আমরা অনেকেই, অনেক দিন যাবত, খাবার কন্ট্রোল, ব্যায়াম করেও ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারছি না। ওজন যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। বর্তমানে ডাক্তাররা বলছেন, এর কারন আর কিছুই নয়, হরমোন। আমাদের শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় হরমোনের মাত্রা সবসময় নির্দিষ্ট থাকে। কোন কারনে হরমোন বেড়ে বা কমে গেলেই দেখা দেয় নানা সমস্যা। তাই ওজন কমানোর জন্য আপনার একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। শুধুমাত্র ডাক্তারই বলতে পারবেন, আপনার ওজন বৃদ্ধির প্রধান কারন কি।
বর্তমান বিজ্ঞানীরা এই হরমোনের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন। আর আশা করা যাচ্ছে, অদুর ভবিষ্যতে শুধুমাত্র এই হরমোন নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ওজন কমানো সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ওজন বৃদ্ধির ৯৯ শতাংশ কারণই হল হরমোনগত। ওজন বাড়ার সাথে নানা হরমোন জড়িত, যেমন, ইসট্রোজেন, থাইরয়েড, ইন্সুলিন, করটিসল, লেপটিন, ঘ্রেলিন ইত্যাদি হরমোন। আজ আমরা লেপটিন হরমোন নিয়ে কথা বলবো…
মোটা বা রোগা হওয়ার আসল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে লেপটিন নামক একটি হরমোনের মধ্যে৷ শরীরের ফ্যাট বা চর্বি থেকেই লেপটিন হরমোন তৈরি হয়। রক্তের মাধ্যমে এরা ব্রেইনে যায়। লেপটিন হরমোন আমাদের ব্রেইনকে জানান দেয়, কতটুকু খেতে হবে, এখন কি খেতে ইচ্ছা করছে কিংবা ক্ষুধা নিবারণ হয়েছে কিনা। ব্রেইনে এই লেপটিনের উপস্থিতির মাধ্যমে বুঝতে পারে, আমাদের শরীরে সঞ্চিত ফ্যাটের পরিমাণ কতটা এবং আরও খাদ্যগ্রহণ প্রয়োজন কি না৷ অনেকের শরীরে লেপটিন হরমোন ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে পর্যাপ্ত খাওয়ার পরও মস্তিষ্কে জানান দেয় না, পেট ভরেছে। যদি কোনও কারণে শরীরে সঞ্চিত ফ্যাটের পরিমাণ কমে যায়, তখন লেপটিনের পরিমাণও সমানুপাতিক ভাবে হ্রাস পায়৷ ফলে ব্রেইন এই কম লেপটিনের উপস্থিতি দেখে বুঝতে পারে যে শরীরে আরও শক্তিগ্রহণ প্রয়োজন এবং তখন তা উপযুক্ত সিগন্যাল পাঠায়, যাতে আরও খাদ্যগ্রহণ করা হয়৷ এর ফলস্বরূপ আমরাও ক্ষুধার্ত বোধ করি৷ তবে শরীরে শুধুমাত্র লেপটিন থাকলেই হবে না দেখতে হবে তা ঠিকঠাক কাজ করছে কি না।
মোটা ব্যক্তির শরীরে ফ্যাট সেলের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে তাঁদের শরীরে স্বাভাবিক ভাবে লেপটিনের পরিমাণও বেশি। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই সমস্ত মোটা ব্যক্তিদের শরীরে লেপটিন সিগন্যাল ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। ফলে রক্তে প্রচুর পরিমাণে লেপটিন থাকা সত্ত্বেও ব্রেইন যেন তাদের দেখতে পায় না। এই ঘটনাকে বলে লেপটিন রেসিট্যান্স, যা বিজ্ঞানীদের মতে ওবেসিটির প্রধান কারণ। আবার, আমাদের ব্রেইনের তৃপ্তির স্থানকেও লেপটিন অনুভূতিহীন করে দেয়। আর তাই আপনি যতক্ষণ না নিজের পছন্দের খাবার পেট পুরে খাচ্ছেন, ততক্ষণ এই হরমোন আপনার খিদেকে জাগিয়ে তোলে, যা মোটেও আপনার পাকস্থলীর ক্ষুধা নয়।
তবে আশার কথা, ডাক্তাররা বলছেন, শুধুমাত্র খাদ্যাভাস, জীবন যাপন পরিবর্তন ও শারীরিক পরিশ্রম দিয়েই এই সমস্যা দূর করা সম্ভব এবং তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
কিভাবে লেপটিন হরমোন বাড়ানো যায়ঃ
. প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটা বা ব্যায়াম করা।
. রাতে পর্যাপ্ত ঘুমানো, কারন ঘুম ঠিকমতো না হলে লেপটিনের মাত্রা কমে যায়।
. স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমানো, দরকার হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া।
. সবুজ শাকসবজি, ফল ও আশ জাতীয় খাবার খাওয়া।
. মিষ্টি জাতীয় যেকোনো খাবার কম খাওয়া বা বাদ দেয়া।
. শর্করা বা কার্বোর পরিমান একেবারে কমিয়ে দেয়া, যেমন, ভাত, রুটি, পাস্তা ইত্যাদি।
. প্রোটিন খাওয়া বাড়িয়ে দেয়া, যেমন, দুধ (ফ্যাট ছাড়া), ডিম, চামড়া ছাড়া মুরগি, মাছ, বিভিন্ন রকমের ডাল, বিচি, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া।
. প্রচুর পরিমানে মাছ খাওয়া।
. স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বা তেল খাওয়া, যেমন, মাখন, ঘি, অলিভ তেল, বাদামের তেল, মাছের তেল ইত্যাদি।
. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, যেমন, লেবু, ব্রকলি, পেয়ারা, জাম, সব ধরনের বেরি, কমলা, আমলকী, জাম্বুরা, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি।
. একই সঙ্গে বেশি পরিমাণে না খেয়ে বারবার অল্প করে খাওয়া ভালো। এর ফলে আমাদের হজম ক্রিয়া যেমন ভালো থাকে, তেমনি গ্যাসট্রিকের রোগীদের জন্যও এটি বেশ উপকারী। একই সঙ্গে এই অভ্যাস আমাদের শরীরের অতিরিক্ত ক্যালরি পোড়াতে সহায়তা করে।
বিশেষ করনীয়ঃ
. কার্বো এবং চিনিযুক্ত খাবার বাদ দেয়া বা কমানো উচিত।
. প্রোটিন জাতীয় খাবার বাড়িয়ে দেয়া উচিত।
. প্রতিদিন নিয়ম করে জোরে জোরে এক ঘণ্টা হাঁটা উচিত।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে লেপটিন নিয়ে কৌতূহল এবং গবেষণার অন্ত নেই৷ আশা করা যায়, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওবেসিটি নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি চলে আসবে বিজ্ঞানীদের হাতে।
যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
…… তিনা শুভ্র ।
