————————————————————–
ইলেক্ট্রনিক্সের এই চরম উৎকর্ষের যুগে আমরা যত জটিল যন্ত্রের কথাই বলিনা কেন, তার যেকোনোটির মূলেই আসলে রয়েছে খুব সাদাসিধে গোছের কিছু বিদ্যুৎ বর্তনী। আমাদের পার্থিব জীবনের সাথে এই বিদ্যুৎ বর্তনীর কোথায় যেন একটা সাদৃশ্য দেখতে পাই। বর্তনীর মৌলিক গঠনটি আমরা সবাই যেভাবে ছোটবেলায় পড়েছি, তার কথাই আবার একটু মনে করা যাক না কেন। তড়িৎ শক্তির উৎস বিদ্যুৎ কোষ, তার দুপাশে লাগানো পরিবাহী তার, আর সেই তারের মাঝখানে সংযুক্ত একখানা বৈদ্যুতিক বাতি। তারের প্রান্ত দুটি কোষের দুপাশে লাগাতেই তড়িৎ বয়ে বেড়ানো ইলেক্ট্রনগুলো বিদ্যুৎ কোষের এক প্রান্ত থেকে বেরিয়ে তারের ভেতরের সুড়ঙ্গ হয়ে আবার কোষের অন্য প্রান্তে ফেরত আসে, আর এই ফেরত আসার পথটিতে আলো জ্বালিয়ে আসে বাতিটিতে – এটাই বর্তনীর মূলনীতি।
পৃথিবীতে আমদের জীবনটাও বোধ করি অনেকটা সেরকমই। জন্ম দিয়ে চলা শুরু, আবার মৃত্যু দিয়ে শেষ। মাঝখানের সময়টুকুতে আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-দক্ষতা দিয়ে যতটুকু কাজ করি, তারই ফলাফলটুকু থেকে যায় আমাদের চারপাশে। এই “ফলাফল” ব্যাপারটিকে একটু ভিন্ন ভাষায় বললে বলা যায় “ভ্যালু-এড” কিংবা “অবদান”। আর এই ভ্যালু-এডটুকুই আমাদের জীবন বর্তনীর আলো। সেই আলোকিত অবদানের পেছনে আছে আমাদের প্রাণশক্তি, যেমনটি আছে বিদ্যুৎ কোষে। এই প্রাণশক্তির ব্যাপারটি শুধু যে শারীরিক তা নয়, হতে পারে তা কোনো অনুপ্রেরণা, হতে পারে আমাদের চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়ে অন্যরকমভাবে চিন্তা করতে শেখানোর মত বড় কোনো ঘটনার ধাক্কা। বর্তনীতে যেমন শক্তিশালী বিদ্যুৎ কোষ ব্যবহৃত হলে আরো বেশী পরিমাণ ইলেক্ট্রন প্রবাহের কারণে বাতির আলোও আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমাদের প্রাণশক্তির ব্যাপারটিও তেমন। ভালো ডায়েট যেমন শারীরে ছুটে চলার শক্তি জোগায়, তেমনি ধনাত্মক চিন্তাও ভালো কিছু অবদান তৈরির বেগ বাড়িয়ে দেয় আমাদের নিউরনে।
জীবনের বর্তনীতে তারের ভূমিকাটিতে বেশ কিছু উপাদান আছে বলে মনে হয়, যেমন আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকাঠামো ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটিরই প্রভাব থাকে আমাদের চলার পথটি সংজ্ঞায়িত হবার পেছনে। ধাতব তারের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রনের প্রবাহটি কতখানি সহজ বা কঠিন তা বোঝাতে “রোধ” শব্দটির ব্যাবহার আমাদের অজানা নয়। আমাদের জীবনের তারেও ঠিক তাই, চলার পথের সমস্ত প্রতিকূলতাই রোধ । বেশি শক্তির বিদ্যুৎ কোষ যেমন বেশি রোধের পরিবাহী তারেও ইলেক্ট্রনকে তাড়িয়ে বেড়ায়, তেমনি আমাদের প্রাণশক্তিটিও তাই। সোজা বাংলায়, যার “দম” বেশি, তার সামনে কোনো “রোধ”ই কোনো বাধা নয়।
আর এই যে “আমি” বা “আমরা” ব্যাপারটি – এটাই বোধ করি ইলেকট্রন। তড়িৎ কোষের রাসায়নিক তরলটি তার কার্যকারিতা হারালে যেমন ইলেক্ট্রন তৈরি ফুরিয়ে যায়, তেমনি “আমি” বা “আমরা” ব্যাপারটিরও অবসান ঘটে কোনো এক সময়, এবং তা অবশ্যম্ভাবী। তবে যত বেশী কিংবা কম ওয়াটের অবদানই আমরা আলো হিসেবে রেখে যাইনা কেন, তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের চারপাশটাকে আলোকিত করে। সে আলোর অনেক রঙ, কেবল কালো রঙটি ছাড়া। কেননা কালো বলে কোনো আলো নেই।
