অধ্যায় ২: ঈশ্বর
মুনিরের এখন আর মেসে ফিরে যেতে কোন বাধা নেই। সে বারোটার আগেই যেতে চেয়েছিল, কিন্তু নজরুল সাহেব তাকে দুপুরের খাওয়া খেয়ে যেতে বলছিলেন। দুপুরে খাবার মেনু ছিল ঢেড়স ভাজি, ডাল আর কাচঁকি মাছ। খাবার শেষে নজরুল সাহেব চা খেতে চাইলেন।
চা হাতে নিয়ে মুনির তার অসুখের কথাটা আলাপ করতে চাইল, কিন্তু কারো করুণা মুনির একদম পছন্দ করে না, ফলে সে কথা বলার আগে কিছুক্ষন ইতস্তত করল।
‘আংকেল, আপনাকে যাবার আগে একটা কথা বলে যেতে চাচ্ছিলাম।’
‘কি কথা?’
‘ওরা যদি টেস্টে খারাপ কিছু খুঁজে পায়, তাহলে এরকম হতে পারে যে আমি খুব অল্প বয়সে মারা যাব।’
নজরুল সাহেব ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন।
‘সেরকম কিছু কি ওরা বলেছে?’
‘ওরা এখনো সব পরীক্ষা শেষ করে নি। কিন্তু এটা একটা সম্ভাবনা তো অবশ্যই।
আংকেল, আমি হয় তো দুএকদিনের মধ্যে বাড়ি চলে যাব, মেসেও নোটিশ দিয়ে দিয়েছি। বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিব কি করা যায়।
জানি না আপনার সাথে আবার দেখা হবে কিনা, বা হলেও কবে হবে। তাই চাচ্ছিলাম ঈশ্বর নিয়ে যে আলোচনাটা শুরু করেছিলাম সেটা শেষ করে যেতে। হয়তো এতে আমার সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।’
নজরুল চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে কাপটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। মুনির তার বর্ণনা শুরু করল।
‘প্রায় একমাস আগে আমি ঈশ্বরের খোঁজে আমার যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘ঈশ্বর নেই’ এমন একটা অবস্থান থেকে, কারণ যা জানি না তা ধরে নিয়ে আমি শুরু করতে চাই নি। আর আমার পদ্ধতি ছিল নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে সবকিছু বিচার করা, কারণ কোনো ঐশীবানীকে সত্য ধরে নিয়ে শুরু করলে সেটার মধ্যে কতটুক সততা থাকতো তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
(নাস্তিকতার বিষয়ে উপসংহার)
প্রথমে আমি নাস্তিকতার পক্ষে প্রধান যুক্তিগুলোর উত্তর পেতে চেষ্টা করেছি। আমি আপনার সাথে কথা বলেছি, ফাদার সুশান্তর সাথে কথা বলেছি, নিজে কিছু পড়াশোনা করেছি। শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে যে ধর্ম মানবজীবন আর বিশ্বজগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রস্তাবিত একটা মডেল মাত্র। যেহেতু আমাদের পর্যবেক্ষণ, চিন্তাশক্তি আর অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করে সব প্রশ্নের সমাধান পাওয়া সম্ভব না, সেজন্য মানুষ কিছু জিনিস ধরে নিয়ে আপাতত জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছে। এই ধরে নেয়া জিনিসগুলোর মধ্যে ধর্ম আছে, ঈশ্বর আছে, এমনকি হয় তো ইশার সেই জীন-ভুতও আছে!
যতক্ষণ পর্যন্ত ঈশ্বর বা ধর্ম নামের এই মডেলটার মধ্যে স্ববিরোধিতা খুঁজে না পাওয়া যাবে, ততদিন এটাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়ার হয় তো সুযোগ নেই। এই মডেল ভুল হতে পারে, ঠিকও হতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে তর্কের অন্তত কিছু নেই।
আর যতক্ষণ পর্যন্ত এই অনুমানগুলো ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে শান্তি দেয়, সমাজে এর প্রচলন থাকলে ক্ষতি কিছু নেই। সমস্যাগুলো শুরু হয় তখনি যখন একজন আরেকজনের ঘাড়ে নিজের মত, বিশ্বাস বা ধর্ম চাপিয়ে দিতে চায়। আমরা দেখেছি তালেবানপন্থীরা এমনকি আমাদের দেশের মত শান্তির দেশেও কি অশান্তি চালু করেছে। ওহাবী আর দেওবন্দী অশান্তির কারণও একপক্ষের ওপর আরেক পক্ষের মত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা। এমনকি নাস্তিক লোকজনও ঠিক এই ভুলটাই করে যখন তারা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে ধর্মকে হেনস্তা করার চেষ্টা করে। আমি এদের কারো দলেই পড়তে চাই না।
(আস্তিকতার বিষয়ে উপসংহার)
এরপর আপনি ঈশ্বরের পক্ষে কতগুলো যুক্তি তুলে ধরেছেন, আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ঈশ্বরের ধারণা একটা যৌক্তিক ধারণা। আপনার যুক্তিগুলো সুন্দর ছিল, কিন্তু সেগুলোকে আমার কাছে প্রমান মনে হয় নি, ওগুলিকে হয়তো বড়জোর প্রাকৃতিক নিদর্শন বলা যায়। আপনি যেমন বলতে চেয়েছিলেন যে ঈশ্বর প্রকৃতিতে নিজের নিদর্শন রেখেছেন, কিন্তু কোন প্রমান রাখেন নি, সেটা যে কোন কারণেই হোক।
একদম শেষে আমরা আলাপ করলাম যে বিজ্ঞান তো দূরের কথা, যুক্তি দিয়েও ঈশ্বরকে প্রমান করা সম্ভব না। তাহলে বাকি থাকলো কি? বাকি থাকল ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। অন্তত আমার কাছে এর মানে হচ্ছে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা প্রত্যেক মানুষের জন্য ব্যক্তিগত একটা যাত্রা। আপনি অন্য একজন মানুষকে তথ্যগুলো দিতে পারেন, যাতে সে তার মতো করে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসকে বেছে নিতে পারে। কিন্তু তাকে আপনি জোর করতে পারেন না।’
নজরুল এতক্ষন কথা শুনছিলেন, এবার যোগ করলেন।
‘আমাদের ধর্মেও আছে যে ধর্মের ব্যাপারে জোরাজুরি নেই। সেটা হয়তো এই কারণেই।’
মুনির বলে চলল।
‘আংকেল, আমার কাছে মনে হয়েছে ঈশ্বরে বিশ্বাস একটা গাছের মতো। এটা যদি কারো মধ্যে বেড়ে ওঠার মতো হয়, তাহলে এমনিতেই বেড়ে উঠবে। আপনি চাইলে গাছটাকে পরিচর্যা করতে পারেন, কিন্তু কোনোভাবেই একে টেনে লম্বা করতে পারবেন না। আমির সাহেবের সাথে যেদিন আমার কথা হল, আমার মনে হল তিনি আমার ভেতর বিশ্বাসটাকে টেনে বড় করতে চাইছেন, আমার সেদিন দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিল।
অথচ আপনি কি জানেন, এর মধ্যে আমার জীবনে একটা অলৌকিক ঘটনাও ঘটেছে, যদি আপনি সেটাকে ওভাবে দেখতে চান? আমার মনে খোদার প্রতি একটা প্রশ্ন ছিল, প্রশ্নটার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমাতে গেছি, তারপর সে রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটার মধ্যে আমার প্রশ্নের উত্তর বা সেটার ইঙ্গিত ছিল। আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি ওটাকে আমি কাকতালীয় ঘটনা বলব নাকি আমার জীবনে খোদার একটা নিদর্শন ভাবব। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে আমার জীবনে ওটা সত্যিই একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ছিল।’
(ঈশ্বর বিষয়ে উপসংহার)
নজরুল সাহেব এবার সামনে ঝুকে এলেন।
‘তাহলে মুনির, ঈশ্বর বিষয়ে তুমি কি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছো?’
‘আমার আরো একটু সময় লাগবে মনে হচ্ছে।’
‘তাহলে অন্তত এটুকু বল, যদি একজন ঈশ্বর থেকেই থাকেন, তিনি কেমন হবেন বলে তোমার ধারণা?’
মুনির হাসল।
‘এক। ঈশ্বর যদি থেকেই থাকেন, তাহলে তিনি অবশ্যই সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হবেন। কারণ তিনি যদি সৃষ্টির মত হন, তাহলে তারও শুরু হয়েছিল কি হয় নি সেই প্রশ্নটা আসবে।
দুই। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থেকেই থাকেন, তাহলে তার অবস্থানও হবে সৃষ্টির বাইরে। কারণ, তিনি যদি স্থান-কালেরও স্রষ্টা হন, তাহলে তিনি কিভাবে এর মধ্যে থাকতে পারেন? যেরকম একজন প্রোগ্রামারের শরীর রক্তমাংসের তৈরী আর সেটা কম্পিউটারের বাইরে, কিন্তু তার প্রোগ্রামটা কম্পিউটারের ভেতরে।
তিন। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তাহলে তিনি নিজেকে সৃষ্টি থেকে নিপুণভাবে আড়াল করে রেখেছেন। তিনি যদি তা না করতেন, তাহলে এতদিনে তার প্রমান কেউ না কেউ বের করে ফেলত।’
(ধর্ম বিষয়ে উপসংহার)
নজরুল হেসে তার চশমাটা খুলে মুনিরের দিকে তাকালেন।
‘আশার কথা কি জানো? প্রধান ধর্মগুলো ঈশ্বরকে নিয়ে ঠিক এই দাবিগুলোই করে থাকে।
আচ্ছা, এবার বল ধর্ম সম্পর্কে তোমার মত কি? আদর্শ ধর্মে ঈশ্বর ছাড়া আর কি কি বিশ্বাস থাকা দরকার?’
‘আমার মনে হয় – এক, ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে পরকাল জিনিসটা দরকারি। ওটা না থাকলে ন্যায়বিচারের ধারণাটা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
দুই, ঈশ্বর যদি সৃষ্টি থেকে নিজেকে একটা দূরত্বেই রাখতে চান, তাহলে হয়ত হয়ত ঐশীবাণী আর সেটা নিয়ে আসার জন্য নবীও জরুরি। কারণ ঐশীবাণী না থাকলে আপনি ঈশ্বরের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা কিভাবে জানবেন? নৈতিকতার মানদণ্ড কিভাবে ঠিক করবেন?
তিন, আপনার কর্ম পূর্বনির্ধারিত, বিজ্ঞানও তাই সমর্থন করে। কিন্তু মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার শক্তি আছে, আর সেই ইচ্ছা-অনিচ্ছাই হবে সে ভালো কি মন্দ তার মাপকাঠি।’
‘গুড। আবার বলছি, প্রধান সবগুলো ধর্মেই এই কথাগুলো আছে। সুতরাং তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পার।’
নজরুল ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগলেন। মুনিরও হেসে তার প্রত্যুত্তর দিল। ঘরে ওই মুহূর্তে হন্ত-দন্ত হয়ে ইশা এসে ঢুকল।
‘বাবা, বাবা, এই যে দেখ। নিউজ দিয়েছে, হেডিং দেখ – ব্রাদার বেনেডিক্ট শঙ্কামুক্ত। উনাকে আপাতত হাসপাতালে থাকতে হবে, কিন্তু আর কোন চিন্তা নেই। উফ, আমার যে কি শান্তি লাগছে!’
‘আলহামদুল্লাহ।’ – নজরুল বললেন।
ইশা এবার মুনিরের দিকে তাকাল।
‘আর এই যে মুনির ভাই, আমার বান্ধবী ফিরে এসেছে। এটা নিশ্চিত যে ওকে জীন তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর ও এমন সব অভিজ্ঞতার কথা বলেছে যা কোন মানুষ কোনোদিন পায়নি।’
মুনির আর নজরুল দুজনই হো হো করে হেসে উঠল। ইশার মুখ কঠিন হয়ে গেল, সে নজরুল সাহেবের পাশে গিয়ে বসল।
‘হাসছেন কেন? ম্যাটার আর এনার্জি তো আসলে একই জিনিস, আইনস্টাইন দেখিয়ে গেছেন। তাহলে এটা কেন সম্ভব হবে না যে মানুষের আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে বস্তুর তৈরী একটা শরীরকে, আর জীনেদের আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে শক্তির তৈরী এক ধরণের শরীরকে? বিজ্ঞান আজ এটা জানে না, একদিন ঠিকই আবিষ্কার করবে।’
মুনির তখনো হাসছিল।
‘এটা অবশ্যই সম্ভব। আর ভেবে দেখ, তুমি যদি এটা আবিষ্কার করতে পার, তাহলে চারদিকে কি হৈ চৈ টাই না পড়ে যাবে। তুমি কিন্তু বড় হয়ে এরকম কোন একজন বিজ্ঞানী হওয়ার প্ল্যান করতে পার।’
ইশা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে মুনিরের দিকে তাকিয়ে রইল।
মুনিরের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল, সে উঠে দাঁড়াল। নজরুল তাকে একটু অপেক্ষা করতে বললেন, তারপর ভেতরে গিয়ে একটা খাম নিয়ে এলেন।
‘এখানে একটা চিঠি আছে। এটা তুমি বাড়িতে গিয়ে পড়বে। আর ফোনে ইশা বা আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে।’
মুনির ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে এল, তখন দুপুরের রাস্তাটা তার কাছে কেন যেন বেশ নির্জন মনে হল।
(চলবে)
