নাস্তিক সমাচার (৮)

অধ্যায় ২: ঐশী বাণীই শেষ কথা

বুধবার দুপুরে রেস্টুরেন্টে খাবার জন্য বের হয়ে মেইন রোডটা পার হতেই কালো পাঞ্জাবি পড়া এক লোক মুনিরের চোখে পড়ল। লোকটাকে সে পেছন থেকে দেখছিল, ফলে চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে না। এটা কি বাসের সেই লোকটাই? হতেও পারে, কারণ বাসের লোকটার মতোই এরও মোটা-সোটা শরীর। আবার এটাও হতে পারে যে, মানুষ যা নিয়ে আশংকা করে তার চোখ সে জিনিসগুলোকেই খুঁজে খুঁজে বের করে। যাই হোক না কেন, খাবার দোকানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত মুনির লোকটার পেছনে থেকেই হাটতে লাগল।

হালিম মিয়ার দোকানের একটা সুবিধা হল, দোকান ফাঁকা থাকলে আরাম করে পেপার পরা যায়। একজনের পেপার পড়া হয়ে গেলে কর্মচারীগুলো সেটা আবার এনে কাউন্টারের পাশের টেবিলটাতে রেখে দেয়। সকালবেলা পেপার আসার সাথে সাথে সবগুলো পাতা স্ট্যাপলার দিয়ে ভালো করে পিন মেরে দেয়া হয়, ফলে পাতাগুলো উল্টা-পাল্টা হয়ে যাবার ভয় থাকে না।

আজকের পেপারের একটা খবর মুনিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ডক্টর তায়ীম আহমেদ ইন্টারনেটে এক জিহাদি বক্তৃতা ছেড়েছে। সেটা লাইভ হওয়ার একঘন্টার মধ্যে ইউটিউব সেটা সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু খুব সম্ভবত এই এক ঘন্টার মধ্যেই এটা কপি হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনলাইন ডেস্ক রিপোর্টারের ধারণা, নিষিদ্ধ বিভিন্ন সাইটে এটা খুব সহজেই পাওয়া যাবে।

ডক্টর তায়ীম যুক্তরাজ্য থেকে রসায়নে পিএইচডি করা একজন বাঙালি। বিদেশে যাওয়ার পর কোনোভাবে তার ইসলাম প্রেম তীব্রভাবে জেগে ওঠে, তিনি ভাবতে শুরু করেন যে সন্ত্রাস ছাড়া বর্তমান ইসলামের বিশ্বায়নের আর কোন সুযোগ নেই। তার বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থান পরিষ্কার নয়, তবে অনেকের ধারণা তিনি বাংলাদেশেরই আছেন আর কোন গোপন আস্তানা থেকে একটা চরমপন্থী গ্রূপের কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

পত্রিকাটি তায়ীমের পুরো বক্তৃতাটি তুলে দেয়নি, তবে মূল বক্তব্যটা ছেপেছে। ভিডিওটি তার কোন এক জুমার খুৎবা থেকে নেয়া, যে জামাত আবার কোন একটা বাসার ভেতরে হচ্ছে। খুৎবায় তিনি বর্ণনা করেছেন কেন মুসলমানদের সবার জিহাদে অংশগ্রহণ করা উচিত, আর কেন অমুসলমান নারী ও শিশুদের বোমা হামলা করা জায়েজ – একদিন না একদিন এরা তো মারা যেতই, সুতরাং কয়েক বছর আগে মারা গেলে দুদিনের এই দুনিয়াতে কোন সমস্যা হবার কথা না।

মুনির কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তার মনে হল যে হতেও পারে যে এরা আরো বড় কোন পরিকল্পনারই ছোট অংশ। মুনির নিজে কোরান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছে, আরবিতে এবং বাংলায়। এসব সন্ত্রাসী গ্রূপগুলোর তাফসীর না শুনলে সে শুধুমাত্র অনুবাদ আর সামনে নুযুল পড়ে কোনদিন বুঝতে পারত না যে কোরানে সন্ত্রাসের কথা বলা আছে। জিহাদের আয়াতগুলো একটা বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বলা হয়েছিল, আর এটা এতটাই পরিষ্কার যে সেটা বোঝার জন্য পন্ডিত হওয়া লাগে না। অথচ এরা সেগুলাকেই প্রসঙ্গের বাইরে নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে।

মাহমুদ ভাইও বিপদে আছে, সকালে উনার মা তাকে ফোন করেছিল। মাহমুদ ভাইয়ের বাবা ব্যবসার কাজে প্রায়ই শহরের বাইরে থাকেন, তার মা এজন্য তাকে নিয়ে চিন্তিত থাকেন। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে হুমকি-ধামকি। গত সপ্তাহে কাফনের কাপড় আসার পর তিনি একেবারেই ভেঙে পড়েছেন, মাহমুদ ভাইকে বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছেন না। এখন তিনি পরিচিত সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কেউ চেনা-জানা আছে কিনা যাতে তার বাসায় পুলিশ পাহারা বসানো যায়। মুনির উনাকে বলেছে ওপরের দিকে তার পরিচিত কেউ নেই।

বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে মুনির পত্রিকাটা ভাঁজ করে একপাশে সরিয়ে রাখল, তারপর প্লেটের বাকি খাওয়াতে মন দিল। ডিমভাজা আর ডাল এরা আজকে ভালোই রান্না করেছে, গরম ভাত দিয়ে খাবার সময় ঘিয়ের একটা গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে, সাথে ফ্রি আচার।

খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে ফিরে এসে সে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। সে দেখল হালিম মিয়া সাথে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে সাথে নিয়ে তার টেবিলের দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসে সে বসার অনুমতি চাইল, মুনির সম্মতি জানাতেই দুজন দুটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
‘মুনির ভাই, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই, ইনি আলমগীর সাহেব, আমাদের এই এলাকার তবলীগ জামাতের আমীর।’

আলমগীর সাহেব সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, মুনির সালামের উত্তর দিয়ে হাত মেলাল। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের বেশি হবে, বুক পর্যন্ত নেমে আসা চাপ দাড়িগুলো বেশির ভাগই সাদা হয়ে গেছে। হাতে তার হাঁটার জন্য লাঠি, চোখে প্লাস্টিকের সাদা-কালো ফ্রেমের চশমা, মাথায় নেটের সাদা গোল টুপি।
‘বাবা, আপনি ভালো আছেন তো?’
‘জি ভালো।’
‘আপনাকে মসজিদে দেখি নাই। আপনি কি এই এলাকাতেই থাকেন?’
‘জি, আমি কাছাকাছিই থাকি।’
‘তাহলে অন্য মসজিদে যান মনে হয়। যা হোক, আপনি মনোযোগ দিয়ে কি যেন পড়ছিলেন দেখলাম।’

মুনির পত্রিকাটা টেনে নিয়ে শিরোনামটা দেখাল।
‘এই খবরটা পড়ছিলাম। একজন প্রবাসী বাঙালি আজকে ফতোয়া দিয়েছেন – আত্মঘাতী বোমা হামলা ইসলামে জায়েজ। তিনি বলেছেন – আফগানিস্তান, সিরিয়া আর ইরাকে পশ্চিমারা সমানে নারী-শিশু করছে। তারা যদি নির্বিচারে আমাদের নারী-শিশুদের হত্যা করতে পারে, তাহলে আমরা কেন তাদের নিরীহ নারী-শিশুদের হত্যা করতে পারব না।
মানলাম পশ্চিমারা মিডল ইস্টে অন্যায় করেছে, কিন্তু আমরাও যদি তাদের মতো করি তাহলে সেইসব সাদা শয়তানদের সাথে আরব মুসলমানদের পার্থক্য কি থাকল?’

আলমগীর সাহেব হাসলেন।
‘এইসবই ওহাবীদের কাজ। তারা আজ-কাল দীন ইসলামের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। তাদের কাজ-কর্ম যে ইহুদিদের প্লানকেই আরো সহজ করে দিচ্ছে, সে বিষয়ে তাদের কোন হুশ নেই। ইসলামে এগুলি জায়েজ নাই, ইসলামের দাওয়াত শান্তির দাওয়াত।
আপনারে একটা ঘটনা বলি। একবার ইহুদিরা সব গোপন বৈঠকে বসল, তাদের আলাপের বিষয় ইসলামের কোন গ্রূপটা সবচেয়ে ডেঞ্জারাস। তাদের কমিটি একটা লিস্ট করল, যেখানে তবলীগ জামাত সবার নিচে, মানে তবলীগ জামাত থেকে তাদের ভয়ের কিছু নাই।
কমিটি যখন এই লিস্ট তাদের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিল তখন চেয়ারম্যান ওদের ডেকে বলল – তোমার করছো কি? তাবলীগরে রাখছো সবার নিচে? ওদেররে এক নম্বরে নিয়ে আসো। কমিটি তো অবাক, জানতে চাইল বিষয় কি।
চেয়ারম্যান হেসে বলে – আরে, এরা মাটির উপরের জিন্দেগী নিয়ে চিন্তিত না, এদের ফিকির মাটির নিচের জিন্দেগী নিয়ে। এরা দুনিয়ার পরোয়া করে না, তো এরা সবচাইতে ডেঞ্জারাস না তো কারা ডেঞ্জারাস। পারলে ওদেরকে গিয়ে আগে ধরো।
কিন্তু আল্লাহ চাইলে কে কাকে ধরবে বলেন? এই যে হালিম ভাই, আমি – আমরা সবাই আসল জিন্দেগীর তালাশ করি, এইজন্যই দীনের খেদমতের ইরাদা করি, মানুষের সাথে দীন নিয়ে কথা বলি।
আপনি আমার দীনি ভাই, এইজন্য আমি নিজের জন্য যেটা ভালো মনে করি, সেটা আপনাকেও বলতে চাই।
বাবা, আপনি দেখেন, এই দুনিয়া কয় দিনের? এইখানে আপনি আশি বছর বড় জোর একশো বছর বাঁচবেন। তারপর? একদিন না একদিন আমাদের এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। যিনি আমাদের এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তার কাছে ফেরত যেতে হবে। ঠিক কিনা বলেন?’

এই দুজন তাহলে জানেনা যে মুনির ব্লগ লেখে আর সেগুলোতে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন থাকে।
‘জি। দুনিয়াতে আমাদের তাহলে কি করা দরকার?’
‘এই তো ভাই, সুন্দর প্রশ্ন করছেন। আখিরাতের জীবন অনন্তকালের জীবন, সে জীবনের শেষ নাই। নবীজি বলছেন, কিয়ামতের দিন লোকজন বলবে দুনিয়াতে আমরা তো মাত্র একবেলা সময় কাটিয়েছি। তাহলে আপনি কি এই দুনিয়ার পিছনে দৌড়াবেন, না আখিরাতের পিছনে সময় দিবেন?’
‘আখিরাতের পেছনে সময় দেয়ার জন্য আমাদের কি করতে হবে?’

আলমগীর সাহেব হাতের পাঁচ আঙ্গুল তুলে দেখালেন।
‘নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, ঈমান। ইসলাম খুব সহজ। কিন্তু এইগুলার সহীহ নিয়ম-কানুন আপনাকে জানতে হবে। আপনি জানেন, হারাম খাবার খেলে চল্লিশ দিন পর্যন্ত আপনার নামাজ কবুল হবে না? ছোট-খাট গাফিলতির জন্য মানুষের সব ইবাদত বরবাদ হয়ে যায়। কিন্তু এগুলি জানতে হলে তো আপনার ট্রেনিং নিতে হবে, বেহেশত তো মাগনা কিছু না। আল্লাহ বলেছেন – তোমাদের জান ও মাল আমি বেহেশতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছি। দুনিয়াতেই কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়, তাহলে আখিরাত এর থেকে ভিন্ন কেন হবে?

কিন্তু আল্লাহ আপনার কাছে বেশি কিছু চান নাই। তিনি খালি চেয়েছেন যে আপনি নিজে দীনের হুকুম-আহকাম মানবেন, আর অন্য মুসলমান ভাই-বোনদের দীনের দাওয়াত দিবেন। এই সহজ কাজটা যদি করতে পারেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আপনার মাকামে পৌঁছায় যাবেন, এমনকি আল্লাহ চাইলে আপনার কবর হয়ে যাবে বেহেশতের বাগিচা। আপনার শুধু একবার দীনের রাস্তায় বের হওয়ার নিয়তটা করতে হবে। তো ভাই, আপনার মনে সে নিয়ত আছে তো ইনশাআল্লাহ?’

‘আপনি বলতে চাচ্ছেন এই হুকুম গুলি ঠিকমতো মানতে পারলেই পরকালে মুক্তি পাওয়া যাবে?’
‘জি। এইটাই আল্লাহর ওয়াদা।’
‘কিন্তু তাদের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন, যারা এই সবগুলি কাজ ঠিকভাবে করে, মানে নামাজ-রোজা করে, হজে যায়, আবার মানুষকেও ঠকায়, ঘুষও খায়, দুর্নীতিও করে?’

‘ভাল-মন্দ সবই কিয়ামতের ময়দানে হিসাব হবে – এক জাররা ভালো কাজের হিসাব হবে, এক জাররা খারাপ কাজেরও হিসাব হবে।’
‘আমার কথা হল ইসলামের হুকুম-আহকাম তাদেরকে ভাল মানুষ বানাতে পারছে না কেন? কোথাও নিশ্চয়ই একটা ফাঁক আছে। কোথাও হয়ত কোন ভুল হচ্ছে।’

আলমগীর সাহেব চশমাটা ঠিক করে নিলেন। কোন কারণে ডান্ডাগুলো ঢিলে হয়ে গেছে, ফলে সেটা বার বার নাক বেয়ে সামনে নেমে আসে।
‘আপনে ঠিকই বলছেন, হারাম রোজগারের টাকায় ইবাদত কবুল হবে না। যারা হারাম রোজগার করে, তাদের সবই বরবাদ হবে।’
‘আমীর সাহেব, এমন কি হতে পারে না যে ধর্মটা আমাদের কাছে শুধুই আনুষ্ঠানিক একটা কিছু হয়ে গেছে বলেই আমরা এর শিক্ষাগুলি থেকে নিজেদের ভেতরে কোন উন্নতি করতে পারছিনা?’

আমীর আলমগীর সাহেব লাঠির হাতলে থুতনিটা রেখে হাসলেন।
‘আপনে একদিন আসেন আমাদের জামাতে, আমরা এসব নিয়ে আরো কথা বলতে পারব। আপনারাই সামনে এই দীনের কান্ডারি হবেন, আপনাদের সাথে মাসোহারা করা ভালো হবে। আমার আরেকটা ছোট কথা ছিল, এই কথাটা বলেই আপনাকে ছেড়ে দিব, আপনাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি।
শোনেন বাবা, বান্দার জিন্দেগীতে লেবাসের একটা আসর থাকেই। আপনে যদি সুন্নতি লেবাস পড়েন, দাড়ি রাখেন, তা হলে শেখ-ওলামাদের দোআ আপনের উপর পড়বেই পড়বে, দেখবেন দীনের লাইন আপনেরে কিভাবে টানতে থাকে।’

মুনির গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাদ্রাসায় ক্লাস ফোরে পড়ার সময় একবার কাদায় পড়ে গিয়ে মুনিরের পায়জামা-পাঞ্জাবি সব একাকার হয়ে গিয়েছিল। ধোয়ার সময় ছিলোনা বলে বাধ্য হয়েই প্যান্ট-শার্ট পড়ে তাকে মাদ্রাসায় যেতে হয়েছিল। সেখানে ঢোকার পর সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকাতে লাগল যেন তারা জীন দেখেছে। ওস্তাদজি তাকে সেদিন এমন মার মেরেছিল যে সে তার মাদ্রাসা জীবনে এই ভুল আর কোনদিন করে নি। সেই ওস্তাদ ক্লাসে সবসময় বলত যে প্যান্ট-শার্ট খ্রিস্টানদের পোশাক, ধর্মপ্রাণ মুসলমান এগুলো পরতেই পারে না।
‘তা আপনের সুন্নতি পোশাক কি? পায়জামা-পাঞ্জাবি?’
‘বাবা, সুন্নতি পোশাক হল যেটা আমাদের নবীজি পরেছেন।’
‘নবীজি তো তার সময়ে যেটা প্রচলন ছিল সেই পোশাক পরেছেন। এটাকে আমরা কেন ধর্ম বলছি? এটাতো ওই সময়ের আরব দেশের স্টাইল ছিল, ওই সময় আবু জেহেলও জোব্বা পরত, দাড়ি রাখত। আমরা কি কৃষ্টি আর ধর্মকে মিলিয়ে ফেলছি না?’

আমীর সাহেব হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
‘বাবা, কেনোর কোন শেষ নেই। আপনি সারাদিন কেন কেন করতে পারবেন, কিন্তু এর কোন সমাধান পাবেন না। মনে রাখবেন, অতিরিক্ত প্রশ্ন শয়তান থেকে আসে। মূল সমস্যাটা কি জানেন? মূল সমস্যা হল ইংরেজি শিক্ষা। আজকাল স্কুল-কলেজে ভুল শিক্ষা দিয়ে আপনের মত মেধাবী ছেলে-পিলেদের নষ্ট করে দিতেছে।’
‘আমীর সাহেব, আমি কিন্তু দশ বছর মাদ্রাসায় পড়েছি। কিন্তু ব্যাপার হল আমার একটা কৌতূহলী মন ছিল, আমি না বুঝে কিছু মেনে নিতে শিখি নি।’

‘বাবাজি, মুসলমান হল শুনলাম-আর-মানলাম এর জাতি। আমাদের ধর্মে আদব একটা বড় বিষয়। যারা আদবের খেলাফ করেছে, তারাই পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে।’
‘আপনি একটা ধর্মীয় নিয়ম পালন করবেন, আপনি বুঝবেন না এটা কেন করছেন?’
‘মুনির, বাবা, আপনার কাজ হল আমল কিভাবে করতে হয় সেটার উপায় তালাশ করা, আমলটা কেন করতে হবে সেটা ওলামা-মাশায়েখদের উপর ছেড়ে দিতে হবে। তাদেরকে হয়রান করার চেষ্টা করলে সেটা বড় বেয়াদবি হবে, আর বেয়াদব লোকজনকে আল্লাহ হেদায়েত দেন না।’

হালিম মিয়া পাশ থেকে পুরো কথোপোকথনটা শুনছিল আর একটু পর পর টেবিলে আঙ্গুল ঠুকছিল। আলোচনা অনেকক্ষন হয়েছে, তাই মুনিরও এবার উঠে দাঁড়াল।
‘আমীর সাহেব, এই যে পত্রিকাতে খবরটা দেখলাম, এই যে ওহাবীরা, যারা কিনা ধর্মের নামে সন্ত্রাস করছে, তারাও তো আপনার মতই দাবি করছে যে ইসলামে এগুলি আছে – আছে শুধু না, এটা ফরজ। ওরাও তো আপনার মতই চিন্তা করছে শুনলাম-আর-মানলাম।
আমার ওস্তাদ একজন সাধারণ মানুষ, উনার ভুল হতেই পারে, কারণ উনি তো কোন নবী না, তাহলে উস্তাদকে প্রশ্ন করা কেন বেয়াদবি হবে?
আপনারা বলেন একজন হিন্দু বা খ্রিশ্চান কেন তার নিজের ধর্মকে প্রশ্ন করছে না? জাকির নায়েক বলেছেন – বিধর্মীরা যদি নিজেদের ধর্মের পুঁথি-পুস্তক অনুসরণ করে নিজেদের প্রশ্ন করতো তাহলেই তারা বুঝে ফেলত যে তাদের ধর্ম ভুল আর ইসলাম ঠিক। আমরা বিধর্মীদের বলছি তাদের ধর্মকে প্রশ্ন করতে, আর নিজেরাই সেই প্রশ্ন করাকে বেয়াদবি বলছি? একজন সাধারণ মুসলমান কিভাবে বুঝবে কোন কথাটা নবীজি সত্যিই বলেছেন, আর কোনটা ওস্তাদজীরা বানিয়ে বা ভুল করে নবীর কথা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন?’

আমীর সাহেব আরেকবার চশমাটা ঠিক করে নিলেন।
‘বাবা, আপনার প্রশ্নের শেষ নাই, মাশাল্লাহ। আপনের সাথে দরকার হলে আরেকদিন কথা বলব, আজ একটু দেরি হয়ে গেছে, আমার উঠা দরকার। আসসালামু আলাইকুম।’

আলমগীর সাহেব আলমগীর সাহেব বিদায়ের সময় আর হাত মেলালেন না, লাঠিতে ভর করে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগুতে শুরু করলেন। হালিম মিয়াও ত্রস্ত ভঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে মুনিরকে বিদায় জানানোর কথা মনে হয় একদম ভুলে গেল।

হালিম মিয়ার দোকান থেকে বের হতে হতে বেলা প্রায় তিনটা বেজে গেল। সে একটা রিক্সা নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হল। এক্সরের রিপোর্টটা নিতে হবে, তারপর সেটা নিয়ে আবার যেতে হবে ডাক্তার আফজালের কাছে। আফজাল সাহেবই কাল তাকে এক্সরে করতে বলেছিলেন।

এক্সরের ওখানে গিয়ে দেখা গেল, তার ফাইল এখনো তৈরী হয় নি। চারবার তাগাদা দেয়ার পর বেলা সাড়ে চারটার দিকে সে তার বুকের এক্সরে হাতে পেল। সেটা নিয়ে প্রায় ছুটে ডাক্তার আফজালের রুমে গিয়ে মুনির দেখল উনি বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মুনীরকে দেখে ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে তাকালেন, কিন্তু কি মনে করে আবার বসতে বললেন।
‘রহমান স্যার আপনার কথা আমাকে আলাদাভাবে বলেছে। আপনি কি উনার কোনরকম আত্মীয় হন?’
‘জি না, আমি রহমান সাহেবের কোন আত্মীয় না।’

মুনির এক্সরে রিপোর্টটা এগিয়ে দিয়ে বলল এটা সে আজই পেয়েছে। ডাক্তার আফজাল কোন রিপোর্টটা নিলেন, তারপর প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে সেটা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করলেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ‘হুম’ বললেন, বারবার মাথা নাড়ালেন। নিরীক্ষণ শেষ হবার পর তিনি মুনিরের দিকে ঘুরে তাকালেন, তারপর অনেক্ষন মুনিরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। ওই কয়েক সেকেন্ড মুনিরের কাছে মনে হল অনন্ত কাল।

‘ভাই, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।’
উনি এক্স-রে প্লেটের ওপর একটা বিশেষ জায়গায় আঙ্গুল রেখে বললেন।
‘এই যে এই জায়গাটা গোলমত একটা জিনিস দেখছেন, এটা সম্ভবত একটা গ্রোথ। এটা নিরীহ হতে পারে, আবার সমস্যার জিনিসও হতে পারে। আপনি যেহেতু রহমান সাহেবের পরিচিত, আপনি শিগগিরই উনার সাথে কথা বলেন। আপনার আরো অনেকগুলি টেস্ট করাতে হবে, ইমিডিয়েটলি করতে হবে। কোন অবহেলা করা যাবে না, বুঝলেন?’

ভদ্রলোক একটা ফর্মে কি সব টেস্টের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে সেটা মুনিরের হাতে ধরিয়ে দিলেন, এক্সরের রিপোর্টটাও ফেরত দিলেন।
‘আবার বলছি, দেরি করা যাবে না। ওকে?’

মুনির কাগজগুলো গুছিয়ে হাতে নিল। ও যখন হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ফিরতি রিক্সা নিল, তখন তার মাথা কাজ করছিল না। কোথা থেকে সে সবকিছু শুরু করবে আর কোথায় গিয়ে সব শেষ হবে, কে বলতে পারে? সে ভেবে রেখেছিল ফেরার পথে এক কাপ চা খেয়ে তারপর ঘরে যাবে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার আর কোনোকিছু খেতে মন চাইল না। সে সোজা মেসের সামনে গিয়ে রিক্সা থেকে নামল।

(চলবে)

Leave a comment