কুহক  

১.

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মাথার ভেতর এক ধরণের ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ শুনতে পান জামান। প্রথমে ডান কান থেকে শুরু হয় পোকা-মাকড়ের গানের মতো এই শব্দটা, তারপর সেটা যায় বাঁ কানে, শেষে ঠিক মাথার মাঝখানে – অনেকটা হেডফোনে গান শোনার মতো অনুভূতি হয় তখন, যদিও এই গুঞ্জনগুলো কখনোই সংগীতের মতো স্বস্তিদায়ক কিছু না।

এটা কোনো শারীরিক সমস্যা না, কারণ সেই ঝিঁ ঝিঁ পোকা প্রায়ই তার সাথে কথা বলে, বিভিন্ন বিষয়ে শলা-পরামর্শও করে। প্রথম জীবনে এতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও পরে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন জামান।   

ক্লাস সিক্সে থাকতে প্রথম এই ঝিঁ ঝিঁ-র শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন জামান। এক মঙ্গলবার সন্ধ্যা, তিনি সমাজবিজ্ঞান পড়া মুখস্ত করছেন। সারা শরীরে ব্যথা, কারণ কিছুক্ষন আগে বাবা তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত বেত দিয়ে পিটিয়েছেন, স্কুল থেকে ফিরতে মাগরেবের ওয়াক্ত পার হয়ে গিয়েছিলো বলে। চামড়ার ওপর সেই জ্বলার জায়গাগুলোতে মালিশ করতে করতেই জামান পড়ছিলেন। ঠিক সেসময় তার ডানদিকের কানে শুরু হলো ঝিঁ ঝিঁ আওয়াজ।

প্রথমে তিনি ভাবলেন, হয়তো বেতেরই কোন বাড়ি কানে গিয়ে লেগেছিলো, আগে তিনি টের পাননি। কিন্তু পরে যখন বাঁ কানেও শব্দ শুরু হলো, ঘাবড়ে গিয়ে কয়েকবার পানি খেলেন। এর কিছুক্ষন পর আপনা থেকেই ওটা ঠিক হয়ে গেলো। 

পরদিন আবার একই ঘটনা, পড়ার মাঝে মস্তিষ্কের ঠিক মাঝখানে শব্দ শুরু। এবার জামান মন দিয়ে শব্দটা শুনতে চেষ্টা করলেন আর তখনই আবিষ্কার করলেন এটা পোকা-মাকড়ের একটানা কোনো গান নয় – বরং ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে এটার একটা নির্দিষ্ট ধারা আছে, অনেকটা গণিতের বিখ্যাত সিরিজগুলোর মতো। উনি যখন শব্দের ভেতর তাল আর লয় গুলো প্রায় ধরে ফেলেছেন, তখনই আবার ওটা বন্ধ হয়ে গেলো।         

এরপর কয়দিন শব্দটা বন্ধ থাকলো। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা, সবাই পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার জন্য অপেক্ষারত জামানও সেই ঝিঁ ঝিঁ জাতীয় শব্দের কথা ভুলে গেলেন।

ওটা আবার তার কাছে ফিরে এলো প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পরে। রাত তখন প্রায় বারোটা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শীতকাল বলে নিজের সিঙ্গেল খাটে লাল লেপের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন জামান, হাতে সেবা প্রকাশনীর রহস্যগল্প সংকলন। ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে আধো অন্ধকার ঘরে খুন-জখমের ঘটনায় ঠাসা লোমহর্ষক এক বিদেশী গল্পের অনুবাদ পড়ছেন, আর তখনি আবার শুরু হলো সেই শব্দ। এবার যেন শব্দটা আরো স্পষ্ট, আরো নির্দিষ্ট – যেন এতদিন কেউ তার মনে ভোঁতা কোন পেন্সিল দিয়ে ছবি আকার চেষ্টা করছিলো তাই ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছিলো না, আর আজ সেই অদৃশ্য অস্তিত্ব পেন্সিলটা চোখা করে নিয়ে এসেছে সরাসরি হুমকি দেবে বলে।   

জামান কান খাড়া করলেন, তখন কেউ কথা বলে উঠলো তার মাথার ভেতর। ‘এই তুই পচা ছেলে’ –  মাথার ঠিক মাঝখানে বেজে উঠলো কণ্ঠটা। হাই স্কুল পড়ুয়া জামান লেপের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে রইলেন।

‘তুই পচা, তুই গাধা, তুই পচা, তুই বলদ’ – নাকি সুরে কণ্ঠটা বলে চললো। জামান বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে তার বাবা-মায়ের ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। কণ্ঠটা তখন বলে চলেছে – ‘ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে।’

সে রাতে তার মা তার সাথে এসে শুয়ে থাকলেন। জামান ঘুমিয়ে পড়লেন, ঝিঁ ঝিঁ-র শব্দ উধাও হয়ে গেলো।

পরের রাতে আবার একই ঘটনা ঘটলো, কিন্তু এবার জামান দাঁতে দাঁত চেপে লেপের নিচে পরে রইলেন।

‘তুই খেলবি আমার সাথে?’ – মাথার ভেতর কণ্ঠটা বললো।

‘তুমি কে?’

‘হি হি হি। আমি চন্দন।’

এ পর্যায়ে জামানের প্যান্ট ভিজে গেল, বাথরুমে যাওয়ার পর তার বমি হলো, রাত্রে একশো চার ডিগ্রি জ্বর এলো।

পরদিন জামানের মা সানোয়ারা বেগম সারাদিন তার মাথায় পানি ঢাললেন। বাবা আফতাব সাহেব সন্ধ্যার পর এক পাতা প্যারাসিটামল আর একটা আইসক্রিম ললি কিনে নিয়ে এলেন, বললেন টক-মিষ্টি খেলে মুখে স্বাদ ফিরবে। সানোয়ারা বেগম আইসক্রিম দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ঠান্ডার মধ্যে কেউ আইসক্রিম খায়!

তিনদিন পর জামানের জ্বর সারলো। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। এশার নামাজের পর আফতাব সাহেব লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা এক ছোট-খাটো শুকনো মানুষকে নিয়ে বাসায় এলেন। মুনাফ মিয়া রাতে ওদের বাসায় ভাত খেলো, তারপর ড্রইং রুমের বেতের সোফায় বসলো কিশোর জামানকে পাশে নিয়ে। বাবা-মা চলে যেতেই জটাধারী লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো নানা কথা – জামান কোনো স্বপ্ন দেখেন কিনা, হাটতে গেলে তার বাম পায়ে ব্যথা করে কিনা, একা একা রাস্তায় হাঁটার সময় কেউ চুল টান দেয় বলে মনে হয় কিনা, এসব।

সব কথা শোনা হয়ে গেলে পর সেই মুনাফ মিয়া ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলো, আফতাব সাহেবকে ডেকে বললো – চিন্তার কিছু নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। যাবার সময় হাদিয়া হিসেবে বেজোড় সংখ্যক নোটে একশো এক টাকা নিয়ে তারপর বিদায় হয়ে গেলো।

পরদিন জামানের গলায় তাবিজ ঝুললো। আর আফতাব সাহেব ড্রইংরুমে ছেলের বিছানা সরিয়ে দিলেন, বললেন এখন থেকে সে এই বসার ঘরেই ঘুমাবে আর তার নিজের ঘরে পড়া-শুনা করবে। সে রাতে জামান নিশ্চিত মনে নিজ খাটে ঘুমাতে গেলেন, যদিও শেষরাত্রের দিকে জামানকে অবাক করে দিয়ে ঝিঁ ঝিঁ আওয়াজ করে উঠলো তার কানের ভেতর। সে নাকি সুরে বললো – “ওই হারামজাদা, জানিস না, তাবিজ-কবজ বেদাত? এইগুলি দিয়ে আমারে ধোকা দিতে পারবি, গাধা কোনখানকার?”

সে রাতে ক্লাস সেভেনে পড়া জামান বুঝতে পারলেন এই ঝিঁ ঝিঁ থেকে খুব শিগগিরই তার মুক্তি নেই, বরং এটা মেনে নিয়ে জীবন চলাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া এটা নিয়ে যত ঘাটাঘাটি হবে, তাকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুমহলে হাসাহাসি আর গা টেপাটেপি ততোই বাড়বে। তাই এটার সাথে যুদ্ধ না করে যত তাড়াতাড়ি সাদা পতাকা উড়িয়ে সন্ধিতে চলে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।

২.

স্কুলের সেই দিনগুলোতে জামান ওই ঝিঁ ঝিঁ-র উপস্থিতিতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। জামান ছিলেন চুপ-চাপ ধরণের মাথা নিচু করে ক্লাসে যাওয়া ছেলে, বাবা আফতাব সাহেবও তার বন্ধুদের সাথে মেলা-মেশা পছন্দ করতেন না – সব মিলিয়ে সেই কণ্ঠের সাথে জামানের অদ্ভুত এক ধরণের বন্ধুত্ব তৈরী হতে শুরু করেছিলো। ঝিঁ ঝিঁ জামানকে ‘ওই হারামজাদা’ বলে ডাকতো, আর তিনিও ঝিঁ ঝিঁ-কে ‘ওই শুওরের বাচ্চা’ বলে সম্ভাষণ করতেন, তারপর দুজনই একসাথে হেসে উঠতেন।

ঝিঁ ঝিঁ তাকে মেয়েদের নানারকম গল্প শোনাতো – পিলুর মনের গোপন কথা, সিঁথির শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশের বর্ণনা, ছেলেদের ঘুরানোর জন্য লাবনীর শয়তানি চাল, এসব নিয়ে গল্প। সেসব গল্পের কোনো কোনটা ছিল খুবই বিশ্রী, আর  ঝিঁ ঝিঁ-র ভাষা যথারীতি থাকতো কুৎসিত। অশ্লীল গালি ছাড়া ঝিঁ ঝিঁ কথা শুরুই করতে পারতোনা, যদিও এসবের মধ্যে জামান অন্যরকম একটা আনন্দ খুঁজে পেতেন।

কিশোর বয়সের জামানকে ঝিঁ ঝিঁ ছেলেদের বিষয়েও নানা কথা শুনাতো। সে বিশদ ব্যাখ্যা করে বলতো, রোমেল কেন সুযোগ পেলেই তাকে ধাক্কা দেয়, জাহেদ মনে মনে নাসরিনকে নিয়ে কি ভাবে, আপন কেন ঢোলা প্যান্ট পরে, ইত্যাদি। ঝিঁ ঝিঁ তাকে উপদেশ দিতো, ঠিক কি কি কাজ করলে জামান অন্য ছেলেদের ওপর তার আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে, কিংবা অন্ততপক্ষে অন্যদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলতে পারবে। স্কুলে যাওয়ার পর জামান যখন ছেলেদের লক্ষ্য করতেন, ঝিঁ ঝিঁ-র সবগুলো তত্ত্ব মিলে যেত আর জামানও স্কুলের সব ধরণের ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পারতেন।

ঝিঁ ঝিঁ-র কথা গুরুত্ব দেয়ার পর থেকেই রোমেল কেন যেন জামানকে এড়িয়ে চলা শুরু করেছিলো, এমনকি ওর চাহনি দেখলে মনে হতো গুণ্ডাটা জামানকে ভয় পাওয়া শুরু করেছে। ঝিঁ ঝিঁ-কে এক রৌদ্রের দুপুরে সেই কথা বলতেই সে হেসে উঠে বলেছিলো – “খারাপ স্বপ্ন দেখিয়েছি ওই কুত্তাটাকে”। জামান ঝিঁ ঝিঁ-র কথার মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারেন নি সেদিন।

নীল ছবি কি জিনিস সেটাও জামান ঝিঁ ঝিঁ-র কাছ থেকেই শিখেছিলেন। দিন-কাল ভালোই কেটে যাচ্ছিলো, যে পর্যন্ত না তিনি আফতাব সাহেবের কাছে ধরা খেলেন এক দিন। সেই বুধবার বিকেলে কেউ বাসায় ছিল না, জামান ভিসিআর-এ ছবিটা চালু করেছেন, আর ঝিঁ ঝিঁ তার কানে নানা মন্তব্য করছে আর বিভিন্ন দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে। খুবই আন্তরিক পরিবেশ, হঠাৎ জামান টের পেলেন তার কাঁধে একটা হাত। আফতাব সাহেব চাবি ফেলে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে দেখেন জামানের এই অবস্থা।

জামান ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন, ভিডিওটা বন্ধ করতেও ভুলে গেলেন। টেলিভিশন স্ক্রিনে যখন নারী আর পুরুষ একসাথে শব্দ করছে, তখন আফতাব সাহেব নিজেই রিমোটটা হাতে নিয়ে ভিসিআর বন্ধ করলেন। জামান নিশ্চিত ছিলেন, বাবা তাকে আজ পিটিয়ে আধমরা না করা পর্যন্ত থামবেন না, মা-ও বাসায় নেই যে এসে কিছুটা রক্ষা করবেন।

নদীর মাঝখানে ডুবতে থাকা সাঁতার না জানা এক ছেলের মতো তিনি তিনি অজানা অচেনা এক সর্বশক্তিমানের কাছে সাহায্য চাইতে লাগলেন, আর মনে মনে সেই স্বত্ত্বাকে কথা দিলেন তিনি জীবনে আর এ ধরণের কিছু দেখবেন না। ঝিঁ ঝিঁ তখন তার মাথা থেকে পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে, ঠিক যেভাবে ক্লাসের দুষ্ট কোন বন্ধু নকলের কাগজ পকেটে গুঁজে দিয়ে টিচারের কাছে বন্ধুকে বিপদে ফেলে দেয় আর তারপর হঠাৎ করে না চেনার ভাণ করতে থাকে।

এদিকে স্রষ্টা হয়তো সেদিন এক বিপদগ্রস্ত কিশোরের ডাক সত্যি সত্যিই শুনেছিলেন, আর তাকে ক্ষমাও করে দিয়েছিলেন। জামানের নিজের অন্তত তাই মনে হয়েছিল, কারণ বাবা তাকে খাবার টেবিলে ডেকে নিয়ে বললেন – ঈশ্বর নিজে ক্ষমাশীল তাই বাবা হিসেবে তিনিও তাকে মাফ করে দিতে রাজি আছেন, শুধু যদি সে এ কাজ থেকে চিরদিনের জন্য সরে আসার অঙ্গীকার করে। জামানের চোখে পানি চলে এলো – শাস্তি থেকে বেঁচে গেছেন বলে না, বরং বাবার প্রতি গভীর এক কৃতজ্ঞতায়।          

আফতাব সাহেব অবশ্য ছেলেকে নিয়ে আর ঝুঁকি নেন নি, স্কুল থেকে টিসি নিয়ে ছেলেকে সোজা বাড্ডার এক কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। মারকাজুল ইসলাম ছিল পুরোপুরি বোর্ডিং মাদ্রাসা, সেখানে জামানকে পাঁচদিন থাকতে হতো আর সপ্তাহান্তে দুই রাত বাসায় এসে থাকতে পারতেন।

মাদ্রাসায় ভর্তির পর জামানের কানে ঝিঁ ঝিঁ-র সেই আনাগোনাও একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও পরবর্তীতে তিনি ওটা মেনে নিয়েছিলেন, ধীরে ধীরে অভ্যস্তও হয়ে উঠেছিলেন কঠোর নিয়ম-কানুনের ধর্মীয় সেই পরিবেশে। সকাল পাঁচটায় উঠে ঠান্ডা পানিতে ওযু করা, নাস্তার আগে দুই ঘন্টা কোরান হিফজ, সাদা পাঞ্জাবি আর গোল টুপি পরে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস, কাবুলি জামা পরে মাঠে ফুটবল খেলা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া – সব তার গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিলো।

মাদ্রাসা শেষ করে জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানিতে চান্স পেয়েছিলেন। পাশ করার পর বিসিএস দিয়ে বন বিভাগে চাকরিও শুরু করেছিলেন সেই সময়। জামান বিয়ে করলেন আঠাশে, পঁয়ত্রিশের মধ্যে তার আর সামিনা আক্তারের সংসারে যোগ হলো একটা সুন্দর ছেলে আর একটা চটপটে মেয়ে। ছেলেটা মেয়ের তিন বছরের বড়ো। এই পর্যন্ত জামান কৈশোরের সেই ঝিঁ ঝিঁ-র সংস্পর্শ থেকে মুক্তই থাকলেন।

৩.

সবকিছু ঠিক-ঠাকই চলছিলো, বড়ো ছেলে শায়ান আর ছোট মেয়ে ঈশা সুন্দরভাবেই বেড়ে উঠছিলো – স্কুল, বন্ধু, খেলা আর ল্যাপটপ নিয়ে অন্য দশটা সন্তান যেভাবে বেড়ে উঠে।

কিন্তু ছেলের বয়স যখন এগারো তখন জামান সাহেব তার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলেন। শায়ান অল্পতেই রেগে যায়, আর রেগে গেলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। বারোতে পড়তেই স্কুলে এক সহপাঠীর হাতে কামড় দেয়ার পর তাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো। তার বাজে রেকর্ডের কারণে অন্য কোনো স্কুলও তাকে নিতে চাইলো না।

ক্লাস সিক্স থেকে শায়ান বাসাতেই ‘হোমস্কুল’ স্কুল করা শুরু করলো। জামান সাহেব মিজান নামে এক বেকার ছেলেকে জোগাড় করলেন ছেলের সাথে থেকে তাকে পড়ানোর জন্য। কিন্তু একদিন অংক করা নিয়ে বকা দেয়ার পর শায়ান টিচারের মাথা ফাটিয়ে দিলো কাঠের স্কেল দিয়ে বাড়ি মেরে। সেই থেকে তরুণ শিক্ষক মিজান আলী উধাও, হোম স্কুলিং-ও বন্ধ।

এর মধ্যে জামান আর সামিনা অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন। কোন লাভ হয়নি। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, সেই ওষুধ খেয়ে শায়ানের ঝিমুনি বেড়েছে, কিন্তু পাগলামি কমে নি। চৌদ্দ বছর বয়সেই ছেলেটা পাঁচ ফুট ছাড়িয়ে গেল, তখন থেকে সামিনা নিজেও তাকে ভয় পাওয়া শুরু করলেন। শায়ানও হয়তো সেটা বুঝতো, মা-কে একা পেলেই জিনিস-পত্র ভাঙচুর করে ভয় দেখাতো। জামান হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে ভাবতেন – হয়তো ও পাগল না, বরং সাক্ষাৎ শয়তান।

ষোলো হবার আগেই ওকে আলাদা ঘরে তালা দিয়ে রাখতে হলো, ওখানেই খাওয়া, পাশের বাথরুমে প্রাকৃতিক কাজ সারা। মাঝে-মধ্যে ঘরের ভেতরই প্রস্রাব-পায়খানা, তারপর সেগুলো পরিষ্কার করার প্রক্রিয়া। মাঝে মাঝে সারারাত ওই ঘর থেকে চিৎকার, প্রতিবেশীদের অভিযোগ, সকালে আবার অফিসে যাওয়ার আগে রুম পরিষ্কার – জামান সাহেদ একসময় ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। এমনি এক অদ্ভুত দিনের শেষে সন্ধ্যা বেলায় তিনি ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিলেন, আর তখনি হঠাৎ আবার শুনতে পেলেন সেই ঝিঁ ঝিঁ-র শব্দ – প্রায় ত্রিশ বছর পর আরেকবার।

‘মেরে ফেল, সব কেস ডিসমিস’ – কণ্ঠটা বললো ওকে। জামান সাহেব হকচকিয়ে উঠলেন। 

‘মেরে ফেল, নষ্ট বীজ রেখে লাভ নাই।’ – আবার সেই নাঁকি সুরে কথা। জামান ধমক দিয়ে উঠলেন – ‘এই চোপ, শুওরের বাচ্চা।’

‘মেরে ফেল, কেউ জানবে না, মেরে ফেল ঐটারে, হি হি হি, মেরে ফেল।’ – ওটা ক্রমাগত বলতেই থাকলো এক কথা।

জামান লাফ দিয়ে উঠে পরে লাইট টা জ্বালিয়ে দিলেন। তখন সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলো।

পরেরদিন ছিল তেরোই আগস্ট। শায়ানের জন্মদিন। সেদিন জামান ছুটি নিলেন। ভোরে উঠে ছেলের ঘর পরিষ্কার করলেন। ছেলেকে নিজ হাতে গোসল করালেন, তারপর ঘরের বাইরে নিয়ে এলেন।

শায়ান সারাদিন ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখলো। বিকেলে সামিনা দুই পাউন্ডের একটা জন্মদিনের কেক নিয়ে এলেন, কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে শায়ান হলুদ রং সহ্য করতে পারে না। এদিকে কেকের অর্ধেকটাই হলুদ রঙের ছিল, সেই কেক কাটার পর যেই তিনি ছেলেকে ওটা খাওয়াতে গেছেন, সে মুখ সরিয়ে নিলো, সামিনার হাত থেকে কেক হাতে নিয়ে দেয়ালে ছুড়ে মারলো, তারপর টেবিল ধরে উল্টে ফেলে দিয়ে চিৎকার শুরু করলো। সামিনা তখন বসার ঘরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

জামান ছেলেকে ধরে কোনোমতে ওর ঘরে নিয়ে ঢুকিয়ে বাইরে তালা লাগিয়ে দিলেন, তারপর বারান্দায় এসে বসে একটা সিগারেট ধরালেন, আর তখনি ঝিঁ ঝিঁ কথা বলে উঠলো তার কানে – ‘মেরে ফেলতে বলেছিলাম, রাজি তো হলি না। এখন বুঝ ঠেলা।’

জামান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

‘এক কাজ কর, ওই হারামজাদার গারদে পাঠিয়ে দে।’

জামান সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। সিগারেটটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে পা দিয়ে পিষতে শুরু করলেন, প্রায় মিনিট খানেক চামড়ার সেন্ডেলের নিচে নিভে যাওয়া সিগারেটটা যাতাযাতি করার পর রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

সে বছরই পহেলা জুন জামান সাহেবের অফিস ছুটি ছিল। সকালে ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন শায়ান কাঁদছে, বড়ো মানুষের মতো নীরব কান্না। বেশ কিছুক্ষন লক্ষ্য করার করার পর ঘরের দরজা খুলে দিলেন, ছেলেকে ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে জানতে চাইলেন কি হয়েছে। শায়ান বললো সে স্বপ্ন দেখেছে, খারাপ স্বপ্ন। জামান ওর মাথায় হাত বুলালেন, পাশে নিয়ে নাস্তা করতে বসলেন। ঘন্টা দুয়েক সবকিছু ঠিকই থাকলো।

ঈশা ড্রইংরুমে বসে টিভি ছাড়ার পরই শুরু হলো সমস্যা। মেয়েটা হিন্দি সিনেমার একটা গান দেখছিলো, যেটাকে সংগীত না বলে কোলাহল আর লাফ-ঝাপের একটা মিশ্রণ বলাই হয়তো শ্রেয়। ঈশা হয়তো ভুলে গিয়েছিলো শায়ান হৈ চৈ সহ্য করতে পারে না, গান শুনলেও ধীরলয়ের সুরই তার পছন্দ। সেই মিউজিক ভিডিওর শেষ দিকে ঢোলের শব্দ যখন খুব দ্রুত, শায়ান অতর্কিতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর টেবিলের ওপর থেকে টেলিভিশনটা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো।

ভাঙা সেই টিভিতে কেমন করে যেন তখনও গানটা বেজে চলেছে। শায়ান একবার টিভির দিকে আরেকবার ছোটবোনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ টেবিলের ওপর থেকে ফুলদানিতে নিয়ে ছুড়ে মারলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জামান লক্ষ্য করলেন, ঈশা কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে আর ওর মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

মেয়ের জামা-কাপড় রক্তে মাখামাখি দেখে জামান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, সোজা গিয়ে সায়ানকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধরলেন, তারপর তার গলা চিপে ধরলেন। এই মুহূর্তে সামিনা ঘরে ঢুকে “কি করো, কি করো, ছেলেটাকে মেরে ফেললো পিশাচটা” বলে চিৎকার শুরু করলেন। জামান শায়ানের কলার চেপে ধরে তাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেলেন তারপর লাথি দিয়ে ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিলেন। তারপর ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

দুপুরের কড়া রোদে এক ঘন্টারও বেশি হাঁটার পর তার মাথা কাজ করতে শুরু করলো। রাস্তার পাশে ফুটপাতে গাছের ছায়ায় কিছুক্ষন বসে থাকার পর বাড়ির দিকে হাটতে শুরু করলেন।

বাসায় ফেরার পর মেয়ের রুমে গিয়ে দেখেন সে বিছানায় শুয়ে আছে, কপালে ব্যান্ডেজ। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু তখনি সামিনা শুরু করলেন চিৎকার – “কি মনে করে মেয়েটাকে এভাবে রেখে তুমি বেরিয়ে গেলে? তোমার জন্যই তো আজ এটা হলো। কি দরকার ছিলো ওকে আহ্লাদ করে বাইরে আনার? তোমার কি আজকাল মাথাও কাজ করে না? যদি আজ মেয়েটা মরে যেত?”

সে সপ্তাহেই জামান একটা ‘কেয়ার হোম’ খুঁজে বের করলেন, যেখানে এধরণের ছেলেদের রাখার ব্যবস্থা আছে। জামান তাদের সাথে সেদিনই চুক্তি স্বাক্ষর করলেন, তারপর বাসায় এসে ছেলের জিনিস-পত্র গোছাতে শুরু করলেন। সামিনা তখন আবার অনেক করে কাঁদলেন, বললেন – এসব হোমে রোগীদের অত্যাচার করা হয়, এরচেয়ে এই তালাবন্ধ করে রাখার ব্যবস্থাটাই বরং ভালো। জামান উত্তর না দিয়ে ছাদ থেকে বড়ো লাল সুটকেসটা নামিয়ে আনলেন।

ওরা বলে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। যে শুক্রবার সন্ধ্যায় সায়ানকে হোমে নামিয়ে দিতে গেলেন, সেদিন গাড়ি থেকে ছেলের কাপড়ের ব্যাগটা নামাতে গিয়ে ওটাকে তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী জিনিস মনে হলো। তিনি যখন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে আসছিলেন, তারপর ওরা ওর ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো, ছেলেটা জানলার গ্রিল ধরে চিৎকার করছিলো। জামান তখন ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন।

সে রাতে বাসায় ফেরার পথে শায়ানের ছোটবেলার কথা তার মনে পড়লো, সেই যে ছেলেটাকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন। রাতের বেলা শায়ান তার কাছে ছাড়া আর কারো কাছেই ঘুমাতে চাইতো না – সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। রিক্সার হুড শক্ত করে ধরে বসে থেকে অনেক চেষ্টা করেও তিনি কাঁদতে পারলেন না, সবকিছুর পরও হয়তো তিনি ঠিক কাজটাই করেছেন – তার পরিবারের যে অংশটা টিকে গেছে, সেটাকে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। যতই ভালোবাসা থাকুক, মৃতদেহ কি কেউ ঘরে রেখে দেয়? দেয় না, এই জগতে সেটা চলে না।

ঘরে ফিরে তিনি সোজা চলে গেলেন সেই ঘরটাতে, যেখানে শায়ানকে তালাবন্ধ করে রাখা হতো। সাদা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে শায়ানের ফেলে যাওয়া খাটটাতেই তিনি শুয়ে পড়লেন, তারপর সারা রাত সিলিং ফ্যানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলেন।

৪.

আগস্ট মাসের শেষের দিকে জামান সাহেব বুকের বাঁ দিকে হালকা চাপ অনুভব করলেন। বিপদ বুঝতে পেরে সামিনা সাথে সাথে স্বামীকে ক্লিনিকে নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। হলি কেয়ারের মালিক ছিলেন জামান সাহেবের বন্ধু, ডাক্তার তারেক দ্রুত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। রাতে জামান সাহেবকে কেবিনে থাকতে হলো।

পরদিন সকালে তারেক জানালেন, ভয়ের কিছু নেই। জামান সাহেবের কোলেস্টরেল হাই, কিন্তু ইসিজিতে খারাপ কিছু আসে নি – সম্ভবত ওটা গ্যাসের সমস্যা ছিল। তাছাড়া তারেক জানতেন যে ছেলেকে হোমে দিয়ে আসার পর জামান সাহেবের ঘুমের সমস্যা বেড়ে গিয়েছিলো। বিকেলের আগেই ক্লিনিক থেকে রিলিজ নিয়ে জামান বাসায় ফিরে এলেন।  

সে রাতে রিলাক্সেন খাবার পরও যখন জামান বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন, তখন আবার ঝিঁ ঝিঁ কথা বলে উঠলো তার কানে – ‘তোর মরার সময় হয়ে আসছে। হি হি হি।’

‘ওই শুওরের বাচ্চা, যা এখন থেকে।’ – জামান নিজ মনেই গালি দিলেন ওটাকে।

‘ওই হারামজাদা। মরণরে ডরাস? ডরানের কি আছে? সারা শরীরে জ্বালা হয়, তারপর সব ঠিক। হি হি হি।’

কেয়ার হোমে দেয়ার মাস তিনেক পর সাপ্তাহিক ভিসিটে গিয়ে জামান লক্ষ্য করলেন, শায়ানের হাতে লম্বা একটা কালো দাগ। তিনি কেয়ার টেকার আলমকে ডেকে জানতে চাইলেন, শায়ানের হাতে এটা কিসের দাগ। আলম ঘুম ঘুম চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো, ছেলে নিজে নিজে ব্যথা পেতে পারে, কেননা সে যখন উত্তেজিত হয়ে যায় তখন এলোপাথাড়ি হাত-পা ছোড়ে। এই ব্যাখ্যায় জামান তেমন ভরসা করতে পারলেন না, কিন্তু কিছু বলারও নেই।   

এরা যদি সত্য লুকায়, জামান সাহেবের সেটা জানার কোনই উপায় নেই। তাছাড়া এরা যদি শায়ানকে না রাখে, তাহলে আবার তার জীবনে শুরু হবে সেই সব ভয়াবহ দিন। সেই বিকেলে পুরোনো সাদা জেলখানাটায় ছেলেকে রেখে ফেরার সময় জামানের মনে হলো, শায়ান বেশ শুকিয়ে গেছে। ওরা কি ছেলেটাকে ঠিকমতো খাওয়াও দেয় না? সেটাও জানার কোন উপায় নেই। বেশি জানতে চাইলে হয়তো সাপ্তাহিক ভিসিট বন্ধ করে দিয়ে মাসে মাত্র একবার দেখা করার নিয়ম বানিয়ে দেবে।  

সে রাতে অনেক গরম পড়লো। ঘুম আসছিলো না দেখে রাত একটার দিকে জামান ছাদে গেলেন একটু হেটে আসতে। সিঁড়িকোঠার দরজা খুলে দেখেন ছাদে জোৎস্নার আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছাদে পা দিয়েই জামান হোঁচট খেলেন, কারণ তার কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ করে উঠেছে কোন আগাম বার্তা ছাড়াই।

‘তুই যখন মরে যাবি, তখন তোর ছেলেকে ওরা মোরব্বা বানাবে। মোরব্বা খাবি? মোরব্বা?’

জামান ছাদের মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। ঝিঁ ঝিঁ-র এই জিনিসটা অস্বীকার করার উপায় নেই, সে যা বলে সব সত্য কথাই বলে – যদিও সে সত্য বেশ তিতে।

‘একটাই উপায় আছে তোর। তোর ছেলে যদি তোর আগে মরে, তাহলেই তুই নিশ্চিন্তে মরতে পারবি। এই হারামি, মরতে তো তোকে হবেই, ওরে শেষ করে তারপর মর, গাধা। হি হি হি।’

সে রাতে অনেকদিন পর জামান নামাজে দাঁড়ালেন – শেষ রাতের প্রার্থনা নাকি কবুল হয়। সেই তাহাজ্জুদ শুরুর আগে পরিকল্পনা করলেন নামাজের ভেতর খোদার কাছে সন্তানের মৃত্যু চাইবেন – এটা তার জন্যও ভালো, অন্য সবার জন্যও ভালো।

সেজদায় নাকি মানুষ খোদার সবচেয়ে কাছাকাছি চলে যায়, দুই রাকাত নামাজের শেষ বৈঠকের আগে তিনি কপাল মাটিতে ঠেকিয়ে খোদার কাছে শায়ানের বিষয়ে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত কেন যেন ছেলের মৃত্যু চাইতে পারলেন না, কি একটা খুব ভেতর থেকে তাকে বাধা দিলো। সবুজ সেই জায়নামাজে অনেক্ষন উপুড় হয়ে পড়ে থাকার পর তিনি শুধু এটুক বলতে পারলেন, খোদা যেন তাকে ছেলের চেয়ে দীর্ঘজীবন দেন। প্রার্থনা শেষ করার পর তিনি বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়লেন। সে রাতে অনেকদিন পর তার ভালো ঘুম হলো।

এদিকে বনানীর সেই কেয়ার হোমে তিন মাসের ভেতর শায়ান ছয় কেজি ওজন হারালো, ছয় মাসে তেরো কেজি। তাকে এখন আর তাগড়া ছেলে মনে হয় না। এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কেয়ারটেকার আলম তাকে জানালো শায়ানের রাগ কমে গেছে, কিন্তু জামান জানতেন ও এত দুর্বল যে ওর পক্ষে আসলে কারো ওপর রাগ দেখানোই সম্ভব না। জামান যখন ওদের জিজ্ঞেস করলেন শায়ানের ওজন কেন কমে যাচ্ছে, ওরা বললো শায়ান কিছু ওষুধ খায় যাতে মুখের রুচি কমে যায়।

সে রাতে বিছানায় যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে ঝিঁ ঝিঁ আবার কথা বলে উঠলো জামান সাহেবের কানে – “তুই জীবিত থাকতেই তোর ছেলের এই অবস্থা, তুই মরলে তো ওরা তোর ছেলেরে মোরব্বা বানিয়ে দিবে।”

“আমি ওকে বাসায় নিয়ে আসবো।” – জামান বলে উঠলেন।

‘হ্যা, নিয়ে আয়। ভালোই হবে, বাকি তিনজনকে এইবার সে সোজা বেহেশতে পাঠাতে পারবে।’

জামান কিছু বললেন না। 

“তুই জানিস না, এগুলি কোনোদিন ঠিক হয় না? ও তো মরবেই, তোদের সাথে নিয়ে মরবে, না হয় মরার আগে তোরে ফতুর করে দিয়ে মরবে।”

জামান সাহেব ক্লান্ত চোখ দুটো বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন, তার মস্তিষ্ক সেদিন আর কোনো চিন্তা নিতে পারছিলো না।

৫.

একুশতম জন্মদিনে শায়ানকে ওরা বাসায় আনার অনুমতি দিলো। ছেলেকে জামান নতুন কেনা সবুজ শার্টটা পরালেন, যত্ন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন। ঘরে এনে ওকে সোফায় বসানোমাত্র শায়ান তার মুখে থুতু দিয়ে হাসতে শুরু করলো। তিনি সেটা মুছতে না মুছতেই আবার সে একই কাজ করলো, যেন এটা একটা খেলা। 

জামানের মাথায় যেন তখন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, তিনি ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে মুখে বালিশ চেপে ধরলেন যেন সে আর থুতু দিতে না পারে। সাথে সাথে ঝিঁ ঝিঁ-ও তার কানে কথা বলা শুরু করলো – ‘ধরে রাখ, নাহলে আবার দিবে কিন্তু।’  

জামানের মাথা তখন কাজ করছে না, রাগ তাকে পেয়ে বসেছে। তার সমস্ত জেদ যেন তখন সেই নিরীহ বালিশটার ওপর।

‘ধরে রাখ, কিচ্ছু হবে না। ওর জান শক্ত আছে।’ – ঝিঁ ঝিঁ বলে চললো।

প্রায় মিনিট দুই পর যখন জামানের মাথা ঠান্ডা হয়ে এলো, তখন তিনি বালিশের ওপর চাপটা একটু কমালেন। শায়ানও তখন নিচে থেকে আর বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু বালিশটা পাশে রেখে শায়ানের দিকে তাকাতেই তার বুকটা ধ্বক করে উঠলো – ছেলেটা নড়ছে না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিলিং ফ্যানটার দিকে।

ঘড়ির সেকেন্ডের কাটাটা হঠাৎ করেই যেন কাঁচের ফ্রেমটার ভেতরে আটকে গেলো ঘন্টাখানেকের জন্য। তারপর সেটা আবার যখন চলতে শুরু করেছে, ঝিঁ ঝিঁ আবার কথা বলে উঠলো, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন কণ্ঠে – ‘তুই ছেলেটাকে মেরে ফেললি? তোর নিজের ছেলেকে গলা টিপে মারলি?’ 

জামানের হাত-পা তখন কাঁপতে শুরু করেছে। মাথার ভেতর ঝিঁ ঝিঁ তখন চিৎকার করে বার বার ওর কৃতর্কমের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মহাবিশ্বের সবচাইতে বড় কৃষ্ণগহবরটা তখন যেন ভর উদয় হয়েছে জামান সাহেবের মাথার ভেতর আর শুষে শুষে নিচ্ছে তার কল্পনার সমস্ত আলো।

৬.

ছেলেকে ওভাবেই কালো সিমেন্টের ফ্লোরে শুইয়ে রেখে জামান ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হলুদ রঙের তপ্ত রোদের ভেতর রাস্তায় রাস্তায় হাটতে লাগলেন। তার দু’পা ছিল খালি, পথচারীদের কেউ কেউ পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ফিরে ফিরে বার বার সেটা লক্ষ্য করতে লাগলো।

জামানের সেসময় মনে হচ্ছিলো, তিনি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন – যেকোনো সময় ঘুমটা ভেঙে যাবে, আর তখন তিনি স্বস্তি নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠবেন। তার জীবনে এমনটা অনেকবারই হয়েছে – একবার তো স্বপ্নে দেখলেন অফিসের ভল্ট খুলে তিন লাখ টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। স্বপ্নটা এত গভীর ছিল যে তার মনে হচ্ছিলো, ঘটনা সত্যিই ঘটেছে, তারই জীবনে। পুলিশ যখন হাতকড়া বেঁধে তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখনি ঘুমটা ভেঙে গেলো আর জামান দেখলেন তিনি ঘেমে নেয়ে উঠেছেন।

এসব ভাবতে ভাবতে জামান নিজের হাতে একবার চিমটি কাটলেন। যখন দেখলেন হাতে সত্যিই ব্যথা লাগছে, তখন পুরোপুরি হতাশ হয়ে ফুটপাতে বসে পড়লেন। সেই প্রথম তিনি বুঝতে পারলেন, পাগল ছেলেটাকে তিনি একেবারে নিজ হাতে খুন করেছেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঝিঁ ঝিঁ-ও আবার তার কানে কথা বলে উঠলো – ‘তোর দুনিয়া আখেরাত দুইটাই গেলো। হি হি হি। দোজখে তুই থাকবি আমার সাথে, আমরা দুই বন্ধু মাস্তি করবো হিন্দি-ইংরেজি নায়িকা ছেমরি গুলির সাথে।’

জামান বুঝতে পারলেন, ঝিঁ ঝিঁ যা বলেছে তার পুরোটাই সত্য – তার দুই পৃথিবীই ধ্বংস হয়ে গেছে। কিতাবগুলোতে লেখা আছে, নিহতের সমস্ত পাপ হত্যাকারীর ওপর চলে আসবে মহাবিচারের আসন্ন সেই দিনগুলোতে। অর্থাৎ এই আজাব থেকে রক্ষা পাবার তার আর কোন পথই খোলা নেই।

জামানের যখন মনে হতে শুরু করেছে এই দুপুর আর শেষ হবে না, আর এই মানসিক বোঝাও তিনি আর বয়ে বেড়াতে পারবেন না, তখন ঝিঁ ঝিঁ আবার কথা বলে উঠলো – ‘তুই মর গিয়ে হারামজাদা। ওই যে বাসটা আসে, ওর সামনে গিয়ে শুয়ে পর তুই, শয়তান। নিরীহ নিষ্পাপ ছেলেটাকে মেরেছিস, তোর বেঁচে থাকার আর কোনো অধিকার নেই।’

জামান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, মোহগ্রস্তের মতো হাঁটতে শুরু করলেন ব্যস্ত সড়কের মাঝ বরাবর। ঝিঁ ঝিঁ তখনও কথা বলে চলেছে তার মাথার ঠিক মাঝখানটায় – ‘এই তো ঠিক আছে। তোর খোদা তোরে ছেড়ে গেছে, সে কোনোদিন তোকে মাফ করবে না।’

ঝিঁ ঝিঁ-র শেষ কথাটা বিশেষ করে খোদার নামটা কানে বেজে উঠতেই জামান কেন যেন হঠাৎ থেমে গেলেন, এক মুহূতের জন্য তার মাথার ভেতর সব চিন্তা কেমন এলো মেলো হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই তার মনে গেলো ছোটবেলার কথা, যখন নীল ছবি দেখতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন বাবার হাতে – ভীষণ মার খাবার জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন, অথচ সেদিন তার খোদা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। মানুষের মহাপাপগুলোও খোদার ক্ষমার তুলনায় ক্ষুদ্র। জামান কিভাবে সেই এক খোদার ব্যাপারে নিরাশ হবেন, যিনি তাকে তার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন?   

জামান রাস্তার মাঝখান থেকে আবার ফুটপাতে ফিরে চলে এলেন। ঝিঁ ঝিঁ তখন আর কোন কথা বলছে না, কিন্তু জামান বুঝতে পারলেন সে এখনো আশে-পাশে আছে। সাদা খদ্দেরের চাদরটা গায়ে সামলে নিতে নিতে তিনি বললেন – ‘তোর ইচ্ছা হলে তুই জাহান্নামে যা।’ তারপর দৃঢ় পায়ে ফিরে যেতে শুরু করলেন বাসার দিকে।

৭.

বাসায় ফিরে জামান যা দেখলেন, তার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। শায়ান ড্রইং রুমে বসে পা দুলাচ্ছে। তাকে দেখা মাত্র সামিনা আক্তার চিৎকার করে উঠলেন – ‘তোমার কোন হুশ আছে? এই পাগল বদমাইশকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কোথায় ফুর্তি করতে বেরিয়েছিলে?’

জামানের মনে হলো এইটাই বরং একটা স্বপ্ন, আর তার ভয় হলো যেকোন মুহূর্তে ঘুম ভেঙে তিনি জেগে উঠবেন ভয়াবহ অন্ধকার কোন পরাবাস্তব জগতে। জীবনে প্রথমবারের মতো স্ত্রী সামিনার চিৎকার তার কানে মধু ঢেলে দিলো।

দরজায় তাকে দেখামাত্র শায়ান ফুলদানিটা তুলে ঢিল মারলো, তারপর হাঁসতে লাগলো যেন এইটা একটা খেলা। অনেক বছর পর জামান সাহেবের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন – “ভাঙতে থাক বাবা, মনের শখ মিটিয়ে ভাঙচুর কর”। কাছে গিয়ে তিনি ছেলের হাতটা আঁকড়ে ধরলেন – না, সত্যিই শায়ান বেঁচে আছে। 

সেই ঘটনার পর জামান ছেলেকে কেয়ার হোম থেকে ছাড়িয়ে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। যত কষ্টই হোক, ছেলেকে চোখে চোখে রাখবেন বলে পণ করেছিলেন। তার খোদা তাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছেন, কৃতজ্ঞতা বলে তো একটা কথা আছে, তাই না?

ওই দ্বিপ্রাহরিক দুঃস্বপ্নের পর থেকে কেন যেন হঠাৎ করেই  জামানের জীবন থেকে সেই ঝিঁ ঝিঁ নামের জিনিসটা উধাও হয়ে গিয়েছিলো। আর কোনোদিন সে দেখা দেয় নি জামানের স্বপ্নে কিংবা জাগরণে।   

সেই রহস্যময় দিনটার পর পর শায়ান আরো একুশ বছর বেঁচে ছিল এই পৃথিবীতে। একচল্লিশ বছর বয়সে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। ছেলেটার হাই ব্লাড প্রেসার ছিল, কিন্তু এই বয়সে তার হঠাৎ চলে যাওয়ার কথা কেউ ভাবে নি।  

ছেলে মারা যাওয়ার পরদিন ভোরে জামান নিজ হাতে ওকে কবরে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। একাকী রিক্সায় বাসায় ফিরতে ফিরতে তার মনে হচ্ছিলো – মহান খোদা তায়ালা তার দোআ কবুল করেছেন, পাগল ছেলেকে নিষ্ঠুর পৃথিবীর কাছে রেখে তাকে মরে যেতে হয় নি।

শায়ান মারা যাবার দেড় মাসের মাথায় জামান সাহেবও বিনা নোটিসে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। হঠাৎই এক ভোরে তার তৃষ্ণা পায়, কিন্তু পানি মুখে দেয়ার আগেই তিনি চেয়ার থেকে হেলে পড়ে যান মাটিতে।

তাকে দাফন-কাফন করার সময় পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বলাবলি করলো – ছেলের সাথে জামান সাহেবের আত্মা বাধা ছিল, তারা দুজন তাই একসাথেই খোদার কাছে ফিরে গেছেন। জামান সাহেবের কবরও ঘটনাচক্রে ছেলের কবরের পাশেই পড়লো। যেহেতু মারা যাবার সময় তার মুখে একচিলতে হাসির একটা রেখা লেগে ছিল, তাই কাছের লোকজন সব ধারণা করলো তিনি মৃত্যুর আগে সম্ভবত খোদার মহান ক্ষমাকে চাক্ষুষ দেখতে পেয়েছিলেন। আর এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, খোদার মমতা তাঁর বিচারের কঠোরতার ওপর জয়ী। এই সব বিবেচনা করে আমরা শায়ান আর জামান সাহেব দুজনের জন্যই একটা সুন্দর পরকাল আশা করতেই পারি, ঠিক কি না?

Leave a comment