……………………
” শ্বশুর বাড়িতে একটি বউকে যখন তখন পিটানো হচ্ছে, কেউ কিছুই বলছে না। কারণ, বউটা দোষী, কথা শুনে না, বউয়ের উপর জীনের আছর আছে…।। “
এধরনের হাজার হাজার ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটছে প্রতিনিয়ত, আর আমরা জীনে ধরার অজুহাত দিয়ে, নিজেদের খায়েশ মিটিয়ে নিচ্ছি।
জিনের আছর, ভূতে ধরা, উপরি বাতাস লাগা, মা কালী ভর করা… বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে আনাচে কানাচে এই সমস্যাগুলো প্রায়ই শোনা যায়। তখন এদের চিকিৎসার অংশ হিসেবে সাধারনত কবিরাজ, পীর, ফকির, বা ওঝা ডেকে আনা হয় । সেই কবিরাজ, পীর, ফকির বা ওঝার অমানুষিক অত্যাচারের মাধ্যমে চিকিৎসা চলে, যার ফলে রোগীর শারীরিক অনেক ক্ষতি হয় এমনকি কখনো কখনো মারাও যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু মানসিক রোগ রয়েছে, যার সাথে, জিনের আছরের লক্ষনগুলো মিলে যায়। এই ধরনের রোগীকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অল্প কিছু চিকিৎসা পেলেই এই ধরনের রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তাই এই ধরনের রোগী দেখলে পীর, ফকির, কবিরাজ, ওঝা ডেকে এনে, ঝাড় ফুঁক না করিয়ে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।
হিস্টেরিয়া নামক এক ধরনের মানসিক রোগ আছে, যার লক্ষণগুলোর সাথে জীনে ধরার পুরাই মিল পাওয়া যায়। যেমন, বারবার খিঁচুনি হওয়া, জ্ঞান হারানো, হাত-পা বেঁকে যাওয়া, হঠাৎ করে কথা বলতে না পারা, চোখে দেখতে না পারা, কানে শুনতে না পারা, হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া, শরীরে ব্যথা বা স্পর্শের অনুভূতি হ্রাস পাওয়া, হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই হাঁটতে না পারা, হাত দিয়ে লিখতে না পারা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, পরিচিত লোককে না চেনা, কোনো ঘটনা মনে করতে না পারা ইত্যাদি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই হিস্টেরিয়া রোগের উপযুক্ত চিকিৎসাও রয়েছে।
সিজোফ্রেনিয়া নামক চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরও একটি রোগ আছে, যার সাথেও জীনে ধরার হুবহু মিল পাওয়া যায়। যেমন, রোগী অবাস্তব কিছু দেখে বা শোনে বা চিন্তা করে। সে এমন কিছু শোনে যেটা আশেপাশের আর কেউ শুনতে পায় না। সে ভাবতে পারে, কেউ তার সাথে সবসময় কথা বলছে কিংবা গায়েবী আওয়াজ শুনতে পায়। উদ্ভট অনেক কিছুই সে করতে পারে। কেউ কেউ আরবীতে সুরা পড়া শুরু করতে পারে, কেউবা জয় মা কালী বলে নাচানাচিও করতে পারে। তখন আশেপাশের সবাই শিউর হয়ে ধরে নেয় যে, একে জীনে ধরেছে। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর অনেক সুন্দর চিকিৎসা রয়েছে।
আবার খিচুনি রোগের কিছু কিছু উপসর্গও এই ধরনের জীনের আছরের সাথে মিলে যায়। এসব রোগীর শরীর কাঁপতে থাকে, তাদের মুখ দিয়ে ফেনা বের হয় এবং কিছুক্ষন পরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখন আমরা একে জীনের আছর বলে চালিয়ে দেই। এই খিচুনি কিন্তু চিকিৎসা করালে সম্পুর্ন সেরে যায় ।
আমাদের সমাজে, অনেক আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, পীর ফকির আছেন, যারা এসব মানসিক রোগীকে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে নিষেধ করে। তারা রোগীর আত্মীয় স্বজনকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখান যে, রোগীকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলে ক্ষতি হবে, রোগী মারা যাবে, সংসারে অভিশাপ, গজব নেমে আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে করে আমরা ভয়ে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই না। পীর, ফকির, কবিরাজ, ওঝা, দিয়ে চিকিৎসা করাই। কখনও কখনও পীর, ফকির, কবিরাজ, ওঝার অত্যাচারে রোগী মারাও যায়। পীর, ফকির, ওঝা তখন জিনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বেঁচে যান।
যে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ জনিত রোগের ক্ষেত্রেই রোগীকে সর্বপ্রথম ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। সুচিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর জীবন হয়ে উঠতে পারে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত।
এই লেখার উদ্দেশ্য চিকিত্সা নয়, শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করা। কোন ভাবেই এটিকে প্রেসক্রিপসন বা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা।
যেকোনো রোগ বা সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
…….. তিনা শুভ্র ।।
