————————————
করোনার বদৌলতে বাড়ি-থেকে-কাজের প্রায় আড়াই বছর হতে চলল। অফিস যাবার সময়টুকু বেঁচে গেলেও, তার পরিবর্তে বেড়েছে সারাদিনের মোট কাজের সময়, বেড়েছে ব্যস্ততা। আরো একটি জিনিস অবশ্য বেড়েছে। না, টাকা-পয়সা জাতীয় কিছু বাড়েনি মোটেই । বেড়েছে দেহের ‘বেড়’, আরো একটু সুনির্দিষ্ট আর খোলাসা করে বললে বলা চলে “দেহের বিষুবাঞ্চলের পরিধি”। বেড়েছে না বলে, বরং ‘বাড়ন্ত’ কিংবা ‘ক্রমবর্ধমান’ শব্দটিই বোধ করি বেশি প্রযোজ্য। এই ক্রমবর্ধমান ‘বেষ্টনী’-টিকে খানিকটা সামলে রাখার জন্য প্রতিদিনই ঘন্টাখানেক হাঁটাহাঁটি কিংবা হাল্কা কায়িক তৎপরতার চেষ্টা থাকে। আর এই পরিবির্তত দৈনিক রুটিনে এতদিন অফিসে-থেকে-অফিস করার সময় যা যা চোখ এড়িয়ে যেত, বাড়ি-থেকে-অফিস শুরু করার পর থেকেই লক্ষ্য করছি “দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া…” ধরনের অনেক কিছুই এখন চোখে পড়ে। এমনকি এড়িয়ে যেতে চাইলেও।
শুধু মানুষ নয়, পোষা প্রাণীদেরও আসলে হাঁটাহাঁটি কিংবা বিচরণ জাতীয় শারীরিক তৎপরতার প্রয়োজন পড়ে। টোকিও শহরেও মানুষ যতরকমের প্রাণী বাড়িতে পোষে তার মধ্যে কুকুরের জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান তাই বলে। মানুষের মতই কুকুরেরও ‘দৈহিক বেষ্টনি’ বেড়ে যাবার ঝুঁকি থাকে, তাই তাদেরও ডায়েটের দরকার পড়ে বৈকি। এদেশে পোষাপ্রাণী মানেই হল সেও পারিবারিক সদস্যদের একজন। তাই বাড়ির বাবা-মা যদি ডায়েট বজায় রাখতে বাইরে হাঁটতে যান, তাহলে সঙ্গী হিসেবে অবশ্যই নিজেদের পোষা কুকুরটিকেও সাথে নিয়ে বের হন। নিজের পেটেরও যত্ন নেয়া হল, Pet-এরও স্বাস্থ্য বজায় রাখা হল। শুধু তাই নয়, পাড়ার অন্যান্যরাও যখন একইসাথে কুকুর নিয়ে হাঁটতে বের হন, তখন সবাই মিলে একটা আড্ডার মত ব্যাপার তৈরি হয়, যাতে শুধু মানুষের মধ্যেই নয় সারমেয়-সমাজের সদস্যদের মাঝেও সৌহার্দ্য বিনিময়ের একটা সুযোগ তৈরি হয়। শুধু ঘরে বসে থাকলে মানুষের মত পোষা কুকুরেরও মন-খারাপ হয়, মানসিক চাপ বাড়ে। পোষা কুকুরটিকে সাথে নিয়ে হাঁটাহাঁটিতে শারীরিক-মানসিক-সামাজিক সব দিক থেকেই সুস্থ থাকার সুবিধাটি অনেকটা এক ঢিলে কয়েক পাখি মেরে ফেলার মত ব্যাপারই বলা চলে।
তবে সব আলোর পেছনেই যেমন কালো থাকে, এই বহুমুখী সুবিধার পেছনেও কিছু ঝামেলা লুকানো আছে। রাস্তায় হাঁটতে বেরুলে শারীরিক তৎপরতার কারণে বৃহদন্ত্রে চাপ পড়াটাই স্বাভাবিক, আর তাতে করে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে চাইবার প্রবণতাটি মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। তবে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সহ্য করার ক্ষমতাটুকু কুকুরের মালিকের থাকলেও, পোষা কুকুরটির কাছ থেকে সেটি আশা করা চলেনা। যেখানেই সুযোগ মিলবে সেখানেই প্রকৃতির ডাকে সারা দেয়াটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। সেটা ইলেক্ট্রিক-পোল অর্থাৎ বৈদ্যুতিক খুঁটিই হোক, কিংবা গাছের গোড়া, অথবা দেয়াল হোক – যেকোনোখানেই সে তার ‘অবদান’ রেখে যেতে পারে, অবলীলায়। জাপানী নিয়মকানুন বড় কড়াকড়ি। এদেশের লোকজনের পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার ওপর জোর দেয়ার ব্যাপারটি অনেকটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের বলেই মনে হতে পারে আমাদের অনেকের কাছে। তাই নিয়মানুযায়ী কুকুর মালিকটিকেই তার প্রিয় পারিবারিক পোষা সদস্যটির ‘অবদান’ পরিষ্কারের দায়িত্বটি নিতে হয়। এই নিয়মটি জানেননা এমন পালক-প্রভু এদেশে খুঁজে পাওয়া বিরল। তাই তাদের সকলেই সারমেয়-ভ্রমনের প্রস্তুতি হিসেবে সাথে করে ডাস্ট-প্যাকেট আর জল নিয়ে বের হোন। রাস্তার এখানে ওখানে কিছু পোস্টারও চোখে পড়ে যাতে কুকুর মালিকদের বিনীত অনুরোধ করা হয় যেন পরিষ্কারের দায়িত্বটুকু এড়িয়ে না যান সে ব্যাপারে। তবে সবাই কি আর কথা শোনে। সব দেশেই সব কালেই কিছু না কিছু ব্যতিক্রম তাই থেকেই যায়। এই ধরনের উদাসীন কুকুর মালিকদের কারণে ঝামেলায় পড়তে হয় সারমেয়-অবদানে ধন্য হওয়া গাছটি কিংবা দেয়ালটি, অথবা বৈদ্যুতিক খুঁটিটি যার বাড়ির সাথে সংলগ্ন থাকে তার। সেদিন বিকালে হাঁটতে গিয়ে জাপানী ভাষায় লেখা একখানা পোস্টার চোখে পড়ল। পোস্টারের অনুরোধের ভাষাটিও বেশ অভিনব মনে হল। অবস্থাদৃষ্টে যা বোঝা গেল, হয়তো অনেক ভোগান্তির পর উপায়ান্তর না দেখে এই বেচারা ভদ্রলোক নিজের বাড়ির আঙিনার দোহাই না দিয়ে বাড়ির সামনের এই বৈদ্যুতিক খুঁটিটিকে অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন কুকুর মালিকদের অনুরোধ জানাতে। অন্তত খুঁটিটির কথা ভেবে হলেও যেন কোনো কুকুর মালিক এই খুঁটিটির গোড়ায় তার প্রিয় পোষা প্রাণীটিকে তার ‘অবদান’ রেখে যাওয়া থেকে বিরত রাখেন। ‘খুঁটির জোর’ ব্যাপারটির যে এরকম একখানা বাস্তবিক প্রয়োগ থাকতে পারে, পোস্টারটি না দেখলে অজানাই থেকে যেত।
পোস্টারের লেখাটির বাংলা অনুবাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ঠিক মনের মত হোলোনা। তারপরও পোস্টারটি দেখার পর থেকেই ভাবছি ভানুঠাকুর হলে কিভাবে পোস্টারটি বাংলায় লিখতেন। নিজের মত করেই একখানা নমুনা তৈরি করার লোভ সামলাতে পারলামনা (ক্ষমা কোরো ‘গুরুদেব’…)
এই স্তম্ভের কান্না তুমি শুনিতে কি পাও
হে পালক-প্রভু তুমি হয়োনা উধাও
না দেখার ছলে
‘সব সারা’ হলে ।
অনুরোধ রইল শুধু, সচেতন হয়ো
এখানে না যেন করে “ইয়ে”, তোমার সারমেয় ।
————————————

পরিশিষ্ট : এদেশের লেখাতে বাঁ-থেকে-ডানে আর উপর-থেকে-নীচে লেখার দু’টি পদ্ধতিই চালু আছে। উপর-থেকে-নীচে লেখা যেকোন কিছুই ডান দিক থেকে পড়ার নিয়ম। পোস্টারের লেখাটি উপর-থেকে-নীচের প্যাটার্নে লেখা, বাংলাটুকুও সেই নিয়মেই লেখার প্রয়াস ছিল। তবে বলাই বাহুল্য, এক ভাষার অন্তর্নিহিত ভাব অনুবাদের যন্ত্রের ভেতর দিয়ে গেলে তার রসটুকু অনেকটাই কমে গিয়ে, শুধু ছিবড়াটুকুই থাকে। আমার এই পোস্টার অনুবাদের ব্যাপারটিও অনেকটা তাই।
