নাস্তিক সমাচার (৭)

পর্ব ৩: আস্তিকতার পক্ষে যুক্তিসমূহ

অধ্যায় ১: সব কারণের মূল কারণ ঈশ্বর

মঙ্গলবার সারাটা সকাল মেঘলা কেটেছে, মেঘলা আর ভ্যাপসা গরম। সকাল এগারোটার দিকে মুনির মেডিক্যালে গিয়েছিল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে, কারণ দুই-তিনদিন হয় তার কাশির সাথে রক্ত আসা শুরু করেছে। প্রথমে সে ভেবেছিল যে এটা সাময়িক কোন সমস্যা, পরে ফুসফুসে সম্ভাব্য ক্যান্সারের আশংকা আবার তার ভাবনায় আসতে শুরু করেছে।

প্রফেসর রহমান ছিলেন না, তার ডিপার্টমেন্টেরই আরেকজন ডাক্তার মুনিরের ফাইলগুলি দেখেছে, তারপর বলেছে যে আগের এক্স-রে রিপোর্টে তেমন কিছু নেই। তবে যেহেতু সে ক্যান্সারের পেশেন্ট, তার উচিত হবে আরেকটা এক্স-রে করে তারপর ডাক্তারের সাথে দেখা করা। সরকারি মেডিকেলে এক্স-রে করতে গেলে অনেক ঝামেলা, সে বাইরে কোথাও থেকে এক্স-রে করিয়ে এলে ভালো হবে। মুনির বলেছে যে তার তাড়া নেই, সে এখানেই এক্স-রে করাবে।

এক্স-রের জন্য টিকেট কেটে দুপুরে সে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখল গরম গরম পুরি ভাজা হচ্ছে, পুরির সাইজও বেশ বড়। সে দুইটা আলুপুরি আর এক কাপ চা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে দোতলায় গিয়ে এক্স-রে রুমের সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। এখানে ভিড় অনেক বেশি, তাছাড়া লোকজন কেমন করে যেন লাইন ভেঙে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের একজন কর্মচারী এদিক-ওদিক ঘুরা-ফিরা করছে আর এজন-সেজনের সাথে কথা বলছে, তারপর টাকা নিয়ে হাতে ছোট একটা কি কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে। মুনিরের বেশি টাকা-পয়সাও নেই, বাসায় ফেরার তাড়াও নেই, ফলে সে একটা বেঞ্চির একপাশে বসে লোকজনের কান্ড-কারখানা লক্ষ্য করতে লাগল।

গরমের ভেতর বসে থাকতে থাকতে মুনিরের একসময় ঘুম এসে গেল। ইদানিং তার সময়ে-অসময়ে ঝিমানি আসে, একটু শীত শীতও লাগে, একটা কাঁথা গায় দিয়ে কোথাও পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

কতক্ষন ঘুমিয়েছে তা মুনিরের মনে নেই, কিন্তু সে যখন চোখ খুললো তখন লোকজনের ভিড় কমে এসেছে। মোবাইলে চোখ রেখে দেখলো চারটা বেজে গেছে। সে দুর্বল পায়ে উঠে গিয়ে হাসপাতালের কর্মচারীকে তার রিসিটটা দেখালো। লোকটা কিছুক্ষন তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, তারপর বাড়তি স্পষ্ট উচ্চারণে উঁচু গলায় জানিয়ে দিল যে মুনিরের সামনে আরো পাঁচজন রোগী আছে।

মুনির তার বেঞ্চে ফিরে এল। হাসপাতালে আসা মানেই সারাটা দিন এখানে শেষ হয়ে যাওয়া। অবশ্য এ ব্যাপারে তার করার তেমন কিছু নেইও, প্রাইভেটে চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট আইডি দেখালে সে এখানে কিছুটা সুবিধাও পায়। সবকিছুর পরও প্রাইভেট ক্লিনিকের চেয়ে সরকারি হাসপাতালের ওপর মুনিরের ভরসা বেশি, এরা অন্ততপক্ষে তাকে খামাখা বাড়তি খরচ করাবে না।

খোলা বারান্দা দিয়ে সামনের বাগানে একটা কাঁঠাল গাছ আর একটা জাম গাছ দেখা যাচ্ছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা বেড়েছে, সকালের তুলনায় গরমটাও একটু কম লাগছে। কোন কারণে তার মাথায় খারাপ সম্ভাবনাগুলো আজ বেশি করে ঘুরে ঘুরে আসছে। হতেও পারে তার ফুসফুসে ক্যান্সার ঢুকে পড়েছে। অসম্ভব না যে অটোপ্সির পর ডাক্তাররা তাকে যে ডায়াগনোসিস বলেছিল সেটা অমূলক ছিল না। হয়তো কেমো নেয়ার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করার চেষ্টাও তার শুরু করা দরকার ছিল, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে সমস্যাটাকে অবহেলা করা ঠিক হয় নি।

বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তার নিজের এলাকার স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলা হয় থুতানি অর্থাৎ থুতুর মতো হালকা বৃষ্টি। মুনিরের গ্রামটা ছিল ছিমছাম, তার মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার নানা টুকরো স্মৃতি – যেমন বাবার হাত ধরে খুব ভোরে রেললাইনের উপর দিয়ে হেটে বাজারে যাওয়া, মায়ের হাতে বানানো রুটি আর সুজি, স্কুলের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, গাছে উঠে আম পেরে খাওয়া, আরো কত কি!

আচ্ছা, কেন তাকে এই বয়সে একা একা মরে যেতে হবে? জীবনটা কেন এতো নিষ্ঠুর? যা শেষ হয়ে যাবে, তা শুরু হবার কি দরকার ছিল? সে নিজের অজান্তেই দেয়ালে একটা লাথি মারল, মেরে আবার পায়ে ব্যথা পেল। আর ঠিক তখনি সেই ছোট-খাট সেই কর্মচারী তাকে ডেকে ভেতরে যেতে বলল। মুনির টলতে টলতে গিয়ে এক্স-রে রুমে ঢুকল।

এক্স-রে রুমে তার আরো একঘন্টা সময় লাগল। অপারেটর আসরের জামাতে নামাজ পড়তে গিয়েছিল, প্রায় আধাঘন্টা পর সে পান চিবাতে চিবাতে ফিরে এলো। ছবি তোলা হয়ে গেলে সে মুনীরকে বলল যেন কালকে বিকালে এই সময়ে এসে রিপোর্ট নিয়ে যেতে।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে মুনির ধুলো ওড়া পথে নেমে এল। রাস্তায় তখন অফিস ফেরতা মানুষের ভিড়। কত লোক চারিদিকে! ফুটপাতগুলোতে মানুষের মাথা মানুষ খাচ্ছে যেন। হাজার হাজার লোক চারিদিকে, অথচ এদের কেউই মুনিরের পরিচিত না, এদের মধ্যে একজনও নেই যার সাথে সে তার সমস্যাটা নিয়ে আলাপ করতে পারে, ফলে এই ভীষণ ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে মূলত একাই। মানুষের জীবনটাও কি এরকমই না? মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী থাকার পর জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে কি প্রতিটা মানুষই একা হয়ে যায় না?

অবশ্য চোখের সামনে মানুষ দেখলে – সেটা পরিচিত হোক আর অপরিচিত – কেন যেন অসহায়ত্ত্বটা একটু কম লাগে। এর মধ্যে নৃতাত্বিক কোন কারণ থাকতে পারে, আর মানুষ তো প্রজাতি হিসেবে সামাজিক জীবই। মুনিরের ইচ্ছে করল না সূর্যের আলো কমে আসা এই বিকেলে নিজের ছোট নির্জন ঘরটাতে ফিরে যেতে – ওখানে যাওয়ামাত্র যেন ঘরটা কবর হয়ে তার পাঁজরের হাড়গুলোকে দুপাশ থেকে চেপে ধরবে আর সে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যাবে।

মুনিরের মনে হল কাউকে তার দুর্ভাগ্যের কথাটা শুধু বলতে পারলেও সে মনের গভীরে এক ধরণের আরাম পেত। বাবার কথা একবার মনে হল, কিন্তু সে ভালোভাবেই জানে বাবাকে এটা বলাই যাবে না, মাকেও না। এতে তাদের মনে অশান্তি সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হবে না, উল্টো টাকা জোগাড় করতে না পারার অপরাধবোধে তারা ওর চোখের সামনেই ভুগতে থাকবে।

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, গায়ের ওপর পানির ফোটা আসছে, বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ। লোকজন বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে, কিন্তু মুনির রাস্তার পাশে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হল তার আর কোন আশা নেই, সে যেন অন্ধকার এক রাতে গভীর কোন সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে, কিন্তু এমন কেউ নেই যে অন্তত তার মরে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে অন্যদেরকে তার দুর্ভাগ্যের কথা জানাতে পারবে।

কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে। বিপদে কখনো কখনো মানুষকে নির্লজ্জ হতে হয়। প্রয়োজনে অন্যের কাছে ভিক্ষার হাত পাতা যায়। মানুষের কাছে ছোট হতে পারাও কখনো কখনো কারো কারো জন্য উদারতা। মুনির সেই অর্থে হলেও উদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, সে ভাবল নজরুল সাহেবকে তার অসুখটার কথা বলবে। তিনি আর কিছু না পারেন, তাকে হয়তো সঠিক উপদেশটা দিতে পারবেন।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ মুনির যখন ইশাদের বাসায় হাজির হল, তখন নজরুল সাহেব কেবল মাগরিবের নামাজ সেরে উঠেছেন। বসার ঘরে তখনও জায়নামাজ বিছানো, উনার নিজের মাথায় টুপি। মুনিরকে বসতে বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন তারপর একটা গামছা এনে দিয়ে তাকে বললেন মাথাটা মুছে ফেলতে। ইশাকে আশে-পাশে দেখা গেল না, হয়তো পড়ালেখা করছে। মুনির নজরুলকে খুলে বলল তার শারীরিক অবস্থার কথা। সব শুনে ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে গেলেন।
‘মুনির, তুমি আমার ছেলের মত, এটা সত্যিই খুব চিন্তার কথা। তোমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করা উচিত। আমি শুনেছি ইন্ডিয়াতে অল্প খরচে এসব ট্রিটমেন্ট করা যায়।’
‘হ্যা, আমি চেষ্টা করব।’
‘তুমি তোমার বাবা-মাকেও জানাবে। তারা কিভাবে নেবেন সেটা তাদের ব্যাপার, কিন্তু তোমার কাজ তোমাকে করে যেতে হবে। তোমার দায়িত্ব তাদেরকে সমস্যাটা জানানো।’
‘আচ্ছা জানাবো।’
‘এটা যদি প্রাথমিক অবস্থায় থাকে, তাহলে চিকিৎসায় ভালো হয়ে যেতেও পারে, তাই না? যদি আল্লাহ না করুক বেশি খারাপ অবস্থা হয়, তাহলে তোমার তো ডিসিশন বদলানোর সুযোগ আছেই।’

মুনিরের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা গেল, সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম।
‘আংকেল, আপনাকে একটা কথা বলি। আমি অনেক ভেবে দেখেছি – আমি হয়তো বেঁচে থাকবো, হয়তো মারা যাবো। মারা যাওয়ার আগে আমি যদি ঈশ্বরকে একটা সুযোগ দিতে চাই, সেটা কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন?
আমি কোন মৌলানার কাছে বিশ্বাসের শিক্ষা নিতে চাই না। কিন্তু আপনি যদি আমাকে প্রমান করতে পারেন যে ঈশ্বর আছেন, তাহলে আমি সেটা গ্রহণ করতে রাজি আছি।’

নজরুল বেশ কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপর স্মিত হাসলেন।
‘তাহলে শুরু থেকেই শুরু করা যাক।
প্লেটো-এরিস্টটল এরা বিশ্বাস করতেন এই বিশ্বজগৎ সবসময় একই রকম ছিল একইরকম থাকবে, অর্থাৎ এই জগতের কোন শুরু নেই শেষ নেই।
পারস্য দার্শনিক গাজ্জালী প্রথম জোরেসোরে এর বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অন্তহীন অতীতের ধারণা অবাস্তব, এই বিশ্বজগতের নিশ্চয়ই একটা শুরু ছিল। আর এর যদি একটা শুরু থাকে, তাহলে কেউ একজন নিশ্চয়ই এটা শুরু করেছিল। ইমাম গাজ্জালীর সিদ্ধান্ত ছিল যে এই কেউ একজনতা অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা।
পরবর্তীতে বিখ্যাত যাজক টমাস একুইনাস এর ওপর ভিত্তি করেই ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে তার পাঁচটি শক্ত যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন।
এখন দেখো এই বিংশ শতাব্দীতে এসে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের হাত ধরে বিগ ব্যাং-এর তত্ত্ব এল, বিজ্ঞানও প্রমান করে দিলো যে ইউনিভার্সের একটা শুরু ছিল।’

মুনির এতক্ষন মন দিয়ে সব শুনছিল।
‘স্বীকার করছি, এটা খুবই ভালো যুক্তি। কিন্তু এখানে প্রমান হচ্ছে যে বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিল, তার মানে এই না যে ঈশ্বরই এটা শুরু করেছেন।’
‘ঈশ্বর না করলে কে শুরু করবেন?’

‘আপনি মাল্টিভার্স তত্ত্বের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আমাদের এই ইউনিভার্সটাই একমাত্র ইউনিভার্স না, এরকম অসংখ্য ইউনিভার্স আছে, ইউনিভার্সের এক মহাসমুদ্রের ভেতর এরা তৈরি হচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।’
‘মাল্টিভার্সও কিন্তু অসীম হতে পারবে না। গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট বলেছিলেন – অসীমতা শুধুই একটা গাণিতিক ধারণা, এটা না দেখা যায় প্রকৃতিতে, না কোন বাস্তবসম্মত চিন্তায়।’

মুনির সোজা হয়ে বসল।
‘মানলাম, মাল্টিভার্স অকল্পনীয় রকম বড়, কিন্তু হয়তো অসীম না। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের ইউনিভার্সের উদ্ভব মাল্টিভার্স থেকে, ঈশ্বর থেকে নয়।’
‘ঠিক আছে, সেক্ষেত্রে বলব – সেই মাল্টিভার্সের উদ্ভব হয়েছিল ঈশ্বর থেকে।’
নজরুল উত্তর দিলেন।

‘আংকেল, কেউ যদি দাবি করে ইউনিভার্স, মাল্টিভার্স আপনা আপনি শুরু হয়েছে? তখন আপনি কি বলবেন?
পদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউস তার বই ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’এ প্রস্তাব করেছেন – যেহেতু এই বিশ্বজগত আসলে সমানসংখ্যক প্লাস আর মাইনাসের সম্মিলন, তার মানে একসময় এটা শূন্য থেকে উদ্ভব হতেই পারে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেও প্রমান হয়েছে যে ভ্যাকুয়ামের ভেতর শূন্য থেকে পজেটিভ আর নেগেটিভ কণা তৈরী হয় আবার মিলিয়ে যায়। ল্যাবরেটরির কাঁচের বয়মের মধ্যে মধ্যে যদি শূন্য থেকে কোন স্রষ্টা ছাড়াই পজেটিভ আর নেগেটিভ কণা তৈরী হতে পারে, তাহলে কেন এটা সম্ভব না যে এই বিশ্ব ঐরকমেরই পজেটিভ কণার মতো আর আমাদের মহাকর্ষ ঐরকমেরই নেগেটিভ কণার মতো? তফাৎ শুধু এই যে এগুলো মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে না গিয়ে ট্রিলিয়ন বছরের মধ্যে মিলিয়ে যাবে?’

নজরুল সাহেব ভুরু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে ছিলেন।
‘কিন্তু ল্যাবরেটরির কাঁচের বয়মের ভেতরটা তো একদম শূন্য না, সেখানে তো অন্তত স্থান-কাল আছে। বিগ ব্যাং-এর আগে তো স্থান-কালও ছিল না।
যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে এই – সবকিছুরই একটা কারণ থাকে, এটাই আমরা দেখে এসেছি।

তুমি যদি মাঠে একটা ঘড়ি খুঁজে পাও, তুমি কখনো বলবে না যে এই জটিল যন্ত্রটা শূন্য থেকে আপনা আপনি এখানে এসেছে। তুমি নিশ্চয়ই বলবে যে এই ঘড়িটার একজন মেকার আছে আর কেউ একজন ওটাকে এখানে ফেলে রেখে গেছে। তো একটা ঘড়ির ক্ষেত্রে তুমি যদি এই কথা বল, তাহলে এই মহাজটিল এই বিশ্বজগতের ব্যাপারে তুমি কি বলবে? এই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে এসেছে?’

মুনির কিছুক্ষন চুপ করে থাকল।
‘এখন যে প্রশ্নটা করব এটা জিজ্ঞেস করলে অনেকেই রাগ হয়ে যায়, আপনি বলেই বলার সাহস করছি। আপনার কথা অনুযায়ী এই মহাবিশ্ব যদি শূন্য থেকে না আসতে পারে, তার অস্তিত্বের জন্য ঈশ্বরের দরকার হয়, তাহলে একই নিয়ম কেন ঈশ্বরের ক্ষেত্রে খাটবে না? কেন ঈশ্বরের একজন স্রষ্টার দরকার হবে না?’

‘একই নিয়ম ঈশ্বরের ওপর খাটবে না, কারণ ঈশ্বর আর মহাবিশ্ব এক জিনিস না। ঈশ্বর স্রষ্টা, আর মহাবিশ্ব তার সৃষ্টি। এ দুটা একরকম হতে পারে না, একই নিয়ম দুজনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। নজরুলের তুলনায় তার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটা বিমূর্ত, নজরুলের সৃষ্টি যে কবিতা তার সাথে ব্যক্তি নজরুলের কিংবা তার শরীরের কোন মিল নেই।’

‘আংকেল, কিছু মনে করবেন না। আপনি যে বলছেন স্রষ্টা আর সৃষ্টি ভিন্ন রকম, সেটা কিন্তু যুক্তি না, সেটা বিশ্বাস। মানছি সেই বিশ্বাস সত্য হতে পারে, কিন্তু এই ধারণার মধ্যে কোন যুক্তি-প্রমান আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।
এটাকে বৈজ্ঞানিক প্রমান বলা যায় না, কিন্তু এটাও হতে পারে যে বিশ্বাসের এই জায়গাগুলো বিজ্ঞানের আওতারই বাইরে। বিজ্ঞানের হয়তো এখানে বলার কিছুই নেই।’

নজরুল কোন উত্তর দিলেন না, একদৃষ্টিতে মুনিরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। বাইরে তখন বৃষ্টির বেগ আরেকটু বেড়েছে।

(চলবে)

Leave a comment