ফেরা

১.

চৈত্র মাসের এক বিকেল। ছোট রাস্তার পাশে আবুল মিয়ার চায়ের দোকানে বসে জাহিদ স্থানীয় পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিল। চা-টা ছিল ঘন, ছোট সাইজের কাপটা প্রতিবার মুখের কাছে আনা মাত্র এর ধোয়া জাহিদের খাড়া নাক আর কালো চশমার ওপর ছোয়া দিয়ে যাচ্ছিল। হাতের পেপারের একটা খবরে চোখ পড়া মাত্র ও একটু নড়ে চড়ে বসল।

গত তিন মাসে এই রেলস্টেশনের আশে-পাশের এলাকা থেকে যে আটজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ উধাও হয়ে গেছে – কোন হদিস ছাড়াই – এই খবর প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত এদের কারো খোঁজ পাওয়া যায় নি। এটা পুরোনো একটা খবর, সে আগেও এ ধরণের একটা কথা মান্নানের কাছে শুনেছে, কিন্তু সে ভেবেছিল এসবই ছোট শহরের খণ্ডকালীন গুজব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সত্যি সত্যিই এসব ঘটে চলেছে ওর আশে-পাশে।

হারিয়ে যাওয়াদের মধ্যে তিনজন ছিল যুবক, দুইজন কিশোর, মধ্যবয়স্ক আর বৃদ্ধ একজন করে, আরেকজন চল্লিশোর্ধ এক মহিলা। এদের প্রত্যেকে নিখোঁজ হয়েছে ভোর হওয়ার ঠিক আগের সময়টায়।  যারা হারিয়ে গেছে, তাদের কারো জীবনেই কোন অস্বাভাবাবিকতা ছিল না, কারোরই কোন ব্যক্তিগত শত্রূ খুঁজে পাওয়া যায় নি। এই দুর্ভাগা আটজনের প্রথমজন ছিল পঁচিশ বছরের এক তরুণ, আর সে হারিয়ে গিয়েছিল আজ থেকে ঠিক তিন মাস আগে। 

তিন মাসের ব্যাপারটা জাহিদের মাথায় বার বার ঘুরে-ফিরে আসতে লাগলো। মলির বিয়েটাও প্রায় তিনমাস আগেই হয়েছিল, জানুয়ারির ত্রিশ তারিখে। ওদের বাসার সবার দাওয়াত ছিল সেই বিয়েতে। মলির ছোটবোন রিমি, যে এখন ক্লাস এইটে পড়ে, নিজে এসেছিল অনুরোধ করে জাহিদকে বিয়েতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জাহিদ কারো কথাই শোনে নি, ওর ফ্লোরের বিছানায় কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে ছিল সারা সন্ধ্যা।     

জাহিদের মনে পড়ল – সুস্থ-সবল এতগুলো মানুষের স্রেফ শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া নিয়ে জাতীয় পত্রিকাগুলোতে খবর বের হয়েছিল গত মাসে, স্থানীয় কাগজে রটেছিল অনেক গুজব। কেউ বলেছে, এটা কোন সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ – হতে পারে এদের মেরে শরীর থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুলে নেয়া হয়েছে, তারপর সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে লাখ টাকায়। যেহেতু শরীরের বেশির ভাগই কালোবাজারে বিক্রি হয়ে গেছে, সেজন্য লাশের খোঁজও পাওয়া যায় নি। আরেকদল বলেছে, এরা সন্ত্রাসী কোন সংগঠনে নাম লিখিয়ে এখন গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে – সময়মত গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে এসে শুরু করবে বোমাবাজি আর আত্মঘাতী হামলা।     

চায়ের কাপ বেঞ্চিতে রেখে জাহিদ উঠে দাঁড়াল, পকেটে হাত দিল খুচরো টাকাগুলোর খোঁজে, পেপারটা রেখে দিল বেঞ্চির একপাশে। এতগুলো মানুষের একসাথে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টা সত্যিই রহস্যজনক। কিন্তু জাহিদ এখনো বিশ্বাস করতে পারে না, এগুলোর ভেতর কোন ষড়যন্ত্র বা রহস্য আছে। ওর ধারণা, জীবনের ওপর বিরক্ত হয়ে মানুষ পালিয়ে অন্য কোথাও অন্য কোনখানে চলে যেতেই পারে, এর মধ্যে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই।  

জাহিদ বড় রাস্তায় সারি সারি শতবর্ষী গাছগুলোর ছায়া মাড়িয়ে হেটে চলে আর বিষয়টা নিয়ে আরেকটু ভাবার চেষ্টা করে। সত্যি কথা বলতে গেলে, মলিও তো এই আটজনের চেয়ে খুব একটি ব্যতিক্রম কিছু না। যে শহরে ভোরবেলা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, দুপুরে বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরে কাঁথা গায় দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়, যে শহরের অলিতে-গলিতে মালাই চা খেয়ে অংক পরীক্ষায় ফেল করার কষ্ট ভুলে যাওয়া যায়, যে শহরে লোডশেডিংয়ের অত্যাচারের ভেতর মোমের আলোতে হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী পড়তে পড়তে অর্ধেক রাত পার করে দেয়া যায় – সে শহর আর সে পুরোনো দিনগুলো ছেড়ে সে তো ঠিকই ঢাকা শহরের মত প্রাণহীন কংক্রিটের বস্তির এক জীবন বেছে নিয়েছে, গার্মেন্টস মালিকের গোলগাল এক ছেলের হাত ধরে চলে গেছে জাকজমকের অন্য এক পৃথিবীতে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে মলিও কিন্তু ওই আটজনের মতোই পলাতক, সুতরাং পত্রিকায় হারানো মানুষের সংখ্যা আট না হয়ে বরং নয়ই হওয়া উচিত ছিল।      

মলির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর প্রায় মাস তিনেক ধরে জাহিদ চেষ্টা করেছে ওর স্মৃতিগুলো ভুলে যেতে, তারপর একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় অনেক ভাবনা-চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে আত্মহত্যা করবে – ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন এক ভোরে। মরে যাওয়ার এটাই বোধহয় সবচেয়ে দ্রুত আর নিশ্চিত উপায়, তাছাড়া দ্রুতগতিতে মৃত্যুর প্রক্রিয়া শেষ হলে যন্ত্রণাটা কম হবার একটা সম্ভাবনা আছে – হয়তো দেখা যাবে কিছু বোঝার আগেই সে মরে গেল।      

মলি তাকে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু জাহিদ কেন যেন ওকে ভুলতে পারে নি। প্রায় প্রতিদিন ওকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই স্কুলের দিনগুলোর স্মৃতি, যখন জাহিদ মলিদের দোতলা বাসাটায় যেত রিমিকে অংক বোঝাতে। রিমি তখনো প্রাইমারীতে পড়ে, সে গোলাপি একটা ফ্রক পরে বারান্দায় এসে দড়ি লাফাত, আর দেখতে ছিল হুবহু মলির মত। এসব স্মৃতি সুন্দর কিন্তু দুঃসহ, হয়তো মৃত্যুর ওপারে গিয়েই এর ভার থেকে চিরতরে মুক্ত হতে পারবে জাহিদ।  

২.

মৃত্যু বিষয়ক পরিকল্পনাটা নিয়ে জাহিদের কোন সংশয় ছিল না, ফলে সোমবারদিন শেষরাতে সে চলে এলো বড়ো রাস্তার মোড়ে রেলক্রসিংটার কাছে, তারপর হাটতে শুরু করল দক্ষিণ দিক বরাবর। মসজিদগুলো থেকে তখনো ফজরের আজানের ধ্বনি ওঠা শুরু করে নি, নেড়ি কুকুরগুলোও যেন পথ ছেড়ে পালিয়েছে, এমনকি আশে-পাশে একটা ঘুমন্ত মানুষও চোখে পড়ছে না। রেললাইন বরাবর হাটতে হাটতে জাহিদের কেন যেন হঠাৎ মনে হল, এ জায়গাটা বড্ড বেশি নির্জন আজকে। প্রতিদিন ভোরে কি রেললাইনটা এরকমই থাকে? চৈত্র মাসের এই গরমের ভেতর হঠাৎ চারিদিকে এত কুয়াশাই বা এলো কোথা থেকে?

বহু বছর আগে – সেই ১৯৩৫ সালে – এরকমই এক পরিস্থিতিতে পড়েছিল ভিক্টর গডার্ড নামে এক ইংরেজ বৈমানিক। সে তার যুদ্ধবিমান নিয়ে এন্ডোভার থেকে ওর নিজ শহর এডিনবার্গ ফিরে আসার পথে এক ঝড়ের কবলে পড়েছিল, আর ঝড়ের ঠিক চরম অবস্থায় হঠাৎ করেই ওর সামনে আকাশ নীল হয়ে গিয়ে নিচে সে দেখতে পেয়েছিল বিশ বছর অতীতের স্কটল্যান্ডের একটা দৃশ্য।

এই কাহিনীটা প্রকাশিত হয়েছিল রহস্যপত্রিকার একটা বিশেষ সংখ্যায়। মলি যখন ক্লাস এইটে পরে তখন ওর সাথে জাহিদের কথা-বার্তা শুরু হয়েছিল রহস্যপত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যাটা নিয়েই। এর পর থেকে মলির সাথে ওর কত কিছু নিয়ে যে কথা হতো সেটা বলে শেষ করা যাবে না।   

মলি আর জাহিদ দুজনেরই বিশ্বাস করতো যে, গডার্ড নামে সেই বৈমানিক সময়ের কোন টানেলে পড়ে গিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও চলে গিয়েছিল সুদূর অতীতে। আসলে ওদের দুজনেরই ছিল বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল, ভিনগ্রহের প্রাণী আর সম্মোহন বিদ্যার মত বিষয়গুলোর প্রতি দারুন আকর্ষণ। দুজনই ভালোবাসতো জুল ভার্ন আর এইচ জি ওয়েলসের অনুবাদ বই পড়ে শিহরিত হতে, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কেনা পেপারব্যাক বইগুলো দেয়া-নেয়া করতো ওরা প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে। হাতে সাদা চুরি পরত মেয়েটা সেসময় – বহুবছর আগের কথা সেসব – তার মনটা ছিল খুব খোলামেলা। একটা চশমা পড়ত স্টিল ফ্রেমের, অদ্ভুত লাগত দেখতে।

স্টেশন থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে থাকতে যে জায়গাটা থেকে মলিদের পুরোনো বাসাটা দেখা যায়, ঠিক সেখানে এসে হাটা থামাল জাহিদ। সাদা রং করা দোতলা সেই বাসার বারান্দাটাতে হলুদ একটা লাইট জ্বলছে, মলিদের নিজেদের বাসা ওটা। হয়তো একটু পর ভোর হলে ওর বাবা, মা কিংবা ছোট বোন রিমি এসে দাঁড়াবে ওখানে, হাতে দাতব্রাশ নিয়ে তাকাবে ভোরের আলোর দিকে। বলা যায় না, মলিকেও ওখানে দেখা যেতে পারে কিছুক্ষন পর, সে তো প্রতি সপ্তাহে একবার আসেই এখানে বেড়াতে – যদিও জাহিদ হয়তো ততক্ষনে চলে গেছে অন্য কোন পৃথিবীতে, অন্য কোন বাস্তবতায়।

আবার হাটতে শুরু করতেই জাহিদের মনে হল শরীরটা আস্ত এক গমের বস্তা হয়ে গেছে, কিছুতেই আর সামনে এগিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। নিজের শরীরকে যে নিজের কাছে বোঝা মনে হতে পারে, সে ধারণা ওর কোনদিন ছিল না। হয়তো আসন্ন সমাপ্তির কথা শরীর কোনভাবে টের পেয়ে গেছে – জাহিদ ভাবল। সে ধপ করে রেললাইনের ওপরই বসে পড়ল। ট্রেন কখন আসবে সেটা সে ঠিক জানে না। সে শুধু জানে যে ভোরে একটা ট্রেন এদিক দিয়ে যায়। ছোটবেলা যখন বাবার হাত ধরে ভোরে হাঁটতে বের হতো, তখন একটা নীল-হলুদ ট্রেনকে স্টেশনের দিক থেকে উত্তর দিকে যেতে দেখতো। ট্রেন হয়তো লেট হয়েছে, হয়তো জীবনের শেষ কয়েকটা ঘন্টা মলির বাসার দিকে তাকিয়েই কাটাতে হবে ওর, আর এটাই ওর ভাগ্যে লেখা ছিল। 

সবসময় যে জাহিদই মলি-রিমিদের বাসায় যেত, তা কিন্তু না। কোন কোন বিকেলে মলি নিজেও  জাহিদদের বাসায় চলে আসতো, গল্প করতো রুমা আপার সাথে। জাহিদ তখন ওদের সাথে গল্পে যোগ দিতো, আর মাঝে মাঝে ক্যারম খেলতো। কিন্তু সন্ধ্যার পর ওকে বাসায় পৌঁছে দেবার জন্য মলি সবসময় জাহিদকেই নিয়ে যেতে চাইতো আর কথা বলার সময় মিটি মিটি হাসত। সন্ধ্যার রাস্তায় অনেকক্ষণ পাশাপাশি হাটার পর ওদের বারান্দার আলোটা দেখামাত্র ও খুব খুশী হয়ে উঠতো।

কুয়াশার মধ্যে হঠাৎ একটা আলোর রেখা দেখে জাহিদ উঠে দাঁড়াল। লাইনটা থর থর করে কাঁপছে, যেন হঠাৎ কোন অশরীরীকে দেখে ভয় পেয়েছে। ট্রেন আসছে তাহলে শেষ পর্যন্ত। জাহিদ দৃঢ় পায়ে ট্রেনের দিকে এগুতে শুরু করল, নিজের অজান্তেই দু’হাত ওর মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু একদিন না একদিন তো মরতেই হবে, আর মলিকে হারানোর এই যন্ত্রনা সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর আসলেও কোন মানে হয় না।

দেখতে দেখতে আলোটা একসময় ওর একেবারে কাছে চলে এলো। ঘন কুয়াশার জন্য বোঝা যায় না, কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার মত অবস্থা হলো ওর। জাহিদ দাঁড়িয়ে পড়ে চরম একটা আঘাতের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেছে, এমন সময় আবার হঠাৎ করেই শব্দটার গতি কমে আসতে শুরু করল, তারপর একসময় সেটা একেবারেই থেমে গেল। ট্রেন কি তাহলে ব্রেক করেছে? ওদের কেউ কি ওকে দেখে ফেলেছে? কাকতালীয়ভাবে কোন যাত্রী কি জরুরি প্রয়োজনে চেন টেনেছে?

৩.

কুয়াশা ঠেলে আলোর দিকটা লক্ষ্য করে সামনে এগুতে শুরু করতেই জাহিদ লক্ষ্য করলো কুয়াশা কেটে যেতে শুরু করেছে। আলোটা এখন আর একটা বিশেষ দিক থেকে আসছে না, বরং চারিদিক থেকেই আলো আসছে, এমনকি সে আলোগুলো প্রচন্ড উজ্জ্বল হওয়া শুরু করেছে। সেসময় হঠাৎ জাহিদের প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হলো, এমনকি একসময় ওর মনে হলো ওর মাথার ভেতর বসে থেকে কোন এক অদৃশ্য শ্রমিক ইটভাঙার বড় এক হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত ওর মস্তিষ্কটাকে পিটিয়ে চলেছে, টুকরো টুকরো হয়ে ওটা রেললাইনের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না পড়া পর্যন্ত ওটাকে সে নির্দয় আঘাত করতেই থাকবে। 

তারপর হঠাৎ করেই আবার ওর শরীরের সমস্ত ব্যথা শূন্যে মিলিয়ে গেল এক মুহূর্তের মধ্যে। এমনকি ওর চারিদিকের দৃশ্যপটও কেমন করে যেন বদলে যেতে শুরু করল দ্রুতগতিতে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে জাহিদ নিজেকে আবিষ্কার করল শীত দুপুরের ঘোলাটে রোদের এক রেললাইনে – অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। সে বুঝতে পারলো না, কি করে শেষরাত হঠাৎ করে দুপুর হয়ে গেল, আর কি করেই বা চৈত্র মাসের দুপুরে ঠান্ডা একটা হাওয়া এসে ওর গায়ে শিহরণ বইয়ে দিতে শুরু করল। তার যখন মনে হতে শুরু করেছে যে পুরো ব্যাপারটায় কিছু একটা ঝামেলা রয়েছে, তখনি ওর নাকে-মুখে কি করে যেন ভারী ধোয়া জাতীয় কিছু ঢুকে গেল। জাহিদ ভীষণভাবে কাশতে শুরু করল।

একসময় কাশি একটু কমে এলেও ওর শাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বাতাস এখানে যেন সিসার মত ভারী, নিঃশাস নিলে মনে হয় বুক ভরছে না। নতুন আবহাওয়াতে অভ্যস্ত হবার চেষ্টায় জাহিদ অল্প করে বার বার শ্বাস নিতে চেষ্টা করল, যদিও নিজের এই উদ্যোগকে ওর নিজের কাছেই গরমের দুপুরে নেড়ি কুকুরের হাঁপানোর মতো কষ্টকর প্রক্রিয়া মনে হল। সে চারিদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে কোথায় এসেছে, কিন্তু ধুলোর একটা ঝড়ের কারণে খুব স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারলো না। 

বালুর ওড়াওড়ির মধ্যে এদিক-ওদিক দেখে অবশ্য ও ধারণা করে নিতে পারল যে এটা ওর স্মৃতির সেই শহরটাই, যদিও চারিদিক বেশ বদলে গেছে। রেলস্টেশনটা আগের মতোই উঁকি দিচ্ছে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, কিন্তু ওর সামনের পার্কটার জায়গায় শত শত সাইনবোর্ডের আঁচলে থেকে যাওয়া চারতলা একটা ঘিঞ্জি ধরণের মার্কেট উঠেছে। রেললাইনের পাশে জেগে উঠেছে সারি সারি বস্তি, তার পাশে দৌড়াদৌড়ি করছে অল্পবয়সী কিছু কিশোর, ওদের একজনের হাতে পিস্তলের মতো কিছু একটা, যদিও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল বলে সে বুঝতে পারল না অস্ত্রটা আসল না নকল।         

এর মধ্যেই একবার ওর চোখ চলে গেল মলি-রিমিদের সেই আগের বাসাটার দিকে, যেটার দিকে তাকিয়ে এই একটু আগেও সে মন খারাপ করছিল। ভরদুপুরে ভুত দেখার মতোই জাহিদ চমকে উঠল যখন সে দেখলো ওই বাসাটার জায়গায় ছয়তলা একটা দালান জায়গা করে নিয়েছে। শুধু ওই বাসাটাই না, ভারী হাওয়ার ভেতর হাটতে হাটতে জাহিদ দেখলো চারিদিকে আরো অনেক পরিচিত প্লটেই নতুন বাড়ি উঠেছে, আর তার মূল্য দিতে বেশির ভাগ গাছ-পালাই কেটে ফেলা হয়েছে।  রেললাইন থেকে নেমে এলোমেলো পদক্ষেপে বড় রাস্তাটার দিকে এগুতে শুরু করার পর সে বুঝতে পারল, কেমন করে যেন সবুজে ঢাকা ওর ছোট শহরটা দালানে দালানে ঠেসে গেছে, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে জাম আর বট গাছের ছায়া পরিণত হয়েছে ইট-কাঠ-সিমেন্টের আধুনিক এক স্তূপে। 

জাহিদ বুঝতে পারলো না সে মারা গেছে কিনা। এমন কি হতে পারে যে মরে গিয়ে ওর আত্মা চতুর্থ মাত্রায় উঠে গেছে? নাকি সে সেই ব্রিটিশ বৈমানিক ভিক্টর গডার্ডের মত সময়ের কোন শর্ট কাট দিয়ে দূর ভবিষ্যতে চলে এসেছে? যদি তাই হয়, তাহলে কতগুলো বছর সামনে সে এসেছে? এই ভবিষ্যতের পৃথিবীটার ভেতর মলি কি বেঁচে আছে? মলি-রিমিরা কি ওই বাসাটাতেই এখনো থাকে? প্রচন্ড কৌতহল থেকে জাহিদ দ্রুত হাটতে শুরু করল মলিদের সেই দক্ষিণপাড়ার দিকে।                

ধুলো আর ধোয়া থেকে মুখ-মাথা ঢেকে প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর জাহিদ মলিদের বাসার কাছে পৌঁছতে পারল। ওদের গলিতে ঢুকে চারিদিকে তাকানোর পর জাহিদ বিশ্বাসই করতে পারছিল না কি করে একটা দোতলা বাড়ির জায়গায় রাতারাতি একটা ছয়তলা ফ্লাট বিল্ডিং হয়ে যেতে পারে। বাসাটার সামনে সে কিছুক্ষন উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করল, তারপর পোস্টার সাঁটা লাইটপোস্টটাতে হেলান দিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সে যখন ফিরে যেতে শুরু করেছে, ঠিক তখনি মলিকে দেখতে পেল জাহিদ।   

মলির মুখের প্রতিটা রেখা জাহিদের মুখস্ত, স্বপ্ন আবার বাস্তব মিলিয়ে কম করে হলেও এক লক্ষবার এই মুখ দেখেছে সে। ওর কোন সন্দেহ নেই এটাই মলি, শুধু মুটিয়ে যাওয়ার কারণে ওকে আগের তুলনায় একটু খাটো মনে হচ্ছে। বড়ো রাস্তার ওদিক থেকে হেটে আসছিল সে, ওর হাত ধরে চার-পাঁচ বছরের একটা ছেলে। বাচ্চাটা সবুজ একটা ললিপপ একবার হাতে নিচ্ছে আরেকবার ছোট্ট শার্টটার পকেটে ঢোকাচ্ছে।  

মলির পরনে সবুজ একটা পাঞ্জাবী। আগে সবুজ রঙটা একদমই পছন্দ করতো না ও। ঐসময় বাসার বাইরে যেতে সবসময় সাদা রঙের জামা পরতে চাইতো সে। অনেক আগে মলিকে যখন ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা সুন্দর স্বপ্ন বলেই শুধু মনে হতো, তখন জাহিদ ভেবেছিল – মলি চিরদিন ওই রকমই থাকবে। ঐসময়টা মলি চুলে বেনী করত খুব সুন্দর করে, হাসিতেও কেমন করে যেন একটা মোহময়তা ছড়িয়ে রাখত সবসময়। ওর চাহনীতে একটা রহস্য ছিল, যেটাকে অনতিক্রম্য বলেই মনে হত জাহিদের কাছে। এই মলি সেই তুলনায় একটু আলাদা তো বটেই।

জাহিদের হঠাৎ মনে হল মলি ওকে দেখতে পেয়েছে, ও যেন জাহিদের দিকেই তাকিয়ে আছে, আর ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। জাহিদও হাত অল্প উঁচু করে মলির দিকে এগিয়ে গেল। ওর বুকের ভেতরে ওই মুহূর্তে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছিল, কিন্তু খুব কাছে আসার পর মলি ওর পাশ কাটিয়ে চলে গেল – যেন ওকে দেখতেই পায় নি, অথবা দেখলেও চিনতে পারে নি। জাহিদ অবশ্য ওকে খুব একটা দোষ দিতে পারলো না, মলির তো এই মুহূর্তে জাহিদকে এখানে আশা করার কথাও না।

মলি একসময় ছেলেকে নিয়ে ছয়তলা সেই বিল্ডিংটার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। এতক্ষন যাবৎ ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে জাহিদ কোন রহস্যময়তা খুঁজে পেলো না, বরং লক্ষ্য করল গেটে ঢোকার সময় ওর পিঠে বেনী দু’টো অতীতের দিনগুলোর মত দুলে ওঠে নি।

জাহিদ ততক্ষনে বুঝে ফেলেছে – সে অন্তত বছর দশেক ভবিষ্যতে চলে এসেছে, সেটা যেমন করেই হোক। যদিও সে বুঝে উঠতে পারছিল না, ভবিষ্যতের এই অপরিচিত পৃথিবীতে সে কি করবে বা কিভাবে টিকে থাকবে। কোথা থেকে যেন ঠান্ডা একটা বাতাস আসছিল। দূরে কোথাও মাইকে সিনেমার গান বাজাচ্ছিল, বিলীয়মান রৌদ্রের বিকেলে চটুল হিন্দী গানগুলোকে খুব বিষন্ন শোনাচ্ছিল। মলিদের নতুন ঠিকানাটাকে পেছনে ফেলে জাহিদ একসময় আবার নেমে এলো সেই ধূলো ওড়া শহুরে রাস্তায়।

বাসস্ট্যান্ডের দিকে ফেরার সময় নিজের স্যাতস্যাতে বাসা আর কাঁঠাল গাছের ছায়াঘেরা উঠোনটাতে ফিরে যেতে ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। রাস্তায় তখন আবার কলেজ ফেরতা ছেলেমেয়েদের ভীড়। কলেজটা কাছে কোথাও, হয়তো বিকেলে কোন ক্লাস হয়। সে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে হাটছিলো আর ভাবছিলো বিচিত্র সব কথা। যা থাকবে না, তা কেন আসে? যা আমাদের করতে ভালো লাগে, তা বেশিরভাগ সময়ই কেন ভুল কাজ? ঠিক কতদিন অপেক্ষার পর মানুষ তার অনুভূতির অপ্রয়োজনীয় এবং যন্ত্রণাদায়ক অংশগুলি থেকে মুক্তি পাবে? একরোখা নির্বোধ কতগুলি প্রশ্ন বহন করে করে ফুটপাতের ওপর হাটতে থাকে সে, কিন্তু হঠাৎই আবার থমকে দাঁড়ায়।

সে একটা মেয়েকে দেখতে পেয়েছে – কলেজ থেকে ফিরছে মেয়েটা। জাহিদ বুঝতে পারলো না সে কোন স্বপ্ন দৃশ্য দেখছে কিনা – কিংবা স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন – কিন্তু মেয়েটাকে তার অনেকদিনের চেনা বলেই মনে হতে থাকে। এমনকি একসময় তাকে একটা অযৌক্তিক প্রত্যয়ও পেয়ে বসে যে, এটা সত্যিই রিমি। রিমি মানে মলির ছোট্ট সেই বোনটা, যাকে সে ছোটবেলায় অংক শেখাতো।

জাহিদ ভালো করে তাকায়, কিন্তু তার বিস্ময়টা কাটতে চায় না। বরং একসময় তার মনে হতে থাকে, সে তার সুদূর কৈশোরের কোন এক মলিকেই বরং দেখছে, যে কখনো কখনো স্ট্রীটলাইটের আলোতে ওর পাশাপাশি হাটত। মেয়েটা যখন ওর পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, সে দেখল মেয়েটার চুলগুলো বেনী হয়ে সামনে এসে মাথার দু’পাশে দুলছে, জাহিদ তখন যেন ওর বড় বড় চোখ দু’টোয় সামান্য রহস্যময়তাও দেখতে পেল।

রিমির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল জাহিদ – অনেকক্ষণ। সে দেখছিল, অনেকগুলো মানুষের ভেতর মেয়েটা ক্রমশ: হারিয়ে যাচ্ছে। ওর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না – মলিকে নয়, ওর জীবনের কিছু টুকরো স্মৃতিকে সে এতোদিন মাথার ভেতর সযত্নে রক্ষা করে এসেছে, আর অদ্ভুত এই শহরের দালানে আর রাস্তায় সেই মুখ আবিষ্কারের একটা নির্বোধ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে এতক্ষন। ওর পুরো বিশ্লেষণটাই সম্ভবত: ভুল ছিল, কারণ সেদিন সেই সন্ধ্যার অন্য এক আলোয় দাঁড়িয়ে জাহিদ লক্ষ্য করল – ওর অনেকদিনের পরিচিত সেই মুখটা অজস্র নতুন মুখের ভীড়ে একসময় খুব সহজেই হারিয়ে গেল। 

মেয়েটা চলে যাওয়ার পর জাহিদ লক্ষ্য করল অদ্ভুত এই পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। দূষণে জর্জরিত এই শহর তার কাছে মুটিয়ে যাওয়া মলির মতোই অপরিচিত মনে হলো। সে বুঝে উঠতে পারল না, আসন্ন রাত ওর জন্য আর কি বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে, তাই ভয় পেয়ে একসময় দৌড়াতে শুরু করল। ও যাচ্ছিল রেললাইনের সেই অংশটার দিকে যেখান থেকে ওর এই দুঃস্বপ্নটা  শুরু হয়েছিল। এই অদ্ভুত বাস্তবতায় এক মুহূর্তও আর সে থাকতে চায় না, যেভাবেই হোক ফিরে যেতে চায় স্মৃতির মত পুরোনো সেই নাম না জানা স্বপ্নের মফস্বলে।

Leave a comment