ইন্টারভিউ

বাসে উঠে পেছনের দিকের জানলার পাশে একটা সিটে গিয়ে বসলাম। তিনটার মতো বাজে, ভেতরে তেমন একটা ভিড় নেই। তবে ঘেমে চলেছি এখনো, বাস ছাড়লে আশা করা যায় শরীরটা একটু জিরোবে।

আরো দুএকজন যাত্রী উঠিয়ে গাড়িটা বাড্ডার দিকে রওয়ানা হতেই লোকটা দৌড়ে বাসে উঠলো। শুকনো মুখ, বসে যাওয়া গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি – বয়স খুব বেশি হলে পঁচিশ হবে। ওর কাঁধে একটা ঝোলা, হাতে দুই প্যাকেট বলপয়েন্ট কলম। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, কিছুক্ষনের মধ্যেই তাহলে শুরু হতে যাচ্ছে অভাবের সংসারের কথা আর ইনিয়ে বিনিয়ে বিক্রি গছিয়ে দেয়ার মহড়া। নিজে একজন সেলস ম্যানেজার বলেই হয়তো আমি অন্য সেলসম্যানদের সহ্য করতে পারি না। জানলার বাইরে দৃষ্টি রাখলাম – মূলত লোকটার সাথে চোখাচোখি এড়ানোর উদ্দেশ্যে।

ফোনটা তখন ক্রমাগত বেজে চলেছে। টাইট ফিট প্যান্টের পকেট থেকে অনেক সংগ্রাম করে মোবাইলটা বের করলাম, রুমা ফোন করেছে। আমি ওটা সাইলেন্ট-এ দিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম।

নিশ্চয়ই শান্তকে আমার অফিসে নেয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ফোন করেছে রুমা। শালা-দুলাভাই এক অফিসে কাজ করবে, একসাথে অফিসে যাবে, একসাথে ফিরবে – দারুন একটা রোমান্টিক ব্যাপার যেন। কিন্তু আমি খুব ভালো করে জানি, শান্ত এই কাজটা করতে পারবে না। ও যে আরাম-আয়েশে বড় হয়েছে, তার পক্ষে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সেলসম্যানের কাজ করা সম্ভবই না। খুব বেশি হলে তিন মাস সে টিকবে এখানে। মাঝখান থেকে শুধু শুধু আমার কাঁধে একটা ঝামেলা, আর বদনাম তো আছেই।

কিন্তু এটা সত্যি যে আমার টিমে একজন দক্ষ সেলসম্যান প্রয়োজন, খুব তাড়াতাড়িই প্রয়োজন। জামান ছেলেটা চাকরি ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেয়ার পর থেকেই আমরা লোকের অভাবে ভুগছি।

‘স্যার।’ – হঠাৎ কারো ডাক আমার চিন্তার ট্রেনকে চেন টেনে থামিয়ে দিলো – ‘স্যার, কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’

সেই লোকটা, নীল বলপয়েন্ট কলমের বিক্রেতা। চরম বিরক্তি চেপে বললাম – ‘হ্যা, বলেন।’

‘স্যার, আপনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনি অফিসে কাজ করেন। ধরে নিতে পারি, আপনাকে কাজের জন্য অনেক লেখালেখিও করতে হয়।’

আমি মাথা নাড়লাম। কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো।

‘স্যার, কখনো কি আপনার এমন হয়েছে যে আপনি একটা সিগনেচার করলেন, তারপর হাত লেগে সেটা জড়িয়ে গেলো। কিংবা কোন কিছু লিখেছেন, সেটা ফুল শার্টের হাতার কোনায় ছাপ ফেলে দিলো। হয়নি কখনো এরকম?’

এই প্রথম লোকটার দিকে তাকালাম। মুখে ওর ক্ষুধার চিহ্ন, কিন্তু কালি পড়া চোখের দৃষ্টি প্রখর।

‘হ্যা, এরকম তো হয় ই।’ – আমি উত্তর দিলাম।

সে হাসলো – ‘এই কলমে সেই অসুবিধাগুলো দূর করা হয়েছে। আপনি কি পরীক্ষা করে দেখতে চান?’

আমি কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর ওকে আমার পাশে বসতে বললাম।

‘কয়টা দিবো, স্যার?’ – সে বসতে বসতে বললো।

‘তার আগে বলেন’ – আমি বললাম – ‘আপনাকে এইভাবে কথা বলা কে শিখিয়েছে? আপনার কোম্পানি?’

‘স্যার, আমি কি কোন ভুল কিছু বলেছি?’

‘না, এই যে আপনি আপনার কলমের চেয়ে আমার সমস্যাটাকে বেশি গুরুত্ব দিলেন, প্রথমেই বিক্রির কথা না বলে আমার একটা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেন। এটা তো অন্য কেউ করে না।’

‘স্যার, আমি মার্কেটিং পড়েছি।’ – সে মাথা নিচু করে বললো – ‘পাশ করে চাকরি পাই নি। এখন এটা করে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছি।’

জানতে চাইলাম সে কোথায় পড়ালেখা করেছে। সে একটা কলেজের নাম বললো, জীবনে শুনিও নি। আমি অবাক হলাম। এই এক ছেলে – একটা অখ্যাত কলেজে পড়েছে, চেষ্টা করেছে শিখতে যতটুক পেরেছে, তারপর সেটা এখন বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। শিক্ষার এরচেয়ে ভালো বাস্তবায়ন আর কি হতে পারে!

সেদিন তার কাছ থেকে দু’টা কলম নিলাম – একটা আমার, আরেকটা রুমার জন্য। তারপর তাকে আমার একটা ভিসিটিং কার্ড দিয়ে বললাম – আমি ছোটোখাটো একটা চাকরি করি, কিন্তু আমার টিমে একজন সেলসম্যান লাগবে, সে যদি আগ্রহী হয় তাহলে যেন আমার সাথে দু-একদিনের মধ্যে যোগাযোগ করে। বেতন যদিও বেশি না, সুযোগ হিসেবে এটা তার ভালো মনে হলেও হতে পারে।  

কার্ডটা হাতে নিয়ে সে একবার ওটার দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকালো। হঠাৎ তার চোখ দু’টো ছল ছল করে উঠলো। আমার সন্দেহ রইলো না, আমি ঠিক লোকেরই ইন্টারভিউ নিয়েছি।

সে বিকেলে বাস থেকে নামার ঠিক আগে দিয়ে রুমাকে মেসেজ দিলাম – ‘ওই পোস্টে লোক নেয়া হয়ে গেছে। শান্তকে সরি বোলো।’

আমি জানি, এর পর আজ রাতটা আমার বেশ খারাপ কাটবে, এমনকি হয়তো বসার ঘরের সোফায়ও ঘুমাতে হতে পারে। কিন্তু কিছু পেতে হলে তো দিতেই হয়, তাই না?

Leave a comment