ছায়া

হামিদের জন্ম হয়েছিল একজন ‘উলটো-মানুষ’ হয়ে – মায়ের পেট থেকে বের হওয়ার সময় ওর মাথা ছিল স্বাভাবিকের উলটো দিকে। ওর নানীর বাড়ির লোকজন ছোটবেলা থেকেই ওকে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করত – হামিদের বয়স যখন চার বছর, তখন থেকেই এরা সময় সময় দোয়ার তদবির নিয়ে আসত ওর কাছে।

একবার দূর সম্পর্কের এক মামা কোলে করে তার মেয়েকে নিয়ে এলো, ভীষণ জ্বর, কোনো ওষুধেই নাকি জ্বর নামছে না – হামিদ বাচ্চাটার পিঠে আস্তে করে একটা থাপ্পড় মেরে দিল, এর একঘন্টার মধ্যেই বাচ্চার জ্বর নেমে গেল। সেসময়টাতেই একজন জ্যোতিষী ওকে দেখে বলেছিল – গায়েবের জগতের সাথে যোগাযোগ করার প্রকৃতিগত একটা ক্ষমতা হামিদের রয়েছে, কিন্তু ওকে সাবধানে রাখাও দরকার কেননা এরকম মানুষ অন্যজগতের অন্ধকার জীবদেরও খুব সহজেই নিজের দিকে আকর্ষণ করে থাকে।

হামিদ যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, তখন একবার সে তিনদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। কারো কোনো ধারণা নেই, সে কোথায় গেল। ওদের দোতালা বাসাটার ছাদে সে গিয়েছিল হাওয়া খেতে, তারপর থেকেই সে নেই। ঠিক তিন রাত পর সে নেমে এলো ছাদ থেকে – চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, যেন খুব ঘুম পেয়েছে।

সেদিন সে সারাদিন ঘুমাল। সন্ধ্যার সময় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার রকিবুল হাসান তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন ছেলে পুরোই সুস্থ আছে। মাগরিবের পর হামিদ জেগে উঠল, বলল তার একজন বান্ধবী তাকে একটা বাগানে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সে কিভাবে ওখানে গেছে তা তার মনে নেই, পূর্ণ জোৎস্নার উজ্জ্বল আলোতে অনেক অচেনা ফুল আর ফল সে দেখেছে সে বাগানে। হামিদের ধারণা সেখানে সে মাত্র কয়েক ঘন্টা ছিল।

মেয়েটার নাম সে জানে না, তবে সে নাকি প্রায়ই আসে হামিদের কাছে – নির্জন ছাদে, চিলেকোঠার ঘরে, বর্ষার রাতে কাঁথার ভেতর – হঠাৎ করেই উদয় হয় গল্প কিংবা খেলা করার জন্য, অথবা চুপচাপ শুধু পাশে বসে থাকতে।

পরদিন সকালে এক হুজুর এলেন হামিদদের বাসায়। তিনি একতলা, দোতলা, ছাদ, উঠান, জাম গাছ, সব তন্ন তন্ন করে কি যেন খুঁজলেন। তারপর হামিদকে ডেকে বললেন, সবার সাথে বন্ধুত্ব করা যায়না। উনি দোয়া পড়লেন, জাফরানের রং দিয়ে সাদা প্লেটে দোয়া লিখে দিলেন ধুয়ে খাবার জন্য, গায়ের ওপর লেবু কাটলেন, জোয়ার ভাটার পানি খেতে দিলেন, আর গোসল করতে বললেন সেই পানি মিশিয়ে। যাবার আগে বিচিত্র সব নিয়মে কালাম পড়ে, দেয়ালগুলোতে পিন মেরে আর পানি ছিটিয়ে ছাদসহ পুরো বাড়ি ‘বন্ধ’ করলেন, এমনকি মোটা একটা তাবিজও দিলেন।

স্কুলে হামিদের প্রিয় বিষয় ছিল বিজ্ঞান, অংকেও সে ক্লাসে বেশি নাম্বার পেত সবসময় – তাবিজ-কবজ বিষয়ক বিচিত্র এইসব কর্মকান্ডের কার্য-কারণ বোঝার মত বুদ্ধি তার ছিল না। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, ঐদিনের পর থেকে মেয়েটা কখনো আর তার কাছে আসেনি। কতদিন হামিদ ছাদে বসে থেকে ভেবেছে, এই বুঝি মেয়েটা আসবে। অথবা গভীর রাতে ঘুম না এলে মনে মনে ওর কথা ভেবেছে, কিন্তু সে আসেনি। অন্তত ওই বয়সটাতে সে হামিদের কাছে আর ঘেঁষতেই পারে নি।

এরপর অনেকদিন চলে গেছে। হুজুরের দেয়া সেই দোয়া-তাবিজ কবে হারিয়ে গেছে, হামিদের মনেও নেই। তবে সেগুলো হারিয়ে গেলেও হামিদের অপার্থিব বান্ধবী তাকে আর দেখা দেয় নি। হামিদও ততদিনে ওসব ঘটনাকে ছোটবেলার কল্পনা বলে ভাবতে শিখেছে।

হামিদের তখন মেট্রিক পরীক্ষা শেষ। বন্ধু মুরাদের সাথে তার বোনের বিয়ে খেতে সে কিশোরগঞ্জ গেছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান গভীর রাত পর্যন্ত হয়েছে। তারপর শেষরাত্রের দিকে একেকজন একেক ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। হামিদের জায়গা হয়েছে ছেলেদের সাথে মূল উঠান থেকে একটু দূরে বাইরের ঘরে। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন হামিদের টয়লেটে যাওয়ার দরকার হল।

প্রচন্ড চাপ এসেছে, কিন্তু টয়লেট ঘর থেকে অনেক দূরে। এতো রাতে অন্ধকার রাস্তা ধরে অতদূর যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মুরাদ বললো উঠানের পাশে গিয়ে কাজ সেরে আসতে, কিন্তু অন্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা হামিদের কিছুতেই অস্বস্তিটা কাটছিল না। কিন্তু একসময় হামিদকে হার মানতে হলো, সে মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে গুটি গুটি পায়ে টিনের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল।

বাইরে চৈত্র মাসের হালকা বাতাস, গায়ে একটা চাদর দিয়ে আসা উচিত ছিল। সে যতদূর সম্ভব দরজা থেকে আড়ালে যাবার চেষ্টা করল – বিয়ে বাড়ি, বলা যায় না কে কখন কোন দিক দিয়ে উঁকি মারছে।

হামিদের বেশ সময় লাগল কাজ শেষ করতে, যেন পুরো পাঁচ-সাত মিনিট ওখানে দাঁড়ানো, আসলে কিন্ত দুই-এক মিনিটের বেশি সময় যায় নি, তবে সে বেশ আরাম পেল কাজটা করে। সারারাত এটা চেপে বসে থাকাটা খুবই ভুল কাজ হত। প্যান্টের জিপার লাগাতে লাগাতে সে আবার চারিদিকে তাকাল – কেউ দেখে ফেলল কিনা। আর তখনি ওই দুজনকে সে দেখতে পেল।

দশ-বারো ফুট দূরে আম গাছটার নিচে বিশ-পঁচিশ বছরের সুন্দর একটা মেয়ে আর কুৎসিত চেহারার একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়ানো। এরা দুজন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কোন হাসি নেই। মেয়েটা প্রাচীন ফ্যাশনের জরিদার একটা পোশাক পরা, আর লোকটা শরীরের তুলনায় বড় আলখাল্লা পড়া। দৃশ্যটার মধ্যে কোথাও একটা সমস্যা ছিল, কিন্তু সেটা নিয়ে হামিদের ভাবার সময় ছিল না। সে ওদের না দেখার ভান করে ঘরের দিকে হাটা শুরু করল।

কিন্তু সে লক্ষ্য করল ওরা দুজন ওর পেছন পেছন আসতে শুরু করেছে – নীরবে। হামিদ নিজেও জানে না কখন সে দৌড়াতে শুরু করেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে একবার সে পেছনে ফিরে দেখল, ওই দুজন শান্তভাবেই হেটে ওর দিকে আসছে, তবু কেমন করে যেন হামিদ আর ওদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে।

হামিদের মনে আছে সে ঘরের বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছেছিল, তারপর আর কিছু মনে নেই। মুরাদ বলেছিল ওরা একটা আওয়াজ শুনে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে হামিদ দরজার কাছে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে।

বোধ হয় কিছু দেখে ভয় পেয়েছে – সকাল হলে পর বাড়ির লোকজন বলছিল। মুরাদের দাদি বলল – আমগাছে জীন আছে। সবাই সেটা নিয়ে একদফা হাসাহাসিও করল। তখন হামিদের মনে পড়ল কোন জিনিসটা ওর কাছে অস্বাভাবিক লেগেছিল – ওই দুই অজানা জিনিস যখন গাছটার নিচে দাঁড়ানো ছিল, ওদের দুজনের মাথায় গাছের ওপরের ডালটা ছুঁই ছুঁই করছিল – তার মানে ওই দুজন কমপক্ষে দশ থেকে বারো ফুট উচ্চতার কোন ধরণের মানুষ ছিল !

সেইদিন দুপুরের দিকে হামিদের ভীষণ জ্বর আসে। উথাল-পাথাল জ্বর। শরীরের তাপমাত্রা একশো চার আর একশো ছয়ের মধ্যে ওঠা-নামা করতে থাকে। মুরাদের দাদি তার মাথায় পট্টি লাগান আর পানি ঢালতে থাকেন। পুরো তিন দিন অবস্থা এরকম থাকে। এর মধ্যে বিয়ে আর বৌভাত শেষ হয়ে যায়। মুরাদের বোনের যে বিয়ে খেতে এতদূর যাওয়া, সে অনুষ্ঠান হামিদের আর উপভোগ করা হয়ে ওঠে না সেবার।

বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর হামিদ দেখে বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে। মজিদ সরকার চিন্তাও করতে পারে না যে ছেলে শুধু মাকে বলেই অন্য কোন জেলায় বিয়ে খেতে চলে গিয়েছিল। কলেজে না উঠতেই যদি এভাবে ছেলের পাখা গজায়, তাহলে ভার্সিটিতে গেলে বাবা-মাকে তো গোনাতেই ধরবে না। সরকার সাহেব ছেলেকে চিলেকোঠার ঘরে আটকে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিলেন, পুরো এক রাত সে এভাবে কাটাবে। এতে যদি তার কিছুটা বোধোদয় হয়।

ছাদের পাশের সে ঘরে কোনো আলো ছিল না, গভীর রাতে জানলা দিয়ে হামিদকে টয়লেটের কাজ করতে হয়েছিল। সে রাতে অন্ধকারে প্রচন্ড ভয় পায় হামিদ, ভয় পেতে পেতেই একসময় ঘুমিয়ে যায়, আর তখনি সে একটা স্বপ্ন দেখে।

সে দেখে যে একটা মেয়ে ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। ঘরের ভেতর চাঁদের আলোয় ওকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা শ্যামলা, মুখ লম্বাটে, চোখ টানা টানা – বড় বড় পাপড়ি আর প্রখর দৃষ্টি সেই চোখে। মুখের দুপাশে লুকানো দুটা বাড়তি দাঁত আছে, হাসলে বোঝা যায়, কিন্তু ওটাতে যেন ওর সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে। ও বলল – ‘ভয় পেয়ো না হামিদ, আমরা ছোটবেলায় একসাথে কত খেলা করেছি!’

হামিদ ওকে চিনতে পারল, স্বপ্নের ভেতরই বলল – ‘তোমাকে না ওরা তাবিজ দিয়ে আটকে দিয়েছে?’

সে হেসে বলল – ‘আমি এখন থেকে স্বপ্নে তোমার কাছে আসতে পারব।’

মেয়েটা ওর হাত ধরল, হামিদ অনুভব করল নরম তুলতুলে একটা রোমশ হাত। ঘুমটা তখনি ভেঙে গেল, আর হামিদের আফসোস হতে থাকল যে স্বপ্নটা কেন আরো দীর্ঘ হল না।

অবশ্য সে রাতের পর থেকে হামিদ এই মেয়েটাকে আবারো স্বপ্নে দেখতে পায়, বারবারই দেখতে পায়। প্রথম প্রথম সে চেনা-জানা মেয়েদের সাথে ওর মিল খোঁজার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাস্তবে এই চেহারার কোনো মেয়েকেই সে আসলে কোনদিন দেখে নি। হামিদ ওর নাম জানত না, স্বপ্নে মেয়েটা শুধু ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলত। হামিদ অনেক ভেবে-চিন্তে ওর নাম দিয়েছিল মায়া।

মায়াকে সে স্বপ্নগুলোতে নানা অবস্থায় পেয়েছে। স্বপ্নে দেখা নাম না জানা এই রহস্যময়ীর সাথে ওর একেক রাতে একেক ধরণের পরিবেশে সময় কাটত – স্বপ্নের আবছায়া ওই জগতে। কখনো ওরা চলে যেত তেপান্তরের এক মাঠে, শূন্য সেই মাঠে শুধু ওরা দুজন হাতে হাত ধরে হাটতে থাকত, অনন্তকাল ধরে যেন। কখনো মেয়েটা ওকে উড়িয়ে নিয়ে যেত অপরিচিত গাছ-পালা ভরা একটা বাগানে, খেতে দিত অদ্ভুত কিছু ফল যা কোন মানুষ কোনোদিন চোখে দেখেনি, যার স্বাদ কখনো কোনো লোক জানে নি।

কখনো আবার হামিদ দেখত যে মেয়েটা ওর চিলেকোঠার নির্জন ঘরটাতেই চলে এসেছে, কাঁথার ভেতর ঢুকে কাতুকুতু দিচ্ছে ওকে, কিছুটা রোমশ হাতে। সে এমন সব পোশাক পড়ত – সোনালী কিংবা রুপালি রঙের – হাল-ফ্যাশনের সাথে যার কোনো মিল নেই, কিন্তু তবুও তাকে সেসব পোশাকে অপরূপ রূপসী মনে হত। কখনো সে দেখা করতে আসত কোনো পোশাক ছাড়াই।

কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। তবে সে যে স্বপ্নগুলোকে উপভোগ করত, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্যি কথা বলতে কি, চিলেকোঠার আলো-আঁধারি ঘেরা স্যাঁতস্যাতে ছোট ঘরটাতে ঠিক ঘুমাতে যাবার আগের সময়টায় সে সচেতনভাবেই চেষ্টা করত বেশি করে মেয়েটার কথা কল্পনা করতে, যদি আবার তাকে স্বপ্নে দেখা যায়। তার সে চেষ্টা কখনো কখনো সফল হত, কখনো কখনো বিফল, কিন্তু সে হাল ছাড়তো না।

ওই বয়সে হামিদ ছিল মাঝারি উচ্চতার সাধারণ একটা ছেলে। সিঁথি করা কালো চুলে তাকে বোকা বোকা দেখাতো। ওর তেমন কোনো বন্ধু ছিল না, বান্ধবী তো দূরের কথা। তার অবসর পুরোটাই কাটত নানান রকম গল্পের বই পড়ে আর তার ছোট খাটটাতে শুয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে আকাশ-কুসুম কল্পনা করে। স্বপ্নের ভেতর এরকম এক প্রেমিকার দেখা পাওয়া তার কাছে ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই বিস্ময়কর, আনন্দের – আর সেজন্য সে এসব স্বপ্নের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করার চেষ্টা করত, আর সকালে ঘুম থেকে উঠে ডাইরিতে লিখে রাখত স্বপ্নের খুঁটিনাটি।

মায়া ছাড়া আরেকটি বিষয়ে হামিদের আগ্রহ ছিল, যদিও এটা ওর বাসার কেউ কোনদিন টের পায় নি। সে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের দেখতে পছন্দ করত, বিশেষ করে পাশের বাসার শিউলি আপাকে। শিউলি কখন গোসল করতে যায়, কোন সানশেডের ওপর থেকে বাথরুমের ভেতরটা দেখতে সুবিধা হয় – এসব তার নখদর্পনে ছিল। মেয়েটার ছাদে শুকাতে দেয়া পাজামা আর অন্তর্বাসের দিকে তাকিয়ে থেকে সে দুপুরের পর দুপুর কাটিয়ে দিতে পারত। রাতের বেলা মায়ার স্বপ্ন, আর দিনের বেলা শিউলি আপার শরীরের নেশা – এই নিয়ে হামিদের দিন দ্রুতই কেটে যাচ্ছিল।

হামিদ এটাও জানত যে শিউলি আপা সন্ধ্যার সময় লুকিয়ে প্রেম করে বাশার স্যারের সাথে – স্যার যখন তাকে প্রাইভেট পড়াতে আসে তখন। একবার আপত্তিকর অবস্থায় তাদের সে দেখেও ফেলেছিল। হামিদের পরিকল্পনা ছিল সেটার কথা বলে শিউলিকে ভয় দেখানো। সে নিশ্চিত ছিল এরকম ভয় দেখালে সে হয়তো হামিদকে তার বিশেষ কিছু মুহূর্ত দেখতে দেবে। হামিদের বেশি আগ্রহ ছিল কাপড় বদলানোর বা গোসল করার অথবা পারলে দুটোরই দৃশ্য নিজ চোখে দেখা।

হামিদের সেই পরিকল্পনা অবশ্য বিফল হয়ে যায় – দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যক্রমে। এক বর্ষার রাতে ম্যালেরিয়া হয়ে শিউলি মারা যায়। হামিদ বড় রকম একটা ধাক্কা খেয়ে এদিক-ওদিক উদ্দেশ্যহীন ঘোরা-ফেরা করে সময় কাটায়। কিন্তু এই পুরো সময়টাতেই মায়া নিয়মিত ওর স্বপ্নে আবির্ভাব হত, কখনো মানুষ, কখনো পরী, কখনো বা মৎস্যকন্যা হয়ে।

সে সময় খুব ব্যতিক্রমী কয়েকটা রাতে সে মায়াকে কালো শাড়ির মতো একটা কাপড়ে দেখতে পেয়েছিল। আর সে স্বপ্ন গুলোতে মেয়েটার সাথে গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো থাকত খাটো করে একটা লোক, বয়স্ক, সামনের একটা দাঁত নেই, শরীরের তুলনায় বড় ঢিলে কাপড় পড়া। এই লোকটার চোখ দুটো রক্ত লাল দেখাত, আর হামিদের দিকে লোকটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। সেই রাতগুলোতে মেয়েটা কিছুতেই হামিদের কাছে আসতে পারত না, দূর থেকে করুণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকত।

ওই লোকটাকে যেদিনই হামিদ স্বপ্নে দেখত তার পরদিনটা তার খারাপ যেত। ঘুম থেকে উঠে মেজাজ খিঁচে থাকত রাতে মায়ার সাথে সময় কাটাতে পারে নি বলে, স্বপ্নে তাকে কাছে পায় নি বলে। তার ওপর আবার সারাদিন হামিদের ভয়াবহ মাথা ব্যথা থাকত।

এরকম এক দিনেই হামিদ একটা কান্ড ঘটিয়েছিল। সকাল থেকে তার বার বার মনে হচ্ছিল যে মানিব্যাগে দুইশ টাকা রেখেছিল, আর এখন সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্দেহটা কাজের ছেলে বিলালের ওপর গিয়ে পড়াতে সে তাকে জেরা করা শুরু করল। ছেলে যতই অস্বীকার করে, হামিদের জেদ ততই বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সে বিলালকে মারতে শুরু করে। মার তো মার, লাগামছাড়া মার – পিটানোর একপর্যায়ে ছেলেটার ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। হামিদের মা এসে বিলালকে না ধরলে ছেলেটা সেদিন মরেই যেত।

দুপুরবেলা ভাত ঘুম দিতে গিয়ে হামিদ অবশ্য টাকাটা খুঁজে পেয়েছিল – বালিশের নিচে। কিন্তু সেটা স্বীকার করার মত মুখ তখন আর তার ছিল না। বিকালে যখন এটা নিয়ে বিচার বসল, তখন হামিদ আবার বলল যে তার মানিব্যাগে একশো টাকার দুইটা নোট ছিল, আর সকালে বিলাল ছাড়া কেউ ঘরে ঢোকে নি। হামিদের বাবা অর্থাৎ সরকার সাহেব ছেলের কথার ওপর ভিত্তি করে বিলালকে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে দিলেন। হামিদ নিজের ঘরে ফিরে এসে টাকাটা একটা মোটা বইয়ের ভেতর রেখে দিল।

মেজাজের সমস্যাটা হামিদের মূলত সেই সময় থেকেই। এরপর সেটা কখনো বেড়েছে, কখনো সীমার মধ্যে থেকেছে, কিন্তু রাগের এই বিষয়টা কখনোই তাকে একেবারে ছেড়ে যায় নি।

হামিদ যখন ইউনিভার্সিটিতে ঢোকে, কিছু বন্ধু-বান্ধবের সাথে পরিচয় আর সম্পর্ক হয়, তখন রাতের বেলা সেসব স্বপ্নের আনাগোনা ওর কমে আসে। তারপর একসময় সে ভার্সিটি পাশ করে, ছোট-খাটো একটা চাকরিতে ঢোকে, এমনকি বেলা নামের চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়েও করে।

একসময় হামিদ তার সদ্য কৈশোরের সেই স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার কথা একদমই ভুলে যায়। বরং মাঝে-মধ্যে ওই কুৎসিত লোকটাকে সে স্বপ্নে দেখত। আর তারপরের দিন যথারীতি তার মেজাজ অসম্ভব খারাপ হয়ে থাকত।

বেলা ছিল ছোট-খাটো মিষ্টি চেহারার একটা শান্ত মেয়ে। অবসর পেলেই ওরা বেড়াতে চলে যেত কক্সবাজার, কিংবা শ্রীমঙ্গলে, কখনো বা বেলাদের গ্রামের বাড়িতে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় শায়ান জন্ম নেয়। ছেলেটা ছিল দেখতে ঠিক বেলার মতো, কিন্তু স্বভাবটা যেন হামিদেরই।

এভাবে বেলা আর হামিদের দিনকাল ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনেই কখনো না কখনো কঠিন সময় আসে, হামিদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। শায়ানের বয়স যখন চার বছর, সেই সময়টাতে হামিদের জীবনে রাগ হয়ে যাবার সমস্যাটা আবার শুরু হয়। সে অল্পতেই রেগে যেত, আর একবার রাগ উঠে গেলে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।

এই যেমন হয়তো রিক্সাওয়ালা ভাংতি নিয়ে ঝামেলা করল আর অমনি ওর মাথায় রক্ত চড়ে গেলো, পারলে রিক্সাওয়ালাকে পেটাতে যায়। একবার বেলাদের দিকের কোনো আত্মীয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে তার এক শালা তার সাথে মস্করা করে কিছু বলল, আর সে রেগে গিয়ে সবার সামনেই বেচারার কলার চেপে ধরল। বেলা সে রাতে ভীষণ বিব্রত হয়, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না কিভাবে সে হামিদকে সাহায্য করতে পারে।

এরই মধ্যে একদিন হামিদ শায়ানকে চড় মেরে বসল। বাচ্চাটার ওপর সেদিন ওর রাগের কারণটা কিন্তু ছিল সামান্যই – ছেলেটা তার হিসাবের খাতায় আঁকাআঁকি করে খাতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেটাতেই হামিদ এতো রেগে যায় যে ওকে বেশ জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসে – এত জোরে যে শায়ানের মাথা গিয়ে দেয়ালে বাড়ি লাগে, মাথা ফেটে যায়।

হতভম্ব হামিদকে বাসায় রেখে বেলা একটা রিক্সা নিয়ে শায়ানকে কাছাকাছি একটা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। মাথার একপাশের চুল চেঁছে ফেলে ডাক্তাররা তিনটা সেলাই করে দেয়, তারপর বেলাকে আশ্বস্ত করে বলে যে ভয়ের কোন কারণ নেই।

বেলা এ পর্যন্ত হামিদের এসব অনেক সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলের রক্ত দেখে তার সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ক্লিনিক থেকে বাসায় না ফিরে সে সায়ানকে নিয়ে এক কাপড়ে চলে যায় মিরপুরে ওর বাবার বাসায়।

এর একমাসের মধ্যে হামিদ বেলার কাছ থেকে একটা উকিল নোটিশ পায়। বেলা ওর নামে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেছে। হামিদ বুঝতে পারে, বেলা সম্ভবত বিবাহ বিচ্ছেদেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

মার্চ মাসের শেষ দিকে আদালতে মামলার প্রথম শুনানি হয়। হামিদ সেদিন আদালতে শায়ানের সাথে তার নানা সুন্দর মুহূর্তের ফটোগ্রাফ জমা দেয়। ওর পক্ষের উকিল বলে যে – হামিদ ভুল করেছে, কিন্তু ছেলের প্রতি তার মমতা প্রশ্নাতীত। উকিল একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও জমা দেয় আদালতে, যেটার মধ্যে বিস্তারিতভাবে বলা আছে হামিদ কিভাবে নিজেকে সংশোধন করবে।

এই সংশোধন পরিকল্পনাটাই সম্ভবত হামিদকে সেসময় জেল-জরিমানার হাত থেকে আপাতত বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তবে শর্ত ছিল যে, উল্লেখযোগ্য উন্নতি না করা পর্যন্ত সে শায়ান কিংবা বেলার ত্রিসীমানায় যেতে পারবে না। পরিকল্পনার মূল অংশ ছিল একজন নামি মনোবিশারদের তত্বাবধানে এক বছর পার করা আর বছর শেষে একটা পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করা যে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

গিয়াস মামা মৌলানা ধরণের মানুষ, কাঁচা-পাকা দাড়ি তার মুখে, পাড়ার স্কুলের হেডমাস্টারদের মতো কালো চশমা পরেন। গত পনোরো বছর ধরে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছেন প্রতি রাতে, সারাক্ষন ওযুর ওপর থাকেন তিনি, পাঞ্জাবির পকেটে মানিব্যাগের পাশাপাশি বহন করেন মিসওয়াক। আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ বহু লোকজনের সাথে তার চেনা-জানা আর উঠা-বসা আছে।

ধর্মের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ না হলেও হামিদের ঘটনাপ্রবাহ থেকে তিনি আঁচ করে নিয়েছিলেন যে তার ভাগ্নের এই সমস্যাটার সাথে অতিপ্রাকৃত কোনো কারণ জড়িত আছে, সুতরাং এর চিকিৎসাটাও হতে হবে আধ্যাত্মিক ধরণের।

গিয়াস মামা বেশ কয়েকদিন এ নিয়ে কথা বললেন হামিদের সাথে – কখনো বাসায় এসে, কখনো বা টেলিফোনে। অনেক বোঝানো-শোনানোর পর হামিদ রাজি হল মামার কথায়, মামা তাকে এক কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেন। আব্দুর রহমান শরীয়তপুরী একজন বৃদ্ধ মানুষ, বয়স প্রায় আশি – কথা বলার সময় বেশ কাশেন। শুকনো ছোট-খাটো শরীর আর সাদা দাড়িতে তাকে সাধারণ একজন মুরুব্বি ছাড়া আর কিছু মনে হল না হামিদের। কিন্তু মামা জানালেন উনি খুবই আল্লাহওয়ালা লোক, এবং মানুষের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে উনি সঠিক মারফতি সমাধান দিতে সক্ষম। কিছু খাদেম তার পা টিপছিল।

বৃদ্ধ কবিরাজ কিছুক্ষণ দোয়া-দরূদ আর ঝাড়ফুঁক করে হামিদকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোন ভৌতিক স্বপ্ন দেখে কিনা। হামিদ বলল যে – হ্যাঁ, সে মাঝেমধ্যে এরকম দু:স্বপ্ন দেখে।

কবিরাজ ভদ্রলোক অনেকক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকলেন। হামিদ যখন ভাবতে শুরু করেছে যে তিনি ঘুমিয়ে গেছেন, তখনি তিনি চোখ খুললেন, সরাসরি তাকালেন হামিদের চোখে। ছানি পড়া ঘোলাটে চোখে তিনি বললেন – ‘ঈমাম গাজ্জালী সাহেব বলছিলেন – শরীরের চাহিদা হইল শুকরের মতন একটা জন্তু আর মনের রাগ হইল কুকুরের মতন অরেকটা জন্তু। আপনের যদি বুদ্ধি থাকত, তাইলে একটারে আরেকটার পেছনে লাগায়ে দিয়ে ব্যস্ত রাখতেন, নিজে ভালো থাকতে পারতেন। আর আপনে দেখি, বাবা, দুইটারেই কোলে নিয়ে পালতেছেন।’

বলে বৃদ্ধ মৃদু হাসতে লাগলেন। হামিদ কেন চোখ সরিয়ে নিল তা সে নিজেও জানে না।

‘আপনে এইটা নিয়ে একটু চিন্তা-ফিকির কইরেন। আমরা তরিকা জানি, কিন্তু কাজ আপনেরেই শুরু করতে হবে, বাবা।’

আব্দুর রহমান সাহেব শেষে একজন খাদেমের কানে কি যেন বললেন। খাদেম জানাল – হামিদের ওপর নাকি জীনের আসর আছে। কবে এবং কোথা থেকে সে জীন তার কাছে এসেছে সেটাও নাকি কবিরাজ বলে দিয়েছেন – বাইশ বছর সাত মাস সতর দিন আগে খানকান্দি নামে এক গ্রামে এই জীনটা নাকি তাকে নজর দিয়েছিল।

হামিদ অবাক হল – এতো বিস্তারিত বর্ণনা কবিরাজ দিতে পারবেন বলে তার ধারণা ছিল না। ফেরার পথে মামা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, খানকান্দি নামে কোন জায়গায় সে কখনো গিয়েছিল কিনা। হামিদ প্রথমে উত্তর না দেয়াতে মামা তাকে আবারো একই প্রশ্ন করেন। তখন হামিদ বলে যে – হ্যাঁ, মেট্রিক পরীক্ষার পর স্কুলের এক বন্ধুর সাথে সে ওই নামে একটা গ্রামে গিয়েছিল, বিয়ে খেতে।

‘সেটা কি বাইশ বছর আগে?’ – মামা জানতে চান।

‘এরকমই হবে।’ – হামিদ অন্যমনস্কভাবে বলে। কিন্তু সে মনে মনে এরমধ্যেই হিসাব করে ফেলেছে, ঠিক বাইশ বছর সাত মাস আগেই সে ওই জায়গাটায় গিয়েছিল।

মামা গম্ভীর হয়ে ছিলেন, এদিকে হামিদ কিছুতেই স্বীকার করলনা যে এটা জীনের আসর হতে পারে। সে আধুনিক মানুষ, জীন-ভূতে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। কবিরাজ সাহেবকে নিয়ে সে একটু হাসাহাসিও করল, মামা তাতে আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন।

হামিদ অবশ্য তার সমস্যাটির ব্যাপারে চেষ্টা ছাড়া বসে থাকল না। সে শহরের একজন নামকরা মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হল। প্রথম সেশনে ডক্টর রয় হামিদের সব কথা শুনলেন, তারপর ভালো করে চিন্তা করে ওকে হিপনোটিক সাজেশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি হামিদকে সমস্যাটির আগাগোড়া চমৎকারভাবে বুঝিয়ে বললেন।

ডক্টর রয় হামিদকে শেখালেন যে মনের দুইটি স্তর আছে – সচেতন স্তরটি আমাদের পরিচিত মন যা আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ব্যবহার করি, অন্যদিকে অবচেতন স্তরটি আমাদের স্বাভাবিক আয়ত্ত্বের বাইরে। যেহেতু রাগ, প্রেম, ভয় এসব অবচেতন মনের বিষয়, সুতরাং হামিদের ক্রোধ কমাতে হবে অবচেতন মনের ভেতর প্রবেশ করে। আর অবচেতন মনে প্রবেশ করার একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি হচ্ছে এই সম্মোহন।

বোঝানো শেষ করে ভদ্রলোক হামিদকে আরাম করে বসতে বললেন, দশ-পনর মিনিটের জন্য পৃথিবীর কথা ভুলে যেতে বললেন। উনার কণ্ঠ নরম হয়ে আসছিল। হামিদকে সম্মোহিত করে ডক্টর রয় বললেন – ‘এখন একটা ঘর কল্পনা করুন, শূণ্য ঘর। এ পৃথিবীতে আছেন শুধু আপনি, আর আপনার এই ঘর। এটাই আপনার মনের ঘর।’

বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর হামিদ সেটা কল্পণা করতে পারল। একটা সাজানো-গোছানো ড্রইং রুম – মাঝখানে একটা সাদা ডাবল সোফা, একপাশে বইয়ের লাইব্রেরি, অন্যপাশে শোকেস। হামিদ তার মনের ঘর দেখে সত্যিই খুব শান্তি অনুভব করল। রয় বললেন এটা তার সচেতন মন।

ডক্টর রয় তাকে একটা সাদা রং করা দরজা খুঁজতে বললেন, হামিদ তার কল্পনার ভেতর ডানদিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে একটা দরজা আছে। রয়ের সাজেশন অনুযায়ী দরজাটা খুলতেই সে দেখতে পেল, বরাবর একটা সিড়ি নেমে গেছে নিচে। নিচে অন্ধকার, কিন্তু সিড়ির ওপরের ধাপগুলো দেখা যাচ্ছে।

রয় তার কণ্ঠস্বর প্রায় খাদে নামিয়ে সাজেশন দিয়ে যাচ্ছিলেন – ‘নিচের ঘরটা অন্ধকার, কারণ ওটা আপনার অবচেতন মন। মনের এই ঘরের কাজকর্ম ঘটে আপনার অজান্তে . . . . . . ওই ঘরে কি হচ্ছে জানতে চান? তাহলে সিড়ি গুনে গুনে নেমে যান। চলুন না, ঘুরে আসি সেই ঘরে। আচ্ছা, মোমবাতিটা নিয়ে যাবেন সাথে করে, কারণ ও ঘরটা চির অন্ধকার।‘

এবার রয় সাজেশন দিলেন সে যেন সিঁড়িটার ধাপ গুনে গুনে নিচের ঘরে নেমে যায়। হামিদ সেটাই করল, তীব্র কৌতূহল নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকল নিচের সে রহস্যময় ঘরটায়। এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনতে গুনতে হামিদ দেখল সে আসলেও নতুন একটা ঘরে চলে এসেছে। এ ঘরটা ওপরের ঘরটার মতই, কিন্তু মোমের আলোয় সে দেখল এ ঘরের দেয়ালের রংটা গোলাপী।

মনের এই নিচের ঘরে হামিদ ডাক্তারের কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন সে যেন ওই ঘরের দেয়ালে বড় বড় করে “রাগ” শব্দটি লেখে, তারপর আবার সেই শব্দটির ওপরই ক্রসচিহ্ন দিয়ে দেয়। হামিদ ঠিক ঠিক যখন সাজেশন অনুসরণ করলো, তখন রয় তাকে সিঁড়ি উল্টো গুনে গুনে উপরে উঠে আসতে বললেন। এভাবে সচেতন মনের ড্রইং রুমে উঠে আসা মাত্রই রয় তার নাম ধরে ডাকলেন আর সাথে সাথে হামিদের সম্মোহন ভেঙে গেল।

হামিদ চোখ খুলে দেখল, সে রয়ের চেম্বারের সেই আধো-অন্ধকার ঘরটাতেই বসে আছে। আশ্চর্য সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা – হামিদ ভাবল।

‘কেমন লাগল, নিজের মনের ঘর দেখতে? অবচেতন মনটা কেমন যেন রহস্যময়, তাই না? – উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন রয়।

হামিদ মাথা নাড়ল, তারপর কি মনে হতেই তাড়াতাড়ি বলল – ‘আচ্ছা, অবচেতন মনের ভেতর আমি যেন একটা ছায়া দেখলাম। এটা কি, ডাক্তার সাহেব?’

‘ছায়া?’

‘হ্যাঁ, যেন অন্য কেউ আছে ওখানে, আমি বাদে অন্য কেউ?’

রয় ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন – ‘এরকম তো হবার কথা না।‘

‘মানে? এরকম হবার কথা না কেন?’

‘কারণ’ – রয় বোঝানোর ভংগীতে বললেন – ‘আপনার মনের অবচেতনে আপনি ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই, এমনকি জেগে থাকা অবস্থায় আপনার নিজেরও সেখানে ঢোকার শক্তি থাকে না।‘

‘তাহলে ছায়াটা কার?’

রয় চুপ করে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন – ‘আপনি ঠিক কি দেখেছেন সেটা জানতে হবে, অবচেতন মন রহস্যময় জায়গা তো, খুব ভালোভাবে না জেনে কিছু বলা সম্ভব না।‘

হামিদ চুপচাপ কথাটা শুনল – সম্মোহনের ঘোর যেন তার পুরোপুরি কাটেনি তখনো। হামিদ সেদিনের মত চলে এলো, কিন্তু তার মনে আশ্চর্য এক স্বপ্নের মত জেগে রইল সে সন্ধ্যার কথা।

এরপর দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ চলে গেছে। হামিদ এরমধ্যে মজার একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে – যখনই কোন কারণে তার রাগ ওঠে, তখনই কোথা থেকে চোখের সামনে একটা ক্রশচিহ্ন ভেসে ওঠে, আর ওমনি তার রাগ পানি হয়ে যায়।

একদিন পাঁচশ টাকার একটা নোটের ভাংতি চাইতেই এক দোকানদার তার সাথে খুব বাজে একটা প্রতিক্রিয়া দেখাল। অন্য কোন সময় হলে তার মাথায় রক্ত উঠে যেত, সেদিন সে শান্তভাবে লোকটাকে শুধু বলল – ‘এত কথা না বলে শুধু বলবেন – ভাংতি নেই, এতে আপনারই কষ্ট কম হবে।’ নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ দেখে হামিদ সেদিন বেশ অবাকই হল।

এরমধ্যে একদিন গিয়াস মামা এলেন হামিদের বাসায়। সেই বৃদ্ধ কবিরাজ নাকি তার কথা জানতে চেয়েছে মামার কাছে। হামিদ বলল, সে ডাক্তার দেখাচ্ছে।

‘ডাক্তার দেখাও, বাবা। কিন্তু পাশাপাশি এই চিকিৎসাটাও কর, এতে ক্ষতির কিছু নেই।‘ – মামা বললেন।

হামিদ হাসল।

‘জানি, তুমি এগুলি মানতে চাও না। কিন্তু এগুলি আছে, আর হুজুর সেটা জানতে পেরেছেন। শোনো, তোমার ওপর যে নজরটা পড়েছে সেটা খুব খারাপ ধরণের। খারাপ না হলে উনি আলাদা করে তোমার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন না – কত লোক আসে উনার কাছে ! তুমি এটা অবহেলা কোরো না।‘ – মামা মনে করিয়ে দিলেন।

হামিদ মাথা নাড়ল।

‘আমি এই দোয়াটা এনেছি। তুমি এটা সবসময় তোমার কাছে রাখবে। এটা কিন্তু খ্বুই গুরুত্বপূর্ণ, বুঝলে বাবা?’ – গিয়াস মামা হিজিবিজি লেখা একটা কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিলেন।

হামিদ কাগজটা নিল, তারপর মানিব্যাগে সেটা ভরে রাখল। মামা চলে গেলেন।

দ্বিতীয়বার হামিদ যখন ডক্টর রয়ের কাছে গেল, রয় তাকে একইভাবে সম্মোহিত করলেন। সম্মোহনের মাধ্যমে সে তার অবচেতন মনের ঘরে ঢুকল, তখন রয় তাকে সাজেশন দিলেন যে রাগের সময় সে শান্ত থাকবে। তারপর যথানিয়মে হামিদকে তিনি বের করে আনলেন মোহাবস্থা থেকে। হামিদ একসময় সম্মোহন থেকে জেগে উঠল বাস্তবতায়।

‘এভাবে আপনাকে নিয়মিত করতে হবে, যেন আপনার অবচেতনে সাজেশনটা স্থায়ী হয়ে যায়, বুঝলেন?’ – রয় হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকালেন।

কিন্তু হামিদকে একটু অন্যমনস্ক মনে হল। সে চিন্তিত মুখে বলল – ‘আজও দেখেছি।‘

‘কি দেখেছেন আজও?’

‘ছায়া, আজকে মনে হয় ছায়ার মালিককেও দেখলাম।’ – হামিদ বলে।

‘ছায়ার মালিক মানে?’

‘সেদিন যার ছায়া দেখেছিলাম অবচেতন মনের ঘরটায়। এটা একটা মেয়ের ছায়া।‘

‘ইন্টারেস্টিং’ – রয় তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন – ‘এরকম তো শুনিনি কখনো। আপনার পরিচিত কারো সাথে মিল আছে তার চেহারার? আপনার অতীত জীবনের কোন প্রেম?’

হামিদ মেয়েটাকে চিনতে পেরেছে – এটাই সেই মায়া, যাকে সে বারবার স্বপ্নে দেখতো কৈশোরে আর যৌবনে। কিন্তু সেই কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না, বরং তাকে পাগল ভাববে। তাই উত্তরে হামিদ বলল সে জীবনে এ চেহারা দেখেনি, কিন্তু সে এটাও বলল যে মেয়েটা অসম্ভব রূপসী।

রয় একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেললেন – ‘সম্ভবত আপনার উইশফুল থিংকিং এটা, স্বপ্নের রাজকন্যা। তবে আপনাকে ফ্র্যাংকলি বলি, হিপনোটিক সাজেশনের সময় এরকম কোন স্বতন্ত্র এনকাউন্টারের কথা এই প্রথম শুনলাম আমি। এটা হবার কথাও নয় – কারণ হিপনোটিক সাজেশন দেবার সময় পেশেন্ট থাকে পুরোপুরি ডাক্তারের নিয়ন্ত্রণে, ডাক্তার যা বলে তাই তার কাছে সত্য বলে মনে হয়, অন্যকিছুর কথা সে তখন ভাবতে পারে না – পারলে সাজেশন দেয়া সম্ভব হতোনা, আর মনও সে সাজেশন নিত না।‘

রয় চুপ করে বসে কি যেন ভাবছিলেন, তখন হামিদ হঠাৎ কি মনে করে বললো – ‘আরেকটা জিনিস ডাক্তার সাহেব। নিচের যে ঘরটা, আধো-অন্ধকার ঘরটা, যেটা কিনা আমার অবচেতন মন, সেটার নিচে কি আরো কোনো ঘর আছে? বা কোনো সুড়ঙ্গ ধরণের কিছু?’

রয় মাথা তুলে তাকালেন – ‘মানে?’

‘আমি যখন ওই ঘরে ঢুকলাম, মেঝের নিচে আওয়াজ হচ্ছিলো। দেখলাম, মেঝেতে লাল একটা কার্পেট আর ওদিক থেকেই আওয়াজটা আসছে। কার্পেটটা সরিয়ে দেখি একটা দরজার মতো, মেঝেতে। কিন্তু ভয়ে ওটা আর আমি খুলে দেখিনি।’

‘ইন্টারেস্টিং’ – রয় বললেন – ‘কার্ল ইউং এরকম একটা ধারণা দিয়েছিলেন বহু বছর আগে। তিনি বলেছিলেন, মানুষের মনের দুটা স্তর – সচেতন মন, আর অবচেতন মন, কিন্তু সেটাই শেষ না। কিন্তু অবচেতন মনেরও নিচে প্রবাহমান আরেকটা স্তর আছে – যে স্তরে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন চিন্তা-ভাবনার তথ্যগুলো সব এক হয়ে যায়, যে স্তরে আমাদের স্বপ্ন আর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাগুলো জন্ম নেয়। অনেকে ধ্যানের মাধ্যমে সেই স্তরে গিয়েছে, এমনকি সেখানে নাকি একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগও করতে পারে – হয়তো এটাই টেলিপ্যাথির ধরণের রহস্যগুলোর আসল ব্যাখ্যা, কে জানে? একটা সম্মিলিত অবচেতন স্থান, তোমার মনের ঘরের তুলনায় এটা অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ের মতো যে পার্কিংটা অনেকগুলো ঘরের নিচে একটা উন্মুক্ত এলাকা। সে যাই হোক, ওই স্তরে যাবার স্বীকৃত কোন পদ্ধতি কিন্তু আমার জানা নেই।’

রয় কিছু বললেন না, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে হামিদের দিকে।        

১০

পরের মাসে হামিদ চিকিৎসার ফল আরো ভালোভাবে অনুভব করল। সে লক্ষ্য করল – শুধু যে তার রাগ কমে গেছে তাই না, সে উত্তেজিতও হচ্ছে খুব কম। অনুশীলনটা সম্ভবত তার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমাগত উন্নতি ঘটাচ্ছে, ফলে সব ক্ষেত্রেই তার ভালো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এরমধ্যে আরেকদিন মামার সাথে তার দেখা হল। উনি জানতে চাইলেন, সে দোয়ার কাগজটা ঠিকমত রেখেছে কিনা। হামিদ বলল – হ্যাঁ, সেটা সে সাথেই রেখেছে।

মামা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে করে বললেন – ‘শোনো, তোমার ওপর কিন্তু একটা না, অন্তত দুইটা আসর আছে – একটা জীন, আরেকটা জীন্নি। খুব সাবধান বাবা। কাগজটা অবশ্যই খুব সাবধানে রাখবে।‘

‘জীন তো বুঝলাম। জীন্নি মানে কি, মামা?’

‘জীন্নি হলো নারী জীন, এগুলি আরো বেশি ভয়ঙ্কর।‘

মামা চলে যাবার পরে হামিদ মানিব্যাগ ঘেটে দেখল, দোয়ার কাগজটা সেখানে নেই – সম্ভবত কখনো সেটা কোথাও পড়ে গেছে। তবে হামিদকে সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না – সে সম্মোহন চিকিৎসার ভেতরই তার সমস্যাটার সমাধান পেয়ে গেছে। ফলে মামার কথা আর দোয়া পড়া কাগজের ব্যাপারটা সে একসময় ভুলেই গেল।

১১

তৃতীয় মাসে হামিদ এপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী ঘড়ি ধরে কাটায় কাটায় ঠিক সময়ে রয় সাহেবের চেম্বারে গিয়ে উপস্থিত হল হিপনোটিক সাজেশন নেবার জন্য। শুরু হলো তৃতীয় সেশনের সম্মোহন পর্ব।

মোহাচ্ছন্ন একটা অবস্থায় পৌঁছে যাবার পর সে তার মনের ঘরে ঢুকল, ঢুকে ডানদিকে দরজা দেখল। সে দরজা খুলে সিড়ি বেয়ে সহজেই নেমে গেল মাটির নিচের ঘরটায়, অর্থাৎ তার অবচেতন মনে। মোমের আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পেল ঘরের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে সেই দেয়ালটা যেখানে রাগ কথাটা লিখে তার ওপর ক্রশচিহ্ন দিয়েছিল সে নিজে। সে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সম্মোহনের ব্যাপারটায়, ফলে এসব ঘটল খুব সহজে আর খুব দ্রুত। সবশেষে সে ঘরের মাঝখানে গিয়ে বসল, সেখানে সে অপেক্ষা করতে থাকল রয়ের সাজেশনের জন্য।

ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। সে মেয়েটাকে আবার দেখতে পেল – ওর ছেলেবেলার স্বপ্নের সেই মায়া। অনিন্দ্যসুন্দর একটা মেয়ে – হামিদ ভাবলো। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে হাসল – নি:শব্দ হাসি। আজও মেয়েটাকে তার কাছে পরীর মত সুন্দর মনে হল। হামিদের মনে হল যেন অনেকদিন পর হারিয়ে যাওয়া কোনো বান্ধবীকে ফিরে পেয়েছে সে। সেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল।

এরমধ্যে সে শুনতে পেল রয়ের কণ্ঠস্বর – ‘উত্তেজনার সময় শান্ত থাকব, আকাশের মত শান্ত।’

তখন মেয়েটা তাকে কাছে ডাকল, সে সম্মোহিতের মত এগিয়ে গেল। মেয়েটা দেয়ালে কি যেন লিখছে। রয়ের কণ্ঠস্বর তখনও দুর্বলভাবে তার কানে আসছে – যেন ওপর তলায় বসে রয় তাকে কথাগুলো বলছেন, আর এখানে সে শব্দগুলো ঠিকমত পৌছাচ্ছে না।

হামিদ দেয়ালের লেখাটা পড়তে শুরু করল, যেটা সেই মেয়েটা এইমাত্র লিখেছে ওর জন্য – ‘আমাকে তুমি সারাজীবন ভালোবাসবে, তুমি আমার সাথে থাকবে চিরদিন।’

লেখাটা পড়ে কেন যেন খুব ভালো লাগলো হামিদের – উত্তেজনাভরা একটা আনন্দ।

মেয়েটা তার হাত স্পর্শ করল, হামিদের তখন ভীষণ ভালো লাগল। অসাধারণ একটা অনুভূতি। মেয়েটা এবার ওকে টেনে নিয়ে চলল। হামিদ দেখল, মেয়েটা তাকে নিয়ে যাচ্ছে প্রথমে সিড়িটার দিকে, যে সিড়ি দিয়ে সে এঘরে নেমে এসেছে। তারপরই ওরা সিড়ি বেয়ে উঠে গেল দরজাটার দিকে, যে দরজা খুলে হামিদ এ ঘরে ঢুকেছিল।

মেয়েটা ওর হাতে একটা বড় তালা এগিয়ে দিল। তারপর একবার ইংগিত করল দরজাটার দিকে, আরেকবার দেয়ালের লেখাটার দিকে।

হামিদের হৃৎপিণ্ড তখন অচেনা এক উত্তেজনায় রীতিমতো লাফাচ্ছে। দরজা লাগানোর জন্য হাত বাড়াতেই হঠাৎ তার চোখে পড়ল ওপাশে, মানে হামিদের মনের মূল ঘরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। হামিদ তাৎক্ষণিকভাবেই লোকটাকে চিনতে পারলো – এটা সেই কুৎসিত লোকটা যাকে হামিদ স্বপ্নে কোনো কোনো সময় দেখতে পেতো। এটাই সে লোকটা হামিদের স্বপ্নগুলোতে যে এই সুন্দর মেয়েটাকে আটকে রাখত, ওর কাছে আসতে দিত না।

হামিদ অবশ্য বিশ্রী লোকটাকে ওর সচেতন মনের ঘরে দেখতে পেয়েও সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাল না, ও তো ওর স্বপ্নের কন্যাকে পেয়েই গেছে। মেয়েটা যখন আপনজনের মতো করে জড়িয়ে ধরলো হামিদকে আর ওর ঠোঁটে গাঢ় করে একটা চুমু খেল, রয়ের কণ্ঠ হামিদ তখন বলতে গেলে শুনতেই পাচ্ছে না।

হামিদ দরজাটা বন্ধ করে দিল – এপাশ থেকে। তারপর মেয়েটার হাত থেকে তালাটা নিয়ে লাগিয়ে দিল দরজায়।

১২

রয় আবারো ডাকলেন – ‘হামিদ, আপনি এখন জেগে উঠবেন।’

কিন্তু এবারো কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না হামিদের মধ্যে। রয় কপালের ঘাম মুছলেন – এরকম ঘটনা তার চিকিৎসক জীবনে আর কোনদিন ঘটেনি, অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে বলেও তার জানা নেই।

রয় আবার চেষ্টা শুরু করলেন। প্রায় আধঘন্টা ডাকাডাকির পর হামিদের চোখ খুলল। রয় হেসে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন – অবশ্য সাথে সাথে এও লক্ষ্য করলেন, হামিদের চোখ ভীষণ লাল হয়ে আছে – জ্বরগ্রস্থ মানুষের চোখের মত লাল।

‘হামিদ, আপনার এখন কেমন লাগছে?’ – রয় দুর্বলভাবে প্রশ্ন করলেন।

‘হামিদ?’ – সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল – ‘হামিদটা আবার কে?’

১৩

ডক্টর রয়ের ধাতস্ত হতে সময় লাগল, কয়েক মিনিট শূন্য দৃষ্টিতে হামিদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর তিনি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললেন – ‘হামিদ, আপনি শান্ত হোন।’

উত্তরে কর্কশ সে কণ্ঠস্বরটা অস্বাভাবিকভাবে হাসতে শুরু করল আর বলল যে ওরা হামিদকে আটকে ফেলেছে, ওকে আর কোনদিন ফিরে পাওয়া যাবে ন। রয়কে বেশ কিছুক্ষন ধরে সে ভীষণ অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজও করল।

কাঁপা হাতে রয় তার নোটবুকে লিখলেন “দ্বৈত স্বত্বা”, তারপর জানতে চাইলেন – ‘আপনি যদি হামিদ না হোন, তাহলে আপনি কে?’

‘আমি সালমান। আমি যারে ধরি, সহজে ছাড়ি না।’

রয় আর সুযোগ নিতে চাইলেন না, বাঁ হাত পেছনে নিয়ে লাল একটা সুইচ টিপে দিলেন। এটা জরুরি তলবের লাইন, রোগী উত্তেজিত হয়ে গেলেই শুধু এটা ব্যবহার করার দরকার হয়, যদিও এ চেম্বারে কাজ শুরুর পর আজ পর্যন্ত এটা ব্যবহার করার তার প্রয়োজন হয় নি। এর সাথে সাথে রোগীকে কথায় ব্যস্ত রাখাও প্রয়োজন, যেকোন সময় সে উঠে আক্রমণ করে বসতে পারে।

‘হামিদ, সালমান কি আপনার খুব পছন্দের কোন নায়কের নাম? আপনি কি জীবনের কোন এক সময় সালমান নামে কারো মত হতে চেয়েছিলেন?’

উত্তরে হামিদ আবারো কিছু অশ্রাব্য গালি দিল রয়কে।

এখন পর্যন্ত কারো পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, এদিকে রোগী উত্তেজিত হয়ে উঠছে। কথা চালু রাখতে গিয়ে রয় একবার ঢোক গিললেন, তারপর জানতে চাইলেন কেন হামিদকে ওরা আটকে রাখতে চাইছে। মানসিক রোগী যদি কাল্পনিক কথা-বার্তা বলা শুরু করে, তখন কখনো কখনো সেই ভুল কথাগুলোর সূত্র ধরেই আলোচনা এগিয়ে নিতে হয়।

উত্তরে কর্কশ কণ্ঠ এক ভয়ঙ্কর তথ্য দিল। সে বলল যে সে আর তার ‘বৌ’ তার এক ‘সর্দার’কে খুশি করার জন্য এ কাজটা করেছে। সর্দার খুশি হলে তাকে এরকম আরো ‘যুবতী বৌ’ দিবে। রয় যখন তাকে সর্দারের পরিচয় জানতে চাইলেন, তখন সে বলল ‘আজাজিল’, তারপর আবার অট্টহাসি হাসতে লাগল।

হাসির এই পর্যায়ে মতিন আর জলিল ঘরে এসে ঢুকল। হামিদ ওদের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা হামিদকে ধরে চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলল। হামিদ হাত পা ছুড়ল, কিন্তু দুইজন শক্ত-সমর্থ প্রশিক্ষিত লোকের সাথে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না।

ডক্টর রয় তখন ওই ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। ফ্রন্ট ডেস্কে সোমাকে বললেন তার আজকের বাকি সব এপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দিতে। ফাইল ঘেটে তিনি হামিদের স্ত্রীর ফোন নম্বর বের করলেন। প্রায় এক ঘন্টা চেষ্টার পর বেলাকে পাওয়া গেল।

বেলার সাথে কথা বলে রয় কফিমেকারে পানি ভরলেন। আজ তিনি চেম্বারেই রাত কাটাবেন। যে সমস্যার সৃষ্টি তিনি করেছেন, নিজে সেটার সমাধান না করা পর্যন্ত তিনি বাসায় যাবেন না। ঢাকা শহরের সবচেয়ে নামকরা মনোরোগ চিকিৎসক তিনি, কোনভাবেই নিজের সুনামে কালো দাগ বসতে দেবেন না এ দুর্ঘটনার কারণে।

১৪

হামিদের জীবনে এতো মজার সময় আর কখনো আসে নি। নিজের মনের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে যে এত ভালো থাকা যায়, তার কোন ধারণাই হামিদের ছিল না। যারা ড্রাগ নিয়ে নেশা করে, তারা তাহলে এভাবেই একটা ঘোরের ভেতর সুখের স্বপ্নে ডুবে থাকে – কখনো জেগে উঠতে চায় না !

মায়া নামের সেই যুবতী মেয়েটা সারাদিন তার সাথে সাথে থাকে আর সে যেভাবে যা করতে বলে, লক্ষী মেয়ের মত ঠিক সেভাবেই সে তা করে। এ যেন চরম মজার একটা খেলা। মায়া যেন রক্ত-মাংসের জীবন্ত একটা পুতুল, আর সে তার পুতুলটাকে নিয়ে মন ভরে খেলছে।

ওর বার বার মনে হয়েছে বেহেশতে হুরপরীরা বোধহয় এরকমই হয়। হামিদ অবশ্য বেহেশতে যাওয়ার আশা করে না। কিন্তু এখানে সে খারাপ কি আছে? আর তাছাড়া সে তো জোর করে কারো সাথে কিছু করছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, এটা মনের ঘর – এখানে যা সে করছে তা তো শেষ পর্যন্ত তার কল্পনাই। কল্পনার মধ্যে পাপই কি আর পুণ্যই বা কি ! মানুষ তার কাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে, কল্পনাকে কখনোই না – সুতরাং কল্পনার এই গোলকধাঁধার মধ্যে হামিদ তার যৌনজীবনের যা যা চাহিদা সব মিটিয়ে নিতে চায় – সেটা সুন্দর হোক, কি অসুন্দর, এ ঘরের সেই তো রাজা।

কিন্তু একটাই সমস্যা এখানে, আর তা হল – সে এখান থেকে বের হতে পারছে না, সে অর্থে সে একজন বন্দি রাজা। অবশ্য তাতে তার খুব একটা আফসোস নেই। গোলাপি রঙের এই ঘরটার সবগুলো দেয়াল মায়া নামের মেয়েটা ভরে দিয়েছে নগ্ন-অর্ধনগ্ন সব মেয়েদের ফুল সাইজ ছবি দিয়ে। ছবিগুলোকে কেন যেন চেনা চেনা মনে হয় হামিদের, যেন তার স্মৃতি থেকে উঠে আসা ছবি এগুলো। কৈশোরে সে শিবলী ভাইয়ের বাসা থেকে পর্নো ম্যাগাজিন চুরি করে এনে সারারাত বসে বসে অশ্লীল ছবিগুলো দেখতো – হতেও পারে সেই ছবিগুলোর সাথে এই পোস্টারগুলোর মিল আছে।

তবে হামিদ যে ছবিটা দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে, সেটা হল শিউলি আপার অদ্ভুত একটা ছবি – গায়ে কাপড় প্রায় নেই বললেই চলে। সেই শিউলি আপা যার প্রতি হামিদের ছেলেবেলায় ভয়াবহ দুর্বলতা ছিল, এটা সেই শিউলি যার শরীর সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে ভালোবাসতো। মায়া এটা কোথা থেকে জোগাড় করেছে সেই জানে।

মায়া মেয়েটা একটা সময়েই শুধু ওকে একা রেখে চলে যায়, আর সেটা হল যখন ওপরের ঘর থেকে বাজখাই গলায় ওই বিশ্রী লোকটা ডাক দেয়। হামিদ লক্ষ্য করেছে, ওই লোকটা ডাক দেয়া মাত্র মায়া কেমন যেন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যায় – যেন না গেলে তার অনেক বড় শাস্তি হবে। মেয়েটার জন্য হামিদের খারাপই লাগে, যদিও সে জানে না এরা দুজন ঠিক কি ধরণের প্রাণী। এরা কি অশরীরী? নাকি হামিদের মনটাই তার সাথে কোনরকম খেলা খেলছে? মানুষের মন খুব বিচিত্র জিনিস, সম্মোহন-টম্মোহন করে এর সাথে না জড়ালেই হয় তো ভালো হতো।

মেয়েটা যখন ওপরে যায়, তখন ওর ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা রুপালি রঙের চাবি বের করে মনের ওপরের ঘরে যাবার তালাটা খোলে, তারপর ওপাশে উধাও হয়ে যায়। হামিদ একবার মায়ার পেছন পেছন গিয়েছিল দেখতে ওপরে কি অবস্থা, দরজার এপাশ থেকে সে দেখে মায়া ওই বিশ্রী লোকটার সাথে প্রেম করছে। দেখে হামিদের একটুও যে রাগ হয় নি, তা না – কিন্তু ব্যাপারটা সে মেনে নিয়েছে। হতেও পারে এরা একই প্রজাতির প্রাণী সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে ওরা নিজেদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইবে। এমনকি এটাও হতে পারে যে ওদের দুজনের সম্পর্কই বৈধ, আর হামিদই বরং এই মেয়েটার সাথে পরকীয়া ধরণের কিছু একটা করছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, ওই ভয়ঙ্কর লোকটা কি জানে না হামিদ আর মায়া নিচের ঘরে কিসব কান্ড করে? অশরীরীদের মধ্যে কি হিংসা-বিদ্বেষ নেই? মানুষ যেমন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাকে অন্যের সাথে সহ্য করতে পারে না, ওরাও কি সেরকমই? তাহলে লোকটা কেন মায়াকে ওর সাথে থাকতে দিচ্ছে?

মুখের তুলনায় বড় নাক আর বিশালবপু এই লোকটাকে হামিদের কেন যেন ভীষণ ভয় করে। ভয় করে বলেই সে দরজা খোলা দেখলেও ওপরের ঘরে যায় না। আর তাছাড়া এখানে তো সে খারাপ নেই। বাস্তব জীবনের মলিনতা, অফিসে দৈনিক বসের তাবেদারী, বাসায় নির্ঘুম রাত, বিবাহবিচ্ছেদের জন্য বেলার উকিল নোটিশ, আদালতে দৌড়া-দৌড়ির অসীম কষ্ট – এসবের চেয়ে এই শান্তির সময়টাই কি ভালো না ?

১৫

ভাগ্নে বৌ বেলার ফোন পাবার পর গিয়াস মামা আর এক মিনিটও অপেক্ষা করেন নি, রাত এগারোটায় ছুটে গেছেন বৃদ্ধ কবিরাজ আব্দুর রহমান সাহেবের কুটিরে। খাদেমরা অবশ্য তাকে সাথে সাথে দেখা করতে দিল না, কারণ উনি তখন মাত্র ঘুমিয়েছেন। অগত্যা গিয়াস সাহেব পাশের মসজিদের বারান্দায় বসে দোয়া-দরূদ পড়তে থাকলেন, তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন।

একজন খাদেমের ডাকে তার ঘুম ভাঙল। লোকটা বলল হুজুর ঘুম থেকে উঠেছেন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য, নামাজ শুরুর আগে আগন্তুক অতিথির সাথে কথা বলতে চান।

আব্দুর রহমান সাহেবের মধ্যে কোন একটা অধ্যাত্বিকতা আছে, তাকে দেখামাত্র গিয়াস মামার দু’চোখ বেয়ে পানি নেমে এলো। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বললেন – ‘হুজুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

বৃদ্ধ ভদ্রলোক সব ঘটনা চুপ করে শুনলেন, পুরোটা সময় তার চোখ বন্ধ করে রাখলেন। সব কথা শেষ হবার পর ছানি পড়া চোখ মেলে তাকালেন সরাসরি গিয়াস সাহেবের দিকে, তারপর আস্তে করে বললেন যে দেরি হয়ে গেছে। গিয়াস সাহেব অপলক চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কোন তর্কে গেলেন না।

‘গন্ডগোলটা বাধাইছে ওই ডাক্তার সাহেব। মন নিয়া খেলার এইসব তরিকা ভালো না – এই বিপদগুলি সাইন্টিস্টরা বুঝে না।’ – বললেন তিনি।

কথা শেষে ভদ্রলোক হাত তুললেন, ইশারা যে তার আর বলার কিছু নেই। গিয়াস সাহেব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন – এই হামিদ ছেলেটাকে তিনি কোলে নিয়ে কত ঘুরেছেন, সে যখন ছোট ছিল! ছেলেটা হয়তো মানুষের মত মানুষ হয় নি – ধর্মের মাপকাঠিতে – কিন্তু তাই বলে তো মামার আদর কমে যেতে পারে না।

হয়তো তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখেই একজন খাদেম তাকে আমন্ত্রণ করল একসাথে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য। গিয়াস সাহেব কি মনে করে সাথে সাথেই ওযুর জন্য পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে শুরু করলেন।

ওযু শেষ করে যখন গিয়াস সাহেব নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন সেই খাদেম লোকটা আবার কাছে এলো। তার নাম মজিদ, বলল – তারা হামিদের এই সম্ভাব্য বিপদের কথা অনেকদিন ধরেই জানে। খন্নাস আর খন্নাসির এরকম জোড়া প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় শহর আর গ্রামের আনাচে কানাচে, এদের কাজই হল জোড় বেঁধে শিকার ধরা – চুপচাপ ধরণের ছেলে খুঁজে পেলেই খন্নাসি মেয়েটা ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে তার সাথে ভাব করে, তার মনে বাসা বাধে, তারপর খন্নাসির হাত ধরে মনের মধ্যে ঢুকে যায় পুরুষ খন্নাসটা। গ্রামদেশে এটাকে জিনে ধরা বলে, কিন্তু মূল ঘটনা অতটা সরল নয়।

যদি হামিদ সজাগ থাকতো, তাহলে তারা ঝড়-ফুক করে এই ‘বদমাইশদের’ দূর করতে পারতেন – এরচেয়ে অনেক ‘জটিল কেস’ তারা অতীতে সমাধান করেছেন। কিন্তু হামিদের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, সে সম্মোহিত অবস্থায় আছে। এটা অনেকটা জাদুগ্রস্ত হয়ে থাকার মত – এ অবস্থায় কোন স্বাভাবিক চিকিৎসা পদ্ধতি কাজ করে না। হামিদকে প্রথমে সম্মোহনের এই ঘোরের মধ্য থেকে বের হয়ে আসতে হবে, তারপরই কেবল এনারা তাকে সাহায্য করতে পারবেন।

‘কিন্তু ডাক্তার তো তাকে ঘোর থেকে জাগাতে পারছে না।’ – মামা বললেন।

‘তাইলে হামিদ সাহেবরেই বাইরে আসার উপায় খুঁজে বাইর করতে হবে।’ – খাদেম উপসংহার টানল।

সে রাতে বৃদ্ধ আবদুর রহমানের সাথে সাথে গিয়াস মামা দীর্ঘ সময় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে ভাগ্নের জন্য প্রাণ খুলে দোয়াও করলেন তিনি। এরপর যখন চলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন বৃদ্ধ অলি তাকে কাছে ডাকলেন। কাছে গিয়ে বসতেই তিনি বললেন

যে হামিদের জন্য তিনি তিনটা দোয়া করেছেন –

এক, তার দিল যেন যেনার নেশা থেকে সরে আসে;

দুই, তার দিলে যেন মেজাজের তাপ কমে যায়;

তিন, তার মধ্যে যেন বুঝ আসে যে ওই দুই শয়তানের একটাকে আরেকটার পেছনে লাগাতে পারলে সে ওই চক্কর থেকে বের হয়ে আসতে পারবে খোদা চাইলে।

গিয়াস সাহেবের চোখ তখন অশ্রুসজল। তা দেখে বৃদ্ধ তার কাঁধে স্নেহভরে হাত রাখলেন, আশ্বাস দিয়ে বললেন – হামিদ যেখানে আটকে পড়েছে, সেখানে বাইরের কোন কথা পৌঁছায় না – একটা জিনিস ছাড়া। আর সেই জিনিসটা হলো দোয়া।

বৃদ্ধ নিচু গলায় বুঝিয়ে বললেন – বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-সন্তানের দোয়ার শক্তি অনেক বেশি, সব বাধা পেরিয়ে খোদার কুদরতে ওগুলো বিপদগ্রস্তের কাছে পৌঁছে যায়। সুতরাং হামিদের নিকটাত্মীয়রা যেন তার জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে।

গিয়াস সাহেব কথাগুলো মনে রাখার ওয়াদা করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন।

১৬

হামিদ মনে করতে পারল না, নিজের অবচেতন মনের আধো-অন্ধকার এই ঘরটায় সে কতদিন ধরে পড়ে আছে। তিন দিন? তিন সপ্তাহ? তিন মাস? এখানে সময়ের হিসাব রাখা খুবই কঠিন, কারণ এখানে তার দৈনিক রুটিনগুলো নেই, এখানে শুধু উপভোগ আর উপভোগ – নিজের মনের মধ্যে তৈরী করে নেয়া এক বেহেশত যেন এটা।

ছোট বেলায় মক্তবে হামিদ শিখেছিল – বেহেশতে যে এতো আনন্দ, সে আনন্দে মানুষ বিরক্ত হবে না, সুখের আতিশয্যকে কখনো একঘেয়ে মনে হবে না। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষ একঘেয়ে হয়ে যায়, এটাই পৃথিবীর নিয়ম – বনি ইসরাইল যদি বেহেশতী খাবার মান্না আর সালওয়া খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে যেতে পারে, তাহলে সেই তুলনায় মায়া তো শুধুই একটা মেয়ে, আরেকটা শরীর। হ্যা, হামিদের বোধ হয় ওকে আর আগের মত মজাদার টক-মিষ্টি সান্নিধ্য মনে হচ্ছে না। কেন এরকম হচ্ছে কে জানে। সে তো প্রথম প্রথম ভেবেছিল এভাবে সে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।

হয়তো এসব কারণেই কাজটা করল সে আজ – মেয়েটা যখন ওর কাছে এলো, তখন তাকে সে পাশে বসিয়ে দিল, কিন্তু জড়িয়ে ধরল না, বা আদরও করল না। মেয়েটা তখন উঠে গিয়ে দেয়ালের একটা ফাঁকা অংশ খুঁজে নিয়ে লিখলো “আরো প্রেম”। হামিদ হেসে না-সূচক মাথা নাড়ল। মেয়েটা তখন ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওপরের ঘরে চলে গেল।

হামিদ তখন ওর অচেতন মনের ঘরটায় ঘুরে-ফিরে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ বিছানার পাশে টেবিলের মত জায়গাটায় সে দেখলো একটা ছবির অ্যালবাম। কৌতূহলবশত সেটা নিয়ে সে বসল উল্টে-পাল্টে দেখার জন্য।

প্রথম পাতাতেই একটা নাদুস-নুদুস বাচ্চা ছেলের ছবি, ছবিতে ছেলেটা দুষ্টু হাসি হাসছে। হামিদ উত্তেজনা নিয়ে একটার পর একটা পাতা উল্টাতে থাকল – সব ছবি শায়ানের, বিভিন্ন বয়সের। আশ্চর্য, শায়ানের কথা হামিদ কিভাবে এতোগুলো দিন ভুলে ছিল ! হামিদের মনে পড়ে গেল কিভাবে সে বাচ্চাটার সাথে মজা করতো, আর কিভাবে ছেলেটা মাঝে-মধ্যে তার বুকের ওপর ঘুমিয়ে পড়তো।

মায়া একসময় ফিরে এসে আবার ওর পাশে বসল, তারপর মাথা ঘষতে শুরু করল ওর বুকে। হামিদ আস্তে করে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল – ‘আমাকে বাইরে যেতে দাও, আমি আমার ছেলেকে একটু দেখে আসি। প্রতি বুধবার আমি ওকে স্কাইপ করি।’

মেয়েটা ওপরের দরজার তালাটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল। হামিদ বলল – ‘আমি তো তোমার কাছে ফিরে আসবোই, তুমি তো আমার সবকিছু।’ কিন্তু উত্তরে মেয়েটা ক্রমাগত মাথা নাড়াতে থাকল। হামিদ বুঝতে পারল, কিছুতেই এখান থেকে ওকে মেয়েটা বের হতে দেবে না। এ কি পাগলামির মধ্যে পড়া গেল !

এরপর মায়া যখন ওর কোলে এসে বসল, তখন হামিদ ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে সিঁড়িটার দিকে ছুটতে শুরু করল। এলবামটা দেখার পর থেকে ওর মনে হচ্ছিল, শায়ানকে একবার দেখতে না পারলে সে মরেই যাবে। ওপরে উঠে সে তালার মধ্যে লাথি মারতে শুরু করল। মায়া ততক্ষনে উপরে উঠতে শুরু করেছে। হামিদের মনে হল মেয়েটা কাঁদছে। এসব প্রাণীর কি তাহলে হাসি-কান্নাও আছে ?

হামিদকে অবাক করে দিয়ে আঁচল থেকে চাবিটা বের করে মায়া দরজার তালাটা খুলে দিলো। হামিদ দরজাটা ধরাম করে খুলে দিয়ে প্রায় ছুটে বের হয়ে এলো ওপরের সে ঘরটায়, ওর পেছন পেছন মায়াও বের হয়ে এলো ধীর পদক্ষেপে। বিশ্রী মোটা লোকটা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, যেন ওরই অপেক্ষায়।

লোকটাকে দেখামাত্র আবার তীব্র একটা ভয় আচ্ছন্ন করে ফেলল হামিদকে, কিন্তু সে যেন কাউকে বলতে শুনল – ‘দুই শয়তানের একটারে আরেকটার পেছনে ফেলতে পারলেই সে ওই চক্কর থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।’ এটা সেই বৃদ্ধ কবিরাজের কণ্ঠস্বর – ওর মনে পড়ল। আর গলার আওয়াজটা আসছে নিচের ঘর থেকে। নিচের ঘরে সেই বৃদ্ধের কণ্ঠ কথা থেকে এলো, তা হামিদ বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে এটুক বুঝতে পারলো যে এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই, ওকে যা করতে বলা হয়েছে ওকে তাই করতে হবে।

হামিদ একটু পিছিয়ে এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরল, তারপর ওর কপালে একটা চুমু খেল। লোকটা চোখের পলকে এগিয়ে এলো ওদের দুজনের দিকে, তারপর ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিল মেয়েটার কাছ থেকে। ওদের ভেতরও তাহলে মানুষের মতোই হিংসা-বিদ্বেষ আছে!

হামিদ জোরে বলে উঠলো – ‘তুমি জানোই না? ও তো আমার প্রেম। ও আমার সাথে সব কিছ করেছে, সব কিছু।’ – বলে হামিদ হাসতে লাগলো। কিন্তু এর ফলে যা হল, তার জন্য হামিদ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। লোকটা হঠাৎ এসে তাকে চেপে ধরলো, ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেল দরজার কাছে, তারপর এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিল নিচের ঘরে।

ঘরের মেঝেতে পড়ে থেকে হামিদ বুঝতে পারল, ওর পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ওপরে তখন লোকটার চিৎকার, মারামারির শব্দ আর মেয়েটার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।

১৭

ডক্টর রয় ভাবতে পারেন নি, হামিদের স্ত্রী তার সাথে দেখা করতে আসবে। কাল সে বলেছিল – কোনোদিন ওকে দেখতে আসবে না, আর এই শাস্তিগুলো আসলে হামিদের প্রাপ্য।

সারা রাত রয় কাটিয়েছেন চেম্বারে, সকাল থেকে মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। তবু তিনি বেলাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হামিদের রুমে নিয়ে এলেন। হামিদকে দেখামাত্র বেলা মুখে হাত দিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল, তারপর রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘এটা হামিদ না। এটা হামিদ হতেই পারে না। হ্যা, চেহারাটা একই আদলের, কিন্তু এটা হামিদ না। দেখেন, হামিদের নাক কি এরকম বিশ্রী রকম বড়? ওর গাল কোনদিন এরকম বিশ্রী থলথলে ছিল না।’

‘আমি জানি এটা হামিদ।’ – রয় তাকে আশ্বস্ত করলেন – ‘স্ট্রেসের প্রভাব মানুষের চেহারাতে পড়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হামিদ এখন প্রচন্ড স্ট্রেসের মধ্যে আছে।’

‘আপনি ওকে জাগিয়ে তুলছেন না কেন?’

‘আমি চেষ্টা করছি। গত চৌদ্দটা ঘন্টা ধরে ডেকে চলেছি, কিন্তু ও সাড়া দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনভাবে ও ওর অবচেতন মনের ঘরে আটকে পড়েছে – বের হতে পারছে না, আমার সাজেশনও শুনতে পাচ্ছে না।’

‘আপনার সাজেশন ছাড়া ও নিজে নিজে বের হতে পারবে না?’

ডক্টর রয় কিছুক্ষন বেলার দিকে তাকিয়ে থাকলেন – ‘পারবে, যদি ও ওই ঘর থেকে বের হওয়ার অন্য কোন দরজা খুঁজে বের করতে পারে। কিন্তু ও যদি আমার সাজেশন দেয়া দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে হয়তো ওখান থেকে আর কোনদিন বের হতে পারবে না।’

‘আপনার সাজেশন দেয়া দরজা ছাড়া আরো দরজা আছে ওখানে?’

‘অবশ্যই আছে। এটা ওর মন, ও চাইলে এমনকি নিজেকে নিজে সাজেশন দিয়ে দরজা বানিয়েও নিতে পারে। আহা, ওকে যদি শিখাতাম কিভাবে নিজেকে নিজে সাজেশন দিতে হয় !’

বেলা রয়ের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইল, ওর অজান্তেই ওর বা চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি নেমে এলো।

রয় হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন, যেন তার কিছু একটা মনে পড়েছে। তিনি প্রায় ছুটে গিয়ে তার বইয়ের তাকে কি যেন একটা খুঁজতে লাগলেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক খোঁজার পর খয়েরি রঙের একটা পুরোনো জীর্ণ বই বের করলেন।

‘একটা উপায় থাকতে পারে।’ – তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিলো। বেলা চোখ মুছে তার দিকে তাকালো।

‘মানুষের সচেতন মনের ঘরের নিচে অবচেতন মনের যে অন্ধকার ঘরটা আছে, এরও নিচে আছে একটা সম্মিলিত অবচেতন এলাকা, খুবই রহস্যময় এর কর্মকান্ড। সে যদি কোনোভাবে ওই জায়গাটার সন্ধান পেতো, তাহলে হয়তো ওর জন্য কোন মেসেজ ওখানে রেখে আসতে পারতাম।’

রয় বললেন, তিনি এখন ধ্যানে বসবেন – একধরণের গভীর আত্মসম্মোহন, চেষ্টা করবেন কোনোভাবে সে গভীরতর চেতনার স্তরে পৌঁছে হামিদকে খুঁজে বের করতে। তিনি অবশ্য কোন নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না, বললেন – সেই এলাকা সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অল্প, তবু তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। বেলা তাকে বিদায় জানিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়ে এলো।

১৮

বেশ কয়েক ঘন্টা, বা কয়েক দিন, ধরে হামিদ নিচের ঘরে বন্দি। মায়া এখন আর ওর কাছে আসে না। ওই লোক তাহলে জানতো না যে মায়া তার সাথে প্রেম করতো। সে মেয়েটাকে রেখেছিল নিচের ঘরে ওকে পাহারা দেয়ার জন্য, আর নিজে নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল মনের ওপরের ঘরের। মায়া তাহলে তার মালিকের, বা স্বামীর, বা যাই হোক না কেন তার, সাথে এক অর্থে বিশ্বাসভঙ্গই করেছিল।

একসময় বিরক্তি কাটানোর জন্য হামিদ তার অবচেতন ঘরের ভেতর আবার পায়চারি শুরু করল।

তখন হঠাৎ ওর মনে পড়লো, বৃদ্ধ কবিরাজের কণ্ঠ সে শুনতে পেরেছিলো এ ঘর থেকে। সে দেয়ালের বিভিন্ন জায়গা কাছ থেকে দেখে বুঝতে চেষ্টা করলো কোথাও লুকানো কোনো প্রকোষ্ঠ আছে কিনা। কিন্তু অনেক খুঁজেও তেমন কিছু পেলোনা।

তখন হঠাৎ ফ্লোরের ওপর লাল গালিচাটা ওর চোখে পড়লো, আর বুকের ভেতর কেন যেন রক্ত ছলাৎ করে উঠলো। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কার্পেটটা সরিয়ে দিলো, আর তখনি দেখতে পেলো একটা লুকোনো দরজা। এক ঝটকায় সে দরজাটা খুলে ফেললো, আর আবছা আলোতে দেখলো নিচে চলে গেছে একটা কাঠের সিঁড়ি – যতদূর চোখ যায় ততদূর, যেন ওটা অতল কোনো গহ্বরে নেমে গেছে।

হামিদ সেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। তার ভীষণ ভয় লাগছিলো, কিন্তু সে জানতো তাকে এর শেষ দেখতেই হবে। ফলে সে নামতে থাকলো যতক্ষণ না সমস্ত আলো শেষ হয়ে যায়, যতক্ষণ না অন্ধকার নিকষ কালো কালি হয়ে চারিদিক থেকে ওকে ঘিরে ধরে।

সে জানে না, কতক্ষন সে এভাবে নেমেছে। যখন ওর মনে হতে শুরু করেছে যে সে স্থান-কাল বিহীন শূন্যতার একটা বৃত্তে ঝুলে আছে, তখন যেন নিচে আলোর একটা বিন্দু দেখতে পেলো। আরো নেমে যাবার পর সে একসময় দেখলো সিঁড়িটা শেষ হয়েছে বিশাল এক প্রান্তরে। আর সে প্রান্তরে এদিক ওদিক কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। সে ছুটে গেলো কাছাকাছি একজনের কাছে, সার্কাসের জোকারের পোশাক পরে লোকটা মাটিতে খামোখাই হুটোপুটি খাচ্ছে।     

আরেকটু সামনে গিয়ে একজন মহিলাকে দেখে হামিদ তার পিছু নিলো। মহিলা তার দিকে ঘুরে তাকাতেই হামিদের ভিরমি খাবার অবস্থা, কারণ মহিলার চেহারা হুবহু হামিদের মতো – যেন ওর যমজ কোনো বোন যে কিনা ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলো। 

তখন একজন চওড়া কাঁধের দীর্ঘকায় এক যুবককে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো। ছেলেটা তার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো, তারপর হঠাৎই আবার সে শূন্যে মিলিয়ে গেলো – ওর চোখের সামনে ছেলেটা স্রেফ উধাও হয়ে গেলো। হামিদ তখন পেছন ফিরে সিঁড়িটাকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আর প্রয়োজন ছিল না, এই প্রান্তর এতটাই শূন্য যে কোনো কিছু চোখ এড়ানোর সুযোগই নেই।

হামিদ ফিরতে শুরু করলো সিঁড়ির দিকে, আর তখন সে দেখলো তার নিজের ছায়া তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। হামিদ এসবের মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না, সে সিঁড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করলো – আগে ঘরে ফিরতে হবে, তারপর এসব নিয়ে চিন্তা করা যাবে।

সে যখন কাঠের সিঁড়ির খুব কাছে চলে এসেছে, হঠাৎ যেন শূন্য থেকে এক বৃদ্ধের উদয় হলো। বৃদ্ধের চুল-দাড়ি তুষারের মতো শুভ্র, চোখে কাঠের এক প্রাচীন চশমা, গায়ে জরিদার সোনালী পাঞ্জাবি, মাথায় কালো পাগড়ি। সে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে আর চশমার আড়াল থেকে হামিদের দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

হামিদ ঘুরে আবার ফিরে এলো বৃদ্ধের কাছে। ঐদিন ওপরের সচেতন ঘরে তাহলে এই কণ্ঠই সে শুনতে পেয়েছিলো, এই কণ্ঠটাই ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিলো ওই ভয়ঙ্কর রাক্ষসটা থেকে। সে বৃদ্ধের হাত দুটো ধরে বললো – ‘আপনি কে?’ কিন্তু বৃদ্ধ কোন, উত্তর দিলেন না, অপলক চেয়ে রইলেন হামিদের চোখের দিকে। হামিদ বৃদ্ধের হাত আঁকড়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু বৃদ্ধ তার হাতে একটা মুখোশ ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত হেটে একপাশে চলে গেলেন।

হামিদ মুখোশটা হাতে নিয়ে দেখলো, এটা তারই চেহারা – কিন্তু আরো সুন্দর আর নিখুঁত। হামিদ অপলক মুখোশের দিকে তাকিয়ে থাকলো, একসময় তার মনে হলো সে ওই চেহারা থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না। ঠিক তখন মুখোশটা কথা বলতে শুরু করলো – ‘হামিদ তুই কেমন আছিস?’ আর হামিদ ভয় পেয়ে ওটা ফেলে দিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করলো।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করার পর চরম অন্ধকার অংশটা পার হওয়ার সময় হঠাৎ হামিদ শুনতে পেলো একটা কণ্ঠ, যেন অনেক দূর থেকে কেউ তাকে ডেকে বলছে – ‘ঘর থেকে বের হওয়ার আরো দরজা আছে, আরো দরজা আছে।’ হামিদ চমকে উঠলো, কারণ এই কণ্ঠটা আবার ডক্টর রয়ের। কিন্তু হামিদ আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে চায় না, তাই ওই কণ্ঠ অগ্রাহ্য করে দ্রুত ওপরে উঠতে শুরু করলো।

অবচেতন মনের বন্দী ঘরে ফিরে হামিদ গোপন দরজাটা বন্ধ করে কার্পেটটা টেনে দিলো ওটার ওপর। সে ভাবতে চেষ্টা করলো এই মাত্র সে কি দেখে আসলো। অনেকক্ষণ চিন্তা করেও যখন সে কোনো কুল-কিনারা করতে পারলো না, সে হাল ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। সেসময় আরো একটা বারের জন্য ওর চোখে পড়ল অসংখ্য নগ্ন ছবি আর পোস্টার, যেগুলো মায়া এ ঘরে লাগিয়ে রেখেছে। ওগুলোর প্রতি কেন যেন হামিদ আজ আর আগ্রহ বোধ করছে না, শায়ানের ছবি দেখার পর ওর ভেতর কি যেন একটা পরিবর্তন এসেছে – এসব কিছুই আর আগের মতো ভালো লাগে না। 

এই মেয়েগুলো – যাদের ছবি এখানে টাঙানো আছে – এরা নিশ্চয়ই কারো মেয়ে কিংবা কারো বোন। যেহেতু ছবিগুলো অনেক পুরোনো, হয়তো এই মেয়েগুলো এতদিনে বয়স্ক মহিলাও হয়ে গেছে, কেউ কেউ মা হয়েছে। তাহলে এই ছবিগুলোর কি অর্থ? কেন এগুলো এখানে রাখতে হবে?

হামিদ কিছু না ভেবেই ছবিগুলো নামিয়ে ফেলতে শুরু করল। খুলতে গিয়ে অনেকগুলো পোস্টার ছিড়েও গেল। সবগুলো ছবি খুলে ফেলার পর সে যখন ওর শোওয়ার জায়গাটায় ফিরে এলো আর শূন্য দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল, তখন অবাক হয়ে দেখতে পেল প্রতিটা বড় পোস্টারের জায়গায় একটা করে ফাঁকা জায়গা। সে অবাক হয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল, দেয়ালের মধ্যে পোস্টারের পেছনে এই খোলা জায়গাগুলো কি সবসময়ই ছিল তাহলে? সে এতদিন শুধু এগুলো লক্ষ্য করে নি?

হামিদের মনে পড়লো, এই একটু আগেই রহস্যময় সে প্রান্তরে আরো রহস্যময় সেই বৃদ্ধ ডক্টর রয়ের কণ্ঠ নিয়ে তাকে বলেছিলো যে ঘরে থেকে বের হওয়ার আরো দরজা আছে। এটা কি সেরকমই একটা দরজা?    

হামিদ জানে, এটা ওর মন, এখানে অনেক বিচিত্র জিনিস ঘটতে পারে। তাই সে দেয়ালের একটা বড় ফোকরের দিকে এগিয়ে গেল। ওর মনে হল এর ভেতর একটা মানুষসমান বড় পাইপের মতো পথ আছে। সে একটু ঝুকে ওটার ভেতর ঢুকে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে শুরু করল।

একটু চলার পরই ওর মনে হল কোথা থেকে যেন আলোর একটা রেখা আসছে। সে সেই আলো অনুসরণ করে এগিয়ে চলল, আর ঠিক তখনই শুনতে পেল পরিচিত কিন্তু ক্লান্ত একটা কণ্ঠস্বর – ‘হামিদ, প্লিজ আপনি জেগে উঠুন।’

১৯

সেদিন বেলা আর ডক্টর রয়ের চোখের সামনেই হামিদ জেগে উঠে জিজ্ঞেস করেছিল সে কোথায়। কি মনে করে রয় তাড়াতাড়ি জানতে চেয়েছিলেন সে হামিদই কিনা, সে হ্যা বলে প্রায় সাথে সাথেই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কাছাকাছি এক হাসপাতালে প্রায় তিনদিন শুশ্রুষার পর হামিদ কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে।

সে ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে হামিদকে গিয়াস মামা নিয়ে গিয়েছিলেন সেই বৃদ্ধ কবিরাজের কাছে, তারপর তাকে সেখানে রেখে চলে এসেছিলেন। আবদুর রহমান সাহেবের কাছে চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত কাটিয়ে সেবার আধ্যাত্মিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়েই তবে বাসায় ফিরেছিল হামিদ। আব্দুর রহমান সাহেব গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিলেন, চল্লিশ দিনের এই ট্রেনিং কোন শয়তান কোনদিন ভুলিয়ে দিতে পারবে না। শত হলেও চল্লিশের একটা আলাদা হেকমত আছে – ইউনুস নবী চল্লিশ দিন মাছের পেটে ছিলেন, মুসা নবী চল্লিশ দিন তুর পাহাড়ে খোদার ধ্যানে মগ্ন ছিলেন তার নবুওত পাওয়ার আগে।

বেলাও হামিদের কাছে ফেরত এসেছিল। সে যখন বুঝতে পেরেছিল যে তার স্বামী শুধু একটা মোহগ্রস্ত অবস্থায়ই ওসব কান্ড ঘটাতো, তখন তাকে ক্ষমা করা বেলার জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল। শায়ানকে ফিরে পেয়ে হামিদও যার পর নাই সুখী হয়েছিল আর প্রতিজ্ঞা করেছিল যে জীবনে সে আর কোনদিন কোন কাম বা ক্রোধের ফাঁদে পা দেবে না, সকাল-বিকেল নামাজ পড়ে খোদার কাছে পানাহ চাইবে শয়তানের হাত থেকে বাঁচার জন্য।

অবশ্য কোন কোন নির্জন সন্ধ্যায় শেষ সূর্যের কোমল আলো পড়ে যখন পশ্চিম আকাশের মেঘগুলো গোলাপি রং ছড়িয়ে দিতো চারিদিকে, তখন হামিদের মনে পড়ে যেত মায়া নামের সেই মেয়েটার কথা – সব সময় না, কখনো কখনো। মেয়েটা এখন কোথায় কিভাবে আছে কে জানে ! ওর কেন যেন বিশ্বাস হতে চাইতো যে সেই অশরীরী তাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসতো। কে বলতে পারে, হয়তো মায়া ছিল ওই নিষ্ঠুর পুরুষ জীনটার শয়তানি খপ্পরে বন্দি, তাই বাধ্য হয়েছিল হামিদকে ফাঁদে ফেলতে, কিন্তু আসলে মেয়েটা এমনিতে হয় তো খারাপ কেউ ছিল না। হতেও তো পারে, তাই না !

পৃথিবীটা আসলে বিচিত্র এক জায়গা। ব্যাখ্যাযোগ্য এবং ব্যাখ্যার অতীত অনেক ঘটনাই এখানে ঘটে। আর তাছাড়া কেউ যখন জীবন থেকে হারিয়ে যায়, তখন সে পরী ছিল না যাদুকরী শক্তিধর ডাইনী ছিল তাতে কিছুই আসে যায় না। অতীত অতীতই, যা গেছে তা আর ফিরে আসবে না। বরং একদিন আমাদের চারদিকে সবকিছু বদলে যাবে, সেদিন আমরা হয়তো আমাদের অতীত অনুভূতিগুলোকে অন্যভাবে দেখতে শিখব। আর বুঝতে পারব, কতগুলো সত্যকে তলিয়ে না দেখাই ভালো।

Leave a comment