ভোর

ভোর হওয়ার আগের সময়টায় রাতের অন্ধকারটা যখন প্রগাঢ়তম হয়, ঠিক তখন ফারুক ছায়াটা দেখতে পায় – প্রতিদিন। ওর বেডরুমের সদ্য চুনকাম করা সাদা দেয়ালের এখানে-ওখানে ভেসে ওঠে একটা বিশেষ চেহারা, আর ফারুক ভয়ে-আতঙ্কে জমে যায় প্রতিদিন – ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

যাদের ‘জাদু-টোনা’ করা হয় কিংবা যাদের ওপর ‘জীনের আসর’ হয়, তারা নাকি অনেকসময়ই ঘরের দেয়ালে কিংবা বাথরুমের মেঝেতে বিভিন্ন রকম চেহারা ভেসে উঠতে দেখে থাকে। ফারুক অবশ্য ওর ঘরে মনিহীন কোন চোখ বা একপাশ থেতলে যাওয়া কোন মুখ দেখে না, ওর দেয়ালগুলোতে ও বরং একটা অতি পরিচিত মুখই দেখতে পায় প্রত্যেকটা দিন – ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

যুক্তিবাদীরা নিশ্চয়ই বলবে, এগুলো সবই মনের ভুল – আসলে মানুষ তাই চায় যা সে কোনোদিন পাবে না, অস্পষ্ট অবয়বগুলোর ভেতরে সে তাই খুঁজে বের করে যা সে প্রবলভাবে দেখতে চায়। ঠিক এ কারণেই একই মেঘে কেউ খুঁজে পায় রবিঠাকুরকে, আর কেউ বা সাদা এক হাতিকে। মনের ভুল কিংবা জীন-ভুত, যে কারণেই হোক, সারা রাত বিছানায় একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ করে কাটিয়ে দেয়ার পর প্রতিদিন দেয়ালে রুমার চেহারাটা দেখতে পায় ফারুক – ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

রুমার সাথে ওর বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে প্রায় ছয় মাস। সব কাগজ-পত্র ঠিক-ঠাক হয়ে যাওয়ার পর যখন রুমা ফোন নাম্বার পাল্টে ফেলল, সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল, এর পরদিনই ফারুক সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া স্ত্রীর চেহারা প্রথম দেখতে পায় ওর বেডরুমে – ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

বেশ কয়েক সপ্তাহ ঘুমহীন কাটানোর পর ফারুক যখন জ্যোতিষীরাজ ধীমান বোসের কাছে পাথর চাইতে গিয়েছিল, জ্যোতিষী বলেছিল – যেহেতু রুমা একসময় ওকে খুব ভালোবাসতো, এটা অসম্ভব না যে তার আত্মা এখনো ঘুরে ফিরে বেড়ায় ফারুকের আশেপাশে, এই ছায়া সেই অশরীরী উপস্থিতিরই প্রতিফলন।
‘মৃতদের আত্মার ব্যাপারে এ ধরণের কথা শুনেছি, কিন্তু জীবিতদের আত্মার ক্ষেত্রে এটা কোনদিন শুনি নি আমি’ – ফারুক বলেছিল।
‘আত্মা তো আত্মাই – তার আবার জীবিত কি, আর মৃত কি!’ – জ্যোতিষী হেসে উত্তর দিয়েছিল।
বোসবাবু থেকে সে সন্ধ্যায় পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ফারুক ‘কুপ্রভাব-বিনাশী’ সবুজ পাথর কিনে আনলো, কিন্তু পরদিনও সে রুমার ছায়া স্পষ্টই দেখলো বিছানার পাশের সাদা দেয়ালে – ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

রুমা কেন ওকে ছেড়ে গেল, সেটা ফারুকের কাছে কোনোদিনই স্পষ্ট ছিল না। ও এখনো জানে না, রুমা ঠিক কি চাইছিল তার কাছ থেকে। সারাদিন কাজ শেষে ওকে এর চেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া কি তার পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল? আটপৌরে জীবনটাকে কি কোনোভাবে এর চেয়ে কম একঘেয়ে করা যেত? নাকি ও যখন ফারুককে চুমু খেত, তখন ওর মনে জেগে থাকতো অন্য কারো চেহারা? ভেতরে ভেতরে কি সবকিছুই বদলে গিয়েছিল, আর ফারুক এর কিছুই ধরতে পারে নি? কিছুই নিশ্চিত নয়, তবু এসব প্রশ্ন ফারুককে সারা রাত জাগিয়ে রাখতো – ভোর হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।

সবসময় যে দুঃসহ স্মৃতিই ফারুককে ওর রাতগুলোতে জাগিয়ে রাখতো, তা কিন্তু না। অন্ধকার গাঢ় হলে বাসার সামনের গলিটা যখন জনশূন্য হয়ে পড়তো, তখন কখনো কখনো ওর মনে পড়তো ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর কথা – দুপুরের লাইব্রেরিতে একসাথে বই পড়া আর একটু পর পর লুকিয়ে একজন অন্যজনকে দেখা, বিকেলে ক্যান্টিনে সিঙ্গারা আর চা খাওয়া। রুমা একদিন তাকে বলল ‘তুমি একটা আস্ত শয়তান’ তারপর তার কান টেনে দিলো, সেদিন বাসায় ফিরে ফারুকের সে কি ফুর্তি ! সোনালী দিনগুলোর সেসব স্মৃতিও ফারুকের ঘুম কেড়ে নিতো, জাগিয়ে রাখতো তাকে – ভোর হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।

যেভাবে হঠাৎ শুরু হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ফারুকের ঘুমের এই সমস্যাটা একদিন আবার হঠাৎ করে ঠিক হয়ে গেল। মার্চের তেরো তারিখ সন্ধ্যায় ঝন্টুর সাথে ওর দেখা হয়েছিল শাহবাগের বইপাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঝন্টু ছিল ফারুক আর রুমা দুজনেরই কাছের বন্ধু। সে কোথায় যেন শুনেছে, রুমার আবার বিয়ে হয়েছে – ছেলে ফ্লোরিডা থাকে। ওই ছেলেরও এটা দ্বিতীয় বিয়ে, তিন বছর আগে তার বৌ ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল। খবর শুনে ফারুক হো হো করে হেসে উঠলো, ঝন্টু তখন চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বন্ধুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সে রাতে বাসায় ফিরে ফারুকের মনে হল, সে অনেকদিন পর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে ওর মনে পড়ল – স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর যখন সে ক্যাসেট ভাড়া করে এনে সারারাত একশন মুভি দেখতো, তখনো তার নিজেকে এরকমই ভারমুক্ত মনে হত। আজ অবশ্য সারারাত ওর টিভি দেখা হল না, একটা রগরগে সিনেমা দেখতে দেখতে কোন এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। অবশ্য প্রতিদিনকার মতোই – তার সেই ঘুম ভাঙলো ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

ঘরে তখন কৃষ্ণগহ্বরের মতো নিকষ কালো সর্বগ্রাসী এক অন্ধকার, একমাত্র আলোর উৎস করিডোর থেকে উদ্বাস্তু হয়ে দরজার নিচ দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া আলোর একচিলতে একটা রেখা। ফারুক উঠে বসে চারিদিকে তাকালো, কিন্তু রুমার চেহারা কোন দেয়ালে ফুটে উঠতে দেখল না আজ – ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

হঠাৎ ফারুকের কি হল সে নিজেও জানে না, সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল – তারপর ঘরের এ দেয়াল থেকে ও দেয়ালে ছুটে বেড়াতে লাগল, পাগলের মত খুঁজতে লাগল কোথাও কোন দেয়ালে রুমার ছায়াটা শেষপর্যন্ত ভেসে ওঠে কিনা। অনেকক্ষণ সে এরকম খুঁজলো, তারপর একসময় হাল ছেড়ে দিল। সে কাঁদতে চেষ্টা করল, কিন্তু ঘুম হারা চোখে অশ্রু এক ফোটাও এলো না। পুরো ব্যাপারটাই যে ওর মনের একটা ভুল ছিল, সেটা খুব দ্রুতই ফারুক বুঝতে পারল সেদিন – ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।

[ অনুপ্রেরণা: Al Stewart এর গান Optical Illusion, যদিও থিম একেবারে ভিন্ন ]

(অনু গল্প / মায়িন খান, অক্টোবর ২০২১)

Leave a comment