খুব ছোট বেলা থেকে যে উৎসাহটা সব রকমের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকেই কম বেশি পেয়েছি তা হল, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। মাঝে মাঝে তো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত যখন কেউ খুব স্নেহ নিয়ে কথাটা বলত। প্রাথমিক ভাবে যা বুঝে নিতাম তা হল, এমন কেউ হতে হবে যাকে লোকে বড় বলবে, যে নিজেকেও বড় জানবে। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, পুরা ব্যাপারটাই এক ধরণের অহংকারের চাদরে মোড়া। এর পর ধর্ম শিক্ষার অসিলায় জানতে পারলাম বড় মানুষ হবার আরেক দৃষ্টি ভঙ্গি। ঘন ঘন অজু, নামাজ, তাসবিহ, জিকির ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে কেউ কেউ মানুষ হবার পথ দেখালো। সব গুলো কাজই ভীষণ উপকারী হবার পরও কেন যেন মনে হল, এগুলো মানুষের ভালো সঙ্গি, কিন্তু মানুষ ঠিক কি জিনিস তা বোঝা হল না।
স্বাধীন চেতা সমাজে চলাফেরা করতে করতে শিখলাম, আমার জীবনে আমার নিজের চিন্তা অনুভূতিই সবচেয়ে মুখ্য। তাই ভাবলাম, আমার যা ভালো লাগে তা করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষ হওয়া। সবচেয়ে বড় বিপদটা হল ওখানেই; বুঝতে পারলাম আমি বেশ সাধারণ একজন মানুষ, অধিকাংশ স্বাভাবিক জিনিসই আমার ভালো লাগে। ঘর সাফ করা থেকে শুরু করে মানুষের শরীর কাটা ছেড়া করা, কিম্বা ভূত থেকে শুরু করে ব্ল্যাক হোল পর্যন্ত নানা বিষয় নিয়ে জ্ঞান অর্জন করা, সবই আমার ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগেনা কোন কিছু না করে থাকতে।
এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ভাবলাম, যা কিছু করি তা তো সুখে থাকার জন্যই করি, তাহলে সুখে থাকলেই তো হল, অত মানুষ হওয়ার চিন্তা করে কাজ কি! কিছু দিন তাই করলাম। বার বার নিজেকে মনে করিয়ে দিলাম, খোদার ইচ্ছায় সুখে আছি। সেও বেশি দিন ভালো লাগলো না। মনে হল, আমি মানুষ, আমার একটা সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ কর্মকাণ্ড থাকা দরকার যা আমাকে অমানুষদের (পশু, পাখি, গাছ ইত্যাদি) থেকে আলাদা করবে। সেটা কোন ভাল/খারাপ কিম্বা দামি/সস্তার ভিত্তিতে নয়, বরং সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যর ওপর ভিত্তি করে।
প্রথম বারের মতো এমন কিছু খুঁজে পেলাম যা আমার মানুষ পরিচয়কে সাহায্য করবে বলে মনে হল। এটা হল, “উপলব্ধি” করা। মন দিয়েই যদি মানুষের মূল পরিচয় হয়, তাহলে উপলব্ধিই মানুষের সনাক্তকারি কাজ। এই “উপলব্ধি”র ওপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলা সম্ভব একজন মানুষ। মনে হল, মানুষ অনেকটা সেই গোলকের মতো যার সব দিকই প্রতিফলক, ঠিক যেমন পারদের তৈরি একটা গোলক। শুধু তফাত হল, পারদের গোলক তার চারপাশের সব কিছুর প্রতিফলন করে, যেখানে মানুষ করে উপলব্ধি।
হ্যাঁ। মানুষ আগাগোড়া উপলব্ধিতে মোড়া এক সৃষ্টি। মানুষ হওয়ার যাত্রা তাই শুরু হতে হবে উপলব্ধি থেকেই। তারপর আরও অনেক কিছুই তাতে যোগ করা সম্ভব। তবে সাবধান। সুতোয় গাঁথা মালাই যেমন একমাত্র বাস্তব মালা, উপলব্ধিতে গাঁথা জীবনই একমাত্র মানুষের জীবন। পুঁতির নেশায় সুতা হারালে যেমন মালা বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়, বড়ত্বের আশায় উপলব্ধিটাকে খোয়ালে মানুষের জীবনও ঠিক তেমনই অমানবিক কিছুতে রূপ নেয়।
চারপাশে তাকালে যখন আমরা বড় অর্থাৎ সফল মানুষ দেখি, তখন যদি তাদের মধ্যে উপলব্ধির গাঁথুনি খুঁজে পাই, তখনই বলতে পারি, একজন মানুষের মতো মানুষ দেখলাম। অন্যথায়, পাহাড়, দালান, দানব অথবা স্তূপের মতো মতো মনে হয় – বড় কিন্তু মানুষ নয়।

ভালো লাগলো।
LikeLike