এটা আমার আত্মহত্যা আর ক্রায়োজেনিক পুনরুজ্জীবনের আগের ঘটনা।
২০১৪ সালের জুলাই মাসের কথা। গ্রীষ্মের হলুদ এক দুপুর। বাইরে কড়া রোদ, ঘরে ভ্যাপসা গরম। ফ্যানের বাতাসও আগুন হয়ে গায়ে লাগছে। এর মধ্যেই বসে ঠান্ডা কোকাকোলার বোতলে চুমুক দিচ্ছি আর টিভির সামনে বসে আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখছি। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি শুধুই খেলা দেখার জন্য। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা আর শক্তিধর জার্মানি। বেলজিয়াম আর হল্যান্ডের মত বড় দলকে হারিয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনা, তাই মনে অনেক আশা এরা জার্মানিকে হারাবে, আর প্রিয় মেসির হাতে উঠবে বিশ্বকাপ।
আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছিল ছুটি নেয়ার জন্য, কারণ আমার বস খেলা বা এধরণের অন্য কোন আবেগ বোঝে না। সে শুধু বোঝে টাকা আর ব্যবসা, কাজের খাতিরে রাত এগারোটা তার কাছে সন্ধ্যা রাত। আমিও কেমন করে যেন এই বায়িং হাউসে আটক পড়েছি, অন্য কোন কাজ জানিনা যেটার জোরে ভালো কোন জায়গায় চাকরি নিতে পারব।
সেই ১৯৯০ সাল থেকে এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি। সেই যে মেক্সিকান রেফারি কোডেসাল অন্যায়ভাবে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দিল – জার্মানিকে অন্যায় একটা পেনাল্টি দিল, আর আর্জেন্টিনাকে ন্যায্য একটা পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করল। কৈশোরের কত রাত যে বিনিদ্র কেটেছিল সেই কষ্ট বুকে নিয়ে। এইবার তেমন কিছু হলে আমি কি করব, জানি না।
জীবনে আর কি আছে? ঠিক এর আগের মাসেই মিনুর বিয়ে হয়েছে। অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই সে ইতালি চলে গেছে স্বামীর সাথে। ইউরোপে যাবার পর আমার কথা তার আর মনে না আসারই কথা। আমিও ওর সবগুলো চিঠি পুড়িয়ে ফেলেছিলাম, আশা করছিলাম এতে তাকে ভুলে যাওয়া আমার জন্য সহজ হবে।
খেলা শুরু হতেই আশা বেড়ে গেল, যখন আর্জেন্টিনার ডিফেন্স সফলভাবে জার্মানদের সব আক্রমণ রুখে দিতে লাগল, এমনকি সুপরিকল্পিত প্রতি-আক্রমণ করতে শুরু করল। আমার উচ্ছ্বাস অবশ্য বেশিক্ষন টিকল না – কারণ হিগুয়াইন ফাঁকা পোস্টে একটা গোল মিস করল, মেসি নিজে গোলকিপারকে একা পেয়ে বল বাইরে মারল, লাভেজ্জিও নিশ্চিত একটা গোল মিস করল। যে আর্জেন্টিনা হেসে-খেলে তিন শূন্য গোলে জেতে, সে কিনা অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোটশের গোলে হারল।
সে বিকেলে আমি প্রথমে কিছু অনুভব করিনি। কিন্তু সন্ধ্যা হবার পর পর আমার বুক কেন যেন ফাঁকা লাগা শুরু করলো। ততক্ষনে গরম কমে এসেছে, আকাশেও কালো মেঘ জমা শুরু করেছে। সে রাতে রাত গভীর হবার আগেই আমি বুঝে ফেললাম, আর্জেন্টিনার এই হারে আমার জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে।
রাত এগারোটার দিকে বৃষ্টি শুরু হল প্রচন্ড। ঝড়-তুফানের ভেতরই আমি ওষুধের দোকানে গিয়ে পাঁচ পাতা সিডাক্সিন ট্যাবলেট কিনলাম। বাসায় ফিরে একসাথে সবগুলো খেয়ে ফেলে ঘরের সবগুলো লাইট নিভিয়ে দিলাম, তারপর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার ধারণা ছিল, এটাই আত্মহত্যার সবচেয়ে আরামদায়ক পদ্ধতি।
আসলেও তাই। আমি তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু অনুভব করলাম না, শুধুই ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর যেন স্বপ্নে দেখলাম আমি একটা হাসপাতালের মত জায়গায় শূন্যে উড়ে বেড়াচ্ছি, আমার শরীরের কোন ভর নেই, আর ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছি আমার নিজের ঘুমিয়ে থাকা কিংবা মৃত শরীরটাকে। আমি হাসপাতালের এক রুম থেকে আরেক রুমে ঘুরে বেড়াতে পারছিলাম, এমনকি ডাক্তার-নার্সদের কথা-বার্তাও কখনো কখনো শুনতে পাচ্ছিলাম।
এভাবে কত সময় কাটিয়েছি ঠিক বলতে পারব না, কারণ সেখানে আমার সময়ের কোন অনুমান ছিল না। কখনো কখনো চারদিক অন্ধকার হয়ে যেত, তারপর আবার একসময় আমি সবকিছু দেখতে-শুনতে পেতাম। আমি প্রতিবার জেগে ওঠার পর টের পেতাম, হাসপাতাল ধরণের জায়গাটার অনেককিছু বদলে গেছে, আর আগের বারের লোকজনও আর নেই। এর অর্থ নিশ্চয়ই সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছিল। সেখানে আমার কোনো স্পর্শ বা গন্ধের অনুভূতি ছিল না।
এরকম এক জেগে ওঠার সময়ই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়। এটা বলে বোঝানো খুব কঠিন, কারণ তার কোন শরীর নেই, তবুও কেমন করে যেন আমি ওর উপস্থিতি বুঝতে পারছিলাম। অবশ্য তার সাথে কথা বলতে পারছিলাম, হয়তো সেটা মন থেকে মনে সরাসরি সংলাপ ছিল।
‘আপনি কে?’
কোন উত্তর নেই।
‘ভাই, আমি জানি আপনি আছেন। কেমন করে জানি সেটা বলতে পারব না অবশ্য।’
‘আমাকে আপনি বুঝবেন না।’ গম্ভীর কিন্তু সুরেলা কণ্ঠ তার।
‘তবুও বলেন।’ আমি বললাম।
‘আপনাদের ভাষায় আমাকে ফেরেশতা বলা যেতে পারে।’
অবাক হলাম। সম্ভবত আমি মারা গেছি বা মারা যাওয়ার প্রক্রিয়াতে আছি।
‘আমি মিজান, মিজানুর রহমান। আমি তো আত্মহত্যা করেছিলাম, আপনি কি – বাই এনি চান্স – মৃত্যুর ফেরেশতা?’
‘সেরকমই কিছু একটা।’
আমি ততক্ষনে আমার ভাগ্য মোটামুটি বুঝে ফেলেছি। স্বস্তির বিষয় হল, মৃত্যুটা যন্ত্রনা ছাড়াই হয়েছে কিংবা হচ্ছে। সে জানতে চাইল আমি কেন আত্মহত্যা করেছিলাম। বললাম আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর আমার বেঁচে থাকা অনেক কষ্টকর হতো, এরচেয়ে মরে যাওয়া শান্তির হবে বলে ভেবেছিলাম।
‘ইশ, হিগুয়াইন যদি মিসটা না করত, তাহলে ফুটবলের ইতিহাস হত অন্যরকম, আর আমাকেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হত না।’
কিছুক্ষন নীরবতার পর সে কথা বলল।
‘কিন্তু কোথাও কোথাও তো হিগুয়াইন গোলটা করেছিল।’
আমার বিদেহী আত্মার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
‘হিগুয়াইন গোলটা করেছিল? মানে কি?’
‘প্যারালেল একটা ইউনিভার্সের কথা জানি, যেখানে গোলটা হয়েছিল।’
‘প্যারালেল ইউনিভার্স কি?’
‘এই বিশ্বজগতের মত আরো অসংখ্য বিশ্বজগৎ আছে। ইউনিভার্সের সেই মহাসাগরে আরো অনেকগুলো ইউনিভার্স এই ইউনিভার্সের পাশাপাশি বয়ে চলেছে। সেই পাশাপাশি ইউনিভার্সগুলোই প্যারালেল ইউনিভার্স। প্রতিটা প্যারালেল ইউনিভার্সে এই পৃথিবীর মত একটা করে পৃথিবী আছে।’
‘ভাই, প্যারালেল ইউনিভার্সে কি সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে?’
‘না, পার্থক্যগুলো ছোট-খাট – যেমন এই পৃথিবীতে হয়তো আপনি অংকে ফেল করেছেন, অন্যটাতে আপনি ফেল করেছেন বিজ্ঞানে।’
আমি বিজ্ঞানের এসব খুটিঁনাটিতে তেমন আগ্রহ বোধ করলাম না, কিন্তু হিগুয়াইনের সেই গোলের কথা মনে হতেই আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।
‘আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমাদের মত আরেকটা জগৎ আছে, আর সেখানে হিগুয়াইন গোলটা করেছিল?’
সে হ্যা বলতেই আমি জোর আবদার করলাম যেন আমি কোনোমতে সেই খেলাটা দেখতে পারি। যে খেলার জন্য আত্মহত্যা করলাম, মৃত্যুর পর ভিন্ন এক বাস্তবতায় যদি সেই খেলাটার বিকল্প কোন ফলাফল দেখতে পারি, তাহলে ক্ষতি কি!
সে কেন যেন রাজি হয়ে গেল, আর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা টিভিসেটের সামনে, যেখানটাতে আর্জেন্টিনা-জার্মানির সেই খেলাটাই হচ্ছে। টিভি আর তার ঘরটাও আমার পরিচিত লাগল, আমি কি তাহলে অতীতে আমার জীবনেই ফিরে গেছি?
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, খেলার তেইশ মিনিটের মাথায় যখন সত্যিই হিগুয়াইন গোলটা করল। এই জগতে সে গোলটা মিস করে নি, ফলে আর্জেন্টিনা ১, জার্মানি ০। আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম। কিন্তু খেলা যত এগুলো, ততই আমার হাসি ম্লান হয়ে গেল। হিগুয়াইন গোল করার পর জার্মানি আরো গুছিয়ে খেলতে শুরু করল, সমস্ত শক্তি নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর নির্ধারিত সময়ে আর্জেন্টিনাকে মোট তিনটা গোল দিল – প্রথমার্ধে দুইটা, দ্বিতীয়ার্ধে একটা। ওই অন্য জগতেও তাহলে জার্মানিই বিশ্বকাপ জিতেছিল?
ফেরেশতার কাছে ফিরে আসার পর আমি নিশ্চুপ ছিলাম। কিন্তু সে কথা বলল।
‘প্যারালেল ইউনিভার্সগুলোতে ঘটনাগুলোর খুঁটি-নাটি ভিন্নরকম থাকে, কিন্তু শেষ ফলাফল আসলে একই রকম হয়।’
হঠাৎ একটা জিনিস ভেবে আমার আশার বেলুনটা আবার ফুলে ওঠে।
‘আচ্ছা ফেরেশতা ভাই, এমন কোন জগৎ কি নেই, যেখানে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছে?’
কিছুক্ষন নীরবতা।
‘এরকম প্যারালেল ইউনিভার্স বিরল। স্টাটিস্টিক্যাল্লি ইনসিগ্নিফিক্যান্ট। তাছাড়া সেই জগতে আপনি কখনোই যেতে চাইবেন না।’
‘কেন? যেতে চাইব না কেন?’
‘ওখানে আর্জেন্টিনা ভালো খেলে ঠিকই, কিন্তু অন্য জায়গায় বড় সমস্যা আছে। যেমন ধরেন, ওই জগতে হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতেছিল।’
এবার আমি সত্যিই দমে যাই। ফিরে আসি বাস্তবে। ওকে আসল প্রশ্নটা করি।
‘আমি কি মারা যাচ্ছি? নাকি অলরেডি মারা গেছি?’
‘আপনার আত্মা শরীর থেকে বের হয়ে গেছে, কিন্তু আমি আপনাকে কোন কারণে দ্বিতীয় আসমানে নিতে পারছি না। টেকনিক্যাল কোন সমস্যা মনে হচ্ছে। সম্ভবত আপনার শরীর নিয়ে বিজ্ঞানীরা কিছু একটা করছে।’
আমি আঁতকে উঠলাম। এতদিন যেটাকে হাসপাতাল ভেবেছিলাম, সেটা তাহলে কোন ল্যাবরেটরি। আমার শরীর নিয়ে ওরা কি কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে?
দ্রুত উড়ে চলে গেলাম আমার শরীরের কাছে। এই প্রথম লক্ষ্য করলাম আমার চোখের পাপড়ির ওপর বরফ জমে আছে, সারা শরীরেও সাদাটে একটা আভা। খুব সম্ভবত আমার শরীরটা ফ্রিজারে রাখা আছে। কিন্তু কতদিন যাবৎ?
আমি ফ্রিজারের বাইরে চলে এসে সাইনবোর্ডগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। যখন দেখলাম ওটার দরজার ওপর ‘ক্রায়োজেনিক চেম্বার’ লেখা, তখনি বুঝে ফেললাম যে ওরা আমার শরীর খুব নিচু তাপমাত্রায় বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার আত্মা শরীর ছেড়ে পুরোপুরি চলে যাবার আগেই বোধ হয় ওরা আমার শরীরকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, ফলে আমার আত্মাটাও আমার শরীরের সাথে এখানে আটকে গেছে।
ফিরে এসে ফেরেশতাকে ঘটনাটা খুলে বললাম। শংকিত মনে জানতে চাইলাম আমি কতদিন যাবৎ এখানে আছি। সে বলল আমার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল প্রায় দুইশ বছর আগের কথা। আমি চুপ হয়ে গেলাম। মনে পড়ল এখানে সময়ের ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই।
এরপর কয়েকদিন ফেরেশতার সাথে আমার দেখা হল না। যখন ভাবতে শুরু করেছি ওর সাথে আর কখনো দেখা হবে না, তেমনি একদিন সে আবার দেখা দিল।
‘মিজান সাহেব, আপনার জন্য আপডেট আছে – আমাকে এইমাত্র তৃতীয় আসমানে ফেরত যেতে বলা হয়েছে। মনে হয় এরা শীঘ্রই আপনাকে জাগিয়ে তুলবে। কংগ্ৰেজুলেশন্স!’
বলে কি! দুইশ বছর পর এই অপরিচিত জগতে জেগে উঠে আমি করবটা কি? ফুটবলের নিয়ম-কানুনও নিশ্চয়ই অনেক বদলে গেছে। তাছাড়া মানুষ এখনো ফুটবল খেলে কিনা সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
আমি অনুভব করছিলাম ফেরেশতার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে আমার অনুভবের ভেতর বিবর্ণ হয়ে আসছে। তবে তার বিদায়বেলায় বাণীটা আমি ঠিকই শুনতে পেলাম।
‘অবশ্য এই জগতে আপনাকে কাউকে সাপোর্ট করে দুঃখ পেতে হবে না। জীবাণু যুদ্ধে বেশির ভাগ মানুষ মরে গেছে। এখন সারা পৃথিবী এক দেশ। বিশ্বকাপ ফুটবল এখানে এখন আর হয় না।’
সম্পূর্ণ অচেনা এক পৃথিবীতে অদ্ভুত এক পুনরুজ্জীবন নিয়ে বেশ কিছুটা দ্বিধা আর শঙ্কা থাকলেও শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। আত্মহত্যার চেষ্টা নিয়েও আমার কোন আর কোন আফসোস ছিল না। এটা যখন ঘটেই গেছে, তার মানে এটাই স্টাটিস্টিক্যাল্লি সিগনিফিকেন্ট ঘটনা, বেশির ভাগ প্যারালেল ইউনিভার্সেই আমার জীবনে আত্মহত্যার ঘটনাই ঘটেছে – অর্থাৎ আমি খেলার কারণে না হলেও অন্য কোন কারণে আত্মহত্যা করেছি সেইসব জগতে।
দুএকটা বিরল জগৎ থাকতে পারে, যেখানে আমি স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করেছি, কিন্তু সে জগৎ আবার হয়তো এতটাই বিকৃত যে সেখানে আবার ফেরাউন মুসাকে নীলনদে ডুবিয়ে মেরেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, তেমন আজব পৃথিবীতে স্বাভাবিক জীবন কাটানোরও কোনরকম স্বপ্ন বা বাসনা আমার আসলেই নেই।
[ বিজ্ঞান কল্প-গল্প / মায়িন খান, জুলাই ২০২১ ]
