হোটেল লাবনীতে তুমি পুরো একটা স্যুট ভাড়া নিয়েছিলে। আত্মহত্যার আগে কয়েকটা দিন তুমি নীরবে নিভৃতে কাটাতে চেয়েছিলে। বুকিংয়ের সময় বলেছিলে, অবশ্যই যেন তোমাকে সাগরের দিকে মুখ করে একটা রুম দেয়া হয়। টাকা নিয়ে তুমি চিন্তা কর নি, আর এত টাকা দিয়ে তুমি করবেই বা কি ! গত বুধবার সন্ধ্যায় তুমি একাকী নিভৃতে একটা মাত্র সুটকেস নিয়ে এই হোটেলে এসে উঠেছিল।
আমি নিশ্চিত নই কেন তুমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। কিন্তু এটা জানি, সেই সিদ্ধান্তটা এসেছিল কি এক ‘নাগিনী’ ছবিতে তোমার বদলে নাহিদা আনোয়ারকে নায়িকা হিসেবে নেয়ার পর পরই।
তুমি লবিতে এসেছিলে নিকাব পরে, যেন তোমার ভক্তরা তোমাকে কোনভাবেই চিনতে না পারে। ম্যানেজার কিন্তু তোমাকে ঠিকই চিনেছিল, কারণ সে ছিল তোমার মুগ্ধ একজন অনুরাগী। কিন্তু সেই তরুণ তোমাকে সাহায্য করেছিল, সে কেমন করে যেন বুঝতে পেরেছিল যে তোমার জীবনে এখন একটু নির্জনতা প্রয়োজন। তোমার মনে হয়েছিল, জীবনে এই প্রথম কেউ তোমার অনুভূতিকে সম্মান করল, অনেকদিন পর কারো সাথে তোমার অভিনয় করতে হল না। তুমি যখন তাকে ‘ধন্যবাদ’ বলেছিলে, সেটা মনের একেবারে গভীর থেকেই ছিল।
ম্যানেজার ছেলেটা তোমাকে তিনতলায় একটা দুই রুমের স্যুট দিয়েছিল। শোবার ঘরের বড় জানলাটা সাগরের দিকে, সকালে সূর্য উঁকি দিতে না দিতেই সমুদ্রটার নীল হয়ে ওঠা দেখা যায় বিছানায় বসেই। বসার ঘরের সাথে লাগোয়া একটা বারান্দা, ওখানে দাঁড়ানো মাত্র সাগরের নোনা বাতাস আর অক্টবর সূর্যের মৃদু আলো তোমার পাতলা গোলাপি ঠোঁট আর নরম ফর্সা গালকে ছোয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতে শুরু করে দেয়।
তুমি সবকিছুই ঠিক করে রেখেছিলে, এমনকি রক্তবর্ণের যে ওড়না দিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে নিজেকে ঝোলাবে সেটাও তুমি ভাঁজ করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলে। তুমি নায়িকা, ড্রেসের অভাব নেই তোমার – তবু মারা যাওয়ার সময় তুমি ওই নীল জামাটা পরবে ভেবেছিলে, যেটা তোমার বাবা গত ঈদে তোমাকে কিনে দিয়েছিল। তোমার পরিকল্পনা ছিল মঙ্গলবারদিন গলায় ফাঁস নেয়া, কেননা সেদিন হতো তোমার ঊনত্রিশতম জন্মদিন।
হোটেলে ওঠার পর পুরো পাঁচদিন তুমি একা একাই কাটালে, একবারের জন্যও রুম থেকে বের হলে না। বেয়ারা সকালের নাস্তা আর রাতের খাবার তোমার বসার ঘরে দিয়ে আসতো, তুমি বেডরুমেই বসে থাকতে, নীরবতা দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পুরো পৃথিবী থেকে।
কিন্তু সোমবার সকালে যখন ম্যানেজার ছেলেটা নাস্তা নিয়ে এলো, তুমি রুম থেকে বের হয়ে এলে। ভেজা কালো চুল তোমার লাল শাড়ির ওপর এলিয়ে পড়ে ছিল। তুমি স্মিত হেসে জানতে চাইলে, বেয়ারা ছেলেটার বদলে খোদ ম্যানেজারকে কেন খাবার নিয়ে আসতে হল। ম্যানেজার বলল, বেশ কয়েকজন একসাথে ছুটিতে গেছে বলে সে নিজে কিছু রুমে সার্ভিস দিচ্ছে। তুমি ওকে বসতে বললে, কিন্তু সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
তুমি ওর নাম জানতে চাইলে, জানতে চাইলে সে কতটুক লেখাপড়া করেছে। রাসেল নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল – সে ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছে, কিন্তু বড় শহরে কোন চাকরি পায় নি। জমানো টাকা সব শেষ হয়ে এলে কাউকে ধরে সে এই চাকরিটা জোগাড় করেছে। কিন্তু এখন সে সুখী, সমুদ্রের গন্ধ তার ভালো লাগে। বন্ধু-বান্ধব নেই বলে সে অবসরে বই পড়ে, আর মাঝে মাঝে কবিতা লেখে। তুমি ওর একটা কবিতা শুনতে চাইলে সে বলেছিল ওসব কবিতা পড়ে শোনানোর মত না ।
সে সন্ধ্যায়ও রাসেল খাবার নিয়ে এলো। তুমি এবারো তাকে বসতে বললে। সে বসল, কিন্তু শুরু থেকেই কাঁচের অ্যাশট্রেটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তুমিই কথা শুরু করলে, বললে – ছয় বছরের ক্যারিয়ারে তুমি অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছো, প্রতিবার চেষ্টা করেছো প্রতিটা চরিত্রের সাথে মিশে যেতে। তোমার সাফল্যের রহস্য এটাই, কিন্তু সবকিছুরই একটা বিনিময় থাকে। তোমাকেও তোমার সাফল্যের মূল্য দিতে হল – পরিণত বয়সে এসে তুমি আজ আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আগের মতো নিজেকে খুঁজে পাও না, তোমার চেহারা কখনো হয়ে যায় সোমা, কখনো তুলি, কখনো বা পাল্টাতে পাল্টাতে তামান্না। রাসেল জানলার বাইরে তাকিয়ে বলেছিল – সে তোমার প্রতিটা সিনেমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে।
তুমি হেসে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে, ও তোমাকে পছন্দ করে কিনা। সে অকপটে স্বীকার করেছিল, তুমিই ওর জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। জানলার বাইরে তাকিয়ে থেকে রাসেল বলেছিল – সে মানুষের সাথে মিশতে পারে না, তাই তার ভালো লাগা না লাগাতে কারো কিছু যায় আসে না।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তুমি হাত-মুখ ধুয়ে ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক দিলে, চুলে বেণী করলে, মুখে ফাউন্ডেশন দিলে আর গায়ে প্যারিস থেকে আনা সেন্ট মাখলে। বাবার দেয়া ঈদের নীল জামা না পরে তুমি লাল রঙের একটা শাড়ি পরলে। আজ মঙ্গলবার বেলা বারোটায় তোমার চেক আউট করার কথা – সবাই জানে তুমি হোটেল থেকে চেক আউট করবে, কিন্তু শুধু তুমিই জানতে তুমি পৃথিবী থেকেই বিদায় নেয়ার পরিকল্পনা করছিলে, আর সেটাও ঠিক বেলা বারোটায়ই।
দশটার দিকে তুমি রুম সার্ভিসে ফোন করে রুমে নাস্তা দিয়ে যেতে বললে। তুমি অনুরোধ করলে যেন ম্যানেজার নিজেই আজ তোমার এই রুম সার্ভিসটা করে। যে লাল ওড়নাটা তোমার ফ্যানের সাথে ঝোলানোর কথা ছিল, সেটা তুমি ড্রয়ার থেকে সরিয়ে সুটকেসে রেখে দিলে।
রাসেল নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢোকার পর তুমি ওকে বললে দরজার বাইরে ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ সাইন লাগিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে, তারপর তোমার পাশে এসে বসতে। সে বাধ্য ছেলের মতই তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল।
সেদিন সারাদিন রাসেল তোমার ঘরে ছিল। কেউ জানে না তোমরা এতক্ষন ঠিক কি নিয়ে গল্প করেছো। যাই হোক, সেই মঙ্গলবার দুপুরে তোমার কিন্তু আর হোটেল থেকে চেক আউট করা হয় নি।
[ অনুপ্রেরণা: Al Stewart এর গান Broadway Hotel, যদিও থিম একেবারে ভিন্ন ]
(অনু গল্প / মায়িন খান, অক্টোবর ২০২১)
