ঊন-মানুষ

১. উপক্রমণিকা

জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব শুরু হয়ে গেছে পৃথিবীতে। ঝড়-জঞ্ঝা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে, শীতপ্রধান দেশে শীতকাল ছোট হয়ে এসেছে, গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলো মরুভুমি হবো-হবো করছে, উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে অনেকগুলো দ্বীপরাষ্ট্র পানিতে ডুবে গেছে। এসবই প্রকৃতির একটা কালচক্র, কিন্তু বিজ্ঞানীরা দাবি করেন – মানুষ জাতি এই চক্রকে ত্বরান্বিত করেছে, মৃত্যুর পর জীবন নেই এমন বিশ্বাসের কারণে হোমোসেপিয়েন্সরা উপর্যুপুরি ভোগের নেশায় তাড়িত হয়েছে, তারপর ধরিত্রীকে রীতিমতো রক্ষিতা বানিয়ে শুষে শুষে খেয়ে অকালবৃদ্ধ করে ফেলেছে।

অদ্ভুত এমন এক দিনেই ভোরের সূর্য ওঠার আগে ঋষির মতো জেগে ওঠেন এক বিজ্ঞান শিক্ষক জহুরুল হক, ব্যতিক্রমী একরোখা এক জহুরুল হক। গমগমে কণ্ঠে তিনি পাঠ করে চলেন সুপ্রাচীন এক গ্রন্থ থেকে বাছাই করা কিছু শ্লোক।

১১: নোহের বয়সের ছয়শত বৎসরের দ্বিতীয় মাসের সপ্তদশ দিনে মহাজলধির সমস্ত উনুই ভাঙ্গিয়া গেল, এবং আকাশের বাতায়ন সকল মুক্ত হইল;

১২: তাহাতে পৃথিবীতে চল্লিশ দিবারাত্র মহা বৃষ্টি হইল; … … …

২১: তাহাতে ভূচর যাবতীয় প্রাণী- পক্ষী, গৃহপালিত ও বন্য পশু, ভূচর সরীসৃপ সকল এবং মনুষ্য সকল মরিল।

২২: স্থলচর যত প্রাণীর নাসিকাতে প্রাণবায়ুর সঞ্চার ছিল, সকলে মরিল।

২৩: এইরূপে ভূমণ্ডল-নিবাসী সমস্ত প্রাণী- মনুষ্য, পশু, সরীসৃপ জীব ও আকাশের পক্ষী সকল উচ্ছিন্ন হইল, পৃথিবী হইতে উচ্ছিন্ন হইল, কেবল নোহ ও তাঁহার সঙ্গী জাহাজস্থ প্রাণীরা বাঁচিলেন।

(আদিপুস্তক ৭)

২. বীথি   

শেষ বিকেলের কমলা রঙের আলোতে বীথির গোলগাল ঘুমন্ত মুখটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল মুনির, তারপর ওর বরফ শীতল কপালে একটা দীর্ঘ চুমু খেয়ে ডিপফ্রিজের ডালাটা বন্ধ করে দিল।

মুনিরের বছর তিরিশেক বয়স এখন। মাঝারি উচ্চতার লোক, শুকনো শরীর, পাতলা নাক, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের নিচে একটা কাটা দাগ আছে, ছোটবেলায় গাছ থেকে পড়ে কেটে গিয়ে হয়েছিল, যদিও মোটা চশমার কারণে সেটা তেমন বোঝা যায় না। এনজিও ‘চেতনা’র অফিসে গুছিয়ে কাজ করার ব্যাপারে মুনিরের সুনাম আছে, তার উপজেলায় সে গতবার শ্রেষ্ঠ মাঠকর্মীর পুরস্কারও পেয়েছে। কিন্তু আজ মেঘে ঢাকা এই দিনে ওর নিজের ঘরে কি হচ্ছে তার কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না।

আজ ওর ঘুম ভেঙেছে অনেক বেলা হয়ে যাওয়ার পর, প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে। উঠে দেখে বীথি কোথাও নেই। এই শনিবারে ওর কোথাও যাওয়ার কথা না, আর গেলেও তো বলেই যাবে। বেডরুম থেকে বের হয়ে ওদের ড্রইং-কাম-ডাইনিংয়ে এসে দেখে সোফা এলোমেলো, বালিশ মাটিতে, কফি টেবিল উল্টানো, সারা ঘর পানিতে ভেসে গেছে, আর দেয়ালে জায়গায় জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। ডিপ ফ্রিজের ডালাটা উঁচু হয়ে আছে দেখে মুনির এগিয়ে গিয়েছিল আর তখনি সে বিথীকে আবিষ্কার করে ওখানে।   

প্রথম দেখে মুনিরের বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে বীথি মারা গেছে, তার ওপর আবার ওর লাশ ফ্রিজের ভেতর যত্ন করে রেখে দেয়া হয়েছে। লুকোচুরি খেলতে গিয়ে বাচ্চারা যেমন করে, মেয়েটা যেন ঠিক সেভাবে পা ভাঁজ করে বাক্সটার ভেতর বসে আছে, যেকোন মুহূর্তে উঠে দাঁড়াবে। সেই তখন থেকে পুরো তিন ঘন্টা ফুল সাইজের সাদা ডিপ ফ্রিজটার সামনে মুনির বসে থেকেছে, বুঝতে চেষ্টা করেছে কিভাবে কি হল – কিন্তু সমস্যা হল কাল সন্ধ্যার পর কি হয়েছিল তার কিছুই ওর মনে আসছে না।

মুনির আরেকবার চারদিকে তাকাল – ফুলদানিটা উল্টে পড়ে আছে, ডাইনিংয়ের একটা চেয়ার মাটিতে পড়া, টেবিলের ওপর একটা ভাঙা গ্লাস। যারাই এই কাজটা করেছে, খুনের আগে ঘরের মধ্যে একটা তুলকালাম কান্ড করেছে তারা। ফ্রিজের ডালায় এখনো ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে, বোঝাই যাচ্ছে লাশ ফ্রিজে ঢোকানোর সময় এটা হয়েছে।   

সকাল থেকে এই পর্যন্ত মোট তেরোবার মুনির ফ্রিজ খুলে দেখেছে – ফ্রিজের ভেতর বীথির মুখটা কিন্তু আগের মতই অনিন্দ্যসুন্দর, শুধু কপালের ডানদিকে একটা বড় কাটা দাগ –  রক্তাক্ত। তাছাড়া হাতে আঁচড়ের দাগ আর গলার একপাশে গভীর ক্ষত চিহ্ন আছে। যেসব অসভ্য এটা করেছে, নিশ্চিতভাবেই পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র তারা।

ওর বোধহয় পুলিশ স্টেশনে চলে যাওয়া উচিত। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটা তার কর্তব্য। গেলে রমনা থানায় যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে, কারণ মৃতদেহ এই এলাকাতেই পাওয়া গেছে। নাকি আবার এটা ধানমন্ডি থানার আন্ডারে পড়েছে? এলাকার এই ভাগাভাগিগুলো মুনিরের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট না।

কিন্তু পুলিশকে বললে যদি তারা ওকেই সন্দেহ করে? করতেই পারে। অথচ সে এটা করেনি, করতে পারেই না। একটা পোকা মারতে যার বুকে লাগে, সে কিভাবে আস্ত একটা মানুষকে মেরে ফেলবে – সেও আবার নিজের স্ত্রীকে! ওদের ভেতর মাঝে-মধ্যে চিৎকার-ঝগড়া হতো, কিন্তু সেটা কোন সংসারে হয় না! আর অবস্থা অতটা খারাপ হলে সে তো বীথিকে ডিভোর্সই দিতে পারত। কেন অযথাই খুনাখুনি করে দুই দুইটা জীবন নষ্ট করতে যাবে? বোঝাই যাচ্ছে, খুনটা অন্য কেউ করেছে। কিন্তু পুলিশকে এটা বোঝাবে কে?

আর সে পুলিশকে বলবেই বা কি? সে তো নিজেও জানে না, কাল রাতে কি হয়েছিল। আর পুলিশকে যদি বলে যে তার স্মৃতিভ্রম হয়েছিল, পুলিশের সন্দেহ তখন নিশ্চিতভাবেই আরো বেড়ে যাবে। এ কি বিপদে পড়া গেল! একে তো প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারানো, তারপর আবার কাউকে সেটা বলতে না পারা। কিন্তু মুনির বুঝতে পারল, এখনই পুলিশের কাছে যাওয়া যাবে না, কিছুটা সময় অপেক্ষা করতেই হবে।

যত বড় বিপদই হোক না কেন মুনিরকে এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আর তার জন্য দরকার নিজেকে স্থির করা। সে মাইক্রোওভেনে এক কাপ পানি দিল গরম করতে, একটু কফি খেলে হয়তো মাথা খুলবে। টেবিলে একটুকরা আধ-খাওয়া বান-রুটি পড়ে ছিল, কফি বানাতে বানাতে সেটা সে চিবোতে শুরু করল – সারাদিনে কিছু খাওয়া হয়নি।       

কয়েক চুমুক কফি পেটে পড়ার পর মুনিরের মাথা একটু একটু করে খুলতে শুরু করল, যদিও এর মাধ্যমে গতরাতের স্মৃতির একবিন্দুও ফিরে এলো না। সে দু’হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে মাটিতেই বসে রইল, ওর ভুরু কুঁচকে গেল বার বার। স্মৃতি ছাড়া ওর হাতে আর যেসব তথ্য আছে, সেগুলোর ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোন উপায় বোধ হয় নেই। 

এটা নিশ্চিত যে বীথি আর বেঁচে নেই, আর এটা অবশ্যই খুন।

খুন করেছে একাধিক ব্যক্তি – অন্তত দুই জন – কারণ এছাড়া লাশটা ফ্রিজে এত সুন্দর করে বসিয়ে দেয়া সম্ভব না।

খুনের আগে ঘরের ভেতর ধস্তাধস্তি হয়েছে।

দরজা অক্ষত আছে, দরজা ভেঙে ওরা ঢোকে নি, তার মানে লোকগুলো পরিচিত বলেই ঘরে ঢুকতে পেরেছিল, অথবা আসল পরিচয় গোপন করে ঘরে ঢুকেছিল।

মোবাইলে হোয়াটসাপের কোন গ্রূপে কথা চালাচালি হচ্ছে। টুং টাং শব্দ করেই চলেছে যন্ত্রটা। মুনিরের একবার মনে হল আছাড় দিয়ে ফোনটা ভেঙে ফেলে। কিন্তু তখনি হঠাৎ সে আবার সোজা হয়ে বসল – মোবাইলে সন্ধ্যার পর কার কার কল এসেছিল সেটা তো এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ঘাটতে শুরু করল। কিন্তু না, কোন কল আসে নি – শুধু নুসরাতের কিছু খুদে বার্তা, সেগুলোও অর্থহীন ধরণের।

‘তুমি আমাদের প্রজাতিরই লোক।‘

‘আমরা হোমোসেপিয়েন্সদের চেয়ে অনেক যোগ্য।‘   

ইত্যাদি হাবিজাবি।  

মুনির নুসরাতের এই মেসেজ নিয়ে তেমন মাথা ঘামালো না। নুসরাত একটু এরকমই, হেয়ালি করে কথা বলে, মজা করে মুনিরের সাথে – ঠিক যেভাবে ছোটবেলায় করতো। রহস্য উপন্যাস পড়ে পড়ে আর ভুতের সিনেমা দেখে দেখে মেয়েটার মাথা এমনিতেও গেছে।

ওর বাসায় একটা আরামিক ভাষার বইও আছে, কোথা থেকে পেয়েছে কে জানে – নুসরাত বলেছিল সে ওই হাজার বছরের প্রাচীন ভাষা একটু একটু শিখেছেও। অদ্ভুত মেয়ে ! এত বিপদের মধ্যেও নুসরাতের ছেলেমানুষি এই খুদে বার্তা মুনিরের ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে প্রশ্রয়ের হাসি এনে দিল।

নুসরাতকে বীথি একদমই সহ্য করতে পারত না। গত ডিসেম্বরে মুনিরের জন্মদিনের পার্টিতে বীথি মেয়েটাকে এমন কুৎসিত গালি-গালাজ করল যে নুসরাত কাঁদতে কাঁদতে ওদের বাসা থেকে বের হয়ে গেল। অথচ মেয়েটা মুনিরের শুধুই বন্ধু। স্ত্রীরা বোধ হয় স্বামীদের ব্যাপারে একটু বেশিই অধিকার ফলাতে ভালোবাসে। 

আচ্ছা, নুসরাত কি এটা ঘটাতে পারে? সে তো পরিচিত মানুষ, যে ওদের ঘরে ঢুকতে পারে। কিন্তু ওর তাহলে কাউকে ভাড়া করে আনতে হবে খুনটা করার জন্য। যত ভাবলো, মুনিরের কাছে ততই এই সম্ভাবনাটাকে অবান্তর মনে হতে লাগল।    

যেহেতু নুসরাতের এটা করার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, সেহেতু মুনিরকে ভেবে বের করতে হবে ও ছাড়া আর কে বা কারা এ কাজ করতে পারে। মুনিরের মনে পড়ল যে গত সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কোন স্মৃতিই ওর মাথায় নেই। তার অর্থ একটাই – যাদের বিশ্বাস করে ঘরে ঢোকানো হয়েছিল, তারা কোনকিছু দিয়ে ওকে অজ্ঞান করেছিল। হয়তো প্রথমে ধস্তাধস্তি করেছে, ড্রইং রুমের অবস্থা দেখে তাই মনে হয়, তারপর না পেরে মুনিরকে ওরা রুমাল বা এরকম কিছু দিয়ে অজ্ঞান করেছে, তারপর বিথীকে মেরেছে। হতে পারে, মুনিরকেও ওদের মারার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু কোন কারণে ওদের তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হয়েছে।   

মুনির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ওর মনে হল পুলিশকে এই সম্ভাবনাটা বোঝানোও কঠিন হয়ে যাবে। ও নিজের মস্তিষ্ককেই অভিশাপ দিতে লাগল, কেন এই জরুরি সময়ই তার স্মৃতিভ্রম হতে যাবে ! 

৩. মুনির    

মুনিরের জীবনে স্মৃতি হারানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয়।

খুব ছোটবেলায় – যখন তার বয়স সাত বছর পাঁচ মাস – মুনির একবার বাসা থেকে তিনদিনের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল, কোথায় গিয়েছে কি করেছে সে পুরোপুরি মনে করতে পারে না। ওর শুধু মনে আছে ও একটা ঘোরের ভেতর ছিল, সে যেন স্বপ্ন দেখছিলো যে সে একটা দানব  হয়ে গেছে, গায়ে অনেক শক্তি কিন্তু পেটে ভীষণ ক্ষুধা – আর সেই ক্ষুধার তাড়নায় সে যেন চোখের সামনে যা কিছু জীবন্ত দেখছে তাই কামড়ে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে। অদ্ভুত সেই অভিজ্ঞতা!

তিনদিন পর জংলা ধরণের একটা জায়গায় বড়োরা ওকে খুঁজে পেয়েছিলো, মুখে রক্তের দাগ – প্রথমে দেখলে মনে হবে ওর ঠোঁট-মুখ কেটে গেছে, কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় অন্য কোনো কিছুর রক্ত ওর মুখে লেগে আছে অথবা কোনো ধরণের প্রাণীর রক্ত ওর মুখে কেউ লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এসব নিয়ে তখন কেউ মাথা ঘামায় নি, ওকে যে খুঁজে পাওয়া গেছে এতেই সবাই খুশি ছিল। বাসার সবার ধারণা ছিল ওকে জিনে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু বড় হওয়ার পর মুনিরের নিজের বিশ্বাস হয়েছিল যে তার ঘুমের মধ্যে হাঁটার রোগ ছিল আর এভাবেই সে রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলো। বিজ্ঞানও ওর এই তত্ত্বটা সমৰ্থন করে।

মুনিরের মনে পড়ে, ওকে ফিরে পাওয়ার পর সবাই তার চারদিকে ঘিরে বসে ছিল – শুধু বাবা ছাড়া। ছোট্ট মুনির এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার বাবাকে খুঁজছিল, কোথাও দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু কে যেন তাকে খুব ভেতর থেকে জানিয়ে দিচ্ছিল, বাবা ওকে আড়াল থেকে দেখছে, আড়চোখে তাকাচ্ছে। সবাই চলে গেলে পর বাবা তার পাশে এসে বসেছিল। জহুর সাহেব ছিলেন শান্ত, যেন কিছুই হয় নি। মুনির বাবার কাছ থেকে আরেকটু মনোযোগ আশা করেছিল, কিন্তু বাবা সবসময়ই একটু কেমন যেন ছিল। 

প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক জহুরুল হক নিজেও মাঝে-মধ্যে উধাও হয়ে যেতেন। কোথায় যেতেন কেউ জানত না, এমনকি আসমা বেগমও না। মুনিরের মনে হত তার মা তার বাবাকে কোন কারণে খুব ভয় পান। অথচ তার বাবা অন্য বাবাদের মত সন্তানকে মারধর করতেন না, এমনকি অংকে ফেল করলেও না।

জহুর সাহেব নিজের মত থাকতেন, আর মাঝে-মধ্যে রাত কাটাতেন বাইরে, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে। তিনি বিচিত্র সব বই পড়তেন, এর মধ্যে প্রাচীন আরামিক ভাষার একটা বইও ছিল। মুনির জানে না, বাবা সেই ভাষা কিভাবে শিখেছেন, আর সেটা তার কি কাজেই বা লাগত।  সন্ধ্যার পর বিড় বিড় করে মন্ত্রের মত কি যেন পড়তেন, যার অর্থ মুনির কিছুই বুঝতে পারত না।

জহুর সাহেব কিন্তু স্কুলে বিজ্ঞান পড়াতেন, সেই আমলে ডারউইনবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন পরিবেশবাদী, জাতীয় দৈনিক যুগের কণ্ঠে প্রায়ই লেখা পাঠাতেন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য। ক্লাসে প্রায়ই বলতেন – ‘তোমরা হোমোসেপিয়েন্সরা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে ফেলছো, স্বার্থপর ভোগের পেছনে ছুটে ছুটে এই নীল ধরিত্রীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছো।‘

মুনির যখন ক্লাস টেনে উঠেছে, সেসময় একবার তার বড়মামা রশিদুল ইসলামের সাথে তার বাবার এ নিয়ে ভীষণ তর্কও হয়েছিল। ঝগড়াটা এত তীব্র ছিল যে মুনিরের এখনো তার খুঁটিনাটি মনে আছে।

‘জহুর, তোমাকে মসজিদে দেখি না। তুমি জানো না, প্রতিটা আদম সন্তানকে ধর্মের বিধান মানতে হয়?’

‘ভাই জান, কিন্তু যদি এমন হয়, আমরা সবাই আদম সন্তান না, কেউ কেউ বানরের সন্তান যেমনটা বিজ্ঞান বলে।‘

এ পর্যায়ে রশিদ মামা রাগে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন – ‘দুই পাতা বিজ্ঞান পড়ে তুমি আমার সাথে তামাশা করার লাইসেন্স পেয়ে গেছো?’

মামা এরপর ছাতাটা বগলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন, মুনিরের বাবা হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর এমুখো হন নি।

মুনির যখন বাবার সাথে একা কোথাও যেত, উনি কিছু কিছু কথা ওকে বলতেন যেটা আর কখনো ওকে বলতেন না, অন্যদের সামনে তো নাই। যেমন এক শুক্রবারদিন সন্ধ্যায় বাজার করে ফেরার পথে তিনি একটা টং ঘরে থামলেন। বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে তার ভারী হাতটা রাখলেন ক্লাস সিক্সে পড়া মুনিরের কাঁধে, তারপর বললেন – ‘মুনির, তোমাকে একটা কথা বলি। খুব ভালো করে মনে রাখবে। এটা ভবিষ্যতে তোমার কাজে লাগবে।’

সেদিন জহুরুল সাহেবের মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল, গুন গুন করে অপরিচিত সুরে কি একটা গান গেয়ে উঠছিলেন একটু পর পর।

‘তুমি বলো তো, আমাদের আদি পিতা কে?’

মুনির উত্তরটা জানতো, কারণ সে ধর্ম ক্লাসে এটা পড়েছে।    

‘মুনির, মানুষের মধ্যে দুই প্রজাতি আছে। একটা এসেছে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসা সেই আদি পিতা আদম থেকে। আর অন্য প্রজাতিটা এসেছে ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে, বিবর্তনের মাধ্যমে। নূহের বন্যার সময় এদের বেশির ভাগ মারা পড়েছিল, কিন্তু একজন টিকে যায় নূহের নৌকায় চুরি করে উঠে। ওর নাম ছিল ইয়াফিল। নূহের নৌকা যখন তীরে ভেড়ে, তখন সে পালিয়ে জঙ্গলে চলে যায়, মূল জনগোষ্ঠী থেকে একটা মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে সংসার গড়ে তোলে। ওর সন্তানেরা আজও কিন্তু পৃথিবীতে টিকে আছে , কিন্তু ওদের খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়।‘

মুনির বুঝতে পারছিল না, কেন ওর বাবা এসব ওকে বলছেন। কিন্তু বাসায় ফিরে সে রাতে সে বার বার ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখে। এর মধ্যে একটা স্বপ্ন ওর এখনো মনে আছে – সারা গা রোমে ভরা একজন নগ্ন পুরুষ তাকে বলছে ‘বাবা, আমার কাছে আয়’ আর সে ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে সেই অর্ধেক-পশু-অর্ধেক-মানুষ থেকে।       

মুনির যখন মেট্রিক পাশ করে সেই বছরই জহুর সাহেব নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কেউ জানে না, উনি কোথায় গেলেন। কেউ বলে – তার আরেকটা সংসার ছিল, সেখানে গেছেন। কেউ বলে – অচেনা কোন জায়গায় তিনি মারা গেছেন, বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ দাফন হয়েছে। কেউ কেউ আবার বলে – জহুর সাহেবের মাথায় গন্ডগোল ছিল, মাঝে মাঝে স্মৃতিভ্রম হত, হয়তো পুরোপুরি স্মৃতি হারিয়ে কোথাও পলাতক হয়েছেন।

৪. মৌলবাদী  

বাইরে মাগরিবের আজান শুরু হতেই মুনিরের চিন্তায় ছেদ পড়ল। ঘরের ভেতর দমবন্ধ হয়ে আসছিল বলে মুনির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে সে বাইরে যাবে। হয়তো খোলা বাতাসে একটু ঘোরা-ফেরা করলে মাথায় আরো কিছু বুদ্ধি আসবে। বলা যায়না, এর ফলে কাল রাতের কিছু স্মৃতিও ফিরে আসতে পারে।

সে মোবাইলটা আর মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে এলো। দরজা লাগানোর সময় সে মোট তিনবার পরীক্ষা করে দেখল তালাটা ঠিকমত লাগানো হয়েছে কিনা, দরজার সামনে খামোখাই কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল, এরপর দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ফ্ল্যাট বিল্ডিংটার বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

মুনির জানে, নিজেকে বাঁচাতে হলে কোনভাবে এই রহস্যের কিনারা তাকে করতে হবে – খুব শিগগিরই করতে হবে। আর যদি তা না পারা যায়, তাহলে হয়তো তাকে পালাতে হবে – প্রথমে বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়া, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়। অসহায় মুনির শেষবারের মত একবার গতরাতের স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু পুরো মস্তিষ্ক হাতড়ে ঘটনার ভাসা ভাসা কোন স্মৃতিও সে খুঁজে পেল না। 

একটা খালি রিকশা আসছে দেখে মুনির লোকটাকে কাছে ডাকল, কিন্তু রিক্সায় উঠে বসে মনস্থির  করতে পারল না কোথায় যাবে। একবার সে ইস্কাটনের কথা বলতে গেল, ইস্কাটনে জামিল থাকে, কিন্তু কেন যেন ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে এল মৌচাক মার্কেটের কথা। কেন মৌচাকের কথা বলল তা সে জানে না, কেউ যেন ওর মুখ দিয়ে মৌচাকের কথাটা উচ্চারণ করিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এরকম একটা পরিস্থিতিতে হয়তো মাথা ঠিকমত কাজ না করাই স্বাভাবিক।

রিকশা চলতে শুরু করার পরও মুনির কয়েকবার লোকটাকে গাড়ি ঘুরিয়ে ইস্কাটনের দিকে যাওয়ার জন্য বলতে চেষ্টা করলো, কিন্তু গলা পর্যন্ত এসে ওর কথাগুলো আটকে গেলো – যেন কেউ ওকে কথাটা বলতে দিচ্ছে না, যেন কেউ অনেক দূর থেকে ওকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে রিকশাটা অমোঘ নিয়তির মতই মৌচাক মার্কেটের দিকে এগিয়ে চলল।

তার মাথায় চিন্তাগুলো তখন আবার ভিড় করতে শুরু করেছে। থানায় রিপোর্ট করলে পুলিশ তাকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, সেটা নিশ্চিত। যেমন, তারা জানতে চাইতে পারে জীবিত অবস্থায় বীথির কোন শত্রূ ছিল কিনা, ইত্যাদি। মুনির মনে মনে এধরনের একটা তালিকা করার চেষ্টা করল, কিন্তু বীথির ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক কোন শত্রূর কথা ওর মনে পড়ল না – শুধু একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ছাড়া।

মুনিরের মনে পড়ে গেল মহিষকান্দি মাদ্রাসার কথা, আর মুহূর্তের মধ্যেই যেন তার মনের ভেতর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। সে পুরোপুরিই আন্দাজ করতে পারল, খুনটা কারা কি কারণে করতে পারে। সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম তার নিজেকে জীবিত মনে হল। 

মাস দুয়েক আগে তার এনজিও মহিষকান্দি মাদ্রাসার তিনজন মৌলভীর নামে মামলা করেছিল, প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার কারণে। তারপর শখানেক মাদ্রাসা ছাত্র আর গ্রামের লোকজন লাঠি-সোটা নিয়ে মুনিরদের কার্যালয় ঘেরাও দিল, ফলে পুলিশ ডাকতে হল। পুলিশ ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি ছুড়ল, তখন লোকজন গেল আরো খেপে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে সাতজন গুরুতর আহত হল। মাদ্রাসার একজন কিশোর মারা গেল, সে বেচারা আসলে গন্ডগোল দেখার কৌতূহল নিয়ে এসেছিল, নিজে কোন মারামারি করে নি। পুরো ব্যাপারটাই মুনিরের কাছে মনে হয়েছিল অপ্রয়োজনীয় আর দুঃখজনক।  

সেই থেকে ওই গ্রামের জনা পঞ্চাশেক পুরুষ পলাতক, সেই তিন মৌলভীর নামে পুলিশের ওপর হামলার কারণে হুলিয়া জারি হয়ে আছে। ওরাও বিষয়টা সহজভাবে নেয় নি, এ পর্যন্ত মুনিরের বাসায় তিনটা উড়ো চিঠি আর একটা উড়ো প্যাকেট এসেছে। বেনামি যে পার্সেলটা দুই সপ্তাহ আগে ওদের বাসায় এসেছে, ওটার ভেতর কাফনের একটা সাদা কাপড় ছিল। সে থানায় ডাইরিও করেছিল। সেই জিডির কথা মনে পড়তেই মুনির নিজের ভেতর একটা স্বস্তি অনুভব করতে শুরু করল।            

মগবাজারে মোড় ঘুরতেই একটা ওষুধের দোকান ওর চোখে পড়ল, বীথির জন্য এখন থেকেই ও ওষুধ কিনত। রিকশাটা দ্রুতগতিতে চলছিল, তবুও মুনির খোলা হুড ধরে বসে বসে ঘামছিল। সে আকাশের দিকে তাকাল, পশ্চিম কোণে কালো মেঘ জমা শুরু করেছে, তবু ভীষণ গুমোট ভাব চারদিকে। মনে হচ্ছে একটা ভালো ঝড় হবে আজ সন্ধ্যায়, আর সেটার পর যদি এই ভ্যাপসা গরমটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।  

মৌলভীদের সাথে ওর গন্ডগোলটা কিন্তু সামান্য তর্কাতর্কি থেকেই শুরু হয়েছিল। মুনিরদের এনজিওটা মৃত্যুদন্ড ধরনের বড় শাস্তিগুলো রোধ করার ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির কাজ করে। মাদ্রাসা থেকে কয়েকজন তার অফিসে এসেছিল এনজিওর এসব কার্যক্রম বন্ধের দাবি নিয়ে। তারা বলেছিল – যেহেতু সমাজে এখনো ধর্ষণের মত জিনিস আছে, যেহেতু মানুষ এখনো দুর্বলকে অত্যাচার করে, একে অন্যকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে, সেহেতু মানুষ সভ্য হয়েছে এমন দাবী করা যায় না।

এরা বলতে চাইছিল – এই আইনগুলো হয়েছিল মানুষের শরীরের জন্য, আর মানুষ আজো সেই মধ্যযুগের মতই শারীরিক রয়ে গেছে। ধর্মের উদ্দেশ্য ছিল, এই আইনগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের আত্মাকে শরীরের উর্ধ্বে উত্তীর্ন করা। যেহেতু আমরা তা করতে পারি নি, সেজন্য ধর্মীয় আইন তুলে দিতে বলা হবে অন্যায়।

মুনির যখন মৌচাক মার্কেটের সামনে রিকশা থেকে নামল, তখন এর মধ্যেই ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত পৌনে নয়টা। একটা ঘোরের মধ্যেই মুনির মার্কেটের মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল।  মার্কেটের বেশ কিছু দোকান ইতোমধ্যে শাটার নামানো শুরু করেছে। যেসব দোকান খোলা, সেগুলোতেও তেমন একটা লোকজন নেই। বাইরের ভ্যাপসা গরমটা মার্কেটের ভেতরে যেন আরো ঘনীভূত হয়েছে, বদ্ধ খাঁচার মতো পুরোনো এই মার্কেটে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।

যত ভয়ই দেখানো হোক, মুনির কোনোদিন তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না – ও সে ধরণের মানুষই না। এই যুগে এসে মৃত্যুদন্ডের মত পাশবিক আইনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কোন মানে আছে বলে সে মনে করে না। চুরির জন্য হাত কেটে ফেলা, রক্তের বদলে রক্ত, বিয়ের বাইরের সম্পর্ক এমনকি যদি সেটা দুর্ঘটনাবশতও হয় তার জন্য পাথর ছুড়ে হত্যা করা – এসব তো চৌদ্দশ বছর আগের নিয়ম। কেন সেগুলোকে আজো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা!  

৫. নুসরাত

মার্কেটের ভেতর আরেকটু এগুতেই সে নুসরাতকে দেখতে পেল – ক্রোকারিজের দোকানটার সামনে। সে যেন মুনিরের জন্যই অপেক্ষা করছিল। কিন্তু ওদের মধ্যে তো আজ কোন কথা হয় নি! মুনিরেরও তো এখানে আসার কোন পূর্বপরিকল্পনাও ছিল না! এই মেয়ে এখানে কি করছে?ওকে দেখামাত্র মেয়েটা হাতের ইশারায় তাকে পেছন পেছন যেতে বলল। মুনিরও সম্মোহিতের মত নুসরাতকে অনুসরণ করতে লাগল।

সারি সারি একঘেয়ে দোকান আর ক্লান্ত ঘর্মাক্ত মহিলা-পুরুষের মধ্যে পাটভাঙা সবুজ শাড়ি আর রক্ত লাল টিপে নুসরাতকে পুরোপুরিই অচেনা লাগছিল। সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় ওকে দীর্ঘাঙ্গিনীই বলা যায়। জরি দেয়া কালো হাই হিলের বাড়তি উচ্চতার কারণে তাকে আরো বেশি ছিপছিপে দেখাচ্ছে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে গাঢ় সবুজ রঙের ব্লাউজ পড়েছে ও, কিন্তু পেছন থেকে কোমরের দৃশ্যমান ফর্সা অংশটার দিকেই বার বার মুনিরের দৃষ্টি চলে যেতে চাচ্ছিল।   

গয়নার একজন দোকানদার, কলেজ ফেরত এক তরুণী, ফর্সা মতো লম্বা একটা ছেলে ওর দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইল, কিন্তু মেয়েটা সবাইকেই উপেক্ষা করে পেন্সিল হিলের শব্দ তুলে গট গট করে নিজের মতো সামনে এগিয়ে চলল।

নুসরাত আর মুনির স্কুলে আর কলেজে একই ক্লাসে পড়ত। ভালো বন্ধুত্ব ছিল দুজনের – একজন প্রাইভেটে গণিত পড়লে আরেকজন পড়ত ইংরেজি, তারপর দিনের শেষে নোট বিনিময় করত, একসাথে পাশের বাসায় যেত টেলিভিশনে সাপ্তাহিক নাটক দেখতে।

মুনিরের বাবা বিজ্ঞান পড়াতেন বলে নুসরাত প্রতি শুক্রবার বিকেল তিনটায় তার কাছে পড়া বুঝতে আসতো, জহুর সাহেব তখন মুনিরকেও ওর পাশে বসিয়ে দিতেন – দুজনকে একসাথে শব্দের বেগ, আলোর প্রতিসরণ এগুলো বোঝাতেন। 

সেই কলেজে পড়ার সময় এক বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দিন নুসরাত লাল পাড় লাগানো সাদা শাড়ী পরে কলেজে এসেছিল। মুনির বোকার মত হা করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে, নুসরাত সেটা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসছিল। মুনির একরাতে নুসরাতকে স্বপ্নেও দেখেছিল – যেন একটা সাদা পরী, আর তার সাদা শাড়ীর আঁচলটা ডানা হয়ে গেছে। সেই স্বপ্নের কথা মুনিরের এখনো মনে আছে। 

নুসরাতের একটা বিষয় মুনিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, আর সেটা হলো – নুসরাত যেন তার জহুরুল স্যারের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো, লোকটা যখন পড়াতো নুসরাতের চোখের পাতাগুলো যেন একবারের জন্যও পড়তো না। নুসরাত হা করে তাকিয়ে থাকতো মুনিরের বাবার দিকে, আর মুনিরের চোখ আটকে থাকতো একরত্তি মেয়েটার ঝলমলে মুখটার দিকে।

কথাটা ভাবতেও মুনিরের অস্বাভাবিক লাগতো, কিন্তু সে আসলে তার বাবাকে একরকম ঈর্ষাই করতো – ঈর্ষা করতো নুসরাত ভদ্রলোককে দেখে সম্মোহিত হয়ে যেত বলে, ঈর্ষা করতো সে নিজে কিছুতেই নুসরাতের পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতো না বলে।

মেনে নিতে আপত্তি নেই মুনিরের, ওর বাবা ছিল একজন রহস্যপুরুষ – খোদ রাসপুটিনের মতো আশ-পাশের লোকজনকে সম্মোহিত করে ফেলার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল তার। হয়তো নুসরাতও এর ব্যতিক্রম হতে পারে নি। একদিন তো মেয়েটা ঘোষণাই করে বসলো – বড়ো হয়ে সে একদিন জহুরুল সাহেবের ইচ্ছে পূরণ করবে, পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন এই দেশটাতে সে একদিন ছড়িয়ে দেবে।

কলেজে পড়ার সময়ই নুসরাতের বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছিল, তারপর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগেই ওর বিয়ে হয়ে যায়। তার বর একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড়ো চাকরি করতো, অনেক টাকা বেতন। যদিও বিয়ের আগ পর্যন্ত নুসরাতকে মুনিরের শুধুই ভালো লাগতো, কিন্তু বিয়েটা হয়ে যাবার পর মুনিরকে সন্ধ্যার রাস্তায়, কিংবা বৃষ্টির দুপুরে, অথবা রাতের অন্ধকারে উদ্দেশ্যহীন এদিক-ওদিক হাটতে দেখা যেত।

ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর মুনির কিন্তু আবার খুঁজে পেয়েছিল তার সেই পুরোনো বান্ধবীকে – সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে – নুসরাত সমাজবিজ্ঞানে, আর মুনির পরিসংখ্যানে। ওদের দুজনকে প্রায়ই একসাথে দেখা যেতো লাইব্রেরিতে, ক্যান্টিনে আর হোস্টেলের পাশের মাঠে। উনিভার্সিটির সেই দিনগুলোতে নুসরাতদের বাসায় যাওয়া-আসাও শুরু করেছিল মুনির। তারপরই ঘটে সেই দুর্ঘটনা – পর পর দুবার – যার কারণে নুসরাতকে বাসায় যাওয়া-আসা ছেড়ে দিতে হয় মুনিরকে। আর সে দুর্ঘটনাগুলোর সাথে মুনিরের স্মৃতি হারানোর পুরোই সম্পর্ক ছিল।

ও যখন ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে পড়ে, মুনির আড্ডা দিতে গিয়েছিল নুসরাতের বাসায়। আড্ডা মানে কিছুটা পড়ালেখা, কিছুটা গল্প-গুজব, আর বাকিটা চা-নাস্তা। ওই বাসাটায় নুসরাত মেয়েটা তখন বলতে গেলে একাই থাকতো, কারণ রশিদ ভাইকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে কাজে যেতে হতো। রশিদ মুনিরকে ছোটভাইয়ের মতো দেখতেন, পাশ করার পর চাকরি-বাকরির জন্য চেষ্টা-তদবির করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। 

লোড শেডিং আর ভ্যাপসা একটা গরম ছিল সে সন্ধ্যায়। ওরা দুজন সন্ধ্যার পর ছাদে চলে গিয়েছিল গল্প করার জন্য। মুনিরের এপর্যন্ত মনে আছে, কারেন্ট আসার পর ওরা নিচে নেমে এসেছিল। কিন্তু এরপর আর কিছু তার মনে নেই।

পরদিন সকালে ঘুম ভেংগে দেখে, সে নুসরাতদের ড্রইংরুমে শুয়ে আছে। মাঝখানে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো, অস্পষ্ট। সে নুসরাতকেও জিজ্ঞেস করেছে – সেরাতে কিভাবে সে জ্ঞান হারাল, কোন খিঁচুনি হয়েছিল কিনা, গায়ে জ্বর ছিল কিনা, ইত্যাদি। কিন্তু মেয়েটা এ ব্যাপারে ওকে একটা কথাও বলেনি।

পরের বার একইরকম একটা ঘটনা ঘটে প্রায় মাস তিনেক পর, এক জুন মাসের শেষ দিকে। সেবারও সন্ধ্যার পর কথা বলছিল সে নুসরাতের সাথে, তারপর হঠাৎ করেই তার কোন স্মৃতি নেই। সকালে মুনির আবিষ্কার করে – সে নুসরাতের বিছানায় শুয়ে আছে।

মুনিরের কাছে স্মৃতি হারানোর ব্যাপারটার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল সম্ভাব্য ভুল বোঝা-বোঝি – মানুষ তো বিশ্বাস করবে না যে ওদের মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটে নি! দ্বিতীয়বার এরকম হবার পর মুনির অস্বস্তিতে সে বাসায় যাওয়াই ছেড়ে দেয়, এমনকি সে ধীরে ধীরে নুসরাতের সাথে সব ধরণের যোগাযোগও বন্ধ করে।

দ্বিতীয়বার ওরকম ঘটার পর পরই এক সাইকায়াট্রিস্টের সাথে সে কথা বলেছিল। ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – তার এমন কোন অভ্যাস আছে কিনা যা তাকে প্রচন্ড আকর্ষণ করে কিন্তু সেটা আবার অনৈতিক। সে এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি, কারণ এরকম কোন কিছুর কথা তার নিজেরও জানা নেই।

ডাক্তার এরপর তাকে একটা অষুধ খেতে দিয়েছেন, আর বলেছেন – এ অষুধ তার নিজের ভেতরের গোপন অনুভূতিগুলোকে বাইরে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে, অনেকটা নিজেকে নিজে আবিষ্কার করার মত। তখন সে নিজেই বুঝতে পারবে – কেন কি হচ্ছে। সে গত একমাস ধরে অষুধগুলো খাচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দু রাতের কোন গোপন কথাই তার মনের অতল গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসেনি।

৬. পলাতক

অপরিকল্পিতভাবে বানানো এই মার্কেটের দম বন্ধ গরমে যখন মুনিরের মনে হল যে সে বমি করে দেবে, তখনি সে দেখল মার্কেটের পেছনের কলাপসিপল গেটটা দিয়ে মেয়েটা বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে। মার্কেটের এ পাশটা একদম নির্জন, এদিকে শুধু দর্জির দোকানগুলো আছে।

মার্কেট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই ঠান্ডা এক রাশ বাতাস মুনিরের শরীরটা জুড়িয়ে দিলো। মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, তাই বেশ জোরে-সোরে বাতাস ছেড়েছে। ওর সমস্ত ক্লান্তি এক মুহূর্তে দূর হয়ে গেল।

নুসরাত তখন অন্ধকার গলিটা পার হয়ে ডানদিকের ছোট রাস্তাটায় গিয়ে উঠেছে। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে, সোডিয়াম লাইটের আলোতে দেয়ালগুলো বিবর্ণ লাগছে। গলির মাথায় কতগুলো কমবয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কোথা থেকে হঠাৎ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টির ফোটা মুনিরের ক্লান্ত ঘর্মাক্ত মুখে এসে পড়ছিল।

মেয়েটা যখন ছেলেগুলোর সামনে দিয়ে চলে গেল, তখন ওরা সেদিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছু বলল না। বৃষ্টি একটু বেড়েছে, মুনিরের শার্টের হাত আর বুক ভেজা ভেজা লাগতে শুরু করেছে, কিন্তু ওর মাথায় এখন সেটা নেই। মেয়েটা বাঁদিকের সরু গলিটাতে ঢোকার আগে ওর দিকে একবার ফিরে তাকাল। এ গলিটা এতো ছোট যে দুটা রিক্সা পাশাপাশি যেতে পারবে না। মুনির গলিতে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে লক্ষ্য করলো যে ছেলে গুলো এদিকে আসতে শুরু করেছে।

এতক্ষন সে ছেলেগুলোকে কোনো পাত্তা দেয়নি। আরেকবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে ওর ধমনীতে রক্ত চলাচল বেড়ে গেল, এমনকি একসময় সে যেন তার নিজের হৃৎস্পন্দনও শুনতে পেতে শুরু করল।

পেছনে মোট পাঁচটা ছেলে, সবগুলো জিনসের প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরা, মাথায় গোল টুপি তিনজনের, মুখে দাড়ি সবগুলোর। মুনির দ্রুত পা চালাল। মহিষকান্দি কওমি মাদ্রাসার কথা তার মনে পড়ে গেল। মুনির ততক্ষনে মোটামুটি নিশ্চিত – এরাই বীথিকে মেরেছে, এখন তার পিছু নিয়েছে তাকে মারার জন্য।

খুব সম্ভবত এরা মুনিরকে মারতেই ওর বাসায় ঢুকেছিল, কিন্তু বীথি ওদের দেখে ফেলাতে অথবা ওদের বাধা দেয়াতে বেচারীকে মরতে হয়েছে। ওরা হয়তো দুজনকে প্রথমে অচেতন করেছিল, নির্বিঘ্নে হত্যা করার জন্য – বিথীকে মারতে পেরেছে, কিন্তু মুনিরকে মারার সময় পায় নি। হয় তো মুনিরের গলা কাটার আগেই কোনো কারণে ওদের সরে পড়তে হয়েছে, আর তাই আজ এসেছে ওদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে।

গলি ধরে মুনির যতই সামনে এগুচ্ছে ততই যেন সেটা আরো সরু হয়ে আসছে। মুনির সামনে দেখলো নুসরাত বৃষ্টিতে পুরোপুরি ভিজে গেছে, কিন্তু বৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এমনভাবে হেটে চলেছে যেন কোথাও কিছুই হয় নি। এদিকে ছেলেগুলোর সাথে মুনিরের দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে।

মুনির যখন দেখল যে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ওরা পাঁচজন তার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন সে বাউন্ডারি দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল – এগুলো ওর কাঁধ সমান উঁচু, দেয়াল টপকানোর দরকার হলে সম্ভবত সেটা করা যাবে। ছেলেগুলোর কাছে কি ধরণের অস্ত্র আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না – ছোট চাকু, রাম দা, কিংবা পিস্তল – যে কোন কিছুই হতে পারে। ওরা ততক্ষনে মুনিরের আট-দশ গজের মধ্যে চলে এসেছে।

বৃষ্টির বেগ ততক্ষনে আরো বেড়েছে। মুনির মাত্র হাত বাড়িয়েছে দেয়াল টপকানোর জন্য। ঠিক তখনি সে শুনতে পেলো নুসরাতের কণ্ঠ – ‘মুনির, এদিকে চলে এসো।‘

নুসরাত তখন একটা ছোট গেট খুলে ভেতরে ঢুকছে। মুনির আর সাত-পাঁচ চিন্তা না করে ওর পেছন পেছন গেটের ভেতর ঢুকে গেল। আর সাথে সাথে নুসরাত গেটটায় খিল লাগিয়ে দিল।

৭. আদিম

দোতলা একটা বাসা। বোঝা যায় তিনতলার কাজ শুরু হয়েছিল, ছাদে অসমাপ্ত কাজের চিহ্ন হয়ে রডগুলো ঝুলে আছে। নুসরাত ওকে সাথে আসার জন্য ইঙ্গিত করে দোতলায় উঠতে শুরু করলো। ও তখন ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, সবুজ শাড়ি থেকে পানি ঝরে পড়ছে। মুনির চুনকাম করা সাদা দেয়ালের ওপর দিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকাল, কিন্তু ছেলেগুলোকে আর দেখতে পেল না। 

পুরোনো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে নুসরাত লাইট জ্বালিয়ে দিল। মুনির বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষন ভেজা কাপড় থেকে পানি ঝরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল, তারপর একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত ঘরে ঢুকে পড়ল। নুসরাত দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। নুসরাতদের এই বাসাটায় আগে ও কোনদিন আসে নি।

‘তুমি কবে বাসা চেঞ্জ করেছো?’ – মুনির জানতে চাইল।

‘এই তো কয়দিন আগে। আমি জানি তুমি চিনবে না, তাই মার্কেটে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’ – নুসরাত বলল।

‘তুমি জানো কি করে আমি এসময়ে মার্কেটে আসবো? আমি নিজেই তো জানতাম না।’

নুসরাত ওর চোখে চোখ রাখল, তারপর এমনভাবে হাসল যেন সে উত্তরটা জানে কিন্তু বলবে না।       

ছোট একটা ড্রইং রুম, একপাশে একটা শোকেস, মাঝখানে বেতের টেবিল আর চেয়ার। মুনির একটা কাঠের চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ল। নুসরাত ওকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল। একটু পর মুনির পর্দার আড়াল থেকে দেখল মেয়েটা একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছে আর ভেজা চুল মুচছে। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, এ বৃষ্টি সারা রাতে থামবে কিনা সন্দেহ আছে।

নুসরাত ফিরল মিনিট দশেক পর। সে তখনও ভেজা শাড়িটাই পরে আছে, ভেজা ব্লাউজ তখনও তার শরীরটাকে জাপ্টে ধরে আছে, আর এলোমেলো হয়ে থাকা ভেজা কালো চুলে ওর সৌন্দর্য যেন দশগুন বেড়ে গেছে। সে ট্রেতে করে এক গ্লাস পানি, দুই কাপ চা আর কিছু চানাচুর-মুড়ি এনেছে। সেই পুরোনো দিনগুলোতেও বৃষ্টি হলে ওরা এরকম চানাচুর মুড়িই মাখিয়ে খেত।

নুসরাত ওর চা-টা হাতে নিয়ে বলল – ‘ছেলেগুলোকে দেখে এতো ভয় পেয়েছিলে কেন?’ 

মুনির একবার এদিক-ওদিক তাকাল, যেন দেখে নিল কেউ তার কথা শুনছে কিনা, তারপর ক্ষীণস্বরে বলল – ‘নুসরাত, আমি একটা বড় ঝামেলায় পড়েছি। সামনে আমার অনেক বড় বিপদ। মনে হচ্ছে এই লোকগুলিই সেই বিপদের কারণ।’

মুনির সকাল থেকে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলোর কথা নুসরাতকে বলল। মহিষকান্দি মাদ্রাসার ঘটনাও বাদ দিল না। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে সে বান্ধবীর মুখের দিকে চেয়ে রইল।

নুসরাত স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল, কিন্তু ওর কপালে চিন্তার কোন ভাঁজ দেখা গেল না।

‘এই ছেলেগুলো এ পাড়ারই লোক। ওদের আমি সবসময়ই গলির মুখে আড্ডা দিতে দেখি। আমার তো মনে হয়, ওরা বরং আমাকে প্রটেক্ট করতে এগিয়ে এসেছিল। মানে তোমাকেই ওরা ছিনতাইকারী ভেবেছিল।’ – বলে সে হাসতে শুরু করল।

মুনির অবশ্য সে হাসিতে যোগ দিতে পারল না, বলল – ‘নুসরাত, আমি নিশ্চিত বীথির খুনের সাথে মাদ্রাসার ওই ঘটনার যোগাযোগ আছে। গতকাল থেকে যা ঘটছে তার এরচেয়ে ভালো কোন ব্যাখ্যা আর হয় না। কিন্তু প্রব্লেম হল আমার কথার কোন প্রমান আমি দিতে পারব না, কারণ কালকের ঘটনা আমি কিছু মনে করতে পারছি না।’

‘ও, এমনেশিয়া? সেই রাতের মতো?’ – নুসরাত মিটি মিটি হাসতে লাগল। আশ্চর্য, মুনিরের এত বড় বিপদে ও হাসছে কি করে ! সে অবশ্য জানে মেয়েটা কোন রাতের কথা বলছে। মুনির কোন উত্তর দিলো না।

নুসরাত হাসছিল – ‘তুমি দেখছি নিজের সম্পর্কে কিছুই জানো না। আমি কিন্তু সব জানি।’

‘তুমি কি জানো?’ – মুনির দুর্বল স্বরে বলে। তাহলে কি নুসরাতই আসলে এই খুনের সাথে জড়িত?    

নুসরাত চায়ে একবার চুমুক দিলো, তারপর কাপটা একপাশে রেখে দিল। তারপর সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে বলল – ‘তার আগে বল, তুমি সত্যিই বুঝতে পারছো না, কাল রাতে খুনটা কে করেছে?’ 

মুনিরের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে নুসরাত হেসে ফেলল, তারপর হঠাৎ সোফায় পা তুলে বসল – ‘আচ্ছা, তোমাকে একটা মজার কথা বলি। তুমি কি জানো, আমাদের চারপাশে সব মানুষই কিন্তু আসলে আদম-হাওয়ার বংশধর না, কেউ কেউ বিবর্তন হয়ে জন্তু-জানোয়ার থেকেও এসেছিল – ঠিক যেমনটা তোমাদের ডারউইন সাহেব বলেছিল। আর কোন কোন বিশেষ রাতে সেইসব অর্ধেক-জন্তু-আর-অর্ধেক-মানুষের আদিম স্বভাব জেগে জেগে ওঠে।’ – মেয়েটা এমনভাবে কথা বলছিল যেন হারিকেন জ্বালিয়ে কেউ বৃষ্টির রাতে ভুতের গল্প বলছে।

৮. দানব

‘প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার বছর আগে প্রক্সিমা-বি নক্ষত্র থেকে পৃথিবীতে এসেছিল এক নভোযান। দু’পায়ের ওপর ভর করে হাটতে পারা এক জোড়া ভিনগ্রহের প্রাণীকে পৃথিবীতে নামিয়ে দিতে এসেছিল সেই রকেট। পৃথিবীতে তখন বিবর্তনের ধারায় নিয়ানডার্থাল-রা জেগে উঠছে। ওরাও দু’পায়ে হাটতে পারতো, কিন্তু ভিনগ্রহের আগন্তুকদের তুলনায় ওরা ছিল নিতান্তই পশু – অনুন্নত, পশ্চাদপদ।

কয়েক হাজার বছর ধরে ভিনগ্রহের প্রাণীগুলো বংশ বিস্তার করে করে পৃথিবীতে জায়গা করে নিতে থাকলো। স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ানডার্থালদের ওরা এড়িয়ে চলতো, স্থানীয়রাও ওদের – যদিও দু’পক্ষই দেখতে কাছাকাছি রকম ছিল।

এরপর এক ভয়াবহ বন্যা হল। ভিনগ্রহবাসীরা নৌকা বানাতে জানতো বলে বন্যা থেকে বেঁচে গেল। আর নিয়ানডার্থাল-রা সে বন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। বন্যা চলে গেলে ভিনগ্রহবাসীরা আবার পৃথিবীর মাটিতে আস্তানা গাড়লো। নিজেদের প্রজাতিকে ওরা নাম দিল মানুষ, যাদেরকে আমরা এখন হোমোসেপিয়েন্স বলে থাকি।

নিয়ানডার্থাল-দের কেউ কেউ কিন্তু টিকে গিয়েছিল – উঁচু পাহাড়ে চড়ে, কিংবা সেই নৌকায় লুকিয়ে উঠে গিয়ে। এমনকি সভ্যতার দৃষ্টির আড়ালে থেকে নিজেদের মধ্যে বংশ-বিস্তার করেও চলেছিল। তুমি কি ওদের খুঁজে বের করতে চাও না?’

‘নুসরাত, চুপ করো তো এখন। এখন হেঁয়ালির সময় না।’

‘হেয়ালি হবে কেন? যদি বলি তোমার সমস্যাটার সাথে এই গল্পের একটা সম্পর্ক আছে? আচ্ছা, কখনো তুমি ওয়েরউল্ফের কথা শুনোনি? তুমি কি ভেবেছো ওগুলো শুধুই গল্প? এর পেছনে সত্য বলে কিছু নেই?’

মুনির বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রইলো – ‘পূর্ণিমার রাতে কিছু মানুষ পশু হয়ে যায়, এগুলোও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?’

‘যদি বলি, সত্যিই কিছু মানুষ – মানে আমরা যদি তাদেরকে মানুষ বলি আর কি – সত্যিই পশুর মতো কিছু একটা হয়ে যায়। যদি বলি, তুমিও সেই পশুর মতোই একটা কিছু?’ 

‘নুসরাত, থামো, প্লিজ। আমি এসব আর নিতে পারছি না।’   

‘মুনির, সত্য তো একদিন না একদিন তোমার জানতেই হবে, তাই না? যদি বলি, ঐ রাতে আমার বাসায়ও তুমি সেরকমই হয়ে গিয়েছিলে! যদি বলি, ওই অবস্থাতে তোমার পক্ষে হত্যা, ধর্ষণ সবই করা সম্ভব?’

মুনির এটাকে তামাশা ভেবে উড়িয়ে দেয়ার হাসি হাসে একবার আর মাথা নাড়তে থাকে।

নুসরাত কিন্তু একটুও হাসে না, সে মুনিরের একেবারে পাশের চেয়ারে এসে বসে, একেবারে গা ঘেঁষে, তারপর প্রায় শোনা যে না এমনভাবে ফিস ফিস করে বলে – ‘আমি নিজে দেখেছি তোমাকে সেই রাতে। আর তুমি আমার ভেতরেও তোমার রক্তের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলে সেদিন, তারপর থেকে আমিও কখনো কখনো তোমার মতোই জানোয়ার হয়ে যাই। কিন্তু জানো? তুমি আমাকে নষ্ট করার পর প্রথম প্রথম আমার অনেক রাগ হলেও পরে ধীরে ধীরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করা শুরু করি। কেন জানো?’  

‘কেন?’ – মুনির ভয়ে ভয়ে জানতে চায়।

‘কারণ, এখন আমিও তোমার বাবা মানে জহুরুল স্যারের মতো হোমোসেপিয়েন্সদের ঘৃণা করি। আমি নিজে হোমোসেপিয়েন্স, মা-হাওয়ার এক কন্যা, কিন্তু ঘৃণা করি পিতা-আদমের সন্তানদের, আমার নিজের প্রজাতির ভাই-বোনদের, কারণ তারা লোভ আর ভোগের নেশায় পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমি প্রায়ই ভাবি, কেন তোমার মতো নিয়ান্থারডাল হয়ে জন্মালাম না, তাহলে অন্তত পরিবেশ বিপর্যয়ের অংশ হতাম না।’   

মুনিরের তখন মাথা ঘোরাতে শুরু করেছে। ‘আমি নিয়ান্থারডাল? কে বলেছে এসব তোমাকে? বাবা?’ – সে রীতিমতো তোতলাতে শুরু করেছে সে সময়।

‘হ্যা, তুমি কমপক্ষে পঞ্চাশ ভাগ নিয়ান্থারডাল। তোমার বাবাও তাই ছিল, এজন্যই হঠাৎ করে তাকে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে হয়েছিল। তোমাদের বৈশিষ্ট্য কি জানো? পূর্ণিমার রাতগুলোতে তোমাদের রক্তে জোয়ার আসে, তখন তোমরা পশুর মতো হয়ে যাও, তারপর রাত শেষ হতেই ভুলে যাও তোমরা কি করেছো। কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশকে হোমোসেপিয়েন্সদের হাত থেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে নিয়ান্ডার্থালদের প্রজাতিকে আবার শক্তিশালী করা। নিয়ান্ডার্থালরা এই পৃথিবীর মাটির সন্তান, তারা এর যত্ন করবে, মায়ের মতো সম্মান করবে এই ধরিত্রীকে – ভিনগ্রহের আগন্তুক অভিবাসী হোমোসেপিয়েন্সদের মতো শোষণ করবে না এই মাটির রস-গন্ধ-সৌন্দর্যকে।’

‘হোমোসেপিয়েন্স হয়ে নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতিকে তুমি কি করে শক্তিশালী করবে?’ – মুনির হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো নুসরাতের এসব তাত্ত্বিক কথা-বার্তা কিংবা তামাশা।

কিন্তু উত্তরে নুসরাত মোহময়ী এক হাসি হাসলো – ‘কেন? নিয়ান্ডার্থালদের সন্তানদের ধারণ করে। মুনির, তুমি কি তোমার এই স্বপ্নের নারীকে দেবে না নিয়ান্ডার্থাল এক সন্তান?’

বলেই মেয়েটা তার গায়ে একটা খামচি বসিয়ে দেয়, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে, তারপর হিস হিস করে বলে – ‘আচ্ছা, এভাবেই তো আমাদের চলতে পারত। বিথীকে মেরে ফেলার কি দরকার ছিল, বল তো? অবশ্য তোমারি বা কি দোষ? ওই সময় তো আর নিজের ওপর কারো কন্ট্রোল থাকে না, তাই না?’ বলে সে পাগলের মত হাসতে শুরু করে।

মুনির প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও অল্পসময়ের ভেতর নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু তখন মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ গলায় একটা কামড় বসিয়ে দিল, ঠিক যেভাবে নেকড়ে তার শিকারকে কামড়ে ধরে।

আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। হঠাৎ করেই মুনিরের মনে হতে শুরু করল, তার শরীরে যেন কোন একটা পরিবর্তন আসছে। মনে হতে লাগল, ওর শরীরের লোমগুলো কোন পশুর লোমের মত বড় বড় হয়ে যাচ্ছে, আর দাঁতও যেন মুখ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে – যেন ওর চেহারা ধীরে ধীরে একটা চতুষ্পদ জন্তুর মত হয়ে যাচ্ছে। আর ওর স্মৃতিতেও ফিরে আসছে এমন অনেক দৃশ্য যা সে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনদিন মনে করতে পারতো না।

নুসরাত তখন হাসতে শুরু করেছে। বিস্ময়ভরা চোখে ওর হাসি দেখতে দেখতে হঠাৎই মুনিরের মনে পড়ে গেল ক্লাস সিক্সে থাকতে সেই পূর্ণিমার রাতে সে মাংসের নেশা পেয়ে বসেছিল তাকে, রুমাদের বাসার খরগোশটাকে ওই শিকার করে খেয়েছিল।

নুসরাতের সারা শরীরকে দুই চোখ দিয়ে স্পর্শ করতে করতে ওর স্মৃতিতে ফিরে এলো, ভার্সিটির সেই রাতে লোডশেডিং শুরু হবার পর পরই কি করে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নুসরাতের কোমল শরীরের ওপর আর সারারাত ধরে তাকে উপভোগ করেছিল।       

এমনকি মুনিরের চোখে গতরাতের দৃশ্যগুলোও সব স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল – ঠিক কিভাবে রাতের খাবার টেবিলে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সে বীথির দিকে কাঁচের গ্লাস ছুড়ে মেরেছিল, আর তার ফলে মেয়েটার কপাল কেটে কেমন এক রক্তারক্তি কান্ড হয়েছিল। যদিও সেই গ্লাসের আঘতে বীথির মৃত্যু হয় নি, কিন্তু ভয়ে চিৎকার করতে করতে মেয়েটা যখন ওকে নারী নির্যাতন আইনে মামলার হুমকি দিয়েছিল, তখন সে মেয়েটাকে কি ভীষণভাবেই না খামচে ধরেছিল, আর গলাতেও প্রচন্ড জোরে কামড় দিয়েছিল ঠিক যেভাবে বাঘ একটা হরিণকে শিকারের সময় কামড়ে ধরে। 

মুনির যখন নিজের শারীরিক পরিবর্তনগুলোকে থামানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন সে দেখল নুসরাতের নিজের চেহারাও কিরকম বদলাতে শুরু করেছে। 

মুনির যখন বুঝতে পারল যে নুসরাতের কথাই সত্যি, অর্থাৎ সত্যি সত্যিই সে চিরদিনের মত আটকা পড়েছে না-মানুষ না-পশু জাতীয় একটা কিছুর শরীরে – তখন সে আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, কিন্ত সে আর্তনাদটাও শোনাল একটা পাশবিক কান্নার মতই।

‘আমি আত্মহত্যা করব’ – মুনির নিজের কান-মাথা চেপে ধরে বলল – ‘তবু এই শরীর থেকে বের হব।’

নুসরাত হাসল, পাশবিক হাসি – ‘তোমার মৌলভী বন্ধুদের কাছে যাও, তারা যদি দয়া করে তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে . . . আসলে মরে যাওয়া ছাড়া এটা থেকে মুক্তির আসলেও আর কোন রাস্তা নেই তোমার’ – শেষ কথাগুলো বলার সময় কেন যেন ওর চেহারা থেকে হাসি মুছে গেল। 

‘তাও যদি হত’ – মানুষ থেকে বন্য জন্তুতে পরিণত হবার কষ্টকর শারীরিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মুনির ভাবল।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্বাভাবিক পূর্ণিমার সেই রাতে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ঢাকা শহরের নিভৃত এক ফ্ল্যাটে পাশবিক উন্মাদনায় মিলিত হয়েছিল একটা পুরুষ আর একটা নারী পশু। 

৯. পরিশিষ্ট

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে মুনির প্রথমে বুঝতে পারছিল না সে কোথায়। নুসরাতকে দেখে ওর মনে পড়ল ও গত সন্ধ্যায় এ বাসায় এসেছিল। ওর এটাও মনে পড়ল, ওরা বীথির লাশ নিয়ে কথা বলছিল। কিন্তু এরপর কি হয়েছে কিছুই তার মনে পড়ল না।

সে নুসরাতকে জিজ্ঞেস করল, সে এখানে কেন। নুসরাত কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, বৃষ্টির জন্য গতরাতে সে আটকে গিয়েছিল। তখন ওর মনে পড়ল কিছু যুবক তার পিছু নিয়েছিল, আর সে ভয়ে দৌড়াচ্ছিল।

সেই সকালে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুনির রমনা থানায় ডাইরি করতে যায়। পুলিশ ওকে থানায় বসিয়ে রেখেই ওর বাসায় অভিযান চালায়। ওর সন্দেহজনক আচরণের কারণে থানা থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠানো হয়।

মুনির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ দাবি করে, কিন্তু ওর ঘরে পাওয়া জিনিস-পত্রে ওর হাতের ছাপ স্পষ্ট ছিল। সেই সন্ধ্যায় মুনিরের ঘরে দ্বিতীয় আরেকজন ছিল সম্ভবত, কিন্তু পুলিশ এখনো নিশ্চিত হতে পারে নি সে কে। মুনিরের মামলা এখন নিম্ন আদালতে বিচারাধীন আছে।

ওই দিনের পর নুসরাতকে আজ পর্যন্ত কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। যেভাবে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে মেয়েটা সেই সন্ধ্যায় মুনিরের মার্কেটে আসার খবর পেয়েছিল, ঠিক একইভাবে হয়তো সে কোন বিপদের গন্ধ পেয়ে গিয়েছিল আর তার ফলে এই ব্যস্ত শহর থেকে হারিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

হতেও পারে, অসহায় রমণী সেজে সে এখন কোন ছোট মফস্বল শহরে এক ভালোমানুষের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে, থাকবে সেখানে ততদিন পর্যন্ত যতদিন না পরবর্তী শিকারকে ও ধরতে পারে।

হতেও পারে, তার গর্ভে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে এক ঊনমানুষ ভ্রূণ, মুনিরের অনাগত নিয়ানডার্থাল সন্তান – নুসরাত আদর করে যার নাম দেবে জহির। মুনির যখন কারাগারে বন্দি, তখন কাউকে না কাউকে তো ওই বিশেষ প্রজাতিটার দল ভারী করার দায়িত্ব পালন করতেই হবে, তাই না?      

মুনির কিন্তু এখনো মনে করে ওকে কোনভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে, সে এখনো মহিষকান্দি গ্রামের তিন মৌলানাকে তার স্ত্রী হত্যার জন্য দায়ী মনে করে আর অভিশাপ দেয়। খুনের রাতের ঘটনা আর এর পরের রাতের ঘটনা সে একেবারেই মনে করতে পারে না।   

মুনিরের নানাভাই শামসুল হক, যিনি চল্লিশ বছরে এক ওয়াক্ত নামাজ কাজ করেন নি, বেঁচে থাকতে প্রায়ই একটা কথা বলতেন – প্রতিটি মানুষের ভেতর লুকিয়ে আছে একটা জন্তু, কারো জন্তুটা হিংস্র বাঘ, কারোটা ভীতু ভেড়া, কারো ভেতরের জন্তু ধূর্ত শিয়াল, কারোটা আবার কুৎসিত কাক। নিজের ভেতরের এই পশুটার কারণেই নিজ ভাই হাবিলকে খুন করেছিল কাবিল, পশুত্বের কারণেই ডাইনি জোহরার ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হয়েছিল ফেরেশতা হারুত। অন্যদিকে পশুত্ব নিজেই একটা শাস্তি, আর এটা থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা ছাড়া আর কোন উপায় খোদার বান্দাদের নেই।

কেন বিশেষ করে এই কথাটাই ঘুরে-ফিরে বার বার তার মনের জানালায় উঁকি দেয়, সেটা মুনির নিজেও জানে না। মানুষের অবচেতন মন আসলে খুব বিচিত্র জিনিস, এর কোন খেলাটা কাকতালীয় আর কোনটা ফ্রয়েডীয় সেটা বোঝা বেশ মুশকিল।

Leave a comment