বয়স গড়িয়ে জীবন পার হয়ে যায়, তবুও আমরা প্রতিদিনই নতুন করে উপলব্ধি করি জীবনটা আসলে ঠিক কেমন! এতে দোষের কিছু নেই, বরং এটাই স্বাভাবিক। এটা জীবন বিষয়ক ধারণার স্বাভাবিক বিবর্তন। তবে প্রতিটা মানুষের জন্যই এটা আলাদা। কেউ হয়তো এই পথ ধরে বনমানুষ থেকে মানুষের জীবনে উপস্থিত হয়, আবার কেউ হয়তো মানুষ থেকে বনমানুষে! বায়োলোজিক্যাল বিবর্তন যেমন প্রকৃতির ছকে বাঁধা, অর্থাৎ এটা পশু থেকে মানুষের দিকেই এগোয়, উল্টোটা নয়, সাইকো-ফিলোসফিক্যাল বিবর্তন বোধ হয় ঠিক সেরকম নয়। ইচ্ছা শক্তি থাকার সুবাদে এটা দু মুখেই যেতে পারে। অর্থাৎ, আমাদের ইচ্ছা বিবর্তনের দিক নিয়ন্ত্রন করে।
বায়োলোজিক্যাল বিবর্তনের একটা বিশেষ দিক হল, যে বা যারা মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনা, তারা বিলুপ্ত হয়। সাইকো-ফিলোসফিক্যাল বিবর্তনের ক্ষেত্রে অচল কিম্বা দুর্বলও টিকে থাকতে পারে, তবে সেটা হয় এক ধরণের ঋণাত্মক অস্তিত্ব। সমাজে ঋণাত্মক আর ধনাত্মক অস্তিত্বের ভারসাম্যের মধ্য দিয়েই সমাজ টিকে থাকে, উন্নতি বা অবন্নতির দিকে যায়। যখন কোন সমাজ উন্নতির দিকে যায়, ধরে নিতেই হবে সেখানে ধনাত্মকের প্রভাব বেশি। তবে ঋণাত্মকের পূর্ণ অনুপস্থিতি কোন বাস্তব চিন্তা নয়। এক মেরুর সমাজ চলেনা, দুটো মেরুই থাকতেই হয়।
বস্তুত আমাদের সমাজে যখনই আমরা এসব নিয়ে কথা বলি, আমরা ধরেই নেই, ধনাত্মকের শুরু হল – সত্য, সততা, কল্যান এসবের মধ্য দিয়ে; অন্যদিকে ঋণাত্মকের শুরু মিথ্যা, অসততা, অকল্যান এগুলোতে। কিন্তু ঠিক তাই কি? আমি বলছিনা এগুলো ভালো মন্দের ভুল উদাহরণ; কিন্তু ভালো-মন্দের শুরুটা বোধ হয় এভাবে নয়, বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী ভালো-মন্দ!
একটু ভেবে দেখুন, ভালোর শুরুর কথা যদি হয় শান্তি, তাহলে কেমন হয়? শান্তির পথ ধরে যে সত্য, সততা আর কল্যান আসবে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য কার! প্রশ্ন আসবে খারাপের শুরুটা তাহলে কোথায়? অশান্তিতে? অনেকটা তাই, তবে পুরোটা নয়। স্থায়ী খারাপ আসে, ছলনার পথ ধরে। যেমন, জীবনে উন্নতির জন্য অসৎ কামাই, পরিক্ষায় ভালো করার জন্য অসদুপায়, কিম্বা ভদ্র মানুষ সাজতে মিথ্যার ব্যবহার – এগুলো স্থায়ী মন্দের জন্ম দেয়।
এখন এই সাধারণ ধারণা থেকে যদি সমাজে উন্নতির কথা ভাবি তাহলে দাঁড়ায়, শান্তির সহজলভ্যতা হলো আমাদের উন্নতির মূলে। কিন্তু এটা কি এতোই সোজা? আসুন ভেবে দেখি!
শান্তির শুরু আর শেষ কিন্তু ব্যক্তিতেই, সমাজ শুধুই এর প্রভাব কিম্বা ফলাফল বয়ে নিয়ে যায়। তাই, ব্যক্তির শান্তির পথই হল সামাজিক উন্নতির প্রথম পদক্ষেপ। একইভাবে, একজন ব্যক্তির শান্তি বা অশান্তির মূলে হল সে নিজে, অর্থাৎ তার চিন্তা, নিজের প্রতি ধারণা আর নিজের প্রতি আচরণ। যে মানুষ নিজেকে ভালবাসে, নিজের কল্যান করে, নিজেকে দয়া করে, ক্ষমা করে, নিজেকে কষ্ট দেয় না কিম্বা শান্তিতে থাকার প্রেরণা দেয় তার ভালো থাকা কখনই কঠিন কিছু নয়। এমনকি খুব কঠিন সব পরিস্থিতিতেও সে শান্তির পথ খুঁজে নেয়। কোন রকম বিশেষ নীতি শিক্ষা ছাড়াই সে অন্যের জন্যও কল্যাণকর হয়, অন্তত অকল্যাণকর থাকে না। আর যে সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি সে সমাজই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উন্নতির দিকে যায়।
তাই, আমাদের মধ্যে যারা দেশ আর সমাজের কল্যান, শান্তি আর উন্নতির কথা ভাবি, তাদের প্রথম আর প্রধান দায়িত্ব হল, নিজের ক্ষেত্রে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা। যদি সেটা পারি, তাহলে আপনা আপনি সমাজ উপকৃত হবে। নিজেকে বাদ দিয়ে সমাজের সেবা শুধুই ধোঁকা, আর ধোঁকাই নিশ্চিত করে সকল ঋণাত্মক অস্তিত্বের।
