১
মাহিনের ধারণা তার বাবা চায়, সে মরে যাক। এ ধারণা অমূলক না। আজ দুপুরে সে যখন রাগের মাথায় ডাল, ভাত আর তরকারি সহ প্লেট ছুড়ে মারল আর এরপর প্লেটটা ভেঙে গেল, খাবারগুলোও চারিদিকে ছিটকে পড়ল, তখন তার বাবা-মা দুজনেই দৌড়ে এলো, আর বাবা বলল সে থাপ্পড় মেরে মাহিনের সবগুলো দাঁত ফেলে দেবে। এরকম ভয়াবহ অসুস্থ একটা বাচ্চাকে কোন বাবা এরকম বলতে পারে!
মাহিনের বয়স মাত্র বারো। এই বয়সে কারো যদি এরকম বিশ্রী অসুখ হয়, তার ওপর যদি সে অসুখে মারা যাওয়ার ভয় থাকে, তাহলে মাঝে-মধ্যে এরকম রাগ হতেই পারে। আর সেরকম রাগ হলে বাবা-মায়ের সেটা সহ্য করে নেয়া উচিত। রোগে শুকিয়ে যাওয়া মাহিন তার সাদা বিছানাটায় শুয়ে এসবি ভাবছিল আর টানা টানা সুন্দর চোখ দুটো দিয়ে সবুজ সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে এর ক্রমাগত ঘুরে চলা দেখছিল।
মাহিন যে খুব তাড়াতাড়িই মারা যাবে, সেটা বাবা-মা তার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু জোহরা ওকে বলে দিয়েছে। জোহরা, জোহরার ছোট ভাই জাহিদ, আর মামা-মামী একদিন এসেছিল ওকে দেখতে। ওর ঘরে এসে কিছুক্ষন কথা বলার পর মিজান মামা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে চোখ মুছছিল, ভেবেছিল মাহিন দেখতে পায় নি, আর জোহরা ওর পাশে বসে ছিল। বড়োরা যখন ড্রইংরুমে চলে গেল কথা বলতে, তখন জোহরা ওর কানে কানে বলল – ‘জানো, আম্মুকে আব্বু বলেছে তুমি দুই মাসের মধ্যে মরে যাবে। তোমার খুব খারাপ একটা অসুখ করেছে। আমি শুনে ফেলেছি। তুমি কিন্তু আবার আব্বুকে বলে দিও না, তাহলে আমার স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিবে।’
প্রথম প্রথম জোহরার কথা মাহিন বিশ্বাস করে নি। ভেবেছে, সে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলেছে, ওকে ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু এরপর যত দিন গেছে, তত তার শরীরের ব্যথা বেড়েছে, আর
এখন তো প্রতিদিন বিকেলে ফার্মেসির বাশার আংকেল এসে ইনজেকশন দিয়ে যায় – ব্যথা কমানোর জন্য। তার মানে জোহরার কথাই ঠিক, সে সত্যিই মনে হয় মারা যাচ্ছে।
কিন্তু এটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে বাবা কি করে এরকম কড়া একটা কথা মুখের ওপর বলে দিতে পারল? মাহিন পাশ ফিরে টেবিলের উল্টোদিকের দেয়ালের দিকে তাকাল, দুপুরে যেখানে সে প্লেটটা ছুড়ে মেরেছিল। দেয়ালে এখনো ডালের দাগ লেগে আছে। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে মা সব পরিষ্কার করেছে – প্রথমে ভাঙা কাছের টুকরাগুলো তুলেছে, তারপর ট্রেতে ভাত আর তরকারি – কিন্তু দেয়ালের রং অফ হোয়াইট বলে ডালের ছিটেগুলো মা দেখতে পায় নি।
মা কিন্তু কোনদিন ওর সাথে রাগ করে কথা বলে নি। মাহিন মনে করে, ওর মা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মা। জোহরার আম্মু, মানে ওর মামী – সেও দেখতে সুন্দর ছিপছিপে, কিন্তু মায়ের মত সুন্দর কোনদিন সে হতে পারবে না। ও যদি মারা যায়ই, তাহলে মরে যাওয়ার আগে ওর মায়ের জন্য অনেক খারাপ লাগবে। বাবার জন্য একটুও খারাপ লাগবে না, কারণ বাবাটা খুব পাষান ধরণের – মনে কোন দয়া-মায়া নেই, সে শুধু চেনে টাকা।
সন্ধ্যার পর মা যখন তার ঘুমের ওষুধ আর দুধ নিয়ে এলো, তখন সে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল ওর চিকিৎসার জন্য কত খরচ হচ্ছে।
‘কেন তুমি এসব জানতে চাচ্ছো, মাহিন?’ – মা বলেছিল।
‘এত ওষুধ কিনতে গিয়ে তোমরা গরীব হয়ে যাচ্ছো, ঠিক না মা? আর কয়দিন এভাবে চললে তোমরা এতো গরীব হয়ে যাবে যে বাড়ি ভাড়া দিতে পারবে না। তখন দোতলার আংকেল আমাদের বাসা থেকে বের করে দিবে। আমি সব বুঝি।’
মা কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল – ‘তুমি ছোট মানুষ, টাকা-পয়সা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু তোমার মাথায় এসব চিন্তা ঢুকল কি করে? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে?’
‘টাকা খরচ হচ্ছে বলেই তো বাবার আমার ওপর এতো রাগ। বলল, আমার দাঁত ফেলে দেবে।’
মা ওর পাশে এসে বসলেন, তারপর মাথায় হাত রাখলেন – ‘শোনো, বাবারা একটু রাগী হয়। তার মানে এই না যে সে তোমাকে পছন্দ করে না। তোমাকে ওই কথা বলার পর সে মন খারাপ করে টিভির সামনে বসে ছিল।’
‘টিভিতে তো সে সারাদিন খবর আর টকশো দেখে। ওটা কিভাবে মন খারাপ করা হল?’
‘শোনো মাহিন, কেউ মন খারাপ করলে কাঁদে, কেউ মন খারাপ করলে টিভি দেখে। তোমার বাবার মন খারাপ হলে সে বসে বসে খবর দেখে, বুঝেছো?’ বলে মা ওর গাল টিপে দেয়। মাহিনও মায়ের কথা বলার ধরণ দেখে হেসে ফেলে।
২
দশটা বাজতে না বাজতেই মাহিনের ঘুম ঘুম লাগতে শুরু করল। ওষুধগুলো খেলে তার এরকম হয় – অনেক ঘুম হয়, কিন্তু ঘুমগুলো কেমন যেন ঘোরের মতো – অর্ধেক স্বপ্ন, আর বাকি অর্ধেক জেগে থাকা। তবুও সেটা সারা গায়ে যে মাঝে মাঝে ব্যথা ওঠে আর মনে হয় কেউ হাড়গুলো চেপে ধরে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে চাচ্ছে – তার চেয়ে অনেক ভাল। অন্য দিনগুলোর তুলনায় কেন যেন আজকে ওর একটু বেশিই দুর্বল লাগছে, আর ঘুমটাও অনেক বেশি করে আসছে।
সে কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিল, মনে নেই। ঘুম ভেঙে দেখে চারদিক অন্ধকার, শুধু জানলা দিয়ে বাইরের স্ট্রিটলাইটের আলো আসছে, আর সে আলোতে দেখা যাচ্ছে কেউ বিছানার পাশের হলুদ সোফাটায় বসে আছে। এতো রাত্রে কাউকে এরকম বসে থাকতে দেখলে ওর ভীষণ ভয় পাওয়ার কথা, এমনকি চিৎকার করে ওঠার কথা, কিন্তু কেন যেন লোকটাকে দেখে ওর একদম ভয় লাগল না। খুব স্বাভাবিক ভাবে সে বলল – ‘তুমি কে?’
‘আমাকে বলছো?’ বাচ্চা ছেলেদের মত একটা কণ্ঠ লোকটার।
‘তোমাকে বলবো না তো কাকে বলবো? ঘরে তো আর কেউ নেই, তাই না?’
লোকটা হেসে উঠল – ‘আমি একজন ফেরেশতা, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম পৃথিবীর সবচেয়ে লক্ষী মেয়েটাকে একটু দেখে যাই।’
‘মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাও নি, তাই না? আমি খুব ভালো করে জানি, তুমি একজন চোর। কিন্তু তোমার জন্য খারাপ খবর আছে, এ বাসায় নেয়ার মতো কিছুই নেই।’
‘বলো কি?’
‘হ্যা, আমার চিকিৎসা করতে গিয়ে বাবা-মা গরীব হয়ে গেছে। মায়ের ড্রয়ারে তুমি কোন গয়না-গাটি পাবে মনে হয় না। তুমি ভুল বাসায় এসেছো, সরি।’
‘তুমি কেন ভাবছো, আমি মিথ্যা কথা বলছি। ফেরেশতারা কিন্তু সত্যি সত্যিই আছে।’
‘আমি জানি ফেরেশতা আছে, মা বলেছে। মা কোনোদিন মিথ্যা কথা বলে না। কিন্তু ফেরেশতারা মানুষের কাছে আসে না। ওরা থাকে আকাশে।’
‘তুমি ভুল জেনেছো। ফেরেশতা মানুষের কাছে আসে। খুব স্পেশাল কিছু সময়ে আসে। আজ সেরকম স্পেশাল একটা সময়। তাছাড়া তুমি দেখো জানলা লক করা, ভেতর থেকে। আমি যদি চোর হতাম, তাহলে তো জানলা ভেঙে ঢুকতে হত, তাই না?’
মাহিন জানলার দিকে তাকাল। ঠিকই তো, জানলা ভেতর থেকে বন্ধ করা। তাছাড়া সে কোনদিন শোনে নি যে কোন চোর কষ্ট করে ঘরে ঢুকে চুরি না করে আরামসে বসে বসে বাসার বাচ্চাদের সাথে গল্প করে।
‘ফেরেশতারা বন্ধ জানলা দিয়ে ঢুকতে পারে?’
‘অবশ্যই পারে’ – লোকটা বলল – ‘আমরা আলো দিয়ে তৈরী। যেসব জিনিসের ভেতর দিয়ে আলো যেতে পারে, আমরাও সেসব জিনিসের ভেতর দিয়ে যেতে পারি। তোমার ঘরে ঢুকেছি ওই কাঁচের জানলা দিয়ে। কিন্তু আমরা দেয়াল ভেদ করে কোন ঘরে ঢুকতে পারি না – ওই যে আমরা আলো দিয়ে তৈরী, সেজন্য।’
মাহিনের হঠাৎ কি মনে হতে সে বলল – ‘আচ্ছা, তুমি যদি ফেরেশতা হও, তাহলে তুমি এসে ভালো হয়েছে। তুমি কি কোনভাবে আমার অসুখটা ভালো করে দিতে পারো? দেখো আমি কিরকম কষ্ট পাচ্ছি, বাবা-মা আমার ওষুধ কিনতে কিনতে গরীব হয়ে যাচ্ছে। তুমি জানো, মা তার সব সোনার গয়না বিক্রি করে দিয়েছে? বাবা আমাদের গ্রামের জমিটা বিক্রি করার জন্য সারাদিন ফোনে কথা বলে।’
ফেরেশতা হাসল, চাঁদের আলোয় তার ফর্সা মুখটা মাহিন দেখতে পাচ্ছিল।
‘তোমার অনেক বুদ্ধি, এজন্য বুঝে ফেলেছো, আমি তোমার সমস্যাটা ঠিক করতে এসেছি।’
মাহিন খুশি হয়ে উঠল – ‘বিশ্বাস কর। কথা দিচ্ছি, যদি ঠিক হয়ে যাই, তাহলে আর কোনদিন অংক হোমওয়ার্ক মিস করব না, ক্লাসের পড়া প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন পড়ব। দিনে এক ঘন্টার বেশি ইউটিউব দেখব না। ইউটিউব একেবারে বাদ দিতে পারব না, এটা অনেক বেশি কষ্ট হয়ে যাবে। আর হ্যা, নামাজ পড়ব, পাঁচ বেলা একদম সময় মত।’
ফেরেশতা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল – ‘এইতো বুঝতে পেরেছো, গুড গার্ল। আচ্ছা মাহিন, একটা জিনিস বল তো, তুমি কি মরে যাওয়াকে খুব খারাপ কিছু মনে কর?’
মাহিন অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল।
‘কিন্তু সেরকম তো নাও হতে পারে ! এমনও তো হতে পারে, মারা যাওয়ার পর আরেকটা পৃথিবীতে মানুষ চলে যায়, আর সে পৃথিবীটা এ পৃথিবীর চেয়েও সুন্দর।’
মাহিন হাত তুলে ফেরেশতাকে থামিয়ে দিল – ‘না, না, আমাদের ধর্ম স্যার বলেছে, মারা যাওয়ার পর অনেক ঝামেলা – কবরে আজাব হবে, কেয়ামতের মাঠে ভয়ে কাঁপতে হবে হাজার হাজার বছর ধরে, তারপর বেশির ভাগ লোকই দোজখে চলে যাবে। এগুলো তো অনেক ভয়ের কথা। আচ্ছা ফেরেশতা আংকেল, বল তো, চুলের চেয়ে চিকন পুল সীরাত দিয়ে মানুষ কি করে পার হবে? আমি তো শিওর নিচে দোজখে পড়ে যাবো।’
ফেরেশতা আবার হাসল, এবার শব্দ করে – ‘ধুরো বোকা মেয়ে, তুমি কেন দোজখে পড়ে যাবে। ওগুলো তো খুব খারাপ লোকদের জন্য। আর তুমি তো অনেক ভালো একটা মেয়ে। আমি কিন্তু জানি – তুমি শুয়ে শুয়ে সবার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর, এমনকি তোমার বাবার জন্যও।’
মাহিন চুপ হয়ে গেল। অনেক্ষন পর বলল – ‘তুমি কেন এসব বলছো, বল তো? তার মানে কি তুমি আমার অসুখ ঠিক করে দিতে পারবে না?’
ফেরেশতা মাথা নাড়ল – ‘আমি তোমাকে তার চেয়ে ভালো কিছু করে দিতে পারব।’
মাহিন উঠে বসল ওর বিছানায় – ‘তার মানে কি, আমি ভালো হব, আর আমরা অনেক বড়োলোকও হয়ে যাবো?’
ফেরেশতা এবার উঠে দাড়াল। মাহিন লক্ষ্য করল সে আপাদমস্তক সাদা কাপড় পরা, কিন্তু সেটা বেলিফুলের মতো সুন্দর একটা সাদা।
‘সব হবে। তার আগে তুমি আমাকে একটা কথা বল তো, পৃথিবীতে তোমাকে সবচেয়ে বেশি কে ভালোবাসে?’
‘মা’ – সাথে সাথে উত্তর দিল মাহিন।
‘হল না।’
মাহিন কিছুক্ষন কি যেন ভাবলো, তারপর বলল – ‘আমি নিজে?’
‘তাও হল না। শেষ চান্স।’
‘পারছি না’ – আরো কিছুক্ষন ভেবে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল মাহিন।
‘তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তোমাকে যে বানিয়েছে, সেই আল্লাহ।’
মাহিন চুপ করে শুনছিল।
‘এটা ঠিক যে, মানুষের মধ্যে তোমার মা-ই তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু সেই মা-কে বানালো কে? মায়ের মধ্যে ভালোবাসা ঢুকিয়ে দিলো কে? আল্লাহই তো, তাই না? তাহলে তোমার জন্য কার ভালোবাসাটা বেশি?’
‘এভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি’ – মাহিন স্বীকার করল – ‘তুমি মনে হয় ঠিকই বলেছ।’
ফেরেশতা এবার মাহিনের পাশে এসে বসল, তারপর ওর হাত ধরল। কি নরম তুলতুলে হাত, ঠিক মায়ের হাতের মতো।
‘তাহলে মাহিন’ – ফেরেশতা বলল – ‘একবার যাবে নাকি? আল্লাহর সাথে দেখা করতে?’
মাহিন তাড়াতাড়ি ফেরেশতার হাত ছেড়ে দিল – ‘আমার ভয় করে।’
‘ভয় কিসের, বোকা?’
‘মানে, আল্লাহর সাথে দেখা করে যদি ফিরে আসতে না পারি?’
‘আল্লাহর সাথে দেখা হলে কেউ সেখান থেকে ফিরে আসতে চায়ও না। কিন্তু তুমি না চাইলে থাকুক, আমি আজ তাহলে চলে যাই।’
‘দাড়াও। একটু। আমাকে চিন্তা করতে দাও।’ মাহিন ফেরেশতার হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিল।
মাহিন ওভাবেই বসে থাকে পুরো পাঁচ মিনিট। ওর মায়ের কথা ভাবে, ছোটবেলার কথা, এমনকি বাবার কথাও। অজান্তেই ওর চোখ দিয়ে পানি নেমে আসে। সবশেষে সে আস্তে করে বলে – ‘আমি চলে গেলে মায়ের কি হবে?’
ফেরেশতা ওর হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে – ‘মা-ও একদিন তোমার কাছে আসবে। তখন তুমি আর তোমার মা একসাথে আল্লাহর কাছে থাকতে পারবে।’
মাহিন আবার বসে থাকে আর কি যেন ভাবে, ফেরেশতার হাত সে শক্ত করে ধরে থাকে পুরোটা সময়। প্রায় এক ঘন্টা এভাবে বসে থেকে পর সে বলে – ‘জানো? অনেক ভেবে দেখলাম। এই ব্যথা আমার আর ভালো লাগে না, আর এই সারাদিন ঘুমও অসহ্য। আচ্ছা, ওখানে কি লাইফ বোরিং নাকি মজার?’
‘ওখানে এতো মজা যে কেউ ঘুমাতে যেতে চায় না। আর তাছাড়া ওখানে কোন অসুখ-বিসুখ নেই।’
‘তাহলে আমি রাজি’ – মাহিন হঠাৎ বলে ওঠে।
‘তাহলে চল’ – ফেরেশতা ওর হাত ধরে ওকে উঠতে সাহায্য করে।
‘দাড়াও। আমি তোমার সাথে যাবো কি করে? আমার শরীর তো তোমার মত আলো দিয়ে বানানো না যে জানলার কাঁচ দিয়ে বের হয়ে যাব।’
অনেক দিন পর মাহিন বিছানা থেকে স্বাভাবিকভাবে উঠে দাড়াল। শরীরটাও অনেক হালকা লাগছে, একদম কোন ব্যথা নেই।
ফেরেশতা মাহিনকে নিয়ে জানলার দিকে যেতে যেতে বলল – ‘তোমার শরীরকে তো আমরা সাথে নিচ্ছি না। যাচ্ছো তো শুধু তুমি, আর তুমি তো দেখতে আলোর মতোই। তুমি এখন আমার সাথে আকাশেও উড়ে যেতে পারবে। আমি শিখিয়ে দেব।’
‘আমার খুব ইচ্ছা মঙ্গল গ্রহটা নিজ চোখে দেখব। আমি কি ওখানেও যেতে পারব?’
‘তুমি যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারবে। আজ থেকে তুমি পৃথিবীর সব বাধা থেকে মুক্ত।’
৩
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মাহিন দেখলো জানলার বাইরে আসার পর থেকেই সে উড়তে পারছে, ফেরেশতার সাহায্য ছাড়াই।
মাহিন উড়ে উড়ে আকাশের আরো ওপরে ওঠার আগে একবার পেছনে ফিরে তাকাল। ও এখন ওর জানলার বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বাবা, মা আর ডাক্তার আংকেল ওর বিছানার পাশে বসে আছে। আশ্চর্য, বাবাও কাঁদছে ! আর মা তো ওকে জড়িয়ে ধরেই শুয়ে আছে।
আহা ! বোকা মা-টা যদি জানতো, জানালার এপাশে কত শান্তি !
[ এ গল্পটা নরওয়ের ঔপন্যাসিক Jostein Gaarder এর Through a Glass, Darkly থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। theme কাছাকাছি হলেও structure আর content পুরোপুরি আলাদা রাখার চেষ্টা করেছি। ]
(রহস্য গল্প / মায়িন খান, আগস্ট ২০২১)
