আমি যেদিন এক্সিডেন্টটা করি তার দুই দিন আগে মাহিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল হিন্দুরা বেহেশতে যাবে কিনা।
ও যখন ওটা জানতে চাইছিল, তখন আমি আর মাহিন জুমার নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম, মাহিন আমার পাশে বসে। হয়তো আজকের খুৎবায় কিছু একটা শুনে ওর মনে হয়েছে যে শুধু মুসলমানরাই বেহেশতে যেতে পারবে। আমিও সেরকম একটা কিছুই তাকে বোঝাতে চাইলাম, বললাম – মুসলমান বাদে সবাই দোজখে যাবে।
‘তাহলে কি পঙ্কজ আংকেলও দোজখে যাবে? সে তো সবসময় আমার জন্য লিন্ডর চকলেট নিয়ে আসে।’
মাহিন গ্রেড ফাইভে পড়ে। বয়সের তুলনায় পাতলা গড়ন আমার ছেলের। ওর মত বাচ্চাদের কানাডার স্কুলগুলোতে মুক্তচিন্তা শেখায়। কিন্তু আমাদের মত ইমিগ্রান্ট বাবা-মায়ের জন্য এটা বড় একটা সমস্যা ,কারণ আমরা উত্তর দিতে অভ্যস্ত নই।
বাসার গলিতে ঢুকতে ঢুকতে ওকে বললাম – ‘শোনো মাহিন, কেউ তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করল, তার মানে এই না যে সে ভালো লোক। যিনি আমাদের বানিয়েছেন তার সাথে ভালো হলেই তাহলে তাকে আসল ভালো লোক বলা যাবে। ঠিক আছে?’
মাহিন মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। কিন্তু আমি জানি, সে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয় নি। পঙ্কজকে সে খুবই পছন্দ করে।
পঙ্কজ অফিসে আমার সহকর্মী। পশ্চিমবঙ্গ বাড়ি। প্রায় ছয় ফুট লম্বা লোক, ক্ষীণকায়, লম্বা নাক – ফর্সা গায়ের রং আর কোঁকড়ানো চুলের জন্য অনেকে তাকে আরবীয় বলে ভুল করে। সে বাংলায় কথা বলে দেখে প্রথমে তার সাথে আলাপ শুরু করেছিলাম – সেই থেকে বন্ধুত্ব, তারপর বাসায় যাওয়া-আসা শুরু। তার মেয়ে অর্চনা গ্রেড সেভেনে পরে, বাসায় নিয়ে গেলেই মাহিনকে গেম খেলতে দেয়, বই পড়ে শোনায়। দুই ভাবীও লম্বা সময় ফোনে কথা বলে আর ফেসবুকে ছবি চালাচালি করে।
মাহিন যে পঙ্কজকে আপন করে নিয়েছে, সেটা কোন কাকতালীয় ঘটনা না। এ লোক কেমন করে যেন বাচ্চাদের সাথে মিশে যায় – তাদের সাথে তাদের মত করে আলাপ করে, তাদের মত করে খেলা করে। একদিন বাসায় এসে মাহিনের সাথে তিন ঘন্টা ভিডিও গেম খেলল। আমি শেষপর্যন্ত ওদের রেখেই বাজার করতে গেলাম, ফিরে এসে দেখি তখনো ওরা খেলছে।
মূল প্রসঙ্গে আসি। এক্সিডেন্টটা হয়েছিল সম্পূর্ণ আমার দোষে। আমি বাঁ দিকে মোড় নিচ্ছিলাম হাইওয়ে ২০১-এ নামব বলে, উল্টাদিক থেকে একটা গাড়ি সোজা আসছিল কিন্তু কেন যেন আমি ভাবছিলাম সে তার ডান দিকে নেমে যাবে। যখন গাড়ি ঘুরিয়েছি, তখন আর সময় ছিল না, সে সোজা এসে মারল আমার গাড়ির পেছনের দরজায়। দরজা বসে গেল, আর চাকা গেল ভেতরে ঢুকে।
পেছনে ওই দরজার দিকেই মাহিন বসা ছিল। তার কিছু হয় নি, শুধু হাতে একটু ব্যথা পেয়েছে। সংঘর্ষের ফলে গাড়ির দরজার ওপর থেকে ব্যাগ বের হয়ে গিয়েছিল, তার মানে এই গাড়ি আর ফিটনেস পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না।
কানাডাতে আমি একটা খুব সাধারণ কাজ করি, তবুও শখ করে চেরিফলের রঙের এই গাড়িটা কিনেছিলাম। টয়োটা সিডান গাড়ি, সেকেন্ড হ্যান্ড হলেও আমার খুব প্রিয় ছিল ওটা। অনেক টাকা লাগে বলে গাড়ির পুরো ইন্সুরেন্স করতে পারি নি, সেজন্য খুব সাবধানে চালাতাম। কিন্তু তারপরও কেমন করে যেন এক্সিডেন্টটা হয়ে গেল, সেটাও আবার আমার নিজের দোষে।
থার্ড পার্টি ইন্সুরেন্সের নিয়ম হচ্ছে, নিজের দোষে একসিডেন্ট হলে ইন্সুরেন্স তার দায়িত্ব নেয় না। এর অর্থ হচ্ছে, আমার নিজের খরচে আমার গাড়ি সারাতে হবে, আর এখানে গাড়ি ঠিক করার খরচ এত বেশি যে, হয়তো এটা ঠিক করার চেয়ে আরেকটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনা ভালো হবে। কিন্তু সেটার টাকাই বা কোথা থেকে পাবো?
এক্সিডেন্টের পর পরই ওখান থেকে আমি পঙ্কজকে ফোন দিলাম, কারণ এই এডমন্টন শহরে সেই আমার একমাত্র বন্ধু। মিনিট পনরোর মধ্যে পঙ্কজ এসে হাজির। সব দেখে-শুনে সে তার পরিচিত কাকে যেন ফোন করলো, আমার ভাঙা গাড়ি রিপেয়ার শপে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। সে আমাকে আর মাহিনকে নিজের গাড়িতে তুলে নিল, তারপর সোজা হাসপাতালে। বলল, এক্সিডেন্টের পর পরই একটা চেকআপ করিয়ে নেয়া খুব জরুরি।
কানাডার পাবলিক হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে হয়, রক্ত না পড়লে বা কেউ মরে যেতে শুরু না করলে সহজে ভেতরে যাওয়া যায় না। ইমার্জেন্সি রুমে অপেক্ষার সেই তিন ঘন্টা পঙ্কজ আমাদের সাথেই বসে রইল। আমাকে এক্সিডেন্টের খুঁটি-নাটি জিজ্ঞেস করে আর মোবাইল টিপে সময়টা সে পার করে দিল। মাহিন আর আমি যখন ডাক্তারের কাছ থেকে ছাড়া পেলাম, তখন পঙ্কজ আমাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারপরই শুধু ফিরে গেল।
সেই এক্সিডেন্টের পর আমি প্রচন্ড মুষড়ে পড়লাম। গাড়ি সারাতে সাড়ে তিন হাজার ডলার লাগবে, আরেকটা গাড়ি কিনতে ছয় হাজার। এত টাকা পাবো কোথায়? গাড়ি ছাড়া এই দেশে চলবই বা কিভাবে? সেসময় ব্লাড প্রেসার বেড়ে অসুস্থ হয়ে পুরো তিনদিন আমি অফিস কামাই করেছিলাম। মূলত দুইটা প্রশ্ন সেই সময়টায় আমাকে খুব কুরে কুরে খাচ্ছিল।
প্রথম প্রশ্নটা ছিল জাগতিক – আমি কি করে এত বড় ভুলটা করলাম? নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিলাম না। এত বছর গাড়ি চালানোর পর এই ভুল কিছুতেই বরদাশত করা যায় না।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটা ছিল আধ্যাত্মিক – খোদা আমাকে কেন রক্ষা করল না? সে সকালেও তো আমি যথারীতি নিরাপত্তার দোয়া পড়েছি ফজরের পরে, আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি – তারপরও কিভাবে এই এক্সিডেন্টটা হল!
প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম এক কাউন্সেলরের কাছে। এক্সিডেন্টের পর এখানে কিছু লোকের সাথে কথা বলে মন হালকা করা যায়, মার্টিন তেমনি এক কাউন্সেলর। অফিসের পক্ষ থেকে এই কাউন্সেলিংটা আয়োজন করা হয়েছিল। আমি সাদা দেয়ালঘেরা একটা ঘরে লাল সিঙ্গেল সোফায় বসে, আর একটা কালো টুলে বসে মার্টিন – সাদা কানাডিয়ান, পরিপাটি চুল, লাল দাড়ি, খয়েরি রঙের চশমা যার সাথে সুন্দর মানিয়ে গেছে।
মার্টিন সব কিছু মন দিয়ে শুনল। মাঝে-মধ্যে এটা-ওটা জানতে চাইল। তারপর শেষে বলল – ‘শোনো মাহফুজ, তুমি হচ্ছো প্রকৃতির একটা ‘প্যাকেজ ডিল’। কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে তুমি এই পৃথিবীতে এসেছ। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো তোমাকে কখনো সুবিধা দিবে, আবার কখনো তোমাকে বিপদে ফেলবে। এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
তোমার দোষে একসিডেন্ট হয়েছে, তার মানে তুমি গাড়ি চালানোর সময় কোন কারণে অস্থির ছিলে। হয়তো চরিত্রের দিক দিয়ে তুমি অস্থির ধরণেরই একজন মানুষ। কিন্তু তুমি ভেবে দেখো, হয়তো আবার তোমার এই অস্থিরতার জন্যই তুমি কোন কাজ ফেলে রাখ না, তোমার অফিসে তোমার বস এজন্য তোমার ওপর ভরসা করে, ইত্যাদি। ঠিক কি না বল? একটা স্বভাব যদি তোমাকে তোমার কাজে টিকিয়ে রাখে, সেই একই স্বভাবের জন্য মাঝে-মধ্যে তোমাকে কিছু মূল্য দিতে হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক কি না, বল? এগুলো অবশ্য আমার নিজস্ব ধারণা, কিন্তু তোমার কি মনে হয়?’
দ্বিতীয় প্রশ্নটা আমি করেছিলাম পঙ্কজকে। আমি জানি, নিজের ধর্মের প্রশ্ন আমার অন্য ধর্মের কাউকে করার কথা না, কিন্তু পঙ্কজের সাথে আমি সব ধরণের কথাই আলাপ করতাম। তাছাড়া সব প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষায় করা হয় না, কোন কোন প্রশ্ন মন হালকা করার জন্যও করা যায়।
ওকে বলছিলাম – ‘আমরা ছোটবেলায় শিখেছি, এই দোয়াগুলি পড়লে জান-মালের হেফাজত হবে। আমি কোনোদিন ফজরের পর এই দোয়াগুলি মিস করি না। ভাবছি, তবুও কেন একসিডেন্টটা হল।’
পঙ্কজ কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল – ‘আমার তো মনে হয়, তোমার খোদা তোমার জান-মালকে ঠিকই বাঁচিয়ে দিয়েছে।’
আমি তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাতেই সে যোগ করল – ‘দেখো মাহফুজ, একবার চিন্তা কর। তোমার ছেলে যেখানে বসা ছিল, ঠিক সেই পাশটাতেই কিন্তু ওই গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছে। একটু গতির এদিক-ওদিক হলেই তোমার মাহিনের যেকোন খারাপ কিছু হতে পারতো। আমি তো বলব, তোমার খোদা তোমাকে আর তোমার ছেলেকে জানে বাঁচিয়ে দিয়েছে, এমনকি দেখো তোমাদের কারোই বড় রকম কোন ইনজুরিও হয় নি।
আর এ গাড়ি ঠিক করে তুমি সহজেই আরো চার-পাঁচ বছর চালাতে পারবে। কিছু টাকা ধার নেবে, আমি নিজেই তোমাকে ধার দিতে পারি, ব্যাঙ্ক থেকেও লোন নিতে পারো। আচ্ছা, একটা জিনিস বল তো। এই এক্সিডেন্টের জন্য তুমি কি না খেয়ে আছ? নাকি পথে বসতে হয়েছে তোমাকে? সত্যি কথা বলতে তোমার কোয়ালিটি অফ লাইফের কোন পরিবর্তনই হয় নি। তাহলে তোমার খোদা কিভাবে তোমার মালের ক্ষতি করল?’
আমি জানতাম পঙ্কজের বাবা হিন্দু পুরোহিত ছিলেন, তবু তার বিশ্লেষণ শুনে আমি রোমাঞ্চিত হলাম। ওকে ছোট করে একটা ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। সে বিকেলে মাহিনটা আবার সেই বেহেশত-দোজখের কথা তুলল। আমি অবশ্য জানতাম সে প্রসঙ্গটা আবার আলোচনায় টেনে আনবে, কারণ এর আগের দিন তাকে সন্তোষজনক কোন উত্তর আমি দিতে পারি নি। সেই একই প্রশ্ন তার – ‘বাবা, তুমি কি সত্যিই শিওর যে পঙ্কজ আংকেল দোজখে যাবে?’
এবার আমি ছেলের কাঁধে হাত রাখলাম, হেসে বললাম – ‘শোনো মাহিন, কারো দোজখে যাওয়া যেমন নিশ্চিত না, তেমনি কারো বেহেশতে যাওয়াও নিশ্চিত না। এসব খোদা তায়ালাই ভালো জানেন, এগুলো নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে।’
মাহিনের মুখে এবার হাসি দেখা গেল। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম – ছেলেটা দেখতে-শুনতে একদম ওর মায়ের মত হয়েছে, এমনকি স্বভাব-চরিত্রেও।
[ ছোট গল্প / মায়িন খান, জুলাই ২০২১ ]
