স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে বারবার দম আটকে আসা…

স্লিপ অ্যাপনিয়া একধরনের ঘুমের অসুখ। এতে ঘুমের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য, রোগীর শ্বাসবন্ধ হয়ে যায়, আবার স্বাভাবিক শ্বাস প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। স্লিপ অ্যাপনিয়ার অন্যতম প্রধান লক্ষণ নাক ডাকা। রাত যত বাড়তে থাকে, নাক ডাকার তীব্রতা তত বাড়তে থাকে। কখনো তিনি টের পান, তবে বেশির ভাগ সময়ই তাদের সঙ্গীরা এই নাক ডাকার অভিযোগ করেন। নাক ডাকতে ডাকতে অনেকের পুরোপুরি শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে শ্বাস নেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন অনেকে। এ সময় কেউ কেউ মৃত্যুভয়ে ভীত হন। রোগী বিষম খাওয়ার মতো গলার কাছে হাত নিয়ে দেখান, যেন গলায় শ্বাস আটকে মারা যাচ্ছেন। এই সমস্যার ফলে মৃত্যু হতে পারে ঘুমের মধ্যেই, বেড়ে যেতে পারে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি! এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা ঘুম ভাঙার পর শ্বাস নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। খুবই জটিল অবস্থায় সারা রাতে বারবার শ্বাস বন্ধ ও ঘুম ভাঙা এই চক্রটি চলতে থাকে। ফলে ঘুমিয়েও ঘুম পূরণ হয় না। এ ঘটনাগুলো যেহেতু গভীর ঘুমের মাঝে ঘটছে তাই রোগী তার এই সমস্যা বুঝতে পারে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে হয়তো তাদের মনেও থাকে না। যেহেতু বারবার ঘুম ভাঙার ফলে ঘুমিয়ে কখনও ঘুম পূরণ না হওয়ার ফলে সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকে।

ঘুমানোর সময় আমাদের শ্বাসনালি শিথিল হয়ে যায়, তবে যাঁদের এই শিথিলতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘটে, তাঁদের ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত ওজন এই রোগের অন্যতম একটি কারণ।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাক-কান-গলার গঠনগত কিছু ত্রুটির কারণেও এ রোগ হতে পারে। আবার মস্তিষ্কের যে অংশ ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অংশে কোনো সমস্যা হলেও স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, তীব্র স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীরা, যাঁরা চিকিৎসা নেন না, তাঁদের মৃত্যুহার প্রতি আট বছরে ৫ শতাংশ বাড়ে। হাই ব্লাড প্রেসার, স্ট্রোক, হৃদরোগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত স্লিপ অ্যাপনিয়া। স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসা করালে হাই প্রেসার নিয়ন্ত্রণ অনেক ভালো হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শুধু ওষুধের মাধ্যমে যাদের হাই প্রেসার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসায় হাই প্রেসার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

স্লিপ অ্যাপনিয়া সব বয়সেই হতে পারে, এমনকি শিশুদেরও।

স্লিপ অ্যাপনিয়ায় কি করবেনঃ

১। যিনি ঘুমের মধ্যে নাক ডাকছেন, তাঁকে ডেকে বা ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়।

২। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণে এনে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলতে হবে। গবেষকরা বলছেন স্থূলকায় ব্যক্তিদের মধ্যে বাড়তি চর্বিযুক্ত জিহ্বা বেশি পাওয়া যায়। স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীরা শরীরের ওজন কমালে সেই সাথে জিহ্বা থেকেও চর্বি কমে যায়। আর তাতে রোগটি কমে আসে।

৩। এরই সঙ্গে শোবার ভঙ্গি বা অভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, চিত হয়ে শোয়ার পরিবর্তে একপাশে ফিরে শোয়ার অভ্যাস করুন। সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। বিছানার মাথা/উপরিভাগ উঁচু করে ঘুমালে স্লিপ অ্যাপনিয়া কমতে পারে।

৪। এ ছাড়াও, খাওয়ার ঠিক পরেই শোবেন না। সম্ভব হলে একটু হাঁটাচলা করে তবেই ঘুমোতে যান। এতে হজমের সমস্যা জনিত কারণে শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি কমে যাবে। সমস্যা দীর্ঘদিনের হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

৫। নাকের মধ্য দিয়ে বাতাস যেন সহজে চলাচল করে, এজন্য একটি কাজ করতে পারেন। তা হল, গভীর শ্বাসের মাধ্যমে বেলুন ফুলানোর চর্চা করা। বেলুনটি বায়ুপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মুখ থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না। দিনে পাঁচবার রিপিট করুন, অর্থাৎ আপনাকে দৈনিক পাঁচটা বেলুন ফুলাতে হবে (নির্দিষ্ট সময় পরপর)। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই পদ্ধতি সবসময় কার্যকর নাও হতে পারে, তাই আপনার সমস্যাটিকে গুরুতর মনে হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

৬। ঘুমের ওষুধ, মাংসপেশি শিথিল করার ওষুধ যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত।

৭। যদি নাক বন্ধ থাকে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ মতো নেজাল স্প্রে ব্যবহার করা বা চিকিৎসা করা।

আপনার পরিবারে বা পরিচিতদের যদি এমন কেউ থাকেন, যিনি সজোরে নাক ডাকেন বা ওনাকে ঘুমের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ হতে লক্ষ্য করেছেন তাহলে ওনার সাথে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সম্বন্ধে আলোচনা করুন এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলুন।

যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

……তিনা শুভ্র ।

Leave a comment