অধ্যায় ৩: আত্মা
মুনির বাসে উঠে বসে জানলার পাশের সিটটা নিল, সজল বসল তার ডানপাশে। জানলা দিয়ে শহরটার দিকে ফিরে তাকিয়ে মুনির যেন গত পাঁচ বছরের ঘটনাগুলো সব একে একে দেখতে পেল। বাসের এ দিকটা থেকে বড়বাজারটা দেখা যায়, কিন্তু মুনিরের কেন যেন তার মেসের দিকে চলে যাওয়ার রাস্তাটা দেখতে মন চাইছিল।
বাসে ওঠার পরও প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ওদের অপেক্ষা করতে হল – সব সিটে লোক না ওঠা পর্যন্ত ড্রাইভার বাস ছাড়বে না। এই পুরো সময়টা সজল ফোনে মুনাকে ধরার চেষ্টা করে কাটাল। সজলের আশংকা মুনা তাকে পরিত্যাগ করেছে, নোটগুলো জোগাড় করে দেয়ার পর থেকেই সে সজলকে না চেনার ভাণ করছে।
ভ্যাপসা গরমে যখন ওরা ভাবছিল নিচে নেমে একটু হেটে আসবে, ঠিক তখনি বাস চলতে শুরু করল। জানলা দিয়ে বাইরের বাতাস আসতে শুরু করতেই মুনিরের ঘামে ভেজা শার্টটা শুকাতে শুরু করল, আর ঠিক তখনি তার মনে পড়ল নজরুল সাহেবের চিঠিটার কথা। কি এমন গোপন কথা তিনি লিখেছেন চিঠিতে যা তিনি তাকে সামনা-সামনি বলতে পারেন নি? হ্যান্ডব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে সে আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করল।
‘বাবা মুনির,
তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষনে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেছো। তোমার জন্য আমার সমস্ত শুভকামনা। তুমি হয়তো জানো, তোমার বয়সী আমার একটা ছেলে ছিল। সাব্বির। ও আল্লাহর কাছে চলে গেছে, অন্তত এরকমই আমি বিশ্বাস করি বা করতে চাই। সাব্বির যদি বেঁচে থাকতো, হয়তো তোমার মতোই বুদ্ধিমান একটা ছেলে হতো।
আমি তোমাকে আমার নিজের ছেলের মতোই দেখি, তাই তোমার ক্যান্সারের কথা শুনে আমি একইরকম কষ্ট পেয়েছি যেরকম কষ্ট সাব্বিরের ব্যাপারে পেয়েছিলাম। তুমি যে মনে মনে কি কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছ সেটাও আমি আন্দাজ করতে পারি। জানিনা তোমাকে আবার দেখতে পাব কিনা, তাই তোমার সাথে আমার খুব ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। এটা আমি শুধু ইশাকে বলেছি, আর এখন তোমাকে বলছি।
আমার যেদিন একসিডেন্ট হয়, সেদিন আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রথম থেকে বলি – একটা বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল সেদিন, আমরা রাত্র করে ময়মনসিংহে ফিরছিলাম একটা প্রাইভেট কার নিয়ে। আমি আর তোমার আন্টি পেছনে বসা ছিলাম, হঠাৎ একটা বাসের হেডলাইট আমার চোখে পড়ল। হেডলাইটের বিষয়টা আমার মনে আছে, কারণ আমার মন বলছিল ওই আলোটা পেছন থেকে আমার দেখতে পারার কথা না। এরপর প্রচন্ড একটা শব্দ, তারপর হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল।
আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো? এই যে এতো বড় একটা আঘাত, আমার কোন ব্যথা পাবার কথা মনে নেই। হয় আমার মন সেই ব্যথার স্মৃতিটা মুছে ফেলেছে, অথবা ব্যথার অনুভুতি শরীর থেকে আমার মস্তিষ্কে যাবার আগেই মাথায় আঘাতের কারণে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। আশা করি, সুলতানা আর সাব্বিরও ব্যথা পাওয়ার আগেই জ্ঞান হারিয়েছিল, তাদের মৃত্যু হয়েছিল হঠাৎ কিন্তু বেদনাহীন। পরীক্ষার কারণে সেদিন ইশা বিয়েটা খেতে যেতে পারে নি, সেজন্য তার সে কি মন খারাপ! এখন আমি বলি, ভাগ্যিস।
অদ্ভুত ব্যাপারটা শুরু হল হাসপাতালে পৌঁছানোর পর। আমার হালকা হালকা মনে পড়ে যে ওরা আমাকে একটা বেডে শুইয়ে হাসপাতালের মধ্যে এখান থেকে ওখানে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত কথা হল আমার মনে হচ্ছিল আমি একই সাথে আমার শরীরের ভেতরে আবার বাইরে। যখন নিজেকে শরীরের ভেতরে মনে হচ্ছিল, তখন সারা গায়ে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করছিলাম। কিন্তু যখন নিজেকে শরীরের বাইরে বলে মনে হচ্ছিল, তখন কোথাও কোনরকম ব্যথা ছিল না।
শরীরের বাইরে থেকে আমি এমন সব কথা শুনতে পাচ্ছিলাম যা স্বাভাবিক অবস্থায় আমার শুনতে পারার কথা না, যেমন পাশের ঘরে ডাক্তার বলছে যে এই পেশেন্টকে বাঁচানো যাবে না। আবার এমন কিছু দেখতে পারছিলাম যা স্বাভাবিক অবস্থায় আমার দেখতে পারার কথা না, যেমন আমি নিজেকেই নিজে চোখ বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি, আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি সাব্বির আর সুলতানাকেও দেখেছি পাশের রুমে, আমি তখন থেকেই জানতাম যে ওদের দুজনকে ডাক্তাররা বাঁচাতে পারে নি। আমি ভীষণ মন খারাপ নিয়ে দেখেছি ওদের শরীরের কি ভয়াবহ অবস্থা ছিল।
এরকম অবস্থায় তিনদিন আমি কাটিয়েছি। দ্বিতীয় দিন রাত্রে আমি ভাবলাম, আমি তো এখানেই ভালো আছি, আমি কোনোমতেই ওই ভাঙা-চোরা শরীরে প্রচন্ড ব্যথার মধ্যে ফিরে যাব না। কিন্তু তৃতীয় দিন সকালে আমার ইশার কথা মনে পড়ে, আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আমাকে বাঁচতে হবে। সেই থেকেই আবার এই ব্যথা-বেদনার পৃথিবীতে আমি।
আমি জানি তুমি ভাবছো, ওই শরীরের বাইরের অনুভুতিটা ছিল শুধুই আমার মনের ভুল, উইশফুল থিংকিং ধরণের কিছু একটা। আমি আমার এই অভিজ্ঞতার কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণও দিতে পারব না, কিন্তু এটুক বলতে পারি যে ওই অনুভুতিটা ছিল খুব বাস্তব একটা অনুভূতি। এটা আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমার মনে হয়েছিল ওই অনুভুতিটা আসলে বাস্তব জীবনের যেকোন ঘটনার চেয়েও বেশি বাস্তব কোন অভিজ্ঞতা। ওই জীবনটা যেন এই জীবনের চেয়েও বেশি বাস্তব একটা অন্যধরণের জীবন।
আমি জানি, নিউরোসায়েন্সের বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে যে মন আসলে শরীরেরই একটা এক্সটেনশন, একটা অংশ, বা বহিঃপ্রকাশ – মন শরীর থেকে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু আমি এখন জানি, আত্মা জিনিসটা মন আর শরীর দুটো থেকেই আলাদা একটা কিছু। এ ব্যাপারে আমি একেবারে নিশ্চিত, অন্তত আমার নিজের অভিজ্ঞতাটার পর।
মুনির, এমন কি হতে পারে না যে শরীর একটা হার্ডওয়্যার, মন তার সফটওয়্যার, আর আত্মা হচ্ছে কমান্ডগুলো? একটা কম্পিউটার মেশিনে হার্ডওয়্যার থাকে, সফটওয়্যারও থাকে, কিন্তু কেউ একজন কম্পিউটারে বসে প্রোগ্রামটা না চালালে মেশিন অচলই থাকে, তাই না?
আচ্ছা তুমি আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। মানুষ তো দূরের কথা, একটা কুকুরও যদি মারা যায়, বিজ্ঞান কি তাকে আবার পুনর্জীবিত করতে পারবে? পারবে না। আমি এটাও বলে দিচ্ছি কেন পারবে না। কারণটা হচ্ছে, মৃত্যুর সাথে সাথে প্রাণীর শরীর থেকে কিছু একটা বের হয়ে চলে যায়, যে কিছু একটা ছাড়া প্রাণীকে প্রাণী বলা যায় না। আমার ধারণা ওটার নামই আত্মা।
আমি জানি তুমি ভাবছো – বিজ্ঞান যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, একদিন না একদিন ঠিকই সেটা করে দেখতে পারবে।কিন্তু আমি যেটা বুঝেছি সেটা হল – বিজ্ঞান প্রাণীর শরীরকে বোঝে, সেটাকে ব্যবহারও করতে জানে, কিন্তু একটা ভাইরাসকেও শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারে না। এইজন্যই আমার মনে হয়, বিজ্ঞান কোনদিন মৃতকেও জীবিত করতে পারবে না। আমার এটাও ধারণা যে বিজ্ঞান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভেতরে চেতনার অস্তিত্বও তৈরী করতে পারবে না। কারণটা হচ্ছে, মানুষ এখন পর্যন্ত জৈবিক চেতনা কি তার কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি, চারিদিকে পদার্থবিজ্ঞানের এই অসম্ভব উন্নতির যুগেও।
বাবা, আমি জানি তুমি একজন সংশয়বাদী, যার প্রমান নেই তা বিশ্বাস করতে চাও না। কিন্তু আমি এসব কথা তোমাকে বলেছি এই আশায় যে তুমি তোমার অসুখ-বিসুখের মধ্যে মনে শান্তি পাবে। এগুলো বলেছি এজন্যে যে মৃত্যুভয় তোমাকে বিষন্ন করে ফেলবে না – শারীরিক মৃত্যুর পর যদি আমার আত্মা বেঁচে থাকে অন্য কোন জগতে, তাহলে আমার ভয়ের কি আছে আর হারানোরই বা কি আছে !
আমি তো ইশাকে সব সময় বলি – তোমার শরীরটা তুমি না, মূল তুমি শরীরের ভেতর কোথাও লুকিয়ে আছো আর শরীরটা এই পৃথিবীতে তোমার একটা বাহন মাত্র। এজন্যই আমার লাশকে মানুষ নজরুলের ডেডবডি বলবে, নজরুল বলে ডাকবে না। শরীর নামে তোমার এই গাড়িটা যেদিন পুরোনো হয়ে কিংবা দুর্ঘটনা হয়ে ভেঙে পড়বে, সেদিন সত্যিকার তুমি শরীর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। সেই অন্য আরেক জগতে তোমাকে হয়তো নতুন কোন শরীরও দেয়া হতে পারে, কে বলতে পারে !
তোমাকে যেটা বলতে চেয়েছিলাম সেটা হল কোনোকিছুকেই ভয় পাবার কিছু নেই, এমনকি মৃত্যুকেও না। হয়ত মৃত্যু অতটা খারাপ কোন অভিজ্ঞতা না। যে কয়দিন আমি জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ঝুলে ছিলাম, সে কয়দিন আমার মনটা ভরে ছিল স্বর্গীয় একটা অনুভূতিতে, যেন আমি খুব নিশ্চিন্তে আছি যেভাবে মায়ের কোলে বাচ্চারা ঘুমিয়ে থাকে।
আমি নিশ্চিত তোমারও একই রকম অভিজ্ঞতা হবে, তবে দোআ করি তোমার অভিজ্ঞতাটা তোমার বৃদ্ধ বয়সে হোক আর তুমি অনেক বছর এ পৃথিবীতে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকো।
ইতি, নজরুল ইসলাম।‘
চিঠিটা পড়া শেষ হলে মুনির সেটা আবার আগের মতো ভাঁজ করে খামে ভরল, তারপর তার ডায়েরিটার ভেতর সেটা ঢুকিয়ে রাখল। ওর মুখে মুচকি একটা হাসি খেলে গেল, তারপর বাইরের সবুজ ফসলের মাঠ দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে গেল।
তার ঘুম ভাঙল মোবাইলের টুং টাং শব্দে। না, সজলের মোবাইল না এটা, ও বেচারা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, হয়তো ঘুমের মধ্যে মোনার স্বপ্নও দেখছে, কিংবা দুঃস্বপ্ন। মুনির ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল।
নজরুল সাহেব টেক্সট করেছেন – ‘মুনির, তুমি কি সত্যিই তোমার প্রশ্নের উত্তর পাও নি?’
উত্তরে মুনির লিখল – ‘ওই ব্যাপারে আপনার ঈশ্বরের সাথে মুনিরের এখনো বোঝাপড়া বাকি আছে।’
কিন্তু পাঠানোর আগে কি মনে করে ‘আপনার’ কথাটা ডিলিট করে তার বদলে ‘আমার’ লিখল, তারপর টেক্সট মেসেজটা নজরুল ইসলামকে পাঠিয়ে দিল।
বাসটা পূর্ণ গতিতে রাজশাহীর দিকে ছুটে চলেছে। বাড়িতে পৌঁছাতে ওদের তখনো বেশ কিছু সময় বাকি।
(সমাপ্ত)
