জালাল সাহেব ইদানিং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করার চেষ্টা করেন। মুসল্লি লোকজনের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর একটা প্রচেষ্টা এটা। এমনিতেও তিনি মসজিদ কমিটির সদস্য, সরকারি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কারণে মসজিদের মেরামত আর রক্ষনাবেক্ষনের দিকটা তিনিই দেখেন। তারপর আবার কমিটির কয়েকজন তাকে ধরেছে আগামী বছরের নির্বাচনে মসজিদের প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানোর জন্য।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোর্শেদ চৌধুরী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যের সাথে একসাথে গন্ডগোলে জড়িয়েছেন। মসজিদের কিছু কাজের টেন্ডার বাইরের লোকের কাছে চলে যাওয়াতে মোর্শেদ সাহেব নাখোশ হয়েছিলেন। এখন অন্তত চারজন চাইছে মোর্শেদ সাহেবকে কমিটি থেকে ‘আউট’ করতে, নেতৃত্বে ‘নতুন মুখ’ নিয়ে আসতে। হতেও পারে জালাল সাহেবই সেই নতুন মুখ।
মসজিদের গেটে দাঁড়িয়ে বাইরে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জালাল সাহেব এসবই ভাবছিলেন। এলজিইডির ডাকসাইটে অফিসার হিসেবে স্থানীয়ভাবে জালাল সাহেবের ইতোমধ্যে নাম-ডাক হয়ে গেছে। বলা যায় না, মসজিদ কমিটি থেকেই তার জনসেবার ইতিহাস শুরু হয়ে যেতে পারে, এমনকি একসময় হয়তো এমপি নির্বাচনেও দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। আর সরকারি টিকিটে একবার এমপি হতে পারলে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া একেবারে যে অসম্ভব তা বলা যাবে না। সরকারের দাপ্তরিক কাজে তার যে দক্ষতা আর সুনাম, সেটা তাকে সেসময় সাহায্য করলেও করতে পারে।
মুসল্লিরা জুমার নামাজে আসতে শুরু করেছে। জালাল সাহেব চিন্তা করে দেখলেন, তিনি এসেছেন সবার আগে, ফলে তার সওয়াব নিশ্চিতভাবেই অন্য সবার চেয়ে বেশি। মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার এই একটা সুবিধা, প্রতি পদে পদে সওয়াব আর দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে বেহেশতের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
জালাল সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন তারপর সতর্কতার সাথে সেটা ফ্লোরে মুছলেন – আল্লাহর রাস্তায় প্রতি ফোটা ঘাম মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে আগের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, সেটা সবাই খেয়াল করে না, শুধু বুদ্ধিমান মানুষই এগুলা মনে রাখতে পারে।
কপালের ঘাম ফ্লোরে মোছামুছি করতে গিয়েই তিনি প্রথম ওকে লক্ষ্য করলেন। ছেলেটার একহারা গড়ন, গালের হাড়দুটো উঁচু হয়ে আছে। আঠারো-বিশ হবে ওর বয়স, মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে সানগ্লাস। হলুদ টি শার্ট হার জিরজিরে বুকের ওপর পতাকার মতো উড়ছে, চিপা জিনসের প্যান্টের কারণে পা দুটোকে তেলাপোকার লিকলিকে পায়ের মত দেখাচ্ছে। এই ছেলে এখানে কি করে!
জালাল সাহেবের মাথায় রক্ত চড়ে গেল, কিন্তু তিনি নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করলেন – বলা যায় না, এ হয়তো হোমরা-চোমরা কারো বখে যাওয়া ছেলে। কানের দুল আর গলার তিনটা ভারী লকেট গুনতে গুনতে জালাল সাহেব নিশ্চিত হলেন, এ নেশা করে, কমপক্ষে ফেনসিডিল খায়। তিনি ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
‘বাবা, আপনার নাম কি?’
‘স্লামালেকুম আংকেল, আমি আফজাল।’
‘আপনি এখানে কি করেন, বাবা আফজল?’
‘আংকেল, জুমার নামাজে আসছি। ছোট হুজুর কালকে বলছে, মুসলমানদের জুমার নামাজে আসতে হয়।’
জালাল সাহেব হাসলেন, তার সে হাসিতে একপাশের ঠোঁট অন্যপাশের চেয়ে বেশি বেঁকে থাকল।
‘বাবা, আপনি কানে এটা কি পড়েছেন?’
‘দুল আংকেল। সুন্দর না? আমার বন্ধু আনছে মালয়েশিয়া থেকে।’
‘হা, সুন্দর তো অবশ্যই। আচ্ছা বাবা, আপনি দেখেন তো আসে-পাশে আর কেউ কি আপনার মতো কানে দুল আর বুকে চেন লাগিয়ে মসজিদে আসছে?’
ছেলেটা অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে লাগল।
‘আপনি বলেন তো, কেন আপনি ঠিক এই ড্রেসটা পরেই মসজিদে আসলেন, তাও আবার জুমা বারে?’
ছেলেটা এবার দাঁত বের করে হাসল, যেন তার কিছু একটা মনে পড়েছে। তার দাঁতগুলোও ময়লা।
‘ও আংকেল। শোনেন। হুজুর যখন আমাকে বলল জুমার নামাজ পড়তে আসতে, তখন এটাও বলেছে যে আমি যেন আমার বেস্ট ড্রেসটা পরে মসজিদে যাই। মানে আল্লাহর সাথে দেখা করতে আসলে তো ভালো ড্রেসটাই পরে আসতে হবে, তাই না? আমি চিন্তা করে দেখলাম, হলুদ গেঞ্জিটাই জিনসের সাথে ভালো যায়। তারপর এই দেখেন একটা এক্সট্রা চেনও লাগিয়েছি, যাতে আল্লাহর সামনে সুন্দর দেখা যায়। আচ্ছা আংকেল এখন যাই, ওযু করতে হবে।’
শরীরে জড়ানো বাড়তি চেন আর লোহা-লক্কড়ের ঝংকার তুলতে তুলতে আফজাল মসজিদের ভেতর হেটে চলল। জালাল সাহেব ছেলেটার পাছার দিকে ঝুলে থাকা জিনসের থেকে চোখ ফিরিয়েই লক্ষ্য করলেন কে যেন একটা প্যাকেট ফেলে রেখে গেছে দরজার কাছে। জালাল সাহেব মনে মনে নিশ্চিত হলেন যে এটা ওই বদমাইশটারই কাজ। কিন্তু ওকে ডেকে এনে আবার ওই চেহারা দেখার রুচি তার হল না।
তাছাড়া মসজিদের ময়লা পরিষ্কার করার মধ্যে অনেক বড় বোনাস সওয়াব আছে। উঁচুমাপের একজন মানুষ হওয়ার পরেও তিনি যে নিচুজাতের লোকের কাজ করে চলেছেন, শুধু দিনের খেদমত করার জন্য, এর মধ্যে যে কি পরিমান আজর আছে তা যদি মানুষ জানত! তিনি একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে তারপর নিজ হাতেই কাগজটা তুলে ময়লার ঝুড়িতে ফেললেন।
( অণু গল্প / মায়িন খান, জুন ২০২১ )
