নাস্তিক সমাচার (১0)

অধ্যায় ৪: ঈশ্বরের ধারণা ছাড়া মানবজীবন অর্থহীন

সকালে ঘুম ভেঙে মুনিরের প্রথমে বুঝতে সময় লাগল সে কোথায় আছে। সাব্বিরের ছবিটায় চোখ পড়ার পরই কেবল সে বুঝতে পারল সে কোথায় আছে আর কেন সে এখানে ঘুমাচ্ছে।

(আধুনিক জীবন উদ্দেশ্যহীন)

পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে লাগল তার কাছে। আসলে হয়তো জীবনটাই এরকম বিভ্রান্তিকর একটা যাত্রা। সে যদি আগামী এক বা দুই বছরের মধ্যে মরে যায়, মানুষ তাকে কয়দিন মনে রাখবে? আর যদি রাখেও, তাতে তার কি আসবে-যাবে? সে তো আর সেই মনে রাখা কিংবা না রাখাকে পরীক্ষা করে দেখতে আসছে না। মুনির জানে এটা স্বার্থপর একটা চিন্তা, এটা এমন একটা চিন্তা যেটা তার সমস্ত বিবেকের বাইরে, কিন্তু নিজের এই অনুভূতির দিকটাকে সে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারছিল না।

তবে হ্যা, সে যদি ভালো কিছু করে যেতে পারে, তাহলে তা মানবজাতির কাজে লাগল। সে যদি এভাবে চিন্তা করে যে, তার নিজের অস্তিত্ব পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের একটা অংশ মাত্র, তাহলেও কিছুটা স্বান্তনা পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যক্তি হিসেবে তার কোনো গুরুত্ব না থাকলেও সামগ্রিকভাবে মানবজাতির একটা গুরুত্ব আছে, আর তার কাজ হবে আমৃত্যু – মানে আর যে কয়টা বছর সে বাঁচে – মানবকল্যাণে কাজ করে যাওয়া।

মানবজাতি যদি একটা বিশাল বৃক্ষ হয়, তাহলে সে একটা পাতা – তার মতো অনেক পাতা হয় বাতাসে না হয় শুকনো হয়ে ঝরে যাবে, কিন্তু আবার নতুন পাতা গজাবে এই সামগ্রিক মানববৃক্ষে, আর এভাবেই এই বিশাল বৃক্ষ সময়কে পাশ কাটিয়ে টিকে যাবে। কিন্তু এই বৃক্ষ কি আসলেই টিকে যাবে?

আমরা যদি পৃথিবীর দিকে তাকাই, পাঁচ বিলিয়ন বছরের মধ্যে লাল দৈত্য হয়ে এই গ্রহকে গ্রাস করবে আমাদের এই সূর্যটাই। মানুষ হয়তো ততদিনে অন্যগ্রহে গিয়ে বসতি গড়বে, কিন্তু এভাবে কত দিন? সবাই জানে, নক্ষত্রগুলো সব মরে মরে যাবে, এই মহাবিশ্ব ক্রমশই হবে শীতল আর প্রাণহীন। এটা কোনো কল্পকাহিনী না, এটা বিজ্ঞান, এটাই বাস্তবতা। পালাবে কোথায় মানবজাতি? এই হতভাগ্য মুনিরের মতো তোমাদেরও একদিন ঝরে যেতে হবে মহাবিশ্ব নামের এক বুড়ো বৃক্ষের দুর্বল এক শাখা থেকে।

মানবজাতি চিরদিন টিকে থাকবে না, থাকতে পারে না। এজন্যই নাস্তিক নিৎসে-রাসেল বলেছিলেন – যেহেতু নাস্তিকতা সত্য, সেহেতু কিছুতেই কিছু যায় আসে না, জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই, মানবজীবন উদ্ভট।

জ্যঁ পল সার্ত্রে নিজে ছিলেন নাস্তিক, কিন্তু একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন তিনি। তার মতে প্রতিটা মানুষের মাঝে আছে ঈশ্বরকে খোঁজার এক অত্যাশ্চর্য প্রবণতা, কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর বলে কেউ নেই সেহেতু মানুষের আত্মার এই শূন্যতা পূরণের কোন উপায়ও নেই।

এই ফরাসি দার্শনিক মনে করতেন – মানুষ ভয়াবহরকম স্বাধীন, তাই তার জন্য সঠিক ধর্ম হবে নিজের প্রতি সৎ থাকা, আর ভুল ধর্ম হবে নিজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে অন্যের শিখিয়ে দেয়া বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকা। উনি মূলত নিজেকেই নিজে ঈশ্বর বানাতে বলেছেন।

মোটকথা, মুনিরের এই আদর্শ পুরুষেরা অনেক গবেষণা করে নাস্তিকতাকেই আদর্শ বানিয়েছেন, কিন্তু তার পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসেবে যে মানবজীবনে সর্বগ্রাসী ব্ল্যাকহোলের মতো চরম এক শূন্যতা আসে, সেটার কোন সমাধান তারা দিয়ে যাননি। মুনিরের ই-মেইলের অন্যপাশে এই তিনজন আদর্শপুরুষের একজনকেও আজ পাওয়া যাবে না, ফলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুনিরকেই তার নিজের জীবনের মূল উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে হবে – হাতে সময়ও হয়তো বেশি নেই।

নজরুল সাহেবের ডাকে মুনিরের চিন্তায় ছেদ পড়ল। ঘর থেকে বের হয়ে দ্বিতীয় একটা প্রাণীর দেখা পেয়ে কেমন করে যেন তার হতাশাও মুহূর্তের মধ্যে অর্ধেক হয়ে গেল। মানুষ যে সামাজিক জীব, সে ব্যাপারে মুনিরের সন্দেহ আরো একবার দূর হল। নজরুল সাহেব যে একজন দারুন মানুষ, সেটাও আরেকবার তার মনে পড়ে গেল।

সেদিন মুনির অনেকদিন পর সকালে ভালো করে নাস্তা খেল – হাতে বানানো রুটি, আলুভাজি আর ডিমের অমলেট, সব শেষে মধু দিয়ে এক কাপ গরম লেবু চা – বাড়তি কোন আয়োজন নেই, কিন্তু পুরো অভিজ্ঞতাটাই তার কাছে অসাধারণ লাগল। আসলে যারা বাসার বাইরে একা থাকে, তারা বোধ হয় একসময় ভুলেই যায় খাবারের মতো সামান্য জিনিসকে শুধু যত্ন আর স্নেহ কিভাবে অসামান্য করে তুলতে পারে।

নাস্তার পর মুনির ড্রইং রুমের সোফায় বসে গতকালের ঘটনাগুলো ভাবছিল – আমির সাহেবের সাথে অমীমাংসিতভাবে শেষ হওয়া বাহাস কিংবা মনোমালিন্য, এরপর এক্সরেতে আশংকাজনক রিপোর্ট, সবশেষে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা অর্থাৎ বিনা কারণে অজানা-অচেনা কিছু লোকের তাড়া খেয়ে ঘরছাড়া হওয়া। সে যদি কুসংস্কারে বিশ্বাস করতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই কালকের দিনটাকে ‘কুফা দিন’ নাম দিত।

তার নিজের ল্যাপটপটা ছাড়া তার সময় কাটানোও সমস্যা। সে যখন চিন্তা-ভাবনা করছিল কিভাবে ল্যাপটপটা অন্তত সরিয়ে আনা যায়, তখনই নজরুল সাহেব তার পাশে এসে বসলেন।
‘কি ভাবছ, মুনির?’
‘আংকেল, আমি আসলে এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে এই আমি একদিন কারো তাড়া খাব। আমার জীবনটা ছিল ঘটনাহীন, এখন হঠাৎ করেই অনেক বড় বড় ঘটনা একসাথে ঘটতে শুরু করেছে আমার জীবনে।’
‘সেই মিশনারি ভদ্রলোকের কি অবস্থা কে জানে। সকালের খবরে কোন আপডেট দেখলাম না।’

মুনির হঠাৎ সামনে ঝুকে এলো।
‘আমার ব্লগে আমি ঠিক এই বিষয়গুলো নিয়েই লিখি। এজন্যই আমি বার বার আপত্তি করে বলেছি, ঐশীবানীকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়াই আমাদের বিশ্বের এই সমস্যাগুলির কারণ।’

‘ঐশীবানীর ভুল বিশ্লেষণ কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা প্রচার হওয়াও একটা বড় সমস্যা।’
‘ইসলাম আর খ্রিষ্টধর্ম যদি দুইরকম কথা বলে, তাহলে একজন লোক নিরপেক্ষভাবে কোনটা মেনে নেবে? ইসলাম ধর্মের মধ্যেই দুইটা হাদিস যদি দুই রকম বলে, আপনি কোনটা মেনে নেবেন? কিংবা দুইটা দল যদি কোরানের একই আয়াতের দুইরকম অর্থ করে, আপনি কাকে সমর্থন করবেন?’

নজরুল সোফায় পিঠ লাগিয়ে বসলেন।
‘একজন মুমিন হিসেবে আমি মনে করি না আল্লাহ কোন ভুল ঐশীবাণী দিয়েছেন। আমার মনে হয়, সমস্যা তখনি শুরু হয় যখন মানুষ ঐশীবাণীকে হারিয়ে ফেলে, বা ভুল জিনিসকে ঐশীবাণী মনে করে, অথবা আরো খারাপ মানে নিজের সুবিধামতো জিনিসকে ঐশীবাণী বলে চালিয়ে দেয়।’
‘আপনি মনে হয় বলতে চাচ্ছেন ইসলামে কোন ভুল ঐশীবাণী নেই। ইসলাম যে মুরতাদদের হত্যা করার বিধান দিয়েছে এটা কি মিথ্যা?’
মুনির জানে, তার ব্লগে শুধুমাত্র সাধারণ কিছু প্রশ্ন করার কারণেই কমেন্টবক্সে বহুলোক তাকে মুরতাদ ঘোষণা করেছে। অসম্ভব না যে তার ওপর গতকালের সেই আক্রমণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পক্ষ থেকে একজন মুরতাদকে শাস্তি দেয়ারই চেষ্টা।

‘আমি স্বীকার করি, বেশির ভাগ ওলামা এটাকে সমর্থন করে। তারা একটা হাদিসের রেফারেন্স দেয় যে নবীজি নাকি বলেছেন ধর্মত্যাগীদের মেরে ফেলতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি না, নবীজি এরকম কিছু বলতে পারেন। কেন বিশ্বাস করি না সেটাও বলছি।
কোরানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, ধর্মের মধ্যে জোরাজুরি নেই। ধর্মত্যাগীদের যদি মেরে ফেলা হয়, সেটা তো এই আয়াতের বিপরীত। নবীজি কি কোরানের বিপরীত কিছু বলতে পারেন? পারেন না।

আমার সামনে কোরানের একটা আয়াত আছে যেটার রেফারেন্স খুব শক্ত আর সেটা শান্তির পক্ষে। তার বিপরীতে আমার সামনে একটা হাদিস আছে যেটা ঠিক হতে পারে আবার ভুলও হতে পারে, আর সেটা কোরানের সরাসরি সেই বাণীর বিরুদ্ধে অশান্তির কথা বলছে। আমার কাছে এটা খুব স্পষ্ট আমি কোনটা বেছে নেব।

আমি জানি তারা হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে বলবে এগুলো সহীহ হাদিস। কিন্তু তুমি যদি ভালো করে পড়াশুনা করো, তাহলে দেখবে হাদিস বিতর্কের ঊর্ধ্বে না। বাজারে প্রচুর জাল হাদিস আছে, অনেক সহীহ হাদিসেরও মূল বক্তব্য নিয়ে মতভেদ আছে। এজন্যই হাদিস স্কুলগুলোতে প্রথমে বলে দেয়া হয় যে হাদিস হচ্ছে খবর, খবর ভুলও হতে পারে ঠিকও হতে পারে। তাই হাদিসের খবরকে ওলামাদের আরো ভালো করে যাচাই করার দরকার ছিল, কিন্তু তারা বেহেশত হারানোর ভয়েই মনে হয় সেটা করা থেকে বিরত থেকেছেন। বর্তমান পৃথিবীর অনেক সমস্যার মূল কারণ তাদের সেই ঝুঁকি এড়ানোর প্রবণতা।
মোটকথা কোরানকে আমি অবিকৃত ঐশীবাণী বলে মনে করি, তাই হাদিস আর কোরানের মধ্যে বিরোধিতা দেখা দিলে আমি কোরানকেই বেছে নিবো, সেটা যে যাই বলুক না কেন।

যা হোক। বাদ দাও এসব। তোমার নিজের কথা বল, মেডিকেল থেকে আর কোন খবর পেয়েছো?’

মুনির জানলার বাইরে তাকাল।
‘ওরা ফুসফুসে একটা গ্রোথের মতো পেয়েছে। খুব সম্ভবত এটা বড় রকমেরই একটা সমস্যা। কিন্তু আমি তো অনেকদিন ধরেই জানি এটা হতে পারে, আমার কাছে এটা নতুন কোন তথ্য না। শুধু মাঝে মাঝে ভাবি – আমি কে, আর এ পৃথিবীতে আমি আসলে কি করতে এসেছিলাম?’

নজরুল এতক্ষন মন দিয়ে কথা শুনছিলেন।
‘জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে এটা অনেক প্রাচীন একটা দার্শনিক সমস্যা। তুমি এ পর্যন্ত এ প্রশ্নের কোন উত্তর পেয়েছো?’

‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই নি, পাওয়া সম্ভব বলে মনেও হয় না। একজন আদর্শ নাস্তিক জীবনের কোন বিশেষ অর্থে বিশ্বাস করে না। সবাই সাংঘাতিকরকম মুক্ত-স্বাধীন, ফলে যে যার মতো করে জীবনের অর্থ খুঁজে নেবে। সমস্যা হল আমি আমার নিজের জীবনের অর্থ কোনভাবেই হিসেবে-নিকেশ করে বের করতে পারছি না।’

‘মুনির, তুমি যদি অনেক টাকা রোজগার করতে চাও, কিংবা বিখ্যাত কোন সাংবাদিক হতে চাও, তাহলে পরিশ্রম তোমার কাছে অর্থপূর্ণ একটা জিনিস হতে পারে। জীবনের সেসব সাময়িক অর্থ তুমি হিসাব করে বের করতে পারবে, কিন্তু জীবনের মূল লক্ষ্যগুলো তুমি এভাবে কোনদিনই বের করতে পারবে না। বিষয়টা হচ্ছে – সম্পত্তি, ক্ষমতা, সম্মান এগুলো বিবেকসম্পন্ন কোন মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। এগুলো বড়জোর বৃহত্তর কোন লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ, আর পথকে তো তুমি গন্তব্য বানিয়ে নিতে পারো না।’

‘জীবনের মূল লক্ষ্য খুঁজে বের করার উপায় তাহলে কি?’

‘জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে সবচেয়ে ভালো জিনিস হচ্ছে একজন ঈশ্বরের ধারণা। যে দর্শনে ঈশ্বর মৃত, সে দর্শন তোমাকে জীবনের অর্থ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সমস্যা হল, জোর করে কাউকে বিশ্বাস করানো সম্ভব না।

(ঈশ্বর ছাড়া নৈতিকতার ধারণা অর্থহীন)

শুধু এটাই না, এরকম আরেকটা বিষয় আছে যেটাকে উইলিয়াম লেন ক্রেইগ নামে একজন পশ্চিমা ধর্ম-বিশেষজ্ঞ ঈশ্বরের পক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন। আর সেটা হল – ঈশ্বর ছাড়া নৈতিকতার ধারণা অর্থহীন।

মিথ্যা বলা যে কোন মানদণ্ডেই অনৈতিক। দান করা যে কোন ধর্মেই নৈতিক। কিন্তু কোথায় লেখা আছে যে চুরি করা খারাপ আর সত্য বলা ভালো? আস্তিকদের দাবি হল ভালো-মন্দের ধারণা ধর্ম থেকেই এসেছে।

(বিবর্তন কি নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে?)

মুনির এবার ওর দিকটা বলতে শুরু করল।
‘আংকেল, আপনার এই কথাটা ঠিক মানতে পারলাম না। মার্কিন স্নায়ুবিজ্ঞানী স্যাম হ্যারিস তার বই ‘দা মোরাল ল্যান্ডস্কেপ’এ দাবি করেছেন নৈতিকতা প্রথমে বিবর্তন থেকে এসেছে, তারপর সমাজ সেটাকে বিধি-নিষেধ বানিয়ে নিয়ে ধর্ম বলে চালিয়ে দিয়েছে। তার মতো নাস্তিক মতবাদীরা বিশ্বাস করেন – যা সামষ্টিকভাবে মানে সবার জন্য ভালো, সেটাই নৈতিক। যেমন প্রজাতি হিসেবে সমৃদ্ধ হতে হলে মানুষের সমাজে ঐক্যের দরকার ছিল, সেই থেকেই নিয়ম-শৃঙ্খলা এসেছে। বৈরিতার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে গিয়ে একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করা দরকার ছিল, এজন্য সত্য বলা নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

নজরুল কাঁধ ঝাঁকালেন।
‘বিজ্ঞানের কাছে মানুষ শুধুই এক বুদ্ধিমান পশু। পশুর কোন নৈতিক দায়িত্ব নেই। সুতরাং পুরোপুরি বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে মানুষেরও নৈতিক কোন দায়িত্ব নেই। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখি? বাস্তবে দেখা যায় যে নৈতিকতাকে মানুষ অংকের নিয়মের মতোই সত্য বলে জানে ও মানে। সততাকে কেউ ঐচ্ছিক মনে করে না, মিথ্যাবাদীও সত্যকে ভালো বলেই জানে।
যেহেতু পৃথিবীতে নৈতিকতার স্পষ্ট মানদণ্ড আছে, আর ঈশ্বর ছাড়া এরকম মানদণ্ডের ভালো কোন ব্যাখ্যা চিন্তা করা যায় না, সেহেতু দাবি করা যায় যে সম্ভবত ঈশ্বর বলে কেউ আছেন।’

‘আংকেল, কেন আপনি ঈশ্বরকেই নৈতিকতার একমাত্র মানদণ্ড ধরে নিচ্ছেন?’

‘কারণ নৈতিক বাধ্যবাধকতা আসতে হবে কোন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। একজন পুলিশ যদি তোমাকে থামতে বলে, তাহলেই তুমি রাস্তায় থামবে, এলেবেলে যেকোন লোক বললে তুমি থামবে না। কেন? কারণ তুমি পুলিশকে কর্তৃপক্ষ মনে কর, একজন পথচারীকে তুমি সেটা মনে কর না।

নৈতিকতার যদি কোন ঐশ্বরিক উৎস না থাকে, তাহলে পুরো পৃথিবী হয়ে পড়বে বিশৃঙ্খল। সব শাসকের ওপর যদি একজন বিশেষ শাসক না থাকে, তাহলে একেকজন নৈতিকতাকে একেকভাবে চিন্তা করবে – স্বৈরাচারী বলবে দেশের স্বার্থে বিরোধীদের মারা নৈতিক দায়িত্ব, চোরাচালানি বলবে আমি দেশের বর্ডার মানি না।

ভালো কথা, আজ আমি ওই মিশনারি ব্রাদারের কথা ভাবছিলাম। আমি ঠিক করেছি, উনার সাথে দেখা করতে যাব, উনার পরিবারের খোঁজ নিব, যদি কোন সাহায্য দরকার হয় করব। তোমার কি মনে হয়?’

মুনিরের কাছে পরিকল্পনাটা ভালো মনে হল, কিন্তু সে বলল যে এতে দুই ধরণের ঝুঁকি আছে – এক, পুলিশ ভাবতে পারে এরা কারা আর কেনই বা কথা-নেই-বার্তা-নেই দেখা করতে আসছে; দুই, যারা কুপিয়েছে তাদের কালো খাতায় নজরুল সাহেবের নাম উঠে যেতে পারে। মুনির নজরুল সাহেবকে মাহমুদের সেই অনলাইন প্রোগ্রামের কথা মনে করিয়ে দিল – সেই যে প্রশ্নোত্তর পর্বে নজরুল বিবর্তনকে সত্য বলেছিলেন, ফলে সে সন্ধ্যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি অনেকের কাছে ধর্মত্যাগী মুরতাদ হিসেবে গণ্য হয়ে গিয়েছিলেন।

নজরুল এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন।
‘যদি বলি, আমি সেই ব্রাদারকে দেখতে গেলেই বরং প্রমান হয়ে যাবে যে ঈশ্বর আছেন?’
‘সেটা কিরকম?’
নজরুলের হাসি ততক্ষনে মুনিরের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে।

‘দেখো, আমি উনাকে দেখতে যাওয়াকে আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি। কিন্তু শুধু নীতির কারণে ঝুঁকি নিয়ে কাউকে দেখতে যাওয়া নিশ্চয়ই বিবর্তন থেকে আসে নি, কারণ এই কাজটা আমার টিকে থাকার বিরুদ্ধে কাজ করছে। এখন আমার এই নৈতিকতা যদি প্রকৃতি থেকে না আসে, তাহলে নিশ্চয়ই ঈশ্বর থেকেই এসেছে। আর এর দ্বারা প্রমান হল যে ঈশ্বর বলে কেউ আছেন।’

মুনির এবার মন খুলে হাসল।
‘ভালোই বলেছেন। সেক্ষেত্রে আমাকেও নিয়ে যেয়েন। বলা যায় না, ঐশ্বরিক নৈতিকতা অনুসরণ করার কারণে আমিও হয়তো ঈশ্বরের সুনজরে পড়ে যেতে পারি।’

এরমধ্যে একটা ফোন আসাতে নজরুল সাহেবকে থামতে হল। ফোনে কিছুক্ষন তিনি হু-হা করলেন, তারপর ফোন কেটে দিলেন। তার মুখের হাসি ততক্ষনে অনেকটাই উধাও হয়ে গেছে।
‘মুনির, পারভেজ বলল মাহমুদের কোন খোঁজ ওরা বের করতে পারে নি, তবে চেষ্টা চলছে। কিন্তু একটা ভালো খবর আছে, ডক্টর তায়ীম দলবলসহ ধরা পড়েছেন। তুমি বিশ্বাস করতে পারবে, এই লোক আমাদের আশেপাশেই কোথাও আস্তানা গেড়ে বসেছিল? তাকে ধরার জন্য পুলিশ আর ৱ্যাবকে রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ করতে হয়েছে। তায়ীম আহত, তার সাথে দুজন মারা গেছে, নিহতদের একজন আবার মহিলা। দুজন শিশুসহ মোট বারোজন ধরা পড়েছে। চিন্তা করতে পারো?’

মুনির একদৃষ্টিতে নজরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না।

(চলবে)

Leave a comment