পর্ব ৪: উপসংহার
অধ্যায় ১: বিশ্বাস
গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। সকালের আকাশ পরিষ্কার, কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির রেশটা রয়ে গেছে। ইশাদের বাসার উঠানে ঘাসগুলো ভেজা। রোদ উঠলেও গরমটা তেমন গায়ে লাগছে না।
নজরুল সাহেব খবরের কাগজে কি যেন দেখছিলেন। মুনির এসে সামনে বসতেই তিনি মুখের সামনে থেকে পেপারটা নামিয়ে ওর দিকে তাকালেন।
‘আংকেল, গত দুইমাস ধরে আমরা আস্তিক আর নাস্তিকের যুক্তি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছি। কিন্তু মনে তো হচ্ছেনা, আমরা কোন সমাধানে পৌঁছাতে পেরেছি।’
‘পুরো ব্যাপারটাই হয়তো একটা জার্নি, কথা বলতে বলতে একসময় আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাব।’
নজরুল বললেন।
‘আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমি প্রথমে নাস্তিকতার পক্ষে কতগুলি যুক্তি দেখালাম, তখন আপনার কথা শুনে মনে হল সেই যুক্তিগুলোর ভালো প্রতি-উত্তর আছে।
তারপর আপনি আমাকে আস্তিকতার পক্ষে কতগুলো যুক্তি দেখালেন, কিন্তু সেগুলিকে আমি কিছুতেই প্রমান বলে মানতে পারলাম না।
তাহলে দুই মাস ধরে এতো কথা খরচ করে আমরা আসলে কোন সিদ্ধান্তেই আসতে পারলাম না?’
নজরুল সাহেব পেপারটা কোলের ওপর থেকে পাশে সরিয়ে রাখলেন।
‘খুব ইন্টারেস্টিং অবসারভেশন তোমার। ঠিক তোমার মত করেই ভেবেছিলেন সতেরো শতকের একজন দার্শনিক। তার নাম ছিল প্যাসকেল। প্যাসকেলের মনে হয়েছিল যে বিশ্বাস কখনো যুক্তির পথ ধরে আসতে পারে না। শেষপর্যন্ত তিনি ঈশ্বরকে নিয়ে জুয়া খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’
‘ঈশ্বরকে নিয়ে জুয়া খেলা? অদ্ভুত কথা।’
‘যেহেতু তিনি মনে করতেন যে বিশ্বাসকে অন্ধ হতেই হবে, সেহেতু তিনি একজন জুয়াড়ির মতো বিশ্বাস নিয়ে বাজি ধরতে চেয়েছিলেন, কারণ জুয়ারিও অন্ধভাবেই তার কৌশলকে প্রয়োগ করে। প্যাসকেল ঈশ্বরের পক্ষ নেয়ার জন্য গেম থিওরি ব্যবহার করেছিলেন। পেশাদার জুয়াড়িদের নিয়ম প্রয়োগ করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে ঈশ্বরে বিশ্বাস লাভজনক একটা জিনিস। দর্শনের ইতিহাসে এটা প্যাসকেলের জুয়া খেলা বলে পরিচিত।
তিনি দেখিয়েছিলেন যে একজন বিশ্বাসীর অবস্থা একজন অবিশ্বাসীর চেয়ে সবসময়ই বেশি সুবিধাজনক।
ধরো, একজন বিশ্বাসী বিশ্বাস করল ঈশ্বর আছেন, সে অবস্থায় ঈশ্বর থাকলে সে তো লাভবান হলোই। এমনকি ঈশ্বর না থাকলেও তার তেমন কোন ক্ষতি নেই, কারণ তাকে অন্তত নরকে যেতে হবে না, মাঝখান থেকে তার বোনাস হল যে সে পৃথিবীতে একটা নৈতিক শান্তিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে গেল।
অন্যদিকে একজন অবিশ্বাসী চিন্তা করল ঈশ্বর নেই, সে অবস্থায় ঈশ্বর না থাকলে সে বেঁচে গেল। কিন্তু ঈশ্বর কোনোভাবে যদি থেকেই থাকেন, তাহলে তাকে অনন্তকাল নরকে কাটাতে হবে।
প্যাসকেল বলতে চেয়েছিলেন যে একজন দক্ষ জুয়াড়ি অবিশ্বাস না বরং বিশ্বাসকেই বেছে নেবে।’
মুনির হাসল।
‘তার মানে সুবিধার জন্য বিশ্বাস? সেটা তো বিশ্বাস হল না।’
‘প্যাসকেল মনে করতেন যে তার এই ঈশ্বরের পক্ষে বাজি ধরার উদ্দেশ্য বিশ্বাসের পথে যাত্রাটা কেবল শুরু করা, একবার এ পথে যাত্রা শুরু করলে বেশির ভাগ মানুষই একসময় সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করতে পারবে।
মোটকথা বিশ্বাসের রাস্তায় প্রথম পদক্ষেপটা তোমাকেই নিতে হবে, কিন্তু একবার সেটা নিতে পারলে ঈশ্বর বাকি পথটা তোমাকে এগিয়ে নেবেন।’
মুনির মাথা নাড়লো।
‘কিন্তু এটা দিয়ে তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান হচ্ছে না। এটা শুধু দেখাচ্ছে যে ঈশ্বরে বিশ্বাস লাভজনক একটা প্রকল্প।’
‘সেটা ঠিক। প্যাসকেলের উদ্দেশ্য ছিল বরং এটা দেখানো যে যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে প্রমান বা অপ্রমাণ করার চেষ্টা অর্থহীন।’
মুনির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর মনে হল ও অনেকবার ঈশ্বরকে সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু তথাকথিত ঈশ্বর সেই সুযোগটা নিতে পারেন নি।
‘মনে হচ্ছে ঈশ্বরের পক্ষের কথাগুলো আসলে শুধুই যুক্তি, কোন প্রমান না।’
নজরুল কতক্ষন কি যেন ভাবলেন, হঠাৎ তার মুখে মৃদু হাসি দেখা দিলো।
‘তুমি জানো? তোমার সাথে দীর্ঘ সব আলাপের পর আমারও ঠিক এ জিনিসটাই মনে হচ্ছে। ঈশ্বরের কোন প্রমান হয়তো আসলেই নেই। আমরা তাঁর পক্ষে যে যুক্তিগুলো তুলে ধরি, ওগুলোকে প্রমান না বলে বরং নিদর্শন বলাই ভালো। কিন্তু ঈশ্বর এত বড় একটা বিষয় যে তাঁর ব্যাপারে নিদর্শনকেও ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
একটা উট যদি বালুর ওপর দিয়ে হেটে যায়, তাহলে তার পায়ের ছাপকে আমরা প্রমান বলি না, বলি চিহ্ন বা নিদর্শন। কিন্তু এ নিদর্শনই আবার আমাদের বিশ্বাসের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়, উটের পায়ের ছাপ দেখে কিন্তু আমরা বলি না যে এই পায়ের ছাপ দৈবচয়ন পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক বৈচিত্রের কারণে হয়েছে। শুধু ঈশ্বরের বেলাতেই আমরা অস্বীকার করার চেষ্টা করতে থাকি।
কেন করতে থাকি, জানো?’
‘কেন?’
‘কারণ ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে আমাদের মানুষ হিসেবে নিজেদের অহংকারে ছাড় দিতে হবে, ঈশ্বরের কথা চিন্তা করে একটা নৈতিক জীবন-যাপন করতে হবে।’
‘আপনি তাহলে স্বীকার করছেন যে আপনি কোন প্রমান ছাড়াই ঈশ্বরে বিশ্বাস করছেন?’
‘প্রমান কিভাবে করবো যদি ঈশ্বর নিজেই নিজেকে জগৎ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন? এই যে সক্রেটিস থেকে শুরু করে মানবসভ্যতার আদি কাল থেকে দার্শনিকরা যে যুক্তি প্রয়োগ করে ঈশ্বরকে খুঁজে পেল না, আমরা এতগুলো ঘন্টা চেষ্টা করে কোন সমাধানে আসতে পারলাম না, সেটা বরং আরো ভালোভাবে প্রমান করে যে স্রষ্টা কত দক্ষতার সাথেই না নিজেকে সৃষ্টি থেকে আলাদা করে রেখেছেন!’
‘স্রষ্টা নিজেকে কেন আড়াল করে রাখবেন? উনার কি আর খেয়ে-দেয়ে কোন কাজ নেই?’ – মুনির এবার প্রশ্ন করল।
‘কারণ সৃষ্টি হচ্ছে পরীক্ষার হল, যেখানে স্রষ্টা আমাদের পরীক্ষা করছেন আমরা তাকে খুঁজে পাই কিনা। তিনি যদি নিজেকে প্রকাশ করেই দেন, তাহলে তো পরীক্ষার হলেই প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়ে দেয়া হল, পরীক্ষাটা অর্থহীন হয়ে গেল।’
মুনির কথাটা মেনে নিতে পারল না।
‘আমি এখনো বুঝলাম না, যা প্রমান করা যায় না তা কেন আমাকে ধরে নিতে হবে? ধরুন কেউ দাবি করলো যে পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যে যদি একটা চায়ের কেটলি উড়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু বললো যে সেটা প্রমান করা যাবে না যেহেতু টেলিস্কোপে এতো ছোট জিনিস ধরা পড়ে না, তাহলে কেন আমি প্রমান ছাড়া তার কথা মেনে নেব? বার্টান্ড রাসেল বলেছিলেন সেই চায়ের কেটলিকে প্রমান করার দায়িত্ব সেই লোকের যে এই উদ্ভট দাবিটা শুরু করেছিল।’
নজরুল হাসলেন।
‘চায়ের কেটলি আর স্রষ্টা এক জিনিস নয়। রাসেলের সেই কেটলি আছে কি নেই তাতে পৃথিবীর কিছু আসবে-যাবে না, কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্ব না থাকলে পুরো বিশ্বটাই উদ্দেশ্যহীন উদ্ভট হয়ে যাবে, অনেককিছুর ব্যাখ্যা মিলবে না। সত্যি কথা বলতে কি – স্রষ্টার অস্তিত্ব আমাদের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং উল্টো আমাদের অস্তিত্বই স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল।
এজন্যই দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ বলেছিলেন – ধর্ম শুধু বিশ্বাস থেকেই আসতে পারে। ঈশ্বরের দিকে যাত্রা শুরুর জন্য তোমাকে সমস্ত যুক্তিকে জলাঞ্জলি দিতে হবে, তারপর অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে হবে শূন্যের মধ্যে, আর মনে-প্রাণে প্রার্থনা করতে হবে যেন ঈশ্বর আমাকে লুফে নেন, বাঁচিয়ে দেন। এটাই প্রকৃত বিশ্বাস। সত্যকে পেতে হলে যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠতেই হবে। কিয়ের্কেগার্দের এই ঈশ্বরের দিকে ঝাঁপ দেয়াকে দর্শনে ‘লিপ টু ফেইথ’ বলা হয়, বাংলায় বললে ‘বিশ্বাসের দিকে ঝাঁপ’ দেয়া।’
‘তাহলে উগ্রগদি লোকজন কি ভুল করলো? তারাও তো চোখ বন্ধ করেই তাদের যার যার বিশ্বাসের দিকে ঝাঁপ দিয়েছে? ‘লিপ টু ফেইথ’ করেই তো তালেবানরা বিশ্বাস করল যুদ্ধে, আর গাঁজাখোররা বিশ্বাস করল মাজারে।’
‘মুনির, দুটা কিন্তু এক বিষয় না। একজন তালেবানের সাথে একজন কিয়ের্কেগার্দের তফাৎ হল, কিয়ের্কেগার্দ অন্যের ওপর নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে আগ্রহী না। নিজেদের যে শান্তির দূত দাবি করে, সেই তাবলীগীরাও দেখবে নিজের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে অত্যন্ত তৎপর। অথচ সত্য তো এই যে চাপিয়ে দেয়া ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বিশ্বাসের বৃক্ষ হয় না, শুধু আনুষ্ঠানিকতার আগাছাই হয়। তোমার আমির সাহেব বল আর সন্ত্রাসী ডাক্তার তায়ীম বল, দুপক্ষই ধর্মের ওই আগাছাই মনের ভেতর বয়ে নিয়ে চলেছে।’
মুনিরের ফোনটা বাজতে শুরু করেছে। সে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলল – ‘আপনার এই পয়েন্টটা আমার পছন্দ হয়েছে। যে যার মত বিশ্বাস করুক, বা অবিশ্বাস করুক, বাইরের কেউ কেন সেটা চাপিয়ে দিতে যাবে?’
মাহমুদ ভাই ফোন করেছে। মুনির অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ফোনটা ধরল। প্রায় মিনিট পাঁচেক কথা বলে সে হাসিমুখে নজরুলের দিকে তাকাল।
‘ভালো খবর, মাহমুদ ভাই নিরাপদ আছে।’
মাহমুদ আসলে গা-ঢাকা দিয়েছিল। বেনেডিক্টের ওপর আক্রমণের খবর শোনার পরপরই সে রাজশাহীতে তার চাচার বাসায় চলে গিয়েছিল, নিরাপত্তার স্বার্থে তার মা-কেও কিছু বলে যায় নি।
নজরুল সাহেব আর মুনির দুজনই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। দিনটা খুব ভালোভাবেই শুরু হয়েছে। মুনির বাইরে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বাড়ির কথা ভাবতে শুরু করল। সে বাড়িতে একবার ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
(চলবে)

I think this is an exceptionally good dialog on the issue of God. Have you considered “wanting to believe ” or “wanting to disbelieve” even before one looks for a solid answer or proof? Just a thought..
LikeLiked by 1 person