নাস্তিকতার পক্ষে যুক্তিসমূহ (১): ঈশ্বর থাকলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, কষ্ট ও সমস্যা কেন?
[ নোট: আমি প্রবন্ধটাকে যথাসম্ভব সেক্যুলার রাখতে চেষ্টা করেছি, কেননা মুসলমানদের মত খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু ভাই-বোনেরাও ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে ]
আমাদের মধ্যে যারা নাস্তিক আছেন, অর্থাৎ যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, তারা প্রায়ই এই প্রশ্নটা করে তাদের বিশ্বাসী ও আস্তিক বন্ধুদেরকে স্তম্ভিত করে দিতে চেষ্টা করেন।
একজন মঙ্গলময় ঈশ্বর থাকলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, কষ্ট ও সমস্যা কেন? কেন আফগানিস্তানে শিশুরা কষ্টে আছে? কেন পৃথিবীতে নারীদের ওপর এতো অবিচার? স্যাম হ্যারিসের মত বিশ্বখ্যাত নাস্তিক লোকজন এই প্রশ্নটাকে আস্তিকতার বিরুদ্ধে বার বার ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছেন।
প্রথম কথা হল, প্রশ্নটা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আদতে কোন প্রমান নয়, এটা শুধুই একটা অভিযোগ যে ঈশ্বর কেন সবাইকে সুখে-শান্তিতে রাখলেন না।
দ্বিতীয় কথা হল, এই নাস্তিকদের এই প্রশ্নটার খুব সহজবোধ্য কিছু উত্তর রয়েছে। এরকম অত্যন্ত শক্তিশালী কয়েকটা যুক্তি নিচে তুলে ধরা হল।
১ – দুঃখ-কষ্ট মানব-আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে
ব্রিটিশ দার্শনিক জন হিক বিশ্বাস করতেন যে স্রষ্টা মানুষকে অসম্পূর্ণ করে বানিয়েছেন আর জীবনটা হলো নিজেকে সম্পূর্ণ করার এক যাত্রা। দুঃখ-কষ্ট মানুষের আত্মাকে সেভাবে খাঁটি বানায়, যেভাবে আগুন স্বর্ণ থেকে খাদকে দূর করে।
যেমন, অনেকেই বড় কোন দুর্ঘটনার পরই কেবল জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজতে শুরু করে, তার আগ পর্যন্ত পশু-পাখির মত ভোগবাদী জীবন-যাপন করতে থাকে। হঠাৎ করে আসা অসুস্থতা কিংবা দারিদ্র্য অনেককেই মানসিকভাবে পরিণত করে।
জন হিকের এই দর্শনটি অবশ্য তাদের জন্য প্রযোজ্য না, যারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল – কেননা এরা কষ্ট পেয়ে মারা গেল ঠিকই কিন্তু সেই কষ্ট থেকে শেখার কোন সুযোগ পেল না। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা পেতে হলে যেতে হবে পরবর্তী যুক্তিগুলোতে।
২ – পৃথিবীতে সমস্যাগুলোর জন্য মানুষ নিজেরাই দায়ী
এলভিন প্লানটিঙ্গার মত দার্শনিকরা বলতে চেয়েছেন – ঈশ্বর জগৎকে সৃষ্টি করে এর মধ্যে কতগুলো নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, আর মানুষকে দিয়েছেন বিবেক ভালো আর মন্দের পার্থক্য বোঝার জন্য। এরপরও যদি মানুষ ভুল পথ বেছে নিয়ে বিপদে পড়ে, তাহলে তার জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা হবে অন্যায়।
রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চালকের দোষে। একটা দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রনায়কের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। এখানে ঈশ্বর কিভাবে দায়ী?
এই যুক্তিটা অবশ্য বন্যা কিংবা জলোচ্ছাসে সর্বস্ব হারানো কিংবা নিরীহ বাসযাত্রীর দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। সে ব্যাখ্যার জন্য যেতে হবে পরের যুক্তিগুলোতে।
৩ – ঈশ্বর যা করেন তা সব মিলিয়ে ভালোর জন্যই করেন
আমরা মানুষ হিসেবে জগতের খুব ছোট একটা ছবি দেখি, কিন্তু ঈশ্বর ওপর থেকে পুরো ছবিটা দেখছেন। ঈশ্বর কল্যাণময়, তিনি যা করেছেন তার মধ্যে কোন না কোনভাবে আমাদের জন্য ভালো কিছু রয়েছে।
ছোট কষ্টের মধ্যে বড় কষ্ট থেকে মুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু বড় সেই কষ্টটাকে দেখতে হয়নি বলে মানুষ কোনোদিনই ঈশ্বরের এই দয়ার কথাটা বুঝতে পারে না, যদি না সে বিশ্বাস করে।
৪ – পরকালের ধারণার মধ্যে দুঃখ-কষ্টের প্রতিদানের আশা আছে
ইতালির প্রখ্যাত যাজক সেইন্ট টমাস একুইনাস প্রায় হাজার বছর আগে এরকম একটা ধারণা প্রচার করেছিলেন। সৃষ্টির যে মডেলে ধার্মিক লোকজন বিশ্বাস করে, সেখানে পরকাল বলে একটা কথা আছে – আর পরকাল বলে যদি কিছু থাকে তাহলে কিন্তু সেখানে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া একজন মানুষের সব কষ্টের শোধ-বাদ হয়ে যাবার সুযোগ আছে।
একজন নিরীহ লোক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে মারা যেতে পারে ঠিকই, কিন্তু সে যদি পরকালে অনন্তকালের জন্য স্বর্গ পেয়ে যায় তাহলে তার আসলে আর কোন আফসোসই থাকে না। আর এভাবে এটা শেষপর্যন্ত ঈশ্বরের ন্যায়বিচারই হয়।
৫ – জীবন একটা পরীক্ষা
বাইবেল কোরান দুটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পার্থিব জীবন পুরোটাই একটা পরীক্ষা, বিপদাপদ তো অবশ্যই মানুষের জন্য পরীক্ষা। পরীক্ষার সব প্রশ্ন সহজ নাও হতে পারে।
যে বিশ্বাসী, সে সুখ আর নিরাপত্তার সময় স্রষ্টার দিকে এগিয়ে যায় কৃতজ্ঞ হওয়ার কারণে, আর দুঃখ-কষ্টের সময়ও স্রষ্টার দিকে এগিয়ে যায় ধৈর্য আর স্রষ্টার ওপর ভরসার মাধ্যমে। সে পুণ্যের সময় স্রষ্টার কাছাকাছি থাকে আশা করে করে, এমনকি পাপের সময়ও কাছাকাছিই থাকে যদি তার মধ্যে অনুশোচনা থাকে। এসব কারণেই একজন বিশ্বাসী সুখ দুঃখ দুই অবস্থাতেই শান্তিতে থাকতে পারে।
ওপরের এ আলোচনা থেকে বোঝা গেল, একটা শক্তিশালী ধর্মীয় মডেল, যেটা নাস্তিকতার যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে, তার মধ্যে দুইটা ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ:
১ – মৃত্যুতে সবকিছুর শেষ নয়, মানুষের আত্মা পরকাল পর্যন্ত টিকে থাকবে, আর সেই পরকালে ন্যায়বিচার পরিপূর্ণ হবে;
২ – জীবন শুধু উপভোগের জায়গা নয়, কষ্টভোগও এর অংশ, আর সুখ-দুঃখ দুটাই মানুষের জন্য ঈশ্বরের পরীক্ষা।
(প্রবন্ধ – চলবে)
