লোক শূন্য থেকে নেমে এল আরো উজ্জ্বল সোনালী রঙের পোশাক পরে, তারপর অনেক্ষন ধরে কথা বলল দুই পক্ষের সাথেই। মুনির স্বপ্নের মধ্যে সে কথাগুলো শুনতে পেল না, কিন্তু তার কেন যেন মনে হল শেষ বিচারের রায়টা সে শুনতে পাবে। কথোপকথন শেষে সোনালী পোশাকধারীরা একসময় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেল।

যৌনকর্মী নারীর হাত ধরে থাকা সোনালী পোশাকধারী বলল – ‘এই মহিলা অগণিত পাপ কাজ করেছে, কিন্তু সেসব পাপের পেছনে তার না ছিল কোনো ইচ্ছা আর না ছিল কোনো অনিচ্ছা। এই পাপগুলো সে করেছে স্রেফ অভ্যাসবশত, যেহেতু সে এগুলো ছাড়া আর কিছুই জানত না, আর তার নিজের জন্মও হয়েছে এক পতিতালয়েই। যেহেতু সে খারাপ উদ্দেশ্যে এসব খারাপ কাজ করে নি, সুতরাং এসব পাপ কাজের দায় তার জন্য অতি সামান্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

তবে তার একটা ছোট ভালো কাজ খুঁজে পাওয়া গেছে – সে একদিন এক তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি খাইয়েছিল নিজে পানি খাবার আগে। কুকুরটা তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছিল, তাই সে নিজের চেয়ে প্রাণীটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। ও যে পরিবেশে বড় হয়েছে, সেই তুলনায় এটা অপ্রত্যাশিত, কারণ এই কাজটা ছিল তার শিক্ষার একেবারেই বিপরীত। তার সব কাজই পূর্ব নির্ধারিত, এই ছোট ভালো কাজটাও, কিন্তু এ কাজটা সে স্বাধীন ইচ্ছায় হৃদয় থেকেই করেছে। সৌভাগ্যজনকভাবে এই ছোট ভালো কাজটা যোগ করার পর এই মহিলার পাল্লা পুণ্যের দিকে হেলে পড়েছে।’ এই বলে লোকটা মহিলাকে বাগানের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে সেখানে প্রবেশ করিয়ে দিল।

পুণ্যবতী নারীর হাত ধরে থাকা সোনালী পোশাকধারী বলল – ‘এই মহিলা অগণিত পুন্য কাজ করেছে, কিন্তু সেসব পুণ্যের পেছনে তার না ছিল কোনো ইচ্ছা না ছিল কোনো অনিচ্ছা। এই পুন্যগুলো সে করেছে স্রেফ অভ্যাসবশত, যেহেতু সে ভালো ছাড়া আর কিছুই জানত না, আর সে জন্মেছেও এক সম্ভ্রান্ত পরিবারেই। যেহেতু সে মহৎ কোন উদ্দেশ্যে এসব ভালো কাজ করে নি, সুতরাং এসব পুন্য কাজের কৃতিত্ব তার জন্য অতি সামান্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

তবে তার একটা ছোট মন্দ কাজ খুঁজে পাওয়া গেছে – যেহেতু তার মনে পশু-পাখির জন্য কোনো দয়া-মায়া ছিল না, একদিন রাগের কারণে এক বিড়ালকে সে বেঁধে রেখেছিলো ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষণ না প্রাণীটা না খেয়ে মারা যায়। ও যে পরিবেশে বড় হয়েছে, সেই তুলনায় এটা অপ্রত্যাশিত, কারণ এই কাজটা ছিল তার শিক্ষার একেবারেই বিপরীত। তার সব কাজই পূর্ব নির্ধারিত, এই ছোট মন্দ কাজটাও, কিন্তু এ কাজটা সে স্বাধীন ইচ্ছায় হৃদয় থেকেই করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ছোট খারাপ কাজটা যোগ করার পর এই মহিলার পাল্লা পাপের দিকে হেলে পড়েছে।’ এই বলে লোকটা তাকে আগুনের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে সেখানে তাকে নিক্ষেপ করল।

মুনিরের স্বপ্ন এখানেই ভেঙে গেল। সে ঘড়ির দিকে তাকালো, রাত তখন সাড়ে তিনটা। এই স্বপ্নটা কি শুধুই একটা কাকতালীয় ঘটনা? তথাকথিত ঈশ্বর কি শুধু ইঙ্গিতের মাধ্যমেই কথা বলতে পছন্দ করেন? স্বপ্নটার মধ্যে কি তার প্রশ্নটার উত্তর আছে?

কাজের ওপর মানুষের শরীরের নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছার ওপর তার আত্মার নিয়ন্ত্রণ আছে? এর মানে কি শরীরের জগৎ আর আত্মার জগৎ আলাদা? কাল দিনের বেলা এটা নিয়ে নজরুল সাহেবের সাথে কথা বলা যেতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে মুনির একসময় আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

(চলবে)

Leave a comment